যদি প্রশ্ন করা হয়, ঘৃণা ও শত্রুতামূলক কার্য দ্বারা যদি গুনাহগারকে ঘৃণা করা ওয়াজিব না হয়, তাহলে কি তা' মুস্তাহাব হবে। ফাসিক এবং গুনাহগারগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। সুতরাং তাদের সঙ্গে আচরণে কিরূপ ফজীলত অর্জন হবে। তাদের সবার সাথেই কি একইরূপ ব্যবহার করতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী ও গুনাহগারদের দু'টো অবস্থা হতে পারে। হয় তাদের আল্লাহর উপর ঈমান নেই। তারাও আবার দু' প্রকার হতে পারে। যথাঃ কাফির ও বেদআতপন্থী। বেদআতপন্থীরাও আবার দু'শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী শরীয়ত বিরোধী মতবাদের দিকে আহবান করে। অন্য শ্রেণী এব্যাপারে নীরব থাকে। নীরবতা অবলম্বনকারী বিদআতপন্থীরা, হয় বাধ্য হয়েই নীরব থাকে নতুবা ইচ্ছাক্রমেই নীরব থাকে। সুতরাং ঈমানের ব্যাপারে গুনাহগারদের তিনটি শ্রেণী হয়।
প্রথম শ্রেণী-কাফির: এরা যদি মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধরত অবস্থায় থাকে তাদেরকে হত্যা করা অথবা গোলামে পরিণত করা যায়। এ দু'পন্থা ব্যতীত তাদের অন্য কোন শাস্তি নেই। যিম্মী (আশ্রিত বিধর্মী) কে ক্লেশ দান করা যাবে না। কিন্তু সে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বা কোনরূপ ক্ষতি সাধন করলে তাকে কষ্ট দেয়া যায়। তাকে কষ্ট দেয়া বা হেয় করার পন্থা তার জীবিকা সংকীর্ণ করা এবং প্রথমেই তাকে সালাম না দেয়া। যখন সে বলে, আসসালামু আলাইকা তখন বলবে, ওয়া আলাইকা, তার সঙ্গে উঠা-বসা, মেলামেশা না করা, কারবারাদি না করা এবং তার উপর কোন দায়িত্ব না দেয়াই উত্তম। নিজ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আমোদ-প্রমোদ করার ন্যায় তার সাথে আমোদ প্রমোদ করা এবং মিলা-মিশা করা অত্যন্ত নিন্দনীয় বা মাকরূহ তাহরিমী যা হারামের নিকটবর্তী। আল্লাহতায়ালা বলেন, "লা তাজিদু ক্বাওমান ইউ'মিনুনা বিল্লাহি ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি ইউওয়াদূদূনা মান হাদ্দাল্লাহা ওয়া রাসূলাহু" অর্থাৎ তুমি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবে না যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করে, যদিও সে তাদের পিতা-মাতা বা সন্তান- সন্ততি বা তাদের ভ্রাতা বা আত্মীয়-স্বজন হয়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, মুসলমান এবং মুশরিক তাদের অগ্নি একে অন্যে দেখতে পায় না। আল্লাহতায়লা বলেন, "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমান্ লা তাত্তাখিযু আদুওয়্যী ওয়া আদুওয়্যাকুম আউলিয়ায়া" অর্থাৎ হে মুমিনগণ। আমার এবং তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।
দ্বিতীয় শ্রেণী-বিশেষ বেদআতপন্থী লোকঃ বেদআতীগণ বেদআতের দিকে আহ্বান করে। যদি বেদআত মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায় তবে তার বিধান যিম্মীদের থেকেও কঠোর। কেননা, বেদআতীদের জিজিয়া দিতে হয় না এবং যিম্মীর চুক্তির সুবিধাও তাকে দেয়া যায় না। যদি বেদআত কুফরীর দিকে না নিয়ে যায় তবে তার বিধান কাফিরের বিধানের তুলনায় লঘু। মুসলমানদের উপর কাফিরের অনিষ্ট সীমাবদ্ধ নয়। মুসলমানগণ কাফিরের কুফরীতে বিশ্বাস করে এবং তার কথার দিকে গুরুত্ব দেয় না এবং লক্ষ্য করে না। পক্ষান্তরে, বেদআতীগণ বেদআতের দিকে লোকদেরকে আহবান করে আর লোকগণ তা' সত্য বলে মনে করে এবং তজ্জন্য তা' তাদেরকেক পথভ্রষ্ট করার কারণ হয়। সতরাং তার মন্দ সীমাতিরিক্ত। তার প্রতি ঘৃণা এবং শত্রুতা প্রকাশ করার উত্তম পন্থা তার সাথে সংশ্রাব বর্জন করা, তাকে যেত মনে কর এবং তার বেদআতের জন্য তাকে তিরস্কার করা। কোন লোককে তার নিকট যেতে না পারতে দেয়া অনুচিত। যদি বেদআতী নির্জনে তোমাকে সালাম দেয় তবে তার উত্তত নেয়ায় সোর নেই। তবে যদি সে তার নিকট থেকে ফিরে থাকায় এবং তার সালামের জবাব না নেয়াজ একথা বুঝতে পারে যে, বেদআত মন্দ জিনিস বলেই তার সাথে এরূপ করা হচ্ছে, তবে তার সালামের জবাব না দেয়াই উত্তম। সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজির হলেও বেদমাতীত মাজলের জন্য তা' ত্যাগ করা ভাল। যেমন কেউ গোসলখানায় থাকলে বা তার মল-মূত্র ত্যাগ করার সময় সালাম বা সালামের জবাব না দেয়া চাই।
যদি বেদআতী একদল লোকের মধ্যে থাকে তবে সে লোকদেরকে উক্ত বেদআতীত সেতে ফিরিয়ে রাখার জন্য এবং বেদআতীদের তাদের চোখে হেয় করার জন্য তার সালামের জবাব না দেয়া উত্তম। বেদআতীকে কোন প্রকার সাহায্য না করা এবং তার থেকে কোনরূপ সাহায্য গ্রহণ না করা বেদআতীর জন্যই কল্যাণকর। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যে বাক্তি বেদআতী লোককে তিরস্কার করে, আল্লাহ তার অন্তরকে শান্তি এবং ঈমান দ্বারা পূর্ণ করেন। যে ব্যক্তি বেদআতীকে অপমান করে, আল্লাহ তাকে ভীষণ রোজ কিয়ামতে সুখে ও শাড়িতে রাখবেন। যে ব্যক্তি কোন বেদআতীর প্রতি বিনম্র হয় বা তাকে সম্মান প্রদর্শন করে অথবা তার কাছে কোন সুসংবাদ নিয়ে যায়, সে হুযুরে পাক (দঃ) এর উপর যা নাযিল হয়েছে তাকে খুবই গুরুত্বহীন মনে করে।
তৃতীয় শ্রেণী- সাধারণ বেদআতী লোকঃ যদি সে অন্যান্য মানুষকে তার মতে আনতে অসমর্থ হয় এবং লোকগণ তার অনুসরণ না করে, তবে তার ব্যাপারটি তত গুরুতর নয়। তাকে প্রথমেই অপমান না করা বা তার সাথে কর্কশ ব্যবহার না করা উত্তম; বরং প্রথম প্রথম তাকে বিনম্রভাবে উপদেশ দেয়াই ভাল। কেননা সাধারণ লোকের মত সত্বর এবং সহজেই পরিবর্তিত হয়। যদি উপদেশে উপকার না হয় এবং যদি তার নিকট থেকে বিমুখ থাকলে ভার বেদআত বৃদ্ধি না পায় তবে সেক্ষেত্রে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাই উত্তম। যদি বুঝা যায় যে, তাতে কোন ফলোদয় হবে না, কেননা তার স্বভাব কঠিন হয়ে গেছে এবং তার ভ্রান্ত বিশ্বাস মজবুত হয়ে গেছে, তখন তার থেকে ফিরে থাকাই উত্তম। কেননা বেদআত মন্দের সীমায় পৌছে যায়, তখন তা' লোকের মধ্যে বিস্তার লাভ করে এবং তার ক্ষতি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
গুনাহগারঃ যে গুনাহগারগণ তাদের কার্য ও আমল দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী করে, বেঈমানীর দ্বারা নয়, তারা দু'শ্রেণীতে বিভক্ত।
একশ্রেণীঃ যে গুনাহগার তার কার্যদ্বারা অন্যকে ক্লেশদান করে, যথা অপরের প্রতি অত্যাচার, অপরের মাল আত্মসাৎ, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, অন্যের কুৎসা রটনা, মানুষের মধ্যে পরস্পরে বিবাদ সৃষ্টি, পরনিন্দা, অপবাদ ইত্যাদি।
অন্য শ্রেণীর গুনাহগার তার কার্যদ্বারা অন্যকে ক্লেশ দেয় না। তারও দু' অবস্থা হয়, যথাঃ (১) অন্যকে কুকাজ এবং অশান্তিজনক কাজের দিকে আহবান করা, যথাঃ মদ্যপায়ী পুরুষ এবং স্ত্রীলোককে একত্র করে যে মদপান করে ও অশান্তি সৃষ্টিকারীদের জন্য অশান্তি এবং মদ পানের সরঞ্জাম যে প্রস্তুত করে (২) এমন গুনাহগার, যে অন্যকে তার গুনাহর কাজের দিকে আহবান করে না, যেমন কেউ মদ পান করে, ব্যভিচার করে, কিন্তু সে অন্যকে এ গুনাহর কাজের দিকে আমযান করে না। তার কবীরাহ হোক, বা দ্বণীরায় হোক সব গুনাহর কার্য সে সর্বদা করে পা সর্বব্য করে না। উল্লিখিত বিভাগসমূহ থেকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণী বের হয়ে থাকে। এগুলোর একটি থেকে অন্যটি কঠোয়।
প্রথম শ্রেণী গুনাহগারঃ এই শ্রেণীর গুনাহগারদের গুনাহ সর্বাধিক ক্ষতিকর এবং মারাত্মক। যথাঃ অত্যাচার, জোরপূর্বক আত্মসাৎ, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান, গীবত পরনিন্দ্য চর্চা। এদের থেকে বিমুখ থাকা, এদের সাথে মেলামেশা না করা এবং এদের সাথে কাজ করাবার বন্ধ করাই উত্তম। কেননা মানুষকে কষ্ট প্রদান করার গুনাহ খুবই গুরুতর। এসব অত্যাচারী লোক তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথাঃ (১) মানুষ হত্যাকারী (২) অন্যের মাল অন্যায়ভাবে আত্মসাৎকারী এবং (৩) সম্পত্তি সম্পর্কিত অত্যাচারকারী। এরমধ্যে একটি থেকে অন্যটি কঠোর। এই শ্রেণীর গুনাহগার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ও এদেরকে অপমান করা মুস্তাহাব ও উত্তম। মোটকথা অপরাধ যত গুরুতর হয়, তার শাস্তিও তত গুরুতর হওয়া চাই।
দ্বিতীয় শ্রেণীর গুনাহগারঃ এরা অশান্তির কারণসমূহ সৃষ্টি করে এবং মানুষের মধ্যে তা' বিস্তার ঘটায়। এরা সাধারণতঃ মানুষের পার্থিব ব্যাপারে তেমন কোন গুরুতর অশান্তির কারণ না ঘটালেও এদের কার্যদ্বারা এরা মানুষের ধর্মের অনিষ্ট করে। তবে বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে যে গুনাহ হয় তা' ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু বান্দা অন্য লোকের ব্যাপারে যে গুনাহ করে, তা' ক্ষমার অযোগ্য এবং তার বিধান কঠোর। এই শ্রেণীর গুনাহগারকেও হেয় ও অপদস্থ করতে হয়। তার নিকট থেকে বিমুখ থাকতে হয় এবং তার সাথে সম্পর্ক কর্তন করতে হয় ও তাকে সালাম দেয়া ত্যাগ করতে হয়।
তৃতীয় শ্রেণীর গুনাহগারঃ যে ব্যক্তি মদ পান করে বা ফরজ কার্য ত্যাগ করে বা কোন হারাম কার্য করে, তার বিধান যাই হোকনা কেন, যে ব্যক্তি তাকে এসব কাজ করতে দেখে তাকে সে ব্যক্তিকে নিষেধ করা ওয়াজিব। চাই তা' প্রহার দ্বারা হোক, কথা দ্বারা হোক বা অন্য কোন প্রকারে হোক। মোটকথা মন্দকার্যে নিষেধ করা ওয়াজিব। যখন সে কোন খারাপ কাজ করে ফেলে এবং জানা যায় যে, এটা তার অভ্যাসগত দোষ এবং সে একাজ সর্বদা করে থাকে, তা'হলে তাকে এসব কাজ থেকে বারণ করা ওয়াজিব তখন, যখন তার ওগুলো থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। যদি সম্ভাবনা না থাকে, তবে তাকে উপদেশ দেয়া বা-সতর্ক করা ওয়াজিব নয় বরং উত্তম। যদি কঠোর ভাষায় সতর্ক করলে উপকার হয়, তবে তাই করবে। তার সালামের উত্তর দেয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এবং তার সংসর্গ হতে বিরত থাকা উত্তম। যদি সে তার কার্য থেকে না ফেরে, যদি জানা যায় যে, তাকে উপদেশ দিলে কোন লাভ হবে না। তবে তার বিধান সম্বন্ধে মতভেদ আছে। বিশুদ্ধ মত হল, মানুষের নিয়তের তারতম্যে বিধানের তারতম্য হয়। এ জন্যই বলা হয়েছে, "ইন্নামাল আ'মালু বিন্নিয়াতি" অর্থাৎ সমস্ত কাজ নিয়ত অনুসারে হয়। দয়া ও করুণার দৃষ্টিতে মানুষের প্রতি লক্ষ্য করা নম্রতার নামান্তর। বরং কর্কশ ব্যবহার করা, বিমুখ হয়ে থাকা, সতর্কতার নামান্তর। এ সম্বন্ধে ফতোয়া দেবার ব্যাপারে বিবেকই যথেষ্ট।
0 Comments