সদয় ব্যবহারের কল্যাণ

        পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ, সদয় ব্যবহার অত্যুত্তম আচরণ। এর বিপরীত দোষ কর্কশ এবং নিষ্ঠুর ব্যবহার। ক্রোধ ও বিরক্তির ফল কর্কশ ব্যবহার এবং সৎস্বভাব ও নিরাপত্তার ফল বিনম্র ব্যবহার। নিষ্ঠুর ব্যবহারের কারণ ক্রোধ এবং অতিরিক্ত লোভ ও প্রভুত্ব। কেননা তা' মানুষকে চিন্তা থেকে মুক্তি দেয় না এবং তাতে স্থিরতা থাকে না। পক্ষান্তরে সদয় ব্যবহার ও সৎকর্মের ফলাফল সৎস্বভাব ব্যতীত অন্য কোন ফল উদগত করে না। ক্রোধের এবং লোভের শক্তি দমন না করলে এবং এদেরকে মধ্যম অবস্থার মধ্যে না রাখলে স্বভাব সুন্দর হয় না। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) সদয় ব্যবহারকে অতিরিক্ত প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে আয়েশা। যাকে সদয় ব্যবহাররূপ সম্পদ দেয়া হয়েছে তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের প্রভূত অংশ দান করা হয়েছে। আর যাকে সদয় ব্যবহারের অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যখন আল্লাহতায়ালা কোন পরিবার-পরিজনের লোককে ভালবাসেন তিনি তাদের মধ্যে সদয় ব্যবহারের গুণ প্রদান করেন। তিনি আরও বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সদয় ব্যবহারের জন্য যা' দান করেন তা' তার বদান্যতার জন্য দান করেন না। যখন আল্লাহতায়ালা কোন বান্দাকে ভালবাসেন তাকে সদয় ব্যবহারের গুণ প্রদান করেন। যে পরিবারের লোক সদয় ব্যবহার থেকে বঞ্চিত তারা আল্লাহর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ স্বয়ং সদয়, তিনি সদয় ব্যবহারকে ভালবাসেন। কর্কশ ব্যবহারে তিনি যা' দেন না সদয় ব্যবহারে তিনি তা' দিয়ে থাকেন।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, হে আয়েশা। সদয় ব্যবহার কর। কেননা আল্লাহতায়ালা আহলে বায়তদেরকে সম্মান দিতে ইচ্ছে করছেন সুতরাং সদয় ব্যবহারের দরজার দিকে তিনি পথ দেখিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, যাকে সদয় ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে সমস্ত মঙ্গল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, রোজ কিয়ামতে দোযখের আগুন কার জন্য হারাম হবে তা' তোমরা জান কি? প্রত্যেক বিনম্র মিষ্টভাষী ও সহজ সরল ব্যক্তির। তিনি আরও বলেছেন, যে শাসনকর্তা তার কর্তৃত্ব কালে সদয় ব্যবহার করে এবং বিনম্র হয় আল্লাহতায়ালা রোজ কিয়ামতে তার সাথে সদয় ব্যবহার করবেন। তিনি আরও বলেছেন যে, সদয় ব্যবহার সৌভাগ্যের চিহ্ন এবং নির্বুদ্ধিতা দুর্ভাগ্যের চিহ্ন। তিনি আরও বলেছেন, ধীর- স্থিরতা আল্লাহর তরফ থেকে এবং সত্বরতা শয়তানের তরফ থেকে আসে। বর্ণিত আছে যে. হযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা সব মুসলমানকে আশীর্বাদ করেছেন; সুতরাং আমাকে কোন কল্যাণবাক্য বিশেষভাবে শিক্ষা দান করুন। তিনি দু'বার কি তিনবার আলহামদুল্লাহ্ বলে তার নিকটবর্তী হয়ে বললেন, তুমি কি দু'বার কি তিনবার আমার নিকট থেকে উপদেশ চেয়েছ? তুমি যখন কোন কার্য করতে ইচ্ছে কর তার ফলাফলের বিষয় চিন্তা করে নিও। যদি তা' সহজ হয় তবে তা' করবে আর যদি কঠিন হয় তবে তা' থেকে বিরত থাকবে।

        হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, একদা তিনি হুযুরে পাক (দঃ) এর সাথে একটি উষ্ট্রের উপর সওয়ার ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) উটটিকে বার বার দক্ষিণে ও বামে ঘুরাতে থাকলে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হে আয়েশা। সদয় ব্যবহার অবলম্বন কর। কেননা এ জিনিসটি যার সাথেই থাকে তাকে সুশোভিত করে। আর এটি যার নিকট থেকে কেড়ে নেয়া হয় তাকে অপদস্থ করে।

        বুযর্গদের বাণীঃ একদা হযরত ওমর (রাঃ) শুনতে পেলেন যে, একদল লোক তাঁর কোন এক শাসনকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তিনি একথা শুনে লোকদেরকে তাঁর দরবারে ডাকালেন। তারা খলীফার নিকট সমবেত হলে, তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনের পর বললেন, হে লোকগণ! তোমাদের উপর আমার এ হক আছে যে, আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা উপদেশ দান করবে এবং মঙ্গল কার্যে আমার সহায়তা করবে। যে ব্যক্তিই হোক না কেন তোমাদের উপর আমার হক আছে। জেনে রাখ যে, শাসনকর্তার ধৈর্য ও সদয় ব্যবহারের তুলনায় আর কোন প্রিয় সম্মানজনক বস্তু আল্লাহর নিকট নেই এবং শাসনকর্তার অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার তুল্য আল্লাহর নিকট আর কোন অপ্রিয় জিনিস নেই। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ লোকদেরকে শান্তির মধ্যে রাখে সে অদৃশ্য থেকে শান্তি পাবে। আর যে তাদেরকে শাস্তির মধ্যে রাখে সে অদৃশ্য থেকে শাস্তি প্রাপ্ত হবে। হযরত ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রহঃ) বলেছেন, সদয় ব্যবহার ধৈর্যের সারথী। হাদীস শরীফে আছে, বিদ্যা মু'মিনের বন্ধু, ধৈর্য তার মন্ত্রী, বুদ্ধি তার প্রমাণ, ইবাদাত তার রক্ষাকারী, সদয় ব্যবহার তার জনক, বিনয়ব্যবহার তার ভ্রাতা এবং সহিষ্ণুতা তার সৈন্যদলের অধিনায়ক।

        কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, ঈমান কত সুন্দর। বিদ্যা বা জ্ঞান তাকে সুন্দর করে। বিদ্যা বা জ্ঞান কত সুন্দর। আমল তাকে সুন্দর করে। আমল কত সুন্দর! সদয় ব্যবহার তাকে সুন্দর করে। আমর ইবনুল আস তার পুত্র আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সদয় ব্যবহার কি? তিনি বললেন, অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে শাসনকর্তার নম্র ব্যবহার। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, নির্বুদ্ধিতা কাকে বলে? তিনি বললেন, ইমামের বিরোধীতা করা। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) তার শিষ্যদেরকে বলেছিলেন, সদয় ব্যবহার কাকে বলে তা' তোমরা জান কি? তারা বলল, আপনি বলে দিন। তিনি বললেন, প্রত্যেক বস্তু এবং বিষয়কে যথাযোগ্য স্থানে রাখা। বিনম্র ব্যবহারকে যথাযোগ্য স্থানে প্রয়োগ করা। অসিকে যথাযোগ্য স্থানে ব্যবহার করা, বেত্রাঘাত যথাযোগ্য স্থানে ব্যবহার করা। এ কথার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, বিনম্ন ব্যবহারের সাথে কর্কশ ব্যবহার এবং কঠিন ব্যবহারের সাথে সদয় ব্যবহার মিশ্রিত হওয়া আবশ্যক। জনৈক কবি বলেছেন 

যেখানে কঠোর ব্যবহার চাই

 নম্রতা সেথা ঠিক নয়

 নম্রতার স্থানে রুঢ় ব্যবহারও

 তেমনি দোষের কাজ হয়।

        সমগ্র স্বভাবের ন্যায় নম্রতা ও কর্কশতার মধ্যবর্তী স্থান অবলম্বন করাই উত্তম। তবে যেহেতু স্বভাব কর্কশ ও কঠিন ব্যবহারের দিকে অধিক অনুরক্ত, তজ্জন্য সদয় ব্যবহারের প্রয়োজন বৃদ্ধি করা উচিত। এজন্যই শরীয়ত কর্কশ ব্যবহারের পরিবর্তে সদয় ব্যবহারকে প্রশংসা করেছে। যদিও কর্কশ ব্যবহার যথাস্থানে উত্তম। যখন কর্কশ ব্যবহার ওয়াজিব হয়ে যায় তখন তা' সত্য খাহেশের সাথে ঐকমত্য হয়ে যায়, তখন তা' চিনি মিশ্রিত ঘৃত থেকেও অধিক স্বাদ হয়। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযও তদ্রূপ বলেছেন। বর্ণিত আছে যে, আমর ইবনুল আস হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর নিকট তার দীর্ঘসূত্রিতা সম্বন্ধে তিরস্কার করে তাকে একখানা পত্র লিখেছিলেন। হযরত মুআবিয়া তার উত্তর লিখলেন, উত্তম কার্যের চিন্তা করাও অধিক উত্তম। এবং তাতে হেদায়েত পাওয়া যায়। সুপথ প্রাপ্ত ঐ ব্যক্তি যে তাড়াহুড়া ত্যাগ করে সোজা পথে চলে আসে। বঞ্চিত ঐ ব্যক্তি, যে ধীর-স্থিরতা ত্যাগ করে বঞ্চিত হয়। স্বাধীন ব্যক্তি অনবরতঃ পুণ্য পেতে থাকে বা পুণ্য পাবার নিকটবর্তী হয়। সত্বরতায় বা দ্রুততায় ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে অথবা ভুল-ভ্রান্তির পথে যেতে হয়। যে ব্যক্তি সদয় ব্যবহার দ্বারা উপকার পায় না তাকে তার নির্বুদ্ধিতাই অনিষ্ট করে। আর যে ব্যক্তি অভিজ্ঞতার দ্বারা উপকার পায় না সে উচ্চ সম্মানের পর্যায়ে পৌছতে পারে না।

        হযরত আবি আওনিল আনছারী (রহঃ) বলেছেন, কেউ কর্কশ বাক্য ব্যবহার করলে তার পরপরই অধিক বিনম্র বাক্য ব্যবহার করা উচিত। হযরত আবু হামযাহ কুফী (রহঃ) বলেছেন, অত্যন্ত আবশ্যকতা দেখা না দিলে কারও নিকট থেকে কোনরূপ খেদমত গ্রহণ করবে না। কেননা প্রত্যেক লোকের সাথে শয়তান থাকে। জেনে রাখবে, লোকগণ যা' তোমাকে বিনম্র ব্যবহারের জন্য প্রদান করবে কর্কশ ব্যবহারের জন্য তা' প্রদান করবে না। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, মু'মিন ব্যক্তি গম্ভীর প্রকৃতিবিশিষ্ট হয়। সে ধীর-স্থিরতার সাথে কাজ করে। সে রাত্রে কাষ্ঠ সংগ্রহকারীর ন্যায় নয়। এটা অধিকাংশ অবস্থায়ই উপকারী এবং উত্তম। কামিল ব্যক্তি সদয় ব্যবহারের উপযুক্ত স্থান এবং কর্কশ ব্যবহারের উপযুক্ত স্থানের বিষয় পার্থক্য করে নিয়ে প্রত্যেক ব্যাপারকে তার ন্যায্য স্থানে প্রয়োগ করে। যদি তার অন্তর্দৃষ্টি লঘু হয় বা কোন বিধান তার নিকট বোধগম্য হতে কষ্টকর হয় তখনও তার সদয় ব্যবহারের দিকে মনের আকর্ষণ থাকে। কেননা অধিকাংশ কৃতকার্যতাই সদয় ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত।

Post a Comment

0 Comments