ঈর্ষার নিন্দা

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, বিদ্বেষের অন্যতম ফল হাসাদ অর্থাৎ ঈর্ষা এবং ক্রোধের ফল বিদ্বেষ। ক্রোধ মূল এবং ঈর্ষা ও বিদ্বেষ তার শাখা ও প্রশাখা। জেনে রাখবে, ঈর্ষারও অনেক জঘন্য শাখা-প্রশাখা আছে। তার সংখ্যা অসংখ্য।

        ঈর্ষার অকল্যাণ সম্বন্ধে অনেক হাদীস রয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, অগ্নি যেমন জ্বালানী কাষ্ঠকে ভস্ম করে, ঈর্ষাও অদ্রূপ পুণ্যরাশিকে বিনাশ করে। তিনি ঈর্ষার নিষেধ, কারণ এবং ফল সম্বন্ধে বলেছেন যে, তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ঈর্ষা করো না, পরস্পরকে ত্যাগ করো না, পরস্পরকে ঘৃণা করো না, পরস্পরের কারবারের উপর কারবার করো না এবং আল্লাহর সমস্ত বান্দা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা আমরা হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি বললেন, এখনই এ পথ দিয়ে বেহেশতবাসী একব্যক্তি আগমন করবে। ক্ষণকাল পরেই দেখা গেল ঐ পথ দিয়ে একজন আনছার চলে আসছেন। তিনি অজু করে এসেছিলেন বলে তার শ্মশ্রু থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল এবং তাঁর বাম হস্তে পাদুকা যুগল ছিল। তিনি এসে সালাম দিলেন। তাঁর পরদিনও হুযুরে পাক (দঃ) ঐরূপ কথা বললেন এবং ঐ দিনও ঐ আনছার ব্যক্তি ঐ পথ দিয়ে এসেছিলেন। তৃতীয় দিনও হুযুরে পাক (দঃ) ঐরূপ কথা বললেন এবং সেদিনও উক্ত আনছার ব্যক্তি ঐ পথ দিয়ে এলেন। যখন হুযুরে পাক (দঃ) গাত্রোত্থান করে উঠে যেতে লাগলেন আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করে তাকে বললেন, আমার পিতার সাথে আমার তর্ক হয়েছে তজ্জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তিনদিন আমি তার নিকট যাব না। যদি আপনি অনুমতি দিন তাহলে এ তিনদিন আমি আপনার গৃহে থাকতে চাই। আনছার ব্যক্তি বললেন, আপনি থাকুন। তারপর তিনি তিনদিন ঐ আনছার ব্যক্তির সাহচর্যে কাটালেন। কিন্তু তাকে তিনি একরাত্রেও তাহাজ্জুদের নামায পড়তে দেখতে পেলেন না। তবে তিনি কোন কথা বলতে শুনতে পেলেন না; বরং তিনি যখন তার শয্যায় যেতেন আল্লাহর যিকির করতে করতে ফজরের নামায পর্যন্ত কাটিয়ে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, তিনদিন অতীত হলে আমি তাঁর এই ইবাদাতকে নগণ্য মনে করে তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা। আমার পিতার উপর আমার কোন ক্রোধ হয় নি এবং তজ্জন্য আমি তাকে ছেড়ে আসি নি; বরং আমি হযরত রাসূলে করীম (দঃ) কে আপনার সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য করতে শুনলাম, তখন আমার মনে আপনার ইবাদাত প্রত্যক্ষ করবার জন্য ইচ্ছে হল। কিন্তু আমি যা' দেখলাম তাতে আপনার ইবাদাতকে আমি যথেষ্ট মনে করতে পারছি না। আপনি বলুন, আপনার এই পদমর্যাদা কিসের দ্বারা লাভ করলেন? আনছার ব্যক্তি বললেন, তুমি যা' দেখেছ তাতেই আমার এই মর্যাদা লাভ হতে পারে। অতঃপর যখন আমি তার নিকট থেকে বিদায় নিতে উদ্যত হলাম তখনও তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তুমি যা' দেখেছ তা-ই আমার ইবাদাত। তবে আমি আমার মনের মধ্যে কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত কোন নিয়ামতের জন্য ঈর্ষা পোষণ করি না। এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বললেন, তবে এজন্যই হয়ত আপনি এ পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু আপনার এ- স্বভাব অবলম্বন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি কখনও তা' পারব না।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তিনটি বিষয় থেকে কোন ব্যক্তি অব্যাহতি পায় না। যথাঃ (১) মন্দ ধারণা, (২) ঈর্ষা এবং (৩) অমঙ্গলের চিহ্ন। আমি তোমাদেরকে উক্ত বিষয়গুলো থেকে অব্যাহতি পাবার পন্থা শিখাচ্ছি। যদি মন্দ ধারণা হয় তা' বিশ্বাস করো না। যখন অমঙ্গলের লক্ষণ পাও তাতে আস্থা এনো না। যখন ঈর্ষা কর অনুসন্ধান করো না। হুযুরে পাক (সঃ) বলেছেন, পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের অভ্যাস তোমাদেরকে আক্রমণ করেছে। তা' হল, ঈর্ষা এবং হিংসা। হিংসাই মুন্ডনকারী। আমি বলছি না যে, তা' কেশ মুন্ডন করে; কিন্তু তা' ধর্মকে মুন্ডন অর্থাৎ বিনষ্ট করে। যাঁর হাতে মুহাম্মদের জীবন তাঁর শপথ, তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করবে না। তোমরা ঈমান আনতে পারবে না যে পর্যন্ত না পরস্পর পরস্পরকে ভালবাস। তোমাদেরকে কোন বস্তু এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত করবে তাকি তোমাদেরকে জানাব না? তা' হল তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, দরিদ্রতা কুফরীর নিকটবর্তী হয়েছিল এবং ঈর্ষা তাকদীরকে পরাভূত করবার নিকটবর্তী হয়েছিল। তিনি বলেছেন, অন্যান্য জাতিদের রীতি-নীতি শীঘ্রই আমার উম্মতকে আক্রমণ করবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, অন্যান্য জাতিদের রীতি-নীতি কি? তিনি বললেন, আমোদ-প্রমোদ, অসতর্কতা, প্রভৃত ধন-সম্পদ, দুনিয়ায় ঈর্ষামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পরস্পর পরস্পরকে দূরবর্তী মনে করা, পরস্পর পরস্পরকে ঈর্ষা করা এমন কি পরম্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং তারপর ভয়াবহ আপদ-বিপদ উপস্থিত হওয়া। তিনি আরও বলেছেন, তোমরা তোমাদের ভ্রাতার দুঃখে সন্তোষ প্রকাশ করো না। কেননা হয়ত আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়ে তোমাকে সে বিপদে লিপ্ত করতে পারেন।

        বর্ণিত আছে যে, হযরত মুসা (আঃ) তাঁর প্রভুর দীদারে গমন করেছিলেন। তিনি আরশের নিচে একব্যক্তিকে দেখে তার উচ্চ পদমর্যাদার জন্য মনের মধ্যে গেবতাহ (অন্যের উন্নতি দেখে নিজে তদনুরূপ উন্নতি কামনা করা) অর্থাৎ প্রতিযোগিতার ভাব এলে তিনি মনে মনে বললেন, নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি তার প্রভুর নিকট অত্যধিক সম্মানিত। অতএব তিনি তাঁর প্রভুকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তির নাম কি? বা এ ব্যক্তি কে? আল্লাহতায়ালা তার উত্তর না দিয়ে বললেন, আমি তার তিনটি নেক কার্যের পরিচয় তোমাকে প্রদান করছি। যথাঃ (১) আল্লাহ মানুষকে যে সম্পদ দেন সে তাতে ঈর্ষা করে না। (২) সে তার পিতা-মাতার অবাধ্য হয় না এবং (৩) সে কূটনামী করে বেড়ায় না। হযরত যাকারিয়া (আঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ঈর্ষাকারী আমার সম্পদের শত্রু। আল্লাহর বিধানে অসন্তুষ্ট। আল্লাহর ভাগ-বন্টনে নাখোশ। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আমি আমার উন্মতের জন্য যা' ভয় করি তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় ভয় তাদের ধন- সম্পদ বৃদ্ধি হওয়া এবং তার ফলে পরস্পর পরস্পরকে ঈর্ষা করা এবং পরস্পরের মধ্যে বিবাদ- বিসম্বাদ হওয়া। তিনি আরও বলেছেন, গোপনীয় প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। কেননা প্রত্যেক সম্পদশালী ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্র। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু আছে। আরজ করা হল, তারা কে? তিনি বললেন, আল্লাহতায়ালা তাঁর করুণার ভান্ডার থেকে যাদেরকে নিয়ামত বর্ষণ করেছেন তাদেরকে যারা ঈর্ষা করে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, হিসাবের পূর্বে পাঁচ ব্যক্তি একটি দোষের জন্য দোযখে যাবে। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। সে পাঁচ ব্যক্তি কে কে? তিনি বললেন, (১) শাসনকর্তা তার অত্যাচারের জন্য। (২) মরুবাসী আরব অন্যায় সাম্প্রদায়িক দ্বীতির জন্য। (৩) ধনী ব্যক্তি অহঙ্কারের জন্য। (৪) পল্লী গ্রামবাসী মূর্খতার জন্য এবং (৫) আলিম ব্যক্তি ঈর্ষার জন্য।

         বুযর্গদের বাণীঃ পূর্ববর্তী জনৈক বুযর্গ বলেছেন, প্রথম যুগে যে পাপ করা হয়েছিল তা' ঈর্ষার পাপ। হযরত আদম (আঃ) এর মর্যাদা দেখে শয়তানের মনে ঈর্ষা জেগেছিল। তজ্জন্য সে হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ করতে অস্বীকার করল; সুতরাং ঈর্ষাই তাকে পাপের দিকে নিয়ে গেল। বর্ণিত আছে যে, হযরত আওন ইবনে আবদুল্লাহ একদা হযরত ফজল (রহঃ) এর নিকট গিয়েছিলেন। তিনি তখন ওয়াসেত প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন। হযরত আওন তাকে বললেন, আমি আপনাকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিতে ইচ্ছে করি। ফজল বললেন, তা' কি? আওন বললেন, অহংকার ত্যাগ করবেন। কেননা এটাই প্রথম পাপ। যদ্বারা আল্লাহকে অমান্য করা হয়েছিল। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। "যখন আল্লাহ ফিরেশতাগণকে আদেশ করেছিলেন, আদমকে সিজদাহ কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদাহ করল।" আপনি লোভ ত্যাগ করবেন। কেননা লোভই হযরত আদম (আঃ) কে বেহেশত থেকে বের করে দিয়েছিল। আল্লাহ তাকে এমন বেহেশতে স্থান দিয়েছিলেন যা' সমস্ত আকাশ এবং দুনিয়া ব্যাপী পরিব্যাপ্ত। আল্লাহতায়ালা বেহেশতে একটি বৃক্ষের ফল ব্যতীত সমস্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু ঐ একটি বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে তাকে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তিনি তা' ভক্ষণ করলেন। যার ফলে আল্লাহতায়ালা তাকে বেহেশত থেকে বের করে দিলেন। অতঃপর তিনি ঐ আয়াতটি পাঠ করলেনঃ "এ বেহেশত থেকে বের হয়ে যাও।"

        আপনি ঈর্ষা। ত্যাগ করবেন।। কেননা হযরত আদম (আঃ)এর পুত্র তার ভ্রাতার প্রতি ঈর্ষাপরবশ হয়ে তাকে হত্যা করেছিল। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেনঃ "তাদের নিকট আদমের দু' সন্তানের সংবাদ পাঠ কর।" যখন ছাহাবায়ে কিরামদের জীবন চরিত আলোচনা করা হয় তখন সংযত থাকবেন। যখন তাকদীরের কথা বলা হয় তখন নীরব থাকবেন। যখন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয় কিছু আলোচনা করা হয় তখনও নীরব থাকবেন।

        একটি উপদেশপূর্ণ উপাখ্যানঃ হযরত বকর ইবনে আবদুল্লাহ একটি উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন। একব্যক্তি কোন বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে বাদশাহর সামনে বলল, ধার্মিক লোকের সৎকর্মের জন্য তার সাথে সদ্ব্যবহার করবেন। আর দুরাচার লোককে ছেড়ে দেবেন। কেননা দুষ্কর্মকারীর দুষ্কর্মই তার শাস্তির পক্ষে যথেষ্ট। একব্যক্তি ঐ ব্যক্তির পদমর্যাদা দেখে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল এবং বাদশাহর নিকট তার নিন্দা করতে লাগল। ঈর্ষাকারী বলল, এই ব্যক্তি হুযুরের মুখে দুর্গন্ধ আছে বলে অপবাদ দিয়ে বেড়ায়। বাদশাহ বললেন, তা' সত্য বলে কিরূপে বিশ্বাস করব? তখন লোকটি বলল, আপনি তাকে ডেকে আনাবেন, যখন সে আপনার নিকটবর্তী হবে দুর্গন্ধ বন্ধ করবার জন্য নিজের নাসিকায় হাত দিয়ে রাখবে। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা তুমি চলে যাও। আমি পরীক্ষা করে দেখব। সে বাদশাহর নিকট থেকে ফিরে গিয়ে ঐ লোকটিকে আহারের জন্য তার গৃহে দাওয়াত দিল এবং তাকে কাঁচা রসুন মিশ্রিত খাদ্য আহার করাল। লোকটি তার গৃহ থেকে বের হয়ে তার অভ্যাসমত বাদশাহর সামনে উপস্থিত হয়ে বলল, ধার্মিক লোকের সৎকর্মের জন্য তার সাথে সদ্ব্যবহার করবেন এবং দুরাচার লোককে ছেড়ে দেবেন। কোন দুষ্কর্মকারীর জন্য দুষ্কর্মই তার শাস্তির পক্ষে যথেষ্ট। বাদশাহ লোকটিকে বললেন, তুমি আমার আরও নিকটে আস। তখন সে বাদশাহর আরও নিকটবর্তী হলে মুখের রসুনের গন্ধ গোপন করবার জন্য সে তার মুখ ও নাসিকায় হাত চেপে রাখল। তখন বাদশাহ মনে মনে বললেন, নিশ্চয়ই সে লোকটি সত্য কথা বলেছে।

         তখন বাদশাহ তার শিরচ্ছেদের হুকুমনামা তার কোন এক শাসনকর্তার নিকট এক লেফাফার মধ্যে পুরে মোহর করে ঐ লোকটিরই হাতে তা' পাঠিয়ে দিলেন। তাতে লিখা ছিল, এই পত্রবাহক তোমার নিকট পৌঁছামাত্র তাকে হত্যা করে দেহ থেকে তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে আমার নিকট পাঠিয়ে দেবে। লোকটি সে পত্রখানা নিয়ে বাদশাহর দরবার থেকে বের হয়ে আসল এবং ঈর্ষাপরায়ণ লোকটির সাথে তার সাক্ষাত হল। সে লোকটি জিজ্ঞেস করল, এ পত্রখানা কার? সে বলল্ব, আমাকে পুরস্কার দেবার জন্য শাসনকর্তার নিকট বাদশাহর পত্র। সে বলল, আমাকে পত্রখানা দিয়ে দাও, আমিই তা' তার নিকট পৌঁছে দেব। সে তার নিকট পত্রখানা দিয়ে দিল। সে লোকটি মনে করল যে, শাসনকর্তা প্রদত্ত পুরস্কার সে নিজেই হস্তগত করবে। অতএব পুরস্কার লাভের লালসায় সে পরম আনন্দে লেফাফাবন্দী পত্রখানা নিয়ে শাসনকর্তার হস্তে অর্পণ করল। শাসনকর্তা পত্র খুলে পড়ে দেখে বলল, এ পত্রে তো তোমাকে হত্যা করবার কথা আছে। তখন সে লোকটি বলল, এ পত্র তো আমার নিকট দেয়া হয় নি। আল্লাহর কসম এ পত্র অন্যের নিকট দেয়া হয়েছিল এবং তার-ই সম্বন্ধে ঐ হুকুম দেয়। হয়েছে; সুতরাং আপনি এ পত্র বাদশাহর নিকট ফিরিয়ে দিন। শাসনকর্তা বলল, বাদশাহর আদেশ তামীল না করে এ পত্র তার নিকট ফেরত দেয়া যায় না। অতঃপর লোকটিকে হত্যা করে তার মস্তক বাদশাহর দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হল।

        তারপর আবার সেই উপদেশদানকারী লোকটি তার অভ্যাস অনুযায়ী বাদশাহর নিকট এসে বাদশাহকে সেই পূর্ব উপদেশ বাণী শুনাল। বাদশাহ তাকে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সে পত্র কি করেছ? সে বলল, আমি পত্র নিয়ে যাবার কালে ঐ ব্যক্তি আমার নিকট পত্রখানা চাইল এবং সে তা' আমার নিকট থেকে নিয়ে নিল। বাদশাহ বললেন, সে ব্যক্তি আমার নিকট বলেছিল যে, তুমি আমার মুখে দুর্গন্ধ আছে বলে রটাচ্ছ। লোকটি বলল, না, আমি তো তা' কখনও রটাই নি। বাদশাহ বললেন, তবে তুমি আমার দরবারে এসে তোমার মুখ ও নাসিকায় হস্ত স্থাপন কেন করেছিলে? লোকটি বলল, সে ব্যক্তি সেদিন আমাকে তার গৃহে দাওয়াত করে খাদ্যের সাথে কাঁচা রসুন মিশিয়ে খাইয়েছিল। আমি আপনার নিকটবর্তী হলে ঐ দুর্গন্ধ প্রকাশ পেতে দিতে আমার ইচ্ছে হল না। তাই ঐরূপ হাত চেপে রেখেছিলাম। বাদশাহ বললেন, তুমি সত্য কথাই বলেছ। তুমি যে প্রত্যহ বলে থাক, দুষ্কর্মকারীর জন্য তার দুষ্কর্মই যথেষ্ট শাস্তি দাতা। এ কথা একেবারেই যথার্থ। তুমি তোমার গৃহে চলে যাও। তাকে তার নিজের মন্দ কার্যই উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে।

        হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) বলেছেন, আমি কারও পার্থিব উন্নতি দেখে ঈর্ষা করি না। কেননা যদি সে বেহেশতবাসী হয়, তা' হলে এই পার্থিব সুখ-সম্পদ তার আখেরাতের সুখ-সম্পদের তুলনায় নগণ্য; সুতরাং তার সাংসারিক উন্নতির বিষয়ে আমি কিরূপে তার প্রতি ঈর্ষা করব? যদি সে দোযখবাসী হয়, তাহলে তার দুনিয়ার সুখ-সম্পদের জন্য তাকে কিরূপে ঈর্ষা করব, কেননা সে এ সমস্ত হারিয়ে দোযখে যাবে।

        একব্যক্তি হযরত হাসান বছরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিল, মু'মিন ব্যক্তি কি ঈর্ষা করেন? তিনি বললেন, তুমি কি হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর পুত্রদের কাহিনী ভুলে গেছ? হাঁ, তার ঈর্ষা আছে। কিন্তু ঈর্ষা যদি তার মনের মধ্যে গুপ্ত থাকে, তার হস্ত বা রসনা দ্বারা প্রকাশ না পায় তা' তার অনিষ্ট করে না। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অধিক মৃত্যু চিন্তা করে, তার আনন্দ হ্রাস পায় এবং ঈর্ষাও হ্রাস পেয়ে যায়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেছেন, আমি সব মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারি কিন্তু সম্পদে ঈর্ষাকারীকে সন্তুষ্ট করতে পারি না। কেননা প্রতিপক্ষের সুখ ও সম্পদ লোপ না হওয়া পর্যন্ত ঈর্যাকারী সন্তুষ্ট হয় না। এইজন্য জনৈক কৰি বলেছেনঃ

শত্রুতা তা' যত বেশী হোক 

দূর করা সম্ভব 

কিন্তু মনের ঈর্ষা হটানো 

বিলকুল অসম্ভব।

            জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, ঈর্ষ্য একটি ক্ষত সদৃশ, যার আরোগ্য নেই। অথবা ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির উপর যে কর্মফল উপস্থিত হয় তা-ই তার শাস্তির পক্ষে যথেষ্ট। জনৈক আরববাসী বলেছে, আমি কোন জালিমকে ঈর্যাকারী অপেক্ষা মজলুমের সদৃশ দেখি নি। তার উপর প্রদত্ত সুখসম্পদ দেখলে তার অস্বস্তি হয় (মনে ক্ষোভ হয়)। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, হে আদম সন্তান। তুমি কেন তোমার ভ্রাতাকে ঈর্ষা কর? যদি আল্লাহ তাকে উপযুক্ত মনে করে তা' দিয়ে থাকেন, তুমি কেন তাকে ঈর্ষা করবে, যাকে আল্লাহ সম্মান দিয়েছেন। যদি সে তজ্জন্য অনুপযুক্ত হয় তার দোযখে গমনের পথ সহজ হবার জন্য ঈর্ষা করো না। কোন বুযর্গ বলেছেন, ঈর্ষ্যকারী তিরস্কার ও অপমান ব্যতীত মজলিসের লোকের নিকট থেকে আর কিছুই পায় না। অভিশাপ ও ঘৃণা ব্যতীত ফিরেশতাদের নিকট থেকে তার জন্য আর কিছুই নেই। সে মানুষের নিকট থেকে দুঃখ ও ব্যর্থতা ব্যতীত আর কিছুই লাভ করে না। বিতর্কের সময় সে কর্কশ ব্যবহার ও ভয় ব্যতীত আর কিছুই পায় না। সে রোজ কিয়ামতেও কঠোর শাস্তি ও অপমান ব্যতীত অন্য কিছু পাবে না।

Post a Comment

0 Comments