পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, পরনিন্দা করা হারাম হলেও কয়েকটি বিশেষ স্থানে প্রায়োজনের তাকীদে তা' জায়েয হয়। অবশ্য গুরুতর কারণ উপস্থিত না হলে তা' জয়েয হয় না। সেই গুরুতর কারণই পরনিন্দার পাপ মোচন করে দেয়। নিম্নোল্লিখিত ছয়টি কারণে পরনিন্দা জায়েয হয়।
প্রথম কারণ-বিচারপ্রার্থী হয়ে অন্যের দোষ বর্ণনা করাঃ যে ব্যক্তি বিচারকের সামনে কারও বিরুদ্ধে অত্যাচার, বিশ্বাসভঙ্গ এবং ঘুষগ্রহণের অভিযোগ করে তখন তার অভিযোগ বিচারকের সামনে বর্ণনা করা জায়েয। তবে যদি সে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত না হয় তাহলে তজ্জন্য সে নিন্দুক ও গুনাহগার হবে। যদি বিচারকের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ থাকে তাহলে বাদশাহর নিকট তার বিরুদ্ধে নালিশ করা এবং তার অন্যায়ের ঘটনা বর্ণনা করা জায়েয হবে। কেননা এই পন্থা অবলম্বন করা ব্যতীত তার প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যার স্বত্ব আছে, তার কথা বলারও অধিকার আছে। তিনি আরও বলেছেন, হক আদায়ে ধনীর বিলম্ব করা অত্যাচার স্বরূপ। তিনি আরও বলেছেন, ঋণ আদায় না করলে ধনী লোককে শাস্তি না দেয়া ও তার সম্মান নষ্ট করা জায়েয হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কারণঃ মন্দ কার্য পরিবর্তনে সাহায্য করাঃ মন্দ এবং গর্হিত কার্য পরিবর্তনে ও গুনাহগারকে সৎ পথে আনার সাহায্যকল্পে তার কার্যাবলী বর্ণনা করা জায়েয। তবে এমন লোকের নিকট তা' প্রকাশ করা সঙ্গত, যে তা' দমন করতে এবং গর্হিত কার্য বারণ করতে সক্ষম। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত ওমর (রাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ) এর নিকট যাওয়ার কালে (কারও কারও মতে) হযরত তালহা (রাঃ) তাকে সালাম দিলেন। কিন্তু তিনি তার সালামের উত্তর দিলেন না। হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) এর নিকট গিয়ে এ ব্যাপারটি উল্লেখ করলে হযরত আবুবকর (রাঃ) তার নিকট এসে ব্যাপারটি মীমাংসা করে দিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারটি তাদের নিকট গীবত বলে গণ্য হয়নি।
একদা হযরত ওমর (রাঃ) এর নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, আবু জান্দাল শাম দেশে মদ পান শুরু করে দিয়েছে। তখন তিনি তার নিকট পত্র লিখলেন। পরম করুণাময় ও দয়ালু রাহমান ও রাহীমের নামে "হামীম তানযীলুল কিতাবি মিনাল্লাহিল আযীযিল আলীমি গাফিরিয যানমি ওয়া ক্বাবিলিত তাওবি শাদীদিল ইকাব" অর্থাৎ হা-মীম পরম পরাক্রমশালী ও সর্বজ্ঞানী থেকে এই কিতাব অবতীর্ণ। গুনাহ ক্ষমাকারী, তাওবাহ গ্রহণকারী, কঠিন শাস্তিদাতা। হযরত ওমর (রাঃ) এর প্রেরিত এই পত্র পেয়ে হযরত আবু জান্দাল (রাঃ) তাওবাহ করলেন। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) এর নিকট যে এই সংবাদ দিয়েছিল তাকে তিনি গীবতের দোষে দোষী করেননি। কেননা তাকে ঐ কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনা এবং এমন লোকের উপদেশ প্রদানপূর্বক তার উপকার করার উদ্দেশ্য ছিল যার উপদেশ সে অবহেলা করতে পারত না। এই বিশুদ্ধ নিয়তের জন্যই এই মন্দ কাজ হযরত ওমর (রাঃ) এর কর্ণগোচর করা জায়েয হয়েছিল। যদি এরূপ উদ্দেশ্য না থাকে তবে পরনিন্দা হারাম।
তৃতীয় কারণঃ ফতোয়া প্রার্থী হওয়াঃ ফতোয়া বা বিধি-বিধ বিধান জানবার জন্য কারও গর্হিত কার্য উল্লেখ করা সঙ্গত বা জায়েয। যেমন আমার পিতা, আম আমার স্ত্রী বা আমার ভ্রাতা আমার প্রতি এরূপ অন্যায় ব্যবহার করে। তা' থেকে মুক্তি পাওয়া ওয়ার উপায় কি? তবে এসব ক্ষেত্রে কৌশল বাক্য ব্যবহার করা নিরাপদ। যেমন ঐ ব্যক্তির সম্বন্ধে আপনার কি মত যার সাথে তার পিতা, ভ্রাতা বা স্ত্রী অন্যায় ব্যবহার করেছে? ওৎবার কন্যা হেন্দা হে হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করল, আবু সুফিয়ান বড় কূপণ লোক। সে আমার ও আমার আমার সন্তানগণের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করে না। আমি কি তার অজ্ঞাতে কোন জিনিস ব্যয় করতে পারি? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, যে পরিমাণ দ্রব্য তোমার এবং তোমার। সন্তান তিদের জন্য আবশ্যক তা' তুমি গ্রহণ করতে পার। হেন্দা এভাবে তার স্বামীর কৃপণতা ও অত্যাচারের বিষয় জানিয়ে দিল। কিন্তু হুযুরে পাক (দঃ) তাকে পরনিন্দার দোষে দোষী করলেন না। কেননা হেন্দার ফতোয়া লওয়ার উদ্দেশ্য ছিল।
চতুর্থ কারণঃ মুসলমানকে ক্ষতিকর কার্যে সতর্ক করাঃ কোন মুসলমানকে ক্ষতিকর বা অনিষ্টকর কার্য থেকে রক্ষা করবার জন্য অন্যের দোষ বর্ণনা করা জায়েয। যখন কোন আলিমকে বেদআতপন্থী লোকের নিকট যাতায়াত করতে দেখে এবং বেদআত ও গুনাহ তার উপর প্রভাব বিস্তার করবে বলে ভয় করে তখন তার বেদআত ও পাপ প্রকাশ করা ন্যায়সঙ্গত অন্য কোন কারণে নয়। এখানেই প্রবঞ্চনার স্থান। কেননা অনেক সময় হিংসাবশতঃ তা' বলা হতে পারে। শয়তান লোকের উপর দিয়ে প্রকাশ করিয়ে তাকে এই ধোকা দিতে পারে। তদ্রুপ যে ব্যক্তি কোন দাসকে খরিদ করে এবং তুমি যদি জান যে, সে দাস চুরি করে বা বড় গুনাহর কাজ করে, তখন তা' প্রকাশ করে দেয়া তোমার জন্য উচিত হবে। কেননা এক্ষেত্রে তুমি নীরব থাকলে ক্রেতার তাতে ক্ষতি হবে এবং তুমি তা' উল্লেখ করলে দাসের অবশ্য ক্ষতি হবে কিন্তু এক্ষেত্রে ক্রেতার ক্ষতি না হওয়াই দেখতে হবে। তদ্রূপ যদি কোন নিরীহ ব্যক্তি কাউকে সাক্ষী মানে তখন তার সাক্ষ্য দেয়া উচিত। যদিও তার সাক্ষ্যদান অপর লোকের ক্ষতি বা মানহানি হয়। তদ্রূপ যদি কেউ বিবাহের পাত্র-পাত্রী সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে যায় কোন ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নয়; বরং মঙ্গল করার উদ্দেশ্যে। যদি জানে যে, তার পরমর্শের ফলে সে এ বিবাহ ত্যাগ করবে তবে তার একথা বলা আমার মনে হয় সঙ্গত হবে না, আর যদি সে জানে তার দোষ অনুসন্ধান ব্যতীত সে ক্ষান্ত হবে না তাহলে তাকে সে তা' পরিষ্কার ভাবে বলে দেবে। হুযুরে পাক (দঃ) একবার বলেছিলেন, এ কি। তুমি কি কুকর্মী লোকের দোষ প্রকাশ করতে মন্দ জ্ঞান করছ? তার দোষ প্রকাশ করে দাও যেন লোকগণ তা' জানতে পারে। তার মধ্যে যে দোষ আছে তা-ই বলে দাও। যেন লোক সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। পূর্বযুগের বুযর্গগণ বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোষের কথা উল্লেখ করলে কোন পাপ হয় না। যথাঃ (১) অত্যাচারী শাসনকর্তা (২) বেদআতপন্থী আলিম এবং (৩) লজ্জাহীন কুকর্মী।
পঞ্চম কারণঃ বিখ্যাত উপনাম দ্বারা ডাকাঃ যে ব্যক্তির লকব বা উপনাম সর্ববিদিত, তাকে সেই নাম দ্বারা ডাকলে পরনিন্দা হয় না। যেমন খোঁড়া, রাতকানা ইত্যাদি। এরূপ নামে ডাকলেও তাতে কোন পাপ হবে না। আলিমগণ মানুষের পরিচয়ের প্রয়োজনের জন্য জায়েয বলেছেন। এরূপ উপনাম ধরে ডাকলে যাদেরকে ডাকা হত তাদের কোনরূপ মনোঃকষ্ট হত না। অবশ্য যদি তাদেরকে এ নামে না ডেকে অন্য নামে ডাকা হয় এবং লোকগণ কারে ডাকা হচ্ছে তা' বুঝতে পারে তবে অন্য নামে ডাকাই উত্তম।
ষষ্ঠ কারণঃ কুকর্মীর কুকর্ম প্রকাশ করাঃ যারা প্রকাশ্য ভাবে কুকর্ম করে বেড়ায় তাদের কার্যকলাপ প্রকাশ করায় কোন দোষ নেই। যেমন স্ত্রীবেশধারী পুরষ, মদখোর, সুরাপারী মাতাল, ব্যভিচারী নপুংসক যারা প্রকাশ্যভাবে এসব কুকর্ম করে বেড়ায়। যদি কেউ তাদের সামনে এই কুকর্মের উল্লেখ করে তারা তা' মানে না। এরূপ লোকের কুকর্ম প্রকাশ করে দেয়া জায়েয। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার মুখমন্ডল থেকে লজ্জার পর্দা হটিয়ে দেয় তাকে নিন্দা করায় কোন দোষ নেই। এর দ্বারা প্রকাশ্য বড় পাপীর কথা বলেছেন। কেননা সে তার গুনাহ গোপন না করে প্রকাশ্যভাবে করে বেড়ায়। যে ব্যক্তি গোপনে পাপ করে তার সম্মান রক্ষা করা আবশ্যক। হযরত ইবনে তারিফ (রহঃ) বলেছেন, আমি হযরত হাসান বছরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি যদি সর্ববিদিত মহাপাপীর কুকর্ম প্রকাশ করে দেই তা' কি পরনিন্দা হবে? তিনি বললেন, তা' পরনিন্দা হবে না। তাকে সম্মান দেখানো যাবে না। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) আরও বলেছেন, তিনটি লোকের নিন্দা করায় দোষ নেই। যথাঃ (১) প্রবৃত্তির দাস (২) প্রকাশ্য কুখ্যাত মহাপাপী এবং (৩) অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ। তিনি এই তিন জনের কথাই একত্র করে বলেছেন। কেননা তারা তাদের গর্হিত কার্য প্রকাশ্যেই করতে থাকে এবং তাতে তারা গৌরব বোধ করে। তারা যখন প্রকাশ্যেই একাজ করতে পারে তখন তা' অন্য কেউ প্রকাশ করায় তা' গর্হিত হবে কেন? হাঁ, তবে যদি তারা এরূপ ইচ্ছে করে যে, তাদের কাজগুলো অধিক প্রকাশ না পাক তাহলে তা' অন্যের জন্য প্রকাশ করা গুনাহর কারণ হবে। হযরত আওফ (রহঃ) বলেছেন, একদা আমি হযরত ইবনে সীরীনের সম্মুখে শাসনকর্তা হাজ্জাজের অত্যাচারের কাহিনী বলতেছিলাম। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারক। তিনি হাজ্জাজের অত্যাচারের জন্য যে রূপ প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন তদ্রূপ হাজ্জাজের নিন্দাকারীর প্রতিশোধও করবেন। কল্য যখন তুমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে তখন হাজ্জাজের সর্বাপেক্ষা বড় পাপ অপেক্ষা তোমার পাপও কোন অংশে ক্ষুদ্র হবে না।
0 Comments