প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, এতক্ষণ তোমরা যে ভয়ংকর দুঃখ-ক্লেশপূর্ণ আবাসস্থলের বিষয় জেনে আসলে, তার বিপরীত অন্য আবাসও আছে। এবার তার সুখ-শান্তি, আরাম- আয়েশ এবং আনন্দের বিষয় লক্ষ্য কর। যে এক আবাস থেকে দূরে থাকে, নিশ্চয়ই সে অন্য আবাসে বসবাস করবে। একদিকে তুমি দোযখের ভয়াবহ অবস্থার কথা চিন্তা করে মনে যেরূপ ভয়-ভীতি জান্মাবে, অন্য দিকে তদ্রূপ বেহেশতের কথা চিন্তা করে মন আনন্দিত ও উৎফুল্ল করে তুলবে।
এবার তুমি বেহেশতবাসীদের অবস্থা লক্ষ্য কর। তাদের মুখমণ্ডলে সুখের নিদর্শন প্রতিভাত হতে থাকবে। সীলমোহর করা শরবত তাদেরকে পান করানো হবে। তারা শ্বেতবর্ণ রত্ন নির্মিত তাঁবুর মধ্যে ও রক্তবর্ণ হীরক খচিত সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকবে। উক্ত তাঁবুর মধ্যে সবুজবর্ণের মণি-মাণিক্যের কারুকার্য খচিত পালঙ্কোপরি শয্যা বিছানো থাকবে। বেহেশতীগণ আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে উপবিষ্ট থাকবে। এ কেদারাগুলো বেহেশতোদ্যানের দুই তীরে স্থাপন করা হবে। উক্ত প্রস্রবণে দুগ্ধ এবং পবিত্র শরাব থাকবে। কচি কিশোর সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট বালকগণ ও কৃষ্ণনয়না হুরী-অন্দরীগণ যথায়-তথায় বিচরণ করবে। অনুপম স্বভাব এবং অপরূপ রূপ-লাবণ্যে সুমণ্ডিত হয়ে এরা বেহেশতীদের মন মাতোয়ারা করে তুলবে। এদরেকে দেখে মনে হবে যেন, হীরক, রত্ন ও মণি। এই হুরী-অন্দরীদেরকে এর পূর্বে কখনও কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি। বেহেশতের দরজায় এরা পায়চারি করবে। এদের প্রত্যেকের সাথে থাকবে সত্তর হাজার করে গেলমান অর্থাৎ মণি-মুক্তোর ন্যায় কচি কিশোর বালক, যারা এদের খাদেম স্বরূপ। এদের দেহ শ্বেতবর্ণ জরির পোশাক দ্বারা বিভূষিত থাকবে। তা' দেখে বেহেশতীদের নয়নযুগল শীতল হয়ে যাবে। গেলমানদের মস্তকে জরি টুপীও শোভা পেতে থাকবে। এ টুপীতে জরির সাথে হীরক ও রত্নও খচিত থাকবে। এদের দেহ থেকে মনোমুগ্ধকর সুঘ্রাণ বিচ্ছুরিত হবে। আল্লাহতায়ালার অপূর্ব কুদরতে এদের কখনও বার্ধক্য আসবে না। ইয়াকুত নির্মিত শোভাময় প্রাসাদে এরা বসবাস করবে। ঐ প্রাসাদসমূহ বেহেশতোদ্যানের মধ্যবর্তী স্থানে স্থাপিত থাকবে।
হুরীগণ তাদের আয়তলোচনের বক্রদৃষ্টি দ্বারা বেহেশতী পুরুষদের প্রতি কটাক্ষপাত করতে থাকবে এবং তাদের আশে-পাশে ঘুরে বেড়াবে। তাদের সাথে থাকবে মনোহর পান-পিয়ালা। তদ্বারা তারা নিজেরা যেমন পানীয় পান করবে, তেমন বেহেশতীদেরকেও পানীয় পান করিয়ে হৃদয় জুড়াবে। ঐ পানীয় হবে যেমনই তৃপ্তিকর, তেমনই সুস্বাদু এবং শীতল ও স্নিগ্ধ। সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট গেলমানগণ সম্মুখে ও ডানে-বামে রত্ন ও মণি-মুক্তাসম ছড়িয়ে থেকে পায়চারি করবে। বেহেশতীগণ দুনিয়ায় যে নেক আমলসমূহ করেছিল, তারই বিনিময় স্বরূপ এ সব পাবে। এরা অত্যন্ত নিরাপদ স্থানে যথা বেহেশতোদ্যানে, প্রস্রবণসমূহের তীরে, এসাতাম্বিনীসমূহের উভয় পার্শ্বে অবস্থান করবে এবং তথায় মহাপ্রভু আল্লাহতায়ালার দিকে দৃষ্টিপাত করে থাকবে। তাদের মুখমণ্ডলে বেহেশতের অনাবিল সুখ ও শান্তির আভা চমকিতে থাকবে। কোনরূপ অপমান, খুঁৎ ও খোটা তাদের মধ্যে থাকবে না। তারা আল্লাহর নিখুঁৎ, নির্দোষ এবং সম্মানিত বান্দা। বেহেশতীগণের প্রতি আল্লাহতায়ালা নানারূপ উপহার-উপঢৌকন পাঠাতে থাকবেন। তাদের মন যখন যা' পেতে চাবে, তখনই তা' এসে তাদের সামনে হাজির হবে। তাদের মনে কোনরূপ ভয়-ভীতি, শোক-দুঃখ, কষ্ট-ক্লেশ বা নিরানন্দের লেশমাত্র থাকবে না। মৃত্যু বা কোন কিছু থেকে বিচ্ছেদের চিন্তা তাদের মনে উদয় হবে না। অজস্র সুখ-সম্পদ, অডেল-নিয়ামত ও অমূল্য মাল-সামান তাদের নিকট স্তূপাকারে মৌজুদ থাকবে, অভূতপূর্ব উপাদেয় ও সুস্বাদু খাদ্য তারা ভক্ষণ করবে। তারা বেহেশতের ঝরণা থেকে দুদ্ধ, মধু ও পবিত্র শরাব পান করবে। সে ঝরণার তলদেশ রৌপ্য দ্বারা নির্মিত। তার প্রস্তরসমূহ বহু মূল্যবান মারজান দ্বারা তৈরী, মৃত্তিকা নির্মিত মেশক দ্বারা বৃক্ষগুলো নির্মিত মারজান এবং অন্যান্য মূল্যবান প্রস্তর দ্বারা। ঝরণাগুলোর দুগ্ধ, মধু ও শরাব পান করার জন্য বেহেশতীদেরকে দেয়া হবে মারজান খচিত রৌপ্য নির্মিত পিয়ালা। মুখবন্ধ অর্থাৎ সীলমোহর করা পাত্রে রক্ষিত পানীয় তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে। প্রত্যেক পানীয়ের মধ্যে ছালছাবীল মিশ্রিত থাকবে। পানীয় এমন স্বচ্ছ এবং নির্মল থাকবে যে, তা' থেকে অপূর্ব জ্যোতি নির্গত হবে। পাত্রগুলোর বর্ণ এবং স্বচ্ছতার জন্য পাত্রের বাইরে থেকেও তা' দৃষ্টিগোচর হবে। কোন মানুষের ঐরূপ পানীয় তৈরী করার সাধ্য নেই। ঐ পানীয়ের প্রস্তুত কার্যে কোনরূপ ত্রুটি থাকবে না। যারা হাতে ধরে পানীয়ের পিয়ালা বেহেশতীদের কাছে সরবরাহ করবে, তাদের মুখশ্রী হবে সূর্যরশ্মির ন্যায়। তাদের রূপ লাবণ্য, মুখশ্রী, চোখের চাহনি, কেশ পারিপাট্য কোন কিছুর সাথেই পার্থিব জগতের কিছু তুলনীয় হবে না।
বড়ই আশ্চর্যের কথা, যে ব্যক্তি-সুখাগারের কথা মনে এই প্রাণে বিশ্বাস করে, এও বিশ্বাস করে যে, এর অধিবাসীদের কখনও মৃত্যু হবে না, তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে, তাদের কখনও কোন বিপদাপদ ঘটবে না, দুর্ঘটনা ঘটবে না, তাদের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের কোন পরিবর্তন হবে না, সে কিরূপে সেই বাসাগারের সাথে ভালবাসা করতে পারে, আল্লাহতায়ালা যার অস্থায়িত্ব ও বিনষ্ট হওয়ার কথা পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছেন। ঐরূপ ক্ষণভঙ্গুর বস্তুকে কিরূপে চিরস্থায়ী বস্তুর বদলে প্রিয় মনে করা যায়। আল্লাহর কসম, যদি বেহেশতের মধ্যে শুধু শারীরিক সুস্থতা থাকে মৃত্যু, ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং শারীরিক অন্যান্য আবশ্যকতা না থাকে, তবে শুধু তারই জন্য অস্থায়ী দুনিয়া ত্যাগের উপযোগী হবে। যেসব বস্তু ত্যাগ করে যেতে হবে, আখেরাতের স্থায়ী সুখকে পরিত্যাগ করে তা' কিরূপে পছন্দ করা যায়। দুনিয়ায় দু দণ্ড সময়, তাও নানারূপ দুঃখ- শোক, ক্লেশ, অভাব-অভিযোগ বিপদ-আপদপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তাকে কি করে স্থায়ী সুখের আগার বেহেশতের পরিবর্তে ভালবাসা যায়, যেখানে মানুষ রাজ-রাজন্যের ন্যায় স্থায়ী কাল পরম সুখে ও নির্ভাবনায় বসবাস করবে? বেহেশতীগণ আল্লাহর আরশে মুআল্লার কাছে গিয়ে আল্লাহর মুখন্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাদের এই দৃষ্টিপাতে তারা এমন অনুপম সুখ লাভ করবে, যার তুলনায় বেহেশতের অতুলনীয় সুখ-সম্পদও তাদের নিকট অতি নগণ্য মনে হবে। আল্লাহর মুখমণ্ডলের দিকে দৃষ্টিপাত কালে অন্য কোন দিকে এক পলকের তরেও ফিরে তাকাবে না। তারা সর্বদা এমন নিয়ামতসমূহের মধ্যে বসবাস করবে, যা' কখনই বিলোপ হবে না বা বিলোপ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, রোজ কিয়ামতে কোন এক ঘোষণাকারী এরূপ খোষণা করবে যে, বেহেশতবাসী। এই বেহেশত মধ্যে তোমরা চিরসুস্থ থাকবে। এর মধ্যে প্রবেশের পর আর তোমাদের কোন রোগ-ব্যাধি বা কোনরূপ অসুস্থতা দেখা দেবে না। এখানে অনন্তকাল ধরে জীবিত থাকবে। আর কোন দিন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে হবে না। এখানে তোমরা সারা জীবনকাল যৌবন-সুখ উপভোগ করবে, কোন দিন বার্দ্ধক্যে উপনীত হতে হবে না। এতে তোমরা বরাবর সুখ ও শাস্তির মধ্যে বসবাস করবে, কোন দিনই কোনরূপ দুঃখ তোমাদেরকে স্পর্শ করবে না। এই-ই মহান আল্লাহতায়ালার প্রকাশ্য ঘোষণা। বেহেশতবাসীদেরকে লক্ষ্য করে বলা হবে, এই-ই তোমাদের প্রতিশ্রুত বেহেশত-আগার। দুনিয়ায় তোমরা যে সৎকার্য করে এসেছ, এ তারই পুরস্কার।
যদি তোমরা বেহেশতের আরও বর্ণনা জানতে ইচ্ছা কর, তবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত কর। বেহেশত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম বর্ণনা আর হতে পাবে না। আল্লহ বলেন, যে তার প্রভুর সম্মুখে দাঁড়াতে ভয় করে, তার জন্য দুটো উদ্যান। সূরা আর রাহমানের শেষ পর্যন্ত। তাছাড়া সূরা ওয়াকিয়াহ এবং অন্যান্য সূরা পাঠ কর। যদি এসব ব্যাপার পুরাপুরি জানতে চাও, তাহলে নিম্নোক্তরূপে চিন্তা ও ফিকির করবে। প্রথমে চিন্তা করবে, বেহেশতের সংখ্যা কত! হুযুরে পাক (দঃ) এ আয়াত সম্বন্ধে বলেছেন (যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দাঁড়াতে ভয় করে, তার জন্য দুটো বেহেশত) বেহেশত দুটোর পাত্র এবং তার মধ্যে যা' আছে, তা' রৌপ্য নির্মিত। দুটো পাত্র এবং তন্মধ্যে যা' আছে তা' স্বর্ণ নির্মিত। তারপর বেহেশতের দরজার দিকে লক্ষ্য কর। তার সংখ্যা অগণিত। ইবাদাতের পরিমাণ অনুসারে ঐ সব দরজার সংখ্যা হয়ে থাকে।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে দুপ্রকার মাল ব্যয় করে থাকে, তাকে বেহেশতের সব দরজা থেকেই অভ্যর্থনা করা হবে। বেহেশতের আটটি দরজা আছে। যে ব্যক্তি নামাযী, তাকে নামাযের দরজা থেকে অভ্যর্থনা করা হবে, যে ব্যক্তি রোযাদার, তাকে রোযার দরজা থেকে অভ্যর্থনা করা হবে, যে ব্যক্তি যাকাতদাতা, তাকে যাকাতের দরজা থেকে অভ্যর্থনা করা হবে। যে ব্যক্তি যোদ্ধা তাকে জিহাদের দরজা থেকে অভ্যর্থনা করা হবে। হযরত আবুবকর (রাঃ) তখন বললেন, আল্লাহর কসম, তাহলে দেখা যায় যে, প্রত্যেকেই এক এক দরজা থেকে অভ্যর্থনা লাভ করবে। কিন্তু এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যে, সে সব দরজা থেকেই অভ্যর্থনা পাবে? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হাঁ, এমন ব্যক্তিও আছে যে, সব দরজা থেকেই অভ্যর্থনা পাবে। আমি আশা করি যে, সেই লোকদের অন্যতম আমিও হব।
হযরত আছেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন আলী (রাঃ)-এর নিকট দোযখের বিষয় উল্লেখ করা হল, তাঁর নিকট তা-ই গুরুতর ব্যাপার বলে বোধ হল। তারপর তিনি বললেন, দুনিয়ায় যারা তাদের প্রভু আল্লাহতায়ালাকে ভয় করেছিল, তাদেরকে একত্র করে বেহেশতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা যখন বেহেশতের দ্বারদেশে গিয়ে উপস্থিত। দিকে নিয়ে একটি বৃক্ষ দেখতে পাবে। ঐ বৃদ্ধে ফের মূল দেশ থেকে হবে, কথায় কার দুটো প্রসবণ প্রবাহিত হতে তাদেরকে প্রস্রবণ থেে থেকে পানি পানি পান করতে আদেশ দেয়া হবে। তদনুযায়ী তারা ঐ পানি প্রত্যেকেই কিছু। পরিমাণ মাণ পান করবে। যার ফলে তাদের উদরের মধ্যে যত রকমে ও অন্য কোন রোগ থাকে এবং হৃদয়ের মধ্যে যদি কোন রোগ, সুঃখ, শোক বা থাকে তা' সবই দূর হয়ে যাবে। তারপর তারা অন্য একটি প্রস্রবণের নিকট পিচে তার পাদি দ্বারা অজু-গোসল করতঃ পবিত্রতা অর্জন করবে। এর ফলে তাদের চেহারার লাবণ্য উঠবে এবং সর্বশরীর উজ্জ্বল হয়ে যাবে। তাছাড়া এরপর থেকে। তাদের মস্তকের কেশ আর কখনও পরিবর্তন হবে না; অর্থাৎ তা' কখনও বৃদ্ধি পাবে না বা হ্রাস পাবে না। যার পরিমাণ কেশ থাকে সবসময় তা-ই থাকবে আর কেশরাজি কখনও নিজের হয়ে বিন্যস্ত। ও করতে হবে না; বরং আপনা আপনি তা' সুবিন্যস্ত হয়ে যাবে এবং সর্বস্য তদ্রূপই থাকবে। সে। আর কেশরাজিতে তেল মর্দন করার কোন প্রয়োজন হবে না; বরং তেল মর্দন ব্যতীতই কে মসৃণ ও উজ্জ্বল থাকবে। অতঃপর তাদেরকে বেহেশতের মধ্যে প্রবেশ করানো বা হবে। বেহেশতের দারোগা ফিরেশতা রেদোয়ান তারেদকে পরম যত্নে অভ্যর্থনা করবে। আর বলবে আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আপনারা সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এখন থেকে আপনার চির দিনের জন্য এই বেহেশতে বসবাস করতে থাকুন।
অতঃপর এই বেহেশতীদের সন্তান-সন্ততি, যারা এর পূর্বেই বেহেশতে প্রবেশ করেছে এসে এদের সাথে সাক্ষাত করবে। এদের ছোট ছোট সন্তানগণ এসে এদের চার পার্শ্বে ঘুরাফিরা করতে থাকবে। যেরূপ দুনিয়ায় শিশু ও কিশোর সন্তান-সন্ততিগণ তাদের মাতা-পিতার চারপাশে ঘুরাফিরা করে। তারা না জানা কোন অজানা স্থান থেকে এসে তাদের সাথে সাক্ষাত করবে। পূর্বোক্ত ফিরেশতার ন্যায় তারাও তাদেরকে লক্ষ্য করে বলবে, আপন সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাদের জন্য এই সম্মান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ব্রীসব সন্তানদের মধ্য থেকে একটি বালক জনৈকা কৃষ্ণনয়না এক হরের নিকট গিয়ে বলবে, অমুক ব্যক্তি আগমন করেছে। দুনিয়ায় যা' তার নাম ছিল সে নামেই সে তার পরিচয় দেবে। ছর তারা নিকট জিজ্ঞেস করবে, তুমি কি তাকে সত্যিই দেখেছ? সে বলবে, হাঁ, আমি নিশ্চয়ই তাকে দেখেছি। এই তো এখনই সে এসে পড়ল বলে। তখন সে আনন্দে লাফিয়ে উঠবে এবং তার গৃহ-দরজায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকবে। যখন সে ব্যক্তি এসে তার গৃহ-দরজায় পৌছবে, সে ঐ প্রাসাদের ভিত্তিমূলের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। তারপর তার মস্তক উত্তোলন করে প্রাসাদের ছাদের দিকে লক্ষ্য করবে। তা' যেন বিদ্যুতের চমকের ন্যায় মনে হতে থাকবে। যদি আল্লাহতায়ালা স্বীয় কৃপাগুণে তার নেত্রদ্বয়কে রক্ষা না করতেন তবে ঐ চমকের প্রভাবে তার দৃষ্টিশক্তি ঝলসে যাবার উপক্রম হত। অতঃপর সে তার মস্তক ঘুরিয়ে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে পাবে যে, সে তার স্বয়ং স্ত্রী। দুনিয়ায় যে স্ত্রীর সাথে সে একত্রে ঘরকন্না ও বসবাস করে এসেছে। বলাবাহুল্য যে, বেহেশতের অকল্পনীয় সুখের প্রভাবেই তার স্ত্রীর এরূপ সুখ-সম্পদ ও রূপ-লাবণ্য সৃষ্টি হয়েছে। তারপর সে বেহেশতী পুরুষটি হেলান দিয়ে বসে বলবে, সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে দুনিয়ায় হেদায়েত দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই আমরা হেদায়েত লাভ করতাম না, যদি আল্লাহতায়ালা দয়া পরবশ হয়ে আমাদেরকে হেদায়েত না দিতেন। এসময় একজন ঘোষণাকারী তাদেরকে এরূপ ঘোষণা জানিয়ে দেবে যে, তোমরা এখানে চিরদিন জীবিত থাকবে। আর কোন দিনই তোমাদের কারুর মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে হবে না। তোমরা চিরদিন এই চিরসুখময় বেহেশতে বসবাস করবে। এখান থেকে তোমাদের আর কোথাও কোনদিনই যেতে হবে না। তোমরা এখানে সারাজীবন সুস্বাস্থ্য নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থরূপে কাল কাটাতে থাকবে। কোনদিন আর তোমাদের কারুরই অসুস্থ হতে হবে না এবং কাউকে কখনও স্বাস্থ্যহানীর জন্য উদ্বেগ পোহাতে হবে না।
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, রোজ কিয়ামতে আমি বেহেশতের দরজায় উপস্থিত হয়ে বন্ধ দরজা খুলে দেয়ার জন্য আদেশ করলে দরজায় নিয়োজিত দারোয়ান এসে বলবে, আপনি কে? আপনার পরিচয় দিন। আমি বলব, মুহাম্মদ আমার নাম। তা' শুনে দারোয়ান বলবে, আপনার পূর্বে আর কারুর জন্য এই দরজা খুলে দিতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।
তুমি এখন বেহেশতের জানালা, কপাট এবং বিভিন্ন দরজার আয়তন ও উচ্চতার পার্থক্য সম্বন্ধে লক্ষ্য কর। কেননা আখেরাতে বিভিন্ন দিক থেকেই উচ্চ ও নিম্ন মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য থাকবে। যেরূপ এই দুনিয়ায় মানুষের প্রকাশ্য ইবাদাত ও অপ্রকাশ্য উত্তম স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। একইভাবে আখেরাতেও মর্যাদার তারতম্য হবে। যদি তুমি আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভের আকাঙ্খা কর। তাহলে তা' লাভের জন্য অত্যধিক পরিশ্রম কর। যেন অন্য কেউ-ই তোমাকে আল্লাহর ইবাদাতে ও অন্যান্য সৎ কার্যসমূহে এবং উত্তম স্বভাব-চরিত্রে অতিক্রম করতে না পারে। জেনে রাখবে, আল্লাহতায়ালা এক্ষেত্রে তোমাকে প্রতিযোগিতার জন্য আদেশ দিয়েছেন। যেমন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "সাবিকু ইলা মাগফিরাতিম মির রাব্বিকুম" অর্থাৎ তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতা কর। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, "ওয়া ফী যালিকা ফালইয়াতানাফুসিল মুতানাফিসূন।" অর্থাৎ এই সম্বন্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীগণ যেন প্রতিযোগিতা করে।
এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, যদি এ সংসারে তোমার চেয়ে তোমার বন্ধু-বান্ধবগণ এবং তোমার প্রতিবেশীগণ অধিক অর্থ সম্পদ উপার্জন করে বা জাঁকজমকপূর্ণ সুরম্য দালান-কোঠা নির্মাণ করে এবং সেদিক থেকে তারা তোমার চেয়ে অগ্রগণ্য হয় তা' তোমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর এবং অসহ্যকর হয়ে পড়ে। তোমার মন তাতে খুবই সংকীর্ণ এবং অসন্তুষ্ট হয়; বরং তোমার মনের মধ্যে অসহ্যকর হিংসা এবং ঈর্ষা সৃষ্টির কারণে তুমি জ্বলে-পুড়ে মরতে থাক এবং তোমার জীবন-যাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠে কিভাবে তুমি তাদেরকে ঐদিক থেকে অতিক্রম করে তাদের অগ্রবর্তী হবে। তজ্জন্য উঠে-পড়ে লেগে যাও। অথচ আখেরাতে বেহেশতে তুমি কিরূপে তাদের চেয়ে মান-মর্যাদা ও সুখ-সম্পদে অগ্রবর্তী হবে সেদিকে তোমার আদৌ খেয়াল নেই। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুনিয়ার সুখ-সম্পদ খুবই সামান্য সময়ের জন্য। পক্ষান্তরে বেহেশতের সুখ-সম্পদ দীর্ঘ দিনের জন্য, দীর্ঘ দিনই নয় বরং অনন্তকালের জন্য।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, বেহেশতবাসীগণ তাদেরকে উচ্চস্থানে বসবাসকারীদেরকে তাদের মস্তকের উপর এরূপভাবে দেখবে যে, দুনিয়ায় তোমরা যেরূপ তোমাদের মস্তকের বহু উপরে আকাশের তারকারাজি দেখছ। বেহেশতের এরূপ উচ্চস্থানে বসবাস করা একমাত্র তাদের মর্যাদার কারণেই সম্ভব হবে। আল্লাহর ইবাদাত, নানরূপ সৎকার্য এবং উত্তম স্বভাব-চরিত্র দ্বারাই এই মর্যাদা অর্জিত হয়। হুযুরে পাক (দঃ)-এর এই হাদীস শুনে সাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। এরূপ মর্যাদা কারা অর্জন করবে? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর নবী ও রাসূলগণই এই মর্যাদা লাভ করবেন। তাঁরা ব্যতীত এই মর্যাদার অধিকারী অন্য কেউ-ই হতে পারবে না। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বললেন, যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, এমন লোকও রয়েছে যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং নবীদেরকে সত্য জেনেছে তারাও অসীম মর্যাদার অধিকারী হবে। তিনি আরও বলেছেন, নিশ্চয়ই এই শ্রেণীর মর্যাদাধারীদেরকে নীচে থেকে অবলোকন করা যাবে। নবী, রাসূলদের পরে যাদের মর্যাদা হবে, তারা হবেন আবুবকর, ওমর এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য লোকগণ।
হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা হুযুরে পাক (দঃ) আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার সহচরগণ! আমি কি তোমাদেরকে বেহেশতের খিড়কী সম্বন্ধে কিছু পরিচয় দেব না? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই দেবেন। তখন তিনি বললেন, বেহেশতের গৃহপ্রাচীর ও বহির্দেয়ালসমূহে বহু খিড়কী থাকবে। এগুলো বহু মূল্যবান মণি-মুক্তো দ্বারা নির্মাণ করা হবে। এ খিড়কীর কপাটসমূহ এমনই স্বচ্ছ ও নির্মল থাকবে যে, তার অভ্যন্তর ভাগ থেকে বহির্ভাগ স্পষ্টরূপে দেখা যাবে এবং বহির্ভাগ থেকে অভ্যন্তর ভাগ একইভাবে স্পষ্টরূপে দেখা যাবে। এর অভ্যন্তর ভাগে অর্থাৎ প্রকোষ্ঠসমূহে অনবরত আনন্দ, স্ফূর্তি, সুখ, সৌন্দর্য, এত অধিক বিরাজ করবে যে, তা' কোন চক্ষু কোনদিনই দর্শন করেনি এবং কোন কর্ণ তা' কোনদিনই শ্রবণ করেনি। এমনকি কোন হৃদয়ও তা' কোনদিন কল্পনা করেনি। তখন আমি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বলুন, এসব খিড়কীযুক্ত কক্ষসমূহের অধিকারী কারা হবে? তিনি জবাবে বললেন, যারা এই দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে শান্তি বিস্তার করে, অভাবগ্রস্ত লোকদেরকে খাদ্য দান করে, নিজেরা দিবসে রোযা রাখে এবং রাত্রে যখন সব লোক নিদ্রাভীভূত হয়ে পড়ে তখন উঠে নামায আদায় করে ও রাতভর তাতে লিপ্ত থাকে। তখন আমি হুযুরে, পাক (দঃ)কে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল। কারা এসব কাজ করতে সমর্থ হবে? তিনি জবাব দিলেন, আমার প্রকৃত উম্মতগণই এসব কাজ করতে সমর্থ হবে। একাজগুলো তাদের দ্বারা কিভাবে আদায় হবে এবার তা' তোমরা শোন। যে ব্যক্তি তার ভ্রাতার সাথে সাক্ষাত হওয়া মাত্র তাকে সালাম দেয় বা তার সালামের জবাব দেয়, সে-ই দুনিয়ায় শান্তি বিস্তার করে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজনকে তার হালাল রুজী দ্বারা তৃপ্তি সহকারে জীবিকা দেয় সে-ই মানুষকে খাদ্য দান করে। যে ব্যক্তি রমযান মাসে রোযা রাখে ও অন্যান্য মাসে তিনদিন রোযা রাখে এবং শাওয়াল মাসে দুটি রোযা রাখে সে-ই যেন সারা হা বছর রোযা খেলো। যে ব্যক্তি এশার নামায ও ফজরের নামায রাগ জামাতের সাথে আদায় করে সে যেন সারারাত নামায আদায় করল।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আদন বেহেশতের মধ্যে উত্তম প্রাসাদসমূহ"। আল্লাহতায়ালার এই আয়াতের অর্থে হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এসব প্রাসাদ ও অট্টালিকা বিভিন্ন রত্ন ও মণিমুক্তা দ্বারা নির্মিত। এর প্রত্যেকটি প্রাসাদে লোহিত বর্ণ বিশিষ্ট ইয়াকুতের সত্তরটি করে গৃহ থাকবে। প্রত্যেক গৃহে সবুজ বর্ণবিশিষ্ট জমররদের তৈরি সত্তরটি করে কক্ষ থাকবে। প্রত্যেক কক্ষে। একটি করে রাজ-সিংহাসন স্থাপিত থাকবে। প্রত্যেক সিংহাসনের উপর বিভিন্ন বর্ণের সত্তরটি করে সুকোমল শয্যা বিছানো থাকবে। প্রত্যেক শয্যার উপর কৃষ্ণনয়না অতীব রূপসী বিশিষ্টা এক রমণী সুসজ্জিতাবস্থায় উপবিষ্ট থাকবে। তাছাড়া প্রত্যেক কক্ষে সত্তরটি করে দস্তরখান থাকবে। প্রত্যেক দস্তরখানে সত্তর প্রকার করে অতি উপাদেয় ও সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত থাকবে। তাছাড়া প্রত্যেক কক্ষে উক্ত রমণী ব্যতীত আরও সত্তরটি করে রূপসী সুবেশা রমণী মোতায়েন থাকবে। যে ব্যক্তি এই কক্ষের অধিকারী হবে আল্লাহতায়ালা তাকে এত অধিক শক্তি ও স্বাস্থ্য দান করবেন যে, সে এই সমস্ত প্রত্যেক রমণীর সাথেই সহবাসে সক্ষম হবে।
0 Comments