পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, পরনিন্দা করার অনেকগুলো কারণ আছে। তন্মধ্যে আমরা এখানে এগারটি কারণ উল্লেখ করব। তন্মধ্যে আটটি কারণ সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে এবং তিনটি কারণ ধার্মিক ও বিশেষ লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রথম কারণ ক্রোধঃ কারও উপর ক্রোধের উদ্রেক হলে মানুষ তার দোষসমুহ উল্লেখ করতে প্রবিও হয় আবং তার মন থেকে তখন হিংসা-বিদ্বেষ উদ্দাত হয়। এটা প্রায় প্রবৃত হয় এবং তার মানুষের মধ্যেই স্বভাবগত কারণেই হয়ে থাকে। । বিশেষতঃ যদি তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক না থাকে। কখনও পোষণ করতে কখনও তার দোষ প্রকাশ্যভাবে এ উল্লেখ না করলেও সে মনে মনে হিংসা-বিদ্বেষ পোষ থাকে। যার ফলে ভবিষ্যতে ওগুলে এগুলোই নিন্দা করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মোটকথা, হিংসা হিংসা-বিদ্বেষ এবং ক্রোধই পরনিন্দ্যর প্রধান কারণ স্বরূপ বলা যায়। এর একমাত্র দাওয়াই ক্রোধ সম্বরণ।
দ্বিতীয় কারণ-বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গীদে জীদের মনস্তুটির টর চেষ্টাঃ বন্ধু-বান্ধব এবং সঙ্গীদের দের মনস্তুষ্টির লক্ষ্যে এবং তাদের বাক্যের সমর্থন ও সাহায্য করার উদ্দেশে দ্দশ্যে অনেক সময় পরনিন্দা করা হয়। কেননা সে মনে করে যদি সে বন্ধু-বান্ধবের নিন্দার প্রতিবাদ করে বা নিন্দার মজলিস ছেড়ে উঠে চলে যায় তবে তারা তাকে পরিত্যাগ করবে; বে; সুতর এর-নিন্দায় শরীক রীক হয়ে যায়। যখন তরাং সেও তখন তাদের সাথে বন্ধুগণ ত্রে ক্রোধভাবে কার কারও নিন্দা সন্দা করে রে তখন সেও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে ক্রোধান্বিতভাবে নিন্দা করতে থাকে। এভাবে সে বন্ধু- রক্ষা করতে গিয়ে অ অনাহূত পর-নিন্দায় লিপ্ত হয়।
তৃতীয় কারণ-নিজের দোষ-ত্রুটি। ঢেকে ফেলার চেষ্টা: যখন কোন ব্যক্তি ক্তি মনে কা করে যে, বিচারক বা প্রধান ব্যক্তির সাম কেউ তার তার নিন্দ্য সন্দ্য করবে এবং তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দে দেবে। ন্দা করে রে তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব রয়েছে তার তখন সে সেই ব্যক্তির নিন্দা করতে থাকে। এভাবে তার নিন্দ লাঘব করার জন্য সে প্রয়াস চালায়। অথবা প্রথমে তার মধ্যে যে সত্য গুণ উল্লেখ করে তারপর মিথ্যা দোষারোপ করে তার প্রতি নিন্দারোপ করে। এক্ষেত্রে ফত্রে সে তার প্রাথমিক সত্যের সাথে মিথ্যার সংযোগ করে দিয়ে বলতে থাকে মিথ্যা বলার আম আমার অভ্যাস নেই। তবে তার এই প্রকৃত অবস্থা আমি আপনাদেরকে জানিয়ে রাখলাম।
চতুর্থ কারণ-নিজে দোষমুক্ত হওয়াঃ পর নিন্দার অন্যতম কারণ যে, কোন নিজেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে সে অন্যের নাম নিয়ে বলতে থাকে সেও এরূপ। সঙ্গে শরীক ছিল। তবে আমার অবশ্য সে কাজটি করার বিশেষ কারণ ছিল। কিন্তু কোন প্রয়োজন ছিল না। দোষ থেকে সেও আমার তার তেমন কোন প্রজন ছিল না
পঞ্চম কারণ- আত্মগৌরব প্রকাশ করাঃ পরনিন্দার পঞ্চম কারণ আত্মপ্রশ প্রশংসা এবং আত্ম- গরিমা প্রকাশের চেষ্টা করা এবং এটা করতে গিয়ে সে অন্যকে হেয় করে। সে বলে যে, অমুক ব্যক্তি মুখ, তার বুদ্ধি কম, তার কথার কোন গুরুত্ব নেই। এসব কথার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে চায় এবং লোকের নিকট ব্যক্ত করে যে, সে তার মাধ্যমে সে চেয়ে অধিক বিধান এবং জ্ঞানী। অথচ তার এই আত্মগরিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মধ্য দিয়েই তাকে অন্যের নিন্দা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ষষ্ঠ কারণ-ঈর্ষাঃ পরনিন্দার ঘষ্ঠ কারণ অন্যের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করা। মানুষ যাকে অধিক প্রশংসা করে, অধিক ভালবাসে, অধিক সম্মান করে, ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি ইচ্ছে করে যে, অমুক ব্যক্তির সেই প্রশংসা, ভালবাসা এবং সম্মান তার থেকে দূর হয়ে যাক এবং তার পরিবর্তে লোকগণ তার প্রশংসা এবং সম্মান করা শুরু করুক। এ কার্য সাধন করতে গেলে তার জন্য ঐ ব্যক্তির নিন্দা করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। নিন্দার মাধ্যমে তার সম্মান ও প্রশংসা নষ্ট করে দিতে হয়। তজ্জন্য সে পরিশ্রম সহকারে তার ছিদ্রান্বেষণে চেষ্টা করতে লেগে যায়। এমন কি কখনও কখনও কোন দোষ-ত্রুটি বের করতে অপারগ হওয়া সত্ত্বেও তার গ্লানি করতে থাকে। এই স্বভাবকেই হাসাদ বা পরশ্রীকাতরতাও বলা হয়।
সপ্তম কারণ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপঃ পরনিন্দার অন্যতম কারণ অন্যকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা। মানুষের দোষত্রুটি সমালোচনা করতে গিয়ে তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং হাসি ঠাট্টা করতে থাকা। পরে এগুলোই নিন্দার কারণ হয়। এভাবে অন্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার মূল কারণ অহংকার এবং আত্মগৌরব।
অষ্টম কারণ-পরিহাসঃ পরনিন্দার আর একটি কারণ হল অন্যকে পরিহাস করা, তাকে অবজ্ঞা করা এবং তার ফলে তাকে নিন্দা করা হয়। মানুষের মধ্যে আত্মাভিমানের ফলেই এই দোষ জন্মে।
বিশেষ লোকের ক্ষেত্রে তিনটি কারণঃ যে কারণ তিনটি বিশেষ লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা' খুবই সূক্ষ্ম এবং কঠিন। শয়তান তা' সৎ কার্যের স্থানে উপস্থিত করে। এর মধ্যে মঙ্গল থাকে বটে, কিন্তু শয়তান তার সাথে সুস্পষ্টভাবে মন্দের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।
প্রথম কারণঃ প্রকৃত সাধু ও ধার্মিক লোকের মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটির কথা জানতে পেরে কেউ কেউ আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলতে থাকে, অমুক সৎ এবং সাধারণ লোকটির কার্যে আমার বড়ই আশ্চর্যবোধ হল। তার মধ্যে সব গুণই বর্তমান কিন্তু একটি দোষ আছে। এজন্যই আমার এরূপ আশ্চর্য লাগছে। দুঃখ প্রকাশের সময় যদি সে তার দোষ প্রকাশ করে এবং তার নাম মুখে উচ্চারণ করে তাহলে সে পরনিন্দার পাপে পাপী হবে। এসব ক্ষেত্রে কেউ কেউ আবার এরূপ কথাও বলে। যেমন অমুকের একটি ব্যাপারে আমি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হলাম। তার ক্রীত-দাসীটি এত কুৎসিত হওয়া সত্ত্বেও সে তাকে অত্যধিক ভালবাসে।
দ্বিতীয় কারণঃ পরনিন্দার দ্বিতীয় সূক্ষ্ম কারণ হল, অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের রূপে অন্যের নিন্দা করা হয়। অন্য লোক কোন দোষ করলে তার জন্য সে দুঃখিত হয় এবং বলে, ঐ হতভাগ্য লোকের ব্যাপারে আমাকে চিন্তিত করে তুলেছে। হয়ত তার সে ব্যাপার সত্য কিন্তু তার নাম উল্লেখ করে সে পরনিন্দার পাপে পাপী হয়। তার চিন্তা ও তার সহানুভূতি সত্য এবং প্রকৃত; কিন্তু অসাবধানতা বশতঃ হঠাৎ তার নাম মুখে উচ্চারণ করে সে পরনিন্দার দোষ করে থাকে। এই তত্ত্ব না জানার কারণে মানুষ সাধারণতঃ এই পরনিন্দা করে থাকে। তাতে তাদের বন্ধুর জন্য সহানুভূতি ও চিন্তার সমস্ত পুণ্য নষ্ট হয়ে যায়।
তৃতীয় কারণঃ পরনিন্দার তৃতীয় সৃদ্ধ কারণ আল্লাহর জন্য ক্রোধ প্রকাশ করা। বিরক্তি- প্রকাশক বাক্য ব্যবহার বা ক্রোধসূচক কথা সাধারণ ভাবে প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু পাপাচারীর নাম উল্লেখ করলেই পরনিন্দা হবে। কোন মন্দ কার্য দেখলে ক্রোধ প্রকাশ করা হয় বটে', কিন্তু অসাবধানতাবশতঃ হঠাৎ তার নাম প্রকাশ করে পরনিন্দার দোষে দোষী হয়। সৎকার্যে উপদেশ এবং মন্দকার্যে নিষেধের সম্পর্কে তার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা সে প্রয়োজনীয় মনে করে কিন্তু অন্যের কার্যে সে তদ্রূপ ক্রোধ প্রকাশ করে না বা তার নাম প্রকাশ বা তার মন্দ উল্লেখ করে না।
এ তিনটি সূক্ষ্ম কারণ সাধারণ লোক ব্যতীতও আলিমদের মধ্যেও সূক্ষ্মভাবে নিহিত আছে। কেননা তারা মনে করে যে, আল্লাহতায়ালার জন্য কারও কার্যে আশ্চর্যান্বিত হলে, আক্ষেপ প্রকাশ করলে তার নামপ্রকাশ করলেও জায়েয হবে, এটা ভ্রান্ত ধারণা। তবে পরনিন্দার বিশেষ প্রয়োজনে পরনিন্দা জায়েয আছে। যদি ব্যক্তিবিশেষের নাম না লওয়া হয়, তা' শীঘ্রই বর্ণনা করা হবে। বর্ণিত আছে যে, হযরত আমের ইবনে ওয়াহেলাহ বলেছেন, এক ব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর সময়ে একদল লোকের নিকট দিয়ে যাওয়ার কালে তাদেরকে সালাম দিল এবং তারাও তার জবাব দিল। যখন সে তাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেল, ঐ লোকদের মধ্যে একজন বলল, আমি আল্লাহর কারণে এই ব্যক্তির সাথে বিদ্বেষ রাখি। তখন সে দলের লোকগণ বলল, তুমি যা' বলেছ, তা' নিশ্চয়ই মন্দ কথা। আল্লাহর কসম, আমরা তাকে নিশ্চয়ই একথা বলে দেব। তারপর তারা তাদের মধ্যে এক ব্যক্তিকে বলল, তুমি যাও এবং ঐ ব্যক্তি যা' বলেছে, তা' তাকে বলে দাও। তারপর তাদের লোক তার নিকট গিয়ে তাকে এ খবর জানিয়ে দিল।
তখন নিন্দিত লোকটি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে যা' ঘটেছে তাঁকে জানালে, হুযুরে পাক (দঃ) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এই ব্যক্তি সম্বন্ধে এ কথা বলেছ? সে বলল, হ্যাঁ। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি কেন তাকে হিংসা করেছ? তখন সে বলল, আমি তার প্রতিবেশী এবং আমি তার সম্বন্ধে উত্তম জানি। আল্লাহর কসম, ফরজ নামায ব্যতীত তাকে আমি কখনও অন্য নামায পড়তে দেখি নি। তখন সে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! তাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি ফরজ নামাযে কখনও বিলম্ব করেছি? আমি কি উত্তম রূপে অজু করি নি, রুকু সিজদাহ উত্তমরূপে আদায় করি নি? হুযুরে পাক (দঃ) এ কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল, এ কথা কখনও আমি বলি নি।
তখন সে বলল, আল্লাহর কসম, ধার্মিক ও অধার্মিক সবাই-ই রমজান মাসে রোযা রাখে। রমজান মাস ব্যতীত তাকে অন্য কোন মাসে রোযা রাখতে দেখি নি। সে উত্তর করল, হে আল্লাহর রাসূল! তাকে আপনি জিজ্ঞেস করুন আমি কি কখনও কোন রমজানের রোযা বাদ দিয়েছি বা তার কোন হক কি আমি নষ্ট করেছি? হুযুরে পাক (দঃ) তা' তার নিকট জিজ্ঞেস করলে সে বলল যে, সে তা' রক্ষা করেছে। তখন সে বলল, আল্লাহর কসম, আমি তাকে কোন ফকির বা মিসকীনকে কখনও দান করতে বা আল্লাহর পথে এক কপর্দকও ব্যয় করতে দেখি নি। তবে ধার্মিক অধার্মিক সবাই যে যাকাত দেয় তা' সে আদায় করেছে। হুযুরে পাক (দঃ) তাকে তা' জিজ্ঞেস করলে সে বলল যে, ফরজ যাকাত সে কম দেয় নি। তখন ঐ লোকটিকে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি উঠে যাও, সে হয়ত তোমার চেয়ে অধিক উত্তম তুমি কেন তাকে হিংসা কর।
0 Comments