হযরত আমেনার পরিচয়

        মা আমেনার পিতা ওয়াহাব বিন আবদে মান্নাফ অতিশয় শান্ত-শিষ্ট এবং বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। দাদা যুহরার নামের সাথে মিলিয়ে তাঁকে তখন ওয়াহাব যুহরী নামে ডাকা হত। তদ্বধি তিনি এ নামেই সমধিক পরিচিত হয়ে রয়েছেন। ওয়াহাব যুহরী তখন মদিনায় বাস করতেন। গণিলা তখন ইযাসরের নামে পরিচিত ছিল। ওয়াহাব যুহরীর পূর্ব-পুরুষ মক্কায় বাস করত এবং এরা মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশোদ্ভূত ছিল। এদের মধ্যে কে কখন কিভাবে মক্কা ছেড়ে মদিনায় বসবাস শরু করে, তার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যতদূর সম্ভব মক্কার দখল নিয়ে খোযাজা গোত্রে যখন কুরাইশদের উপরে হামলা চালায় এবং তাদেরকে পরাস্ত করে মক্কা হতে তাড়িয়ে দেয়, সেই সময় হয় তাদের কোন পূর্ব পুরুষ মদিনায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল এবং সে হতেই তাদের বংশধরগণ এখানে বসবাস করে আসছে। মদিনা বা ইয়াসরিবের আবহাওয়া মক্কার আবহাওয়ার তুলনায় অনেকটা স্নিগ্ধ ও মোলায়েম ছিল। তাই এখানকার মানুষের মন ও মেজাজ মক্কার লোকদের তুলনায় অনেকটা শান্ত-শিষ্ট ছিল।

        মক্কার অধিবাসীদের মত তারা তেমন উগ্র ও রুক্ষ্ম প্রকৃতির ছিল না। এদের আচার ব্যবহার ও স্বভাব-চরিত্রও তুলনামূলকভাবে ভদ্রতাসুলভ ছিল। অবশ্য জাহেলিয়াত বা মূর্খতার দিক দিয়ে মদিনার অধিবাসীগণও কোন অংশে কম ছিল না। এরা একদিকে আল্লাহকে বিশ্বাস করত, অন্যদিকে নানা দেব দেবী প্রতিমাকে পূজা করত। এ শ্রেণীর লোকগণ ব্যতীত মদিনায় আর এক শ্রেণীর লোক ছিল তারা উপজাতি হলেও পুরুষানুক্রমিক-ভাবে যুগ যুগ ধরে মদিনায় বসবাস করে আসছিল। এরা ছিল ইয়াহুদী সম্প্রদায়। এরা যদিও নিজদিগকে হযরত মূসা (আ)-এর উম্মত এবং তাওরাত গ্রন্থের অনুসারী বলে দাবি করত, কিন্তু আসলে তারা হযরত মুগা (আ) বা তাওরাত গ্রন্থের কোন একটি নির্দেশও পালন করত না। এরা মনগড়া ধর্ম সৃষ্টি করে তদনুযায়ীই নিজেরা পরিচালিত হত। হযরত মুসা (আ)-এর প্রতি অবতীর্ণ মূল তাওরাতের বিভিন্ন স্থানে এরা পরিবর্ধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে তাওরাতকে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আসলে তাওরাতের সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই। ইয়াহুদী জাতীটি বড়ই সুচতুর জাতী। এরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশেষত সুদের কারবার দিয়ে অর্থোপার্জন করত। পৌত্তলিকদের অপেক্ষা এরা ধনী ও স্বচ্ছল ছিল। এরা স্থানীয় অজ্ঞ ও মূর্খ অধিবাসীদের মধ্যে কৌশলে বিবাদ সৃষ্টি করে তাদের ওপর নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এরা গরিব কৃষক সমাজের মধ্যে সুদের বিনিময়ে ঋণ প্রদান করত এবং সুদসহ মূলঋণের মোট চার-পাঁচ গুণ টাকা আদায় করে নিয়ে নিজেরা ধনবান হত এবং গরিব কৃষককুলকে আরও বেশি গরিব বানিয়ে ফেলত। এরা মদিনার একেবারে আদিম অধিবাসী না হলেও বহিরাগত হিসেবে ছিল অতিশয় প্রাচীন। বহুকাল যাবত বাস করার ফলে এরাও মদিনার স্থায়ী অধিবাসীরূপে পরিণত হয়েছিল। স্থানীয় বর্বর অধিবাসীদেরকে নানা বিপর্যয়ের মধ্যে ফাঁসিয়ে দিয়ে পরে এরাই আবার তাদের ওপর মাতব্বরী করত। ইয়াহুদীরা ব্যতীত মদিনায় আরও একটি বহিরাগত দল বাস করত। এরা ছিল খ্রিস্টান। খ্রিস্টানদের রীতি-নীতি ও আচার-ব্যবহার ইয়াহুদীদের অপেক্ষা অনেক সদয়, ভদ্র ও নম্র ছিল। কিন্তু ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের মতামত ও মতবাদ অত্যন্ত অযৌক্তিক ও অবাস্তব ছিল। তাদের কেউ কেউ হযরত ঈসা (আ)-কে স্রষ্টার পুত্র ও কেউ কেউবা হযরত ঈসা (আ) ও বিবি মারিয়ামকে বিভিন্ন ক্ষমতায় স্রষ্টার অংশীদার মনে করত।

        মদিনার ওয়াহাব যুহরীর আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। সাধারণ ধনী বলতে যে পরিমাণ অর্থ থাকার প্রয়োজন, ওয়াহাব যুহরীর সে পরিমাণ ধন-সম্পদই ছিল। তাঁর সংসারে কোন প্রকার অনটন ছিল না। সংসারে একমাত্র স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বেশ সুখেই কাল কাটিয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতার সুখ যথেষ্ট থাকলেও একটি দিক দিয়ে তারা মোটেই তৃপ্ত ছিলেন না। বিবাহের পরে দীর্ঘদিন ধরেও তাদের কোন সন্তান-সন্ততি না হওয়াই এ অতৃপ্তির মূল কারণ। এরূপ সন্তানহীন দম্পতির মনে যে অশান্তি ও অতৃপ্তির জ্বালা পুঞ্জিভূত থাকে তা শুধু ভুক্তভোগিরাই বুঝতে পারে। একটি সন্তানের অভাবে সত্যিই ওয়াহাব দম্পতির যাবতীয় সুখ ও শান্তি এবং ধন-দৌলত ব্যর্থ হয়ে উঠেছিল। সুন্দর বাড়িঘর ও আরামের উপকরণাদি ক্রমেই তাদের কাছে বিরক্তিকর ও মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছিল।

        অবশেষে তারা মানত করলেন, আল্লাহ্ যদি তাদেরকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন তবে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই মক্কায় গিয়ে পবিত্র গৃহ খানায়ে কা'বায় হজ্জ করে আসবেন। উল্লেখ থাকে যে, তখনকার দিনে হজ্জ করার অর্থ ছিল পবিত্র কা'বা গৃহ যিয়ারত ও তাওয়াফ করা এবং কা'বা গৃহে রক্ষিত দেব-দেবী ও প্রতিমাদের সম্মুখে ভোগ্য-দ্রব্যসমূহ স্থাপন করে সাষ্টাংগে প্রণাম করা। আর জগতের অসংখ্য লোকই তখন এভাবে বিভিন্ন পার্থিব উদ্দেশ্য সফল করতে হজ্জ আদায় করত। পূর্ব পুরুষদের প্রথা এবং প্রচলিত নিয়মানুযায়ী ওয়াহাব দম্পতিও দেবদেবীদের পূজা করতেন। তথাপি প্রকৃত স্রষ্টা সর্বশক্তিমান নিরাকার প্রভুর প্রতি তাদের আন্তরিক বিশ্বাস ছিল। বস্তুত আরবের সে অন্ধকার যুগেও সেখানে দু-চারজন এমন ছিলেন যাদের স্বভাব-চরিত্র ছিল উন্নত, আচার-ব্যবহার ছিল নম্র, ভদ্র এবং পরিমার্জিত। তাদের হৃদয় মধ্যে আল্লাহ্ তা'য়ালার প্রতি ছিল অসীম ভক্তি ও বিশ্বাস। যদিও তারা বিশ্বাসী ছিলেন। ওয়াহাব দম্পতি ছিলেন আরবের এ শ্রেণীর পৌত্তলিক। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা ওয়াহাব দম্পতির প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। ওয়াহাবের স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই গর্ভবতী হলেন। স্বামী-স্ত্রীর মন আশায় আনন্দে ভরে উঠল। তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে অশেষ শোকর জ্ঞাপন করলেন। যথাসময়ে তাদের গৃহ আলো করে ফুটফুটে চন্দ্রের মত একটি কন্যা সন্তান আগমন করল। কন্যা সন্তানের প্রতি বিরাণ এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা মদিনার পৌত্তলিকনের মধোও প্রচলিত ছিল। কন্যা তারাণ্য ভূমিতি শিশু কন্যাকে জীবন্ত করতে প্রোথিত করত কিন্তু মনিলার ওয়াহাব দম্পতি দীর্ঘ দিন ধরে সন্তান লাভে বঞ্চিত ছিল। একটি সন্তান লাভের জন্য তারা ব্যাকুলভাবে জ দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন। তাই কিনা ভূমিষ্ঠ হবার পরে তাকে গোসল করিয়ে বস্ত্রাবৃত করার যখন এবে ওয়াহাবের কোলে দিল, ওয়াহাব চক্ষু উঠিয়ে একবার শিশু কন্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। আনন্দে তাঁর বক্ষ ভরে গেল। সন্তানহীনতার দপ্ত হৃদয়ের ক্ষত তাঁর মুহূর্তে। যেন শুকিয়ে গেল। আনন্দের আতিশয্যে তিনি বার বার সন্তানটির সোনালি গণ্ডে স্বরন করতে লাগলেন। ওয়াহাব তুলে গেলেন দেশের প্রচলিত প্রথা। ভুলে গেলেন তিনি কন্যা সন্তান জন্যজনিত অপমানের কথা। মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে হল না নবজাত কন্যাকে গলা টিপে হত্যা করা বা জীবন্ত কবর দেয়ার কথা। কন্যার জন্য ওয়াহাবের হৃদয় মধ্যে মমতার বান ডাকল। কন্যা সন্তান লাভ করার পর ওয়াহাবের সংসারে যে পরিপূর্ণ শাস্তি ও সুখের জোয়ার প্রবাহিত হল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নহে। জনশ্রুতি আছে, ওয়াহাবের পত্নী যখন গর্ভবর্তী তখন একদা স্বপ্নে দেখছিলেন, এক শুভ্রবেশ পরিহিত সরবেশ এসে তাঁকে এক অপূর্ব সংবাদ শুনিয়ে গেলেন।

Post a Comment

0 Comments