পাঠক-পাঠিকা। তোমরা জানতে পেরেছ যে, রোগের মূল কারণ দূর করাই প্রত্যেক রোগের ওষুধ: সুতরাং ক্রোধের কারণগুলোর পরিচয় জানা অত্যাবশ্যক। হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন বস্তু কঠিন। তিনি বললেন, আল্লাহর ক্রোধ। তখন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) বললেন, কোন বস্তু আল্লাহর ক্রোধের নিকটবর্তী হওয়ার কারণঃ তিনি বললেন, ক্রোধ। তখন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কোন বস্তু ক্রোধকে প্রথমে সঞ্চার করে এবং বৃদ্ধি করে? হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, অহঙ্কার, গৌরব, সম্মানো এবং উদ্ধত্য। যে সকল কারণ ক্রোধ উৎপাদন করে, তা' আত্মাভিমান, আত্মপ্রীতি, ঠাট্টা, উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কোন কথা কানে লাগান, তর্ক-বিতর্ক করা, বিরোধিতা করা, বিশ্বাসঘাতকতা করা, অতিরিক্ত ধন-সম্পত্তি ও যশের অতিরিক্ত লোভ করা। শরীয়ত মতে এসব দোষ একত্র হলে জঘন্য স্বভাবে পরিণত হয়। এসব দোষ স্থায়ী হলে ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। সুতরাং এ কারণগুলোর বিপরীত গুণ দ্বারা তা' দূরীভূত করা দরকার। আত্মাভিমানকে নম্রতার দ্বারা দূরীভূত করতে হবে। খোদপছন্দীকে আত্মার পরিচয় দ্বারা নির্মূল করতে হবে। তা' অহঙ্কারের অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হবে।
অহঙ্কারকে এরূপ চিন্তা দ্বারা দূর করতে হবে যে, তুমি দাসানুদাস। প্রত্যেক লোকই একই পিতৃপুরুষ আদম (আঃ) এর বংশধর। কিন্তু কার্যের জন্য বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন পদমর্যাদা হয়েছে। আদম সন্তানগণ একই জাতি। গৌরব শুধু কার্যের কল্যাণের জন্য, বংশের জন্য নয়। গৌরব, খোদপছন্দী, আত্মাভিমান জঘন্যতম দোষ। এসব দোষই মূল। যদি এ খেয়াল হতে মুক্ত না হও, তাহলে অন্যের চেয়ে তোমার অধিক মাহাত্ম্য নেই। সুতরাং অহঙ্কার করো না। তুমি একজন ক্ষুদ্র দাস মাত্র। অতএব তোমার পক্ষে মোটেই অহঙ্কার। শোভা পায় না। ঠাট্টা-উপহাসকে ধর্মের জরুরী বিষয়ে ব্যস্ত থেকে দূর করতে হবে। জীবনভর তাতে ব্যস্ত থাকবে যেন ঠাট্টা-কৌতুক করবার অবসর না পাও। যেখানে তা' হতে দেখ, সেখান থেকে দূরে সরে যাবে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকে চেষ্টা ও পরিশ্রম সহকারে ফজীলত, সুন্দর স্বভাব এবং ধর্মীয় বিদ্যা অন্বেষণে ব্যস্ত থেকে, তা' দূর করলে তা-ই তোমাকে পারলৌকিক সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেবে। আত্মাভিমান দোষ লোকজনকে কষ্ট না দিয়ে এবং লোকের উপহাস করা থেকে নিজেকে রক্ষা করে দূর করতে হবে।
কুটনামী দোষের দাওয়াইঃ এ দোষের দাওয়াই মন্দ কথা হতে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং উত্তরের তিক্ততা থেকে আত্মরক্ষা করা। জীবন ধারনের আরাম আয়েশের জন্য অতিরিক্ত লোভের দাওয়াই অত্যাবশ্যকীয় পরিমাণ জিনিসে সন্তুষ্ট থাকা, যেন অভাবহীনতার সম্মান থাকে এবং অভাবের অপমান সহ্য করতে না হয়। প্রত্যেকটি স্বভাবের দাওয়াইর জন্য রিয়াজাত বা চরিত্র উন্নতিকর বহু পরিশ্রমের আবশ্যক হয়।
মোটকথা এসব স্বভাবের ক্ষতি এবং আপদ বিপদের বিষয় বিশেষ অবগত থাকবে, যেন হৃদয়ে তার মন্দ দেখে তা' ঘৃনা ভরে প্রত্যাখ্যান করতে পার এবং তারপর তার বিপরীত বিষয়ের উপর সর্বদা লেগে থাকতে পার যে পর্যন্ত তাতে অভ্যস্ত হয়ে হৃদয়ের উপর তা' সহজ না হয়। যখন তা' হৃদয় থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং হৃদয় এ সব জঘন্য দোষ থেকে নির্মল ও পবিত্র হয়, তা' থেকে যে ক্রোধ উৎপন্ন হয় তা' থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
মূর্খ লোকদের প্রায় সবাই ক্রোধের প্রধান কারণ মনে করে বীরত্ব, সাহস, পৌরুষ, আত্মসম্মান ইত্যাদিকে এর ফলে তাদের প্রবৃত্তি সে দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের নিকট তা উত্তম বলে বোধ হয় বড় বড় অহঙ্কারী লোকদের বীরত্বের প্রশংসা করে ও তাদের কাহিনী বর্ণনা এবং শ্রবণ করে তারা ক্রোধকে হৃদয়ে আরও বদ্ধমূল করে। মূলতঃ ক্রোধকে বীরত্ব আখ্যা দেওয়া নির্বুদ্ধিতা। এটাই হৃদয়ের মারাত্মক ব্যাধি এবং বুদ্ধির খর্বতা। যে সব লোকের বুদ্ধি দুর্বল ও খর্ব, তাদের ক্রোধ দ্রুত সঞ্চার হয়। রোগীর ক্রোধ সুস্থ ব্যক্তির ক্রোধের চেয়ে দ্রুত আসে। স্ত্রীলোকের ক্রোধও পুরুষাপেক্ষা দ্রুত আসে। যুবকের ক্রোধ বৃদ্ধ ব্যক্তি অপেক্ষা দ্রুত সঞ্চার হয়। মেজাযী এবং মন্দস্বভাবী লোকের ক্রোধ মর্যাদাশালী লোকদের অপেক্ষা দ্রুত হয়। নিকৃষ্ট লোকের একটি লোকমা ছুটে গেলে সে ক্রদ্ধ হয়। বখীলের একটি কেউ নিয়ে গেলে তার ক্রোধ হয় এমনকি এরূপ লোক তার পরিবারবর্গ, সন্তান সন্ততি এবং বন্ধু-বান্ধবদের উপরও ক্রুদ্ধ হয়।
হযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, "লাইছাশ্ শাদীছ বিসছুরআতি ইন্নাযাশ শাদীছল্লাযী ইয়ামলিকু নাফসাহু ইনদাল শাজাবি"। অর্থাৎ কুস্তিতে বিপক্ষকে পরাভূত করলে কেউ শক্তিশালী হয় না। বরং ক্রোধের সময়ে যে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে সে-ই শক্তিশালী। মূর্খদের সামনে ধৈর্য্য, ক্ষমা ও সংযমপন্থীদের ক্রোধ দমনের ঘটনা উল্লেখ করাই মহাদাওয়াই। কেননা তাতে নবী, আউলিয়া, বিচারক, আলিম এবং রাজ্যের বড় বড় লোকদের কাহিনীর বর্ণনা আছে। এর বিপরীত লোকদের বর্ণনাও আছে, যাদের বুদ্ধি বা মাহাত্ম্য নেই।
0 Comments