হে বেচারা। সেই ভীষণ দিনের জন্য প্রস্তুত হও। যেদিনের ব্যাপারটি অতি ভয়াবহ, যার সময়দীর্ঘ, যার বিচারক কঠোর এবং যা' অতি নিকটবর্তী। সেই দিন তুমি আকাশকে খণ্ড-বিখণ্ড দেখবে, তারকারাজি আল্লাহর ভয়ে চারদিকে বিক্ষিপ্ত, উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো অন্ধকারপূর্ণ, সূর্য উল্টানো, পাহাড়-পৰ্ব্বত স্থানচ্যুত, উষ্ট্রগুলো বিচ্ছিন্ন, জীবজন্ত একত্রিত, সমুদ্র উথলিত, প্রাণ ওষ্ঠাগত, দোযখের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত, বেহেশত নিকটবর্তী, দুনিয়া প্রলম্বিত। সেদিন দেখতে পাবে, দুনিয়ায় প্রবল ভূমিকম্প। দুনিয়া তাব ভার-বোঝা বের করে দেবে। সে দিন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দলে আসতে দেখবে, যেন তাদের কার্যসমূহ তারা দেখতে পায়। সেদিন সারা জগত ও পাহাড়- পর্বতসমূহকে একটি মাত্র ধাক্কা দেয়া হবে। সেদিন আকাশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। সে দিনটি অতীব ভয়ঙ্কর দিন। ফিরেশতাগণ আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী অবস্থান করবে এবং তোমার প্রভুর আরশ বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। সেদিন কোন বিষয় গুপ্ত থাকবে না। সেদিন পাহাড়-পর্বত শূন্যে উড়তে থাকবে। যমিনকে বিস্তৃত ময়দানরূপে দেখতে পাবে, দুনিয়ায় প্রবল ভূমিকম্প হবে। পাহাড়-পর্বতগুলো ধুনিত তুলার ন্যায় বিক্ষিপ্ত হতে থাকবে। সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্ত মক্ষিকার ন্যায় হবে। সেদিন স্তন্য দানকারিণী স্ত্রীলোক তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে। প্রত্যেক গর্ভবর্তী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত হবে। লোকদেরকে উন্মত্ত ও মত্ত অবস্থায় দেখা যাবে। এসব ব্যাপার যা' হবে তাতো অতি সামান্য। আল্লাহর কঠোর শাস্তি হবে সর্বাপেক্ষা ভীষণ ও ভয়ঙ্কর।
সেদিন এই দুনিয়া অন্য দুনিয়ায় পরিবর্তিত হবে। আসমানগুলো পরাক্রমশালী আল্লাহর ভয়ে অন্য অবস্থা প্রাপ্ত হবে। সবকিছু একাকার হয়ে এক বিশাল প্রান্তরে পরিণত হবে। তাতে কোন বক্রতা বা অসমতা দেখতে পাবে না। পাহাড়-পর্বতগুলো স্থির মনে হবে কিন্তু তা' মেঘের চলাচলের ন্যায় দ্রুতবেগে উড়ে চলবে। সেই দিন এমনি অবস্থার মধ্যে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে এবং তা' লোহিতবর্ণের চর্মের ন্যায় হবে। সেদিন কোন মানুষ বা জিনকে কোন বিষয় জিজ্ঞেস করা হবে না। কোন পাপীকে কোন কথা বলতে দেয়া হবে না এবং তাকে তার ত্রুটি সম্বন্ধেও জিজ্ঞেস করা হবে না। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি যে সৎকার্য বা অসৎকার্য করেছিল তা' সসন্তই তাদের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি যা' উপস্থিত করা হবে তা' দেখতে পাবে এবং যা তারা অগ্রে পাঠিয়েছিল তা' তারা সাক্ষ্য দেবে। সেদিন মানুষের রসনা বন্ধ হয়ে যাবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কথা বলবে। সেই দিনটির কথা শুনেই মহানবী হুযুরে পাক (দঃ) পক্ককেশবিশিষ্ট হয়েছিলেন। একদা হযরত আবু বকর (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার মস্তকে পক্ক কেশ দেখেছি। তিনি বললেন, কুরআনে পাকের সূরা হৃদ এবং এজাতীয় অন্যান্য সূরা যেমনঃ সূরা ওয়াক্কিয়া, সূরা মুরসিলাত, সুরা আম্মা ইয়াতাসাযালুন, সূরা ইযাশ শামসু কুসয়্যিরাত ইত্যাদি আমাকে পক্ক কেশবিশিষ্ট করেছে।
হে ব্যর্থ পাঠক! তুমি কিরাত পড়তেছ, কুরআন শরীফ সুর করে তিলাওয়াত করতেছ, তোমার রসনাকে নাড়াচাড়া করছ, তবে যা' তুমি পড়ছ যদি তার বিষয়গুলো চিন্তা করতে, তাহলে নিশ্চয় তোমার কলিজা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। তোমার মস্তকের কেশরাশি দন্ডায়মান হয়ে যেত। তোমার সর্বশরীর শিউরে উঠত। কিন্তু তোমার কোন চিন্তা-ভাবনা নেই, তাই তুমি কুরআন পাঠের ফল থেকে বঞ্চিত। যা' তুমি পড়ছ তন্মধ্যে কিয়ামত একটি বিষয়। আল্লাহতায়ালা তন্মধ্যে কিয়ামতের ভয়াবহ ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং কিয়ামতের বহু গুণবাচক নাম দিয়েছেন। যাতে করে তুমি তার বহু নাম দ্বারা তার ভীষণ ও ভয়ঙ্কর অবস্থা সম্বন্ধে আন্দাজ করতে পার। এছাড়া বহু নাম ব্যবহার করার আল্লাহতায়ালা অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞানী লোকদের সজাগ ও সতর্ক করা। কিয়ামতের নামগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি নামেরই একটি গুপ্তত্ত্বো উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং প্রত্যেক নামেরই একটি ভিন্ন অর্থ আছে; সুতরাং সেই অর্থগুলোর পরিচয় জানার চেষ্টা কর।
এখন আমরা কিয়ামতের নামগুলো সংগ্রহ করে তা' উল্লেখ করব। কিয়ামতের উক্ত নামগুলো হল, উত্থানের দিন, অনুতাপের দিন, ক্ষোভের দিন, হিসাবের দিন, প্রশ্নের দিন, প্রতিযোগিতার দিন, কড়াকড়ি হিসাবের দিন, ঈর্ষার দিন, ভূমিকম্পের দিন, ধ্বংসের দিন, সংজ্ঞাহীনতার দিন, ভীষণ ঘটনার দিন, আঘাতকারীর দিন, বিপদের দিন, ভয়ঙ্কর বিপদের দিন, চীৎকারের দিন, প্রথম সিঙ্গার ফুঁকের দিন, ভয়াবহ দিন, হঠাৎ দুঃখ আগমনের দিন, সাক্ষাতের দিন, বিচ্ছেদের দিন, বিতাড়নের দিন, প্রত্যাবর্তনের দিন, শান্তির দিন, পলায়নের দিন, স্থায়ীদিন, চিরস্থায়ী দিন, ফলভোগের দিন, পুরস্কার লাভের দিন, ক্রন্দনের দিন, একত্র হবার দিন, প্রতিজ্ঞাকৃত দিন, উপস্থিতির দিন, ওজনের দিন, ন্যায় বিচারের দিন, বিচারের দিন, পৃথক হবার দিন, অপমানের দিন, কষ্টের দিন, নিশ্চিত বিশ্বাসের দিন, প্রত্যাগমনের দিন, ফুৎকারের দিন, হঠাৎ আঘাতের দিন, প্রকাশিত দিন, ধমকির দিন, উঞ্চতার দিন, ভয়ের দিন, অস্থিরতার দিন, শেষ সীমার দিন, আশ্রয়ের দিন, প্রতীজ্ঞার দিন, প্রতীক্ষার দিন, দুশ্চিন্তার দিন, ঘর্মের দিন, অভাবের দিন, অন্ধকারের দিন, আলোর দিন, ছিন্ন-বিচ্ছন্ন হবার দিন, অপেক্ষার দিন, বহির্গমনের দিন, চিরস্থায়ী বসবাসের দিন, প্রমাণের দিন, সন্দেহাতীত দিন, গুপ্তবিষয় প্রকাশ হবার দিন, সেদিন। যখন কোন লোক অন্য কোন লোকের কাজে আসবে না, সেদিন যখন দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে, সেদিন যখন কোন বন্ধু অন্য বন্ধুর কাজে আসবে না, সেদিন যখন কোন লোকের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না, সেদিন যখন দোযখের দিকে আহ্বান করা হবে, সেদিন যখন তারা মুখমন্ডলের উপর হেঁটে দোযখে আসবে, সেদিন যখন তাদের মুখমন্ডল দোযখের মধ্যে উল্টানো হবে, সেদিন যখন কোন সন্তান তার পিতার কোন কাজে আসবে না, সেদিন যখন লোকগণ তাদের মাতা-পিতা থেকে পলায়ন করবে, সেদিন যখন তারা কথা বলতে পারবে না, সেদিন যখন তাদেরকে ওজর-আপত্তি তুলতে অনুমতি দেয়া হবে না। সেদিন যখন আল্লাহর কথার অগ্রাহ্যকারী থাকবে না, সেদিন যখন তারা বের হয়ে যাবে, সেদিন যখন তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে, সেদিন যখন কোন ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না, সেদিন যখন অত্যাচারীদের কোন আপত্তি উপকার করবে না, সেদিন যখন আপত্তি অগ্রাহ্য করা হবে, গুপ্ত কথা প্রকাশ করা হবে, মনের কথা উদঘাটন করা হবে, পর্দা ছিন্ন করা হবে, সেদিন যখন সবকিছু স্মরণ হবে, দৃষ্টিশক্তি কম হবে, দোষত্রুটি প্রকাশ হয়ে পড়বে; সেদিন যখন বান্দাগণকে তাড়িয়ে দেয়া হবে এবং তাদের সাথে সাক্ষী থাকবে, বালকগণ বৃদ্ধ হয়ে যাবে এবং বৃদ্ধগণ তন্ময়তা প্রাপ্ত হবে, সেদিন যখন দাঁড়ি পাল্লা স্থাপন করা হবে, অদৃষ্টলিপি বিস্তার করা হবে, নরকাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হবে, উত্তপ্ত সলিল উথলে উঠবে; অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে, কাফিরগণ নিরাশ হবে; মানুষের বর্ণ পরিবর্তিত হবে; রসনা অবশ এবং বাকরুদ্ধ হবে,'অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জবান খুলে যাবে।
হে মানব! তোমাকে করুণাময় প্রভু থেকে কে প্রবঞ্চিত করেছে? তুমি যে দরজা বন্ধ করে দিয়েছ, পর্দা লটকিয়ে দিয়েছ এবং পাপকার্যে নিমগ্ন আছ। এ তুমি কি করছ? তোমার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, সুতরাং তোমার জন্য শত সহস্র দুঃখ। হে অমনোযোগীদের দল। আল্লাহ তোমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নবী প্রেরণ করছেন এবং প্রকাশ্য কিতাব পাঠিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের উল্লিখিত অবস্থাসমূহের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তারপর তিনি মানুষের অমনোযোগিতার বিষয়ও জানিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, মানুষের হিসাব নিকটবর্তী। কিন্তু তারা তারপরও অমনোযোগিতায় নিমগ্ন। এ কোন অবস্থা? তাদের প্রভুর নিকট থেকে কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা কি তার থেকে কোন কথা শুনে নিঃ নিশ্চয়ই শুনেছে অথচ তারা খেলা-ধূলায় লিপ্ত আছে। কিয়ামত নিকটবর্তী তাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেছেন, কিয়ামত নিকটবর্তী, হিসাব নিকটবর্তী, কিন্তু মানুষ তাকে দূরবর্তী মনে করছে। মানুষের অবস্থা এরূপ হওয়া উচিত ছিল যে, কুরআন পাঠ করে সাথে সাথে তদনুযায়ী কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু মানুষ যেন কুরআনের আয়াতের অর্থের দিকে লক্ষ্যই করে না, চিন্তাও করে না যে বিভিন্ন নামে কিয়ামতের দিনটির পরিচয় দেয়া হয়েছে সে দিকে লক্ষ্য করে তারা প্রস্তুত হয় না। আমরা আল্লাহর নিকট এই গাফলতী থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ তাঁর অসীম করুণায় যেন আমাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করেন।
0 Comments