"তারিখে হাবীবে ইলাহা' এবং অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত আছে, খ্রিস্টান বাদশাহ আবরাহা (যার ঘটনা পরে উল্লেখ করব) যখন মক্কার কা'বা গৃহ ধ্বংস করার জন্য আসে, তখন হযরত (সাঃ)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিব মক্কার শাসনকর্তা ছিলেন। আবরাহার সৈন্য, বাহিনী আবদুল মুত্তালিবের কিছু সংখ্যক উট জবরদস্তিমূলকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল। আবদুল মুত্তালিব সেই উটগুলোকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বয়ং আবরাহার শিবিরে গমন করেন। আবরাহা ইচ্ছা করলে তখন ডাকে হত্যা, বন্দী কিংবা অপমানিত করতে পারত। কিন্তু সে তা কিছুই করতে পারে নিঃ বরং সে তাঁকে দেখামাত্র তাঁর প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়ল যে, তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তৎপ্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে নিজের পার্শ্বের আসনে উপবেশন করাল। আবদুল মুত্তালিবের ললাট হতে দূরে মুহাম্মদী (সাঃ) তখনও পুত্র আবদুল্লাহর ললাটে স্থানান্তরিত হয় নি। সুতরাং সে উজ্জ্বল আলোকরাশিই তাঁর ললাটদেশে চমকাচ্ছিল। আর শুধু তন্নিমিত্তই আবরাহার মত বিরাট শক্তিমান সম্রাট তাঁর প্রতি এত আকৃষ্ট হয়েছিল, তাঁকে ঐরূপ সম্মান প্রদর্শনে বাধ্য হয়েছিল।
নূরে মোহাম্মদী (সাঃ) এর অদ্ভুত আকর্ষণের আর একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। নূরে মোহাম্মদী (সাঃ) তখন আবদুল মুত্তালিবের ললাট হতে আবদুল্লাহর ললাটে স্থান্যন্তরিত হয়েছে। তিনি তখন পূর্ণ বয়স্ক যুবক। এমনি সময় একদিন তিনি স্বীয় গৃহ হতে কা'বা গৃহাভিমুখে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বনু খাসআম গোত্রের ফাতেমা বিনতে মোররাহ নাম্নী জনৈকা বুদ্ধিমতী যুবতীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হল। ফাতেমা এর পূর্বে আবদুল্লাহকে আরও বহুবার দেখেছেন ও তাঁর কথাবার্তা শুনেছেন। কিন্তু আজ তিনি আবদুল্লাহকে যে দৃশ্যে দেখলেন, কেমন এক অত্যুজ্জ্বল আলোক শিখা তাঁর ললাট হতে ফুটে বের হচ্ছে। তার ঔজ্জ্বল্যে তাঁর সারা দেহ মোহনীয় হয়ে উঠেছে। ফাতেমার মনে হল, তা আবদুল্লাহর স্বাভাবিক সৌন্দর্য নয়। নিশ্চয়ই কোন অলৌকিক জ্যোতি যেন তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁর ওপর তা কোন অশুভ এর প্রভাবও নয়। কারণ অশুভ শক্তির প্রভাব মানব দেহের ক্ষতি সাধন করে। তাছাড়া তা এভাবে উজ্জ্বল জ্যোতির আকারে প্রকাশ পেতে পারে না। ফাতেমা আবদুল্লাহকে বললেন, আবদুল্লাহ! একটু সময় তুমি বসবে কি? তোমার সাথে দুটি কথা বলার আছে। আবদুল্লাহ্ উপবেশন করলেন। ফাতেমা তাঁকে যথেষ্ট আদর-যত্ন করে অবশেষে বললেন, তুমি ভাই আমাকে পরিণয়ে আবদ্ধ কর। আমি তোমাকে আমার স্বামীরূপে পেতে চাই।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আরবে সে যুগে সাধারণ অবস্থায় যাই থাকুক না কেন, ভদ্র সমাজে বিবাহের ব্যাপারে পাত্রীর অভিভাবকের মতামতের উপরেই বিবাহ সংঘটিত হত। পাত্র বা পাত্রী এতে স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করত না। ফাতেমার এ কথা ভালভাবেই জানা ছিল। তা ছাড়া তিনি আরবের একটি ভদ্র বিশিষ্ট কবিলার কন্যা ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে তিনি সব সংকট ও বাধা-বিপত্তি দু পায়ে ঠেলে একটি যুবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার প্রস্তাব দিলেন তার বিশেষ কারণ ছিল। তা হচ্ছে, আবদুল্লাহকে দেখার সাথে সাথে তার অন্তরে এমন এক মোহ সৃষ্টি হয়েছিল যাতে তিনি নিজেকে মোটেই ধরে রাখতে পারেন নি। ফাতেমার এ প্রস্তাবের উত্তরে আবদুল্লাহ বললেন, না, তা হয় না ফাতেমা। বিবাহের ব্যাপারে আমার নিজের কোন অধিকার নেই, পিতা-মাতা এখনও জীবিত আছেন। তাদের অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে আমি তোমার নিকট কোন কথা দিতে পারব না। তুমি এক কাজ কর, যিনি তোমার অভিভাবক আছেন তিনি আমার পিতার নিকট নিয়ে প্রস্তাব পেশ করুন। তারপর আমার পিতা যদি প্রস্তাব গ্রহণ করেন তা হলে আমার অমতের কিছু খালয়ে না। অন্যথায় আমার মাথা কোন কিছু করা সম্ভব নয়। আবদুল্লাহর এ জবাব হনে ফাতেমা যদিও খুশি হলেন না, তবু তার পক্ষে করার মত কিছু ছিল না। তিনি নীরব হয়ে হইলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ তার নিকট হতে বিদায় এহণ করবেন। বলা ব্যস্থল্য যে, তখন আবদুল্লাহর কালাটে অপূর্ব নূরে মোহাদ্বনীর উজ্জ্বল রোশনাই বিকশিত হয়েছিল, আর তাঁর অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণেই ফাতেমা ভাংক ঐওপভাগেই বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর সত্যতা পরবর্তীকালের ঘটনা খরা নিঃসন্দেহ কপে প্রথাবিক হয়েছে। তখন আবদুল্লাহর বিবি আমেনার সাথে বিবাহ হয়েছিল এবং তাঁর ললাট হাতে দূতে মোহাম্মদী বিবি আমেনার গর্তে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। এ সময় একদিন আবদুল্লাহ কোথাও হাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ আজও সে পূর্বোক্ত যুবতী ফাতেমার সাথে সাক্ষাত হল। ফাতেমা তখনও অবিবাহিতা ছিলেন। তিনি একবার চক্ষু তুলে আবদুল্লাহর দিকে হাকালেন, তারপর কোন কিছু না বলেই তিনি আপন কাজে মনোনিবেশ করালেন। ফাতেমার আজদের অবস্থা দেখে আবদুল্লাহ কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, যে ফাতেমা। তুমি না একনা আমার নিকট বিবাহ বসতে প্রস্তাব দিয়েছিলে, কিন্তু আজ যে কিছুই না বলে একেবারে মৌন হয়ে বইলে? এর কারণটা কি?
ফাতেমা বললেন, আবদুল্লাহ। তুমি এতদিনে নিশ্চয়ই কোন ভাগ্যবতী মহিলাকে বিবাহ করেছ। আমি অবশ্য ভোমার বিবাহের কথা কারও নিকট শুনি নি। জবে তোমার চেহারা দেখেই বুঝে গিয়েছি যে, তুমি নিশ্চয়ই এখন বিবাহিত। যে মহিলাকে ভূমি বিবাহ করেছ, তার মত ভাগ্যবতী নারী এ জগতে আর নেই।
সেদিন আমি তোমাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলাম, তার কারণ কি জান? সেদিন তোমার ললাটে এক অদ্ভুত দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, যার আকর্ষণ কোন রমণীই অবহেলা করতে পারে না। কিন্তু আজ আর তোমার ললাটে যে দীপ্তির কোন নিদর্শন নেই। তা দেখেই আমি অনুমান করছি যে, এতদিন নিশ্চয়ই তোমার বিবাহ হয়ে গিয়েছে এবং এখন সে নূরের নীপ্তি তোমার ললাট ছাড়িয়ে তোমার বিবাহিতা পত্নীর গর্ভে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আবদুল্লাহর পরিপূর্ণ যৌবনকালে তখনও তাঁর বিধি আমেনার সাথে বিবাহ হয় নি, কিন্তু পিতা আবদুল মুত্তালিবের ললাট হতে নূরে মোহাম্মনী আবদুল্লাহর ললাটে আশ্রয় নিয়েছে, তখন তাঁর ললাট এবং মুখমণ্ডল এমন অলৌকিক সৌন্দর্যের আভায় বিকশিত হয়েছিল যে, তাঁকে দেখে আরবের শতাধিক শ্রেষ্ঠ রূপসী যুবতী তাঁর সাথে বিবাহ বসতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাদের আশা বার্থ হওয়ায় হদয়ের জ্বালা সইতে না পেরে তারা সকলেই আত্মহত্যা করেছিল।
0 Comments