জুলুম বা অত্যাচারের প্রতিশোধ

 তুমি মীযানের ব্যাপারটি এখন বুঝতে পারলে অর্থাৎ যার নেকীর পাল্লা ভারী হবে, যে সন্তুষ্টচিত্তে জীবন যাপন করবে আর যার নেকীর পাল্লা হাল্কা হবে, তার হাসিয়াহ দোযখে স্থান হবে। সে হাবিয়াহ দোযখ হল ভীষণ আগুনের কুন্ড। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি নিজের হিসাব নিজে গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত কেউই এই মীযানের বিপদ থেকে রক্ষা পাবে না। মীযান থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার কার্য ও কথা শরীয়তের তুলাদণ্ডে মেপে কাজ করে ও কথা বলে। যেমন হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের হিসাব গ্রহণ করার পূর্বে নিজেদের হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর। নিজেদের হিসাব নিজেরা গ্রহণ করার অর্থ মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যেক পাপ থেকে খালেছ হৃদয়ে তাওবাহ করা এবং আল্লাহর, ফরজ কার্যগুলোর মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি হয়েছে, তার অনুসন্ধান করা, তন্ন তন্ন করে অন্যায়ভাবে গ্রহণকৃত মাল যারটা তাকে ফিরিয়ে দেয়া, রসনা বা হস্ত দ্বারা যার ক্ষতি করা হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ করা, মন্দ ধারণার প্রতিকার করা এবং তা' দূর করে মনে সন্তুষ্টি দান করা, কোন অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ বাকী না থাকা, কোন ফরজ কার্যের ত্রুটি বাকী না থাকা। এরূপ ব্যক্তি বেহেশতে বিনা হিসাবে যেতে পারবে। যদি এই অন্যায় কাজের প্রতিকার না করে কেউ প্রাণ ত্যাগ করে, তার শত্রুগণ তাকে ঘিরে ধরবে। কেউ তার হাত ধরবে, কেউ তার কেশগুচ্ছ ধরবে, কেউ বলবে, তুমি আমাকে অত্যাচার করেছ। কেউ বলবে, তুমি আমাকে তিরস্কার করেছ। 

        কেউ বলবে, তুমি আমাকে বিদ্রূপ করেছ, ঠাট্টা করেছ, আমাকে নিন্দা করেছ। কেউ বলবে, আমি তোমার প্রতিবেশী ছিলাম কিন্তু তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ। কেউ বলবে, তুমি আমাকে মজুর নিযুক্ত করেছিলে, কিন্তু আমার পাওনা আদায় করনি। কেউ বলবে, তুমি অমুক মাল আমার নিকট বিক্রয় করেছ বটে, কিন্তু তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ এবং আমার নিকট তোমার মালের দোষ গোপন রেখেছ। কেউ বলবে, তোমার মালের মূল্য সম্বন্ধে তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ। কেউ বলবে, তুমি আমাকে অভাবগ্রস্ত দেখেছিলে এবং তুমি ছিলে অভাবশূন্য। কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি। কেউ বলবে, তুমি আমাকে অত্যাচারিত দেখেছিলে এবং সে অত্যাচার দূর করার মত তোমার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তুমি তা' না করে বরং অত্যাচারীর খোশামোদ করেছ এবং আমার দিকে এতটুকু লক্ষ্য করনি। যখন তুমি এই অবস্থায় থাকবে এবং তোমার পাওনাদারগণ ডাদের নখ্যগ্র বিস্তার করবে, তারা তাদের হস্ত তোমাকে আক্রমণ করার জন্য প্রসার করবে, তখন তুমি সম্পূর্ণ হতভম্ব এবং কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়বে। মোটকথা এমন একটি লোকও বাকী থাকবে না, যাদের সাথে তোমার মাত্র একটি দেরহামের লেন দেন হয়েছে, সেও তোমার নিকট তার ব্যাপার নিয়ে হাজির হবে। যাকে তুমি নিন্দা করেছ, যার সাথে তুমি সামান্য বিশ্বাস ভঙ্গ করেছ বা যাকে ঘৃণার চোখে দেখেছ, তারাও তাদের ব্যাপার নিয়ে উপস্থিত হতে কছুর করবে না। এই অবস্থা থেকে আল্লাহ তোমাকে কিছুতেই মুক্ত করবেন না, যে পর্যন্ত না তারা তোমাকে মুক্তি প্রদান করে। তদুপরি আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "অলা তাহসাবান্নাল্লাহু গাফিলান আম্মাইয়া'মালুজ জালিমূনা ইন্নামা ইয়ুয়াবৃদ্ধিরুহুম লিইয়াওমিন তাশখাছু ফীহিল আবছারু মুহত্বিঈনা মু্যুনিষ্ট রুউসিহিস লা ইয়ারতাব্দু ইলাইহিম ত্বারফুহুম ওয়াফয়িদাতুহুম হাওয়ায়ুন" অর্থাৎ অত্যাচারীগণ যা' করে, সে বিষয়ে আল্লাহতায়ালাকে অমনোযোগী বলে ধারণা করো না। তাদেরকে ঐ দিনের জন্য সময় দেয়া হচ্ছে, যে দিন তাদের চক্ষুর দৃষ্টি উর্দ্ধমুখী হয়ে যাবে। তারা মস্তকোত্তলন করে প্রধাবিত হবে। তাদের দৃষ্টি তাদের দিকে থাকবে না এবং তাদের অন্তর পেরেসান হয়ে যাবে।

        ওহে! দুনিয়ায় মানুষের সম্মান নষ্ট করতে এবং তাদের ধন সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করতে তোমরা উঠে-পড়ে লেগে গিয়েছিলে, সেদিন আবার তোমাদের এ ব্যাপারটিও ঠিক তন্ত্রপ জোরে-শোরে গুরুত্ব দিয়ে ধরা হবে, কেননা আল্লাহতায়ালা তাঁর ন্যায় বিচারকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং তাঁর শাসনদণ্ড দ্বারা তোমাদের বিচার করবেন। সেদিন তুমি নিঃস্ব, অসহায় এবং দরিদ্রাবস্থায় থাকবে। তখন তোমার পুণ্য থেকে পুণ্য গ্রহণ করে তাদেরকে দিয়ে দেয়া হবে। যে পুণ্য দুনিয়ায় তুমি বহু কষ্টে অর্জন করেছিলে, তার মালিক তোমার শত্রুগণ হয়ে যাবে।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, হুযুরে পাক (দঃ ) বলেছিলেন, দরিদ্র কে তা' তোমরা জান কি? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। আমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি দরিদ্র, যার অর্থ-সম্পদ নেই। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, (না, সে নয় বরং) আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র সেই ব্যক্তি যে রোজ কিয়ামতে নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে; কিন্তু অন্যকে তিরস্কার করার দরুন বা নিন্দা করার দরুন বা অন্যের মাল আত্মসাৎ করার দরুন বা অন্যায়ভাবে রক্তপাত করার দরুন বা অন্যকে প্রহার করার দরুন তাদেরকে তার পুণ্যসমূহ দিয়ে নিজেকে খালিহাত হয়ে যেতে হবে। যদি তাদের দেনা শোধ করতে গিয়ে তার পুণ্যে কুলিয়ে না উঠে, তখন তাদের পাপসমূহ তার উপর বর্তাবে ও তার ফলে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। 

        এখন তুমি সেই দিনটির দিকে লক্ষ্য কর, তোমার সৎকার্যসমূহ রিয়া, শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং অন্যান্য বিপদ থেকে নিরাপদ নয়, তারপর যদি বা দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তোমার একটি সৎকার্য ঐসব থেকে নিরাপদ হয়, তাও তোমার পাওনাদারগণ তোমা থেকে নিয়ে যাবে। হয়ত যদি তুমি তোমার নিজের কাজের হিসাব কর তবে দেখবে যে, তোমার রাত্রে নামায আছে, দিবসে রোযা আছে কিন্তু এমন একটি দিন পাবে না যে, তুমি কারও না কারও নিন্দা করনি, তখন তোমার সমস্ত পুণ্য উক্ত নিন্দাকৃত ব্যক্তিকে দিলেও তোমার সেই নিন্দার ক্ষতিপূরণ হবে না। এই অবস্থায় হারাম ভক্ষণ, সন্দেহপূর্ণ দ্রব্য ভক্ষণ, ইবাদাতের ত্রুটি এসব তো আছেই। এগুলোর অবস্থা কি হবে? তুমি সেদিন তোমার এসব জুলুম বা অত্যাচারমূলক কাজ থেকে কিভাবে মুক্তি লাভের আশা কর যখন শিংবিশিষ্ট ও শিংহীন নিম্নশ্রেণীর জন্তুর পর্যন্ত বিচার হবে? হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, হুযুরে পাক (দঃ) দুটি ছাগকে লড়াই করতে দেখে বললেন, হে আবু যর। এরা কোন বিষয় নিয়ে লড়াই করছে, তুমি বলতে পার কি? আমি বললাম, বলতে পারি না ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। তিনি বললেন, তুমি বলতে পার না কিন্তু আল্লাহতায়ালা তা' বলতে পারেন। এ লড়াইর কারণ তাঁর অজানা নয়। রোজ কিয়ামতে নিশ্চয়ই আল্লাহ এর বিচার করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, দুনিয়ায় এমন কোন প্রাণী নেই যা এমন কোন পাখি নেই যে, পাখা দ্বারা উড়তে পারে, যা' তোমাদের ন্যায় উন্নত বা এক শ্রেণীর প্রাণী নয়। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) এর অর্থে বলেছেন যে, সৃষ্ট জীব সবই বলাঃ পশু-পাখি, জীব-জন্তু-প্রাণী রোজ কিয়ামতে একত্র করা হবে। তারা আল্লাহর ন্যায় বিচারে অত্যাচারিত পশু অত্যাচারী পশুকে শিং দিয়ে গুতিয়ে তার দুনিয়ায় গুতানোর বদলা নেবে। তারপর আল্লাহ বলবেন, এখন তোমরা মাটি হয়ে যাও। তখন এ বিচার দেখে কাফির বলবে, আফসুস। যদি আমিও এভাবে মাটি হয়ে যেতে পারতাম।

        হে দুর্ভাগা। তুমি ভেবে দেখেছ কি সে দিন কিরূপ হবে, যে দিন তুমি তোমার আমলনামা পুণ্য। শূন্য দেখতে পাবে? যে পুণ্যের জন্য তুমি সারা জীবন কাটিয়ে যাবে, তখন তুমি বলবে, আমার পুণ্য কোথায়? তোমাকে বলা হবে, তোমার পাওনাদারদের আমলনামায় তা' চলে গেছে আর তোমার আমলনামা পাপে পূর্ণ হয়ে রয়েছে। অথচ তুমি সারা জীবন সে পাপ থেকে বিরত রয়েছ এবং পাপ থেকে ধৈর্য ধারণ করে থাকার জন্য কত কষ্ট বরণ করেছ। তুমি তখন বলবে, হে প্রভু! আমি এসব পাপ তো কখনও করিনি। তখন তোমাকে বলা হবে, এসব পাপ ঐ লোকদের, তুমি যাদের অগোচরে নিন্দা করেছ, যাদেরকে তুমি তিরস্কার করেছ, যাদের অনিষ্টের ইচ্ছা করেছ, যাদের সাথে ক্রয়-বিক্রয়ে, আচরণে এবং তর্ক-বিতর্কে ও অন্যান্য কাজ-কর্মে অন্যায় ব্যবহার করেছ।

         হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, শয়তান আরবে মূর্তি পূজা হবে না বলে নিরাশ হয়েছে কিন্তু অচিরেই সে তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবে। কেননা তোমরা জঘন্য শ্রেণীর নিন্দনীয় ও অনিষ্টকারী কার্য করবে। তুমি যতদূর পার নিজেকে অন্যায় থেকে রক্ষা কর। কেননা কোন বান্দা রোজ কিয়ামতে পাহাড় সমান পুণ্য নিয়ে আসবে। কিন্তু তা' শীঘ্রই তাকে ত্যাগ করে যাবে। তখন বান্দা বলতে থাকবে, হে প্রভু! অমুক ব্যক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে অত্যাচার করেছে। আল্লাহ বলবেন, তার পুণ্য থেকে ঐ অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ করে লও। এইভাবে তার পুণ্য নিতে নিতে সব পুণ্য শেষ হয়ে যাবে।

         আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমার মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে। তারপর রোজ কিয়ামতে তোমাদের প্রভুর নিকট তোমরা বিবাদ করতে থাকবে। যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল, হযরত জোবায়ের (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমাদের পরস্পরের মধ্যে দুনিয়ায় যা' ঘটেছে তার সাথে পাপের সম্পর্ক কি? তিনি বললেন, হাঁ, সম্পর্ক আছে; যে পর্যন্ত তোমরা পরস্পরের হক আদায় না করবে। তখন হযরত জোবায়ের (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! তা' হলে তো অবস্থা ভীষণ হবে। তুমি এখন সেই কঠিন দিনের বিষয় চিন্তা কর, যেদিন এক পদক্ষেপও ক্ষমা করা হবে না এবং এক চপেটাঘাত এবং একটি বাক্যও বিচার ব্যতীত যাবে না, যে পর্যন্ত জালিম থেকে মজলুমের জন্য ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা না হবে। 

        হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)কে বলতে গুনেছি, আল্লাহ সমস্ত লোককে উলঙ্গ, ধূলি-ধূসরিত এবং মালমাত্তাহীন অবস্থায় একত্র করবেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, মালমাত্তা বা বস্তুশূন্য অবস্থা কি? তিনি বললেন, তা' হল, তাদের সাথে কোন ব্যক্তি বা কোন বস্তু-ই থাকবে না। তারপর তাদের প্রভু তাদেরকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বলবেন এবং সেই ডাকের আওয়াজ নিকট বা দূর থেকে একই সমান শ্রবণ করা যাবে। আমি অধিপতি (দাইয়্যান) প্রতিশোধ গ্রহণকারী। বেহেশতীদের একজনও বেহেশতে যেতে পারবে না, যে পর্যন্ত দোষখীদের মধ্যে একজনেরও তার উপর হক থাকে; এবং তা' আদায় না করে। দোযখীদের মধ্যে একজনও দোযখে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত বেহেশতবাসীদের মধ্যে একজনের নিকটও তার হক থাকে এবং সে তার প্রতিশোধ গ্রহণ না করে।

        আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তা' কিরূপে হবে, যখন আমরা আল্লাহর নিকট উলঙ্গ এবং ধূলি-ধূসরিত অবস্থায় উপস্থিত হব? তিনি বললেন, পাপ ও পুণ্য নিয়ে হে আল্লাহর বান্দাগণ! উভয় অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করবে। মানুষের ধন-দৌলত আত্মসাৎ করা, তাদের সম্মান নষ্ট করা, তাদের মনকে সংকীর্ণ করে দেয়া এবং তাদের সংসর্গে এসে তাদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করা ইত্যাদি কাজগুলোকে ভয় করবে। কেননা বান্দা আল্লাহর প্রতি যে গুনাহ করে তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তা' মাফ করিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করলে তা' ক্ষমা পাওয়া যায় না। যে ব্যক্তি বহু মানুষের হক নষ্ট করে থাকে এবং সে যদি তাওবাহ করে, তাতে সেই হক নষ্টের ক্ষতিপূরণ হয় না; বরং সে যেন বহু পুণ্য কার্য করে, যাতে প্রতিশোধের দিন ঐ পুণ্যের দ্বারা তার উপকার হয়। কোন কোন ইবাদাত পূর্ণ ইখলাছের সাথে শুধু আল্লাহর জন্য করবে। যেন আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ-ই তা' না জানে। হয়তো তা-ই তোমাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে।

        হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা হুযুরে পাক (দঃ) যখন তাঁর দরবারে উপবিষ্ট ছিলেন, তখন আমরা তাঁকে হাস্য করতে দেখলাম। এমন কি তাঁর সম্মুখের দন্তরাজি দেখা যেতে লাগল। হযরত ওমর (রাঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হোক, আপনার হাস্য করার কারণ কি? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে দুই ব্যক্তি মহান প্রভুর নিকট নতজানু হয়ে বলবে, হে প্রভু! আমার ভ্রাতার নিকট থেকে আমার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ কর। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তোমার ভ্রাতাকে তার হক দাও। সে বলবে, আমার নিকট আর কোন পুণ্য বাকী নেই। তখন আল্লাহ প্রথম দাবীদার ব্যক্তিকে বলবেন, তার নিকট আর কোন পুণ্য বাকী নেই, এখন তুমি কি করবে? সে বলবে, হে প্রভু! তাহলে সে আমার পাপ বহন করবে। তখন হুযুরে পাক (দঃ)এর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তারপর তিনি বললেন, সেদিনটি বড়ই ভীষণ দিন। যেদিন মানুষ তাদের বোঝা নামিয়ে রাখার আবশ্যকতা দেখবে। তখন আল্লাহ দাবীদারকে বলবেন, তুমি তোমার মস্তক উত্তোলন কর এবং বেহেশতের দিকে লক্ষ্য কর। তখন সে তার মস্তক উঠিয়ে বলবে, হে প্রভু। আমি রৌপ্যের উচ্চ শহরসমূহ দেখছি। স্বর্ণ ও রত্নখচিত প্রাসাদসমূহ দেখতে পাচ্ছি। এগুলো কি কোন নবীর জন্য, না কোন ছিদ্দীকের জন্য, না কোন শহীদের জন্য? আল্লাহতায়ালা বলবেন, এগুলো ঐ লোকের জন্য, যে আমাকে এগুলোর মূল্য আদায় করে। সে বলবে, হে প্রভু! কে এগুলোর মূল্য দিতে পারে? আল্লাহ বলবেন, ইচ্ছা করলে তুমিও এর মূল্য দিতে পার। সে জিজ্ঞেস করবে, এগুলোর মূল্য কি? তিনি বলবেন, এগুলোর মূল্য তোমার ভাইকে ক্ষমা করে দেয়া। তখন সে বলবে, হে প্রভু! আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি তোমার ভ্রাতার হস্ত ধারণ করে তাকে বেষেশতে নিয়ে যাও। তারপর হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে রীমাংসা করে নাও। কেননা আল্লাহতায়ালা মুমিনদের মধ্যে মীমাংসা করিয়ে দেবেন। আল্লাহতায়ালার গুণ অনুসরণ করলে এই পুরস্কার পাওয়া যায়। তাই এটা এক সতর্কবাণী। সুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করাই এই গুণ।

        এখন চিন্তা কর, তোমার আমলনামা এসব অন্যায় ও অত্যাচার থেকে মুক্ত কিন্যা বা আল্লাহ তোমাকে তা' ক্ষমা করে দেন এরূপ করুণা তুমি তার নিকট প্রার্থনা কর কিনা। চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের বিষয় নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস কর। বিচারের স্থান থেকে যদি তুমি এই অবস্থায় যাও যে, সন্তুষ্টির পরিচ্ছদ তোমার উপর পতিত হয় এবং সৌভাগ্য অর্জন কর, যারপর আর কখনও দুর্ভাগ্য হবে না এবং এমন সুখ উপভোগ কর যার কোন শেষ নেই। তখন তোমার কিরূপ আনন্দ হবে? তখন তোমার মন আনন্দে উথলে উঠবে। তোমার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে। তোমার সর্বশরীর দীপ্তিময় হয়ে যাবে। যেরূপ পূর্ণ চন্দ্রের রাত্রে চন্দ্র উজ্জ্বল হয়। এখন চিন্তা কর, সমস্ত সৃষ্টজীবের মধ্যে তুমি কি তোমার মস্তক উচ্চ করে তোমার পৃষ্ঠ বোঝামুক্ত করতে চাও এবং সুখ-সম্পদের অধিকারী হয়ে তোমার দুই পার্শ্বে সন্তুষ্টির দ্যুতি নিরীক্ষন করতে চাও? তাহলে সবাই তোমাকে ও তোমার অবস্থাকে অবলোকন করতে থাকবে এবং তোমার রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য দেখে তারা ঈর্ষা করবে। ফিরেশতাগণ তোমার সম্মুখে ও পিছনে চলতে থাকবে এবং তারা সমস্ত জীবের সম্মুখে ঘোষণা করবে, এই ব্যক্তি অমুকের পুত্র অমুক। আল্লাহতায়ালা তার উপর সন্তুষ্ট এবং সেও আল্লাহতায়ালার উপর সন্তুষ্ট। সে এমন সৌভাগ্য লাভ করেছে যারপর আর কখনও কোন দুর্ভাগ্য হবে না। তুমি দেখ না যে, এই পদমর্যাদা ঐ পদমর্যদার চেয়ে কি অধিক নয়? যা' তুমি দুনিয়ায় মানুষের নিকট তোমার কার্য প্রদর্শন করে, তাদেরকে খোশামোদ করে ও তোয়াজ করে অর্জন কর, যদি তুমি জান যে, তা' এ থেকে উত্তম অথচ তার সাথে এর কোন সম্বন্ধ নেই, তাহলে আল্লাহর প্রতি কর্তব্য সাধনে নির্মল ইখলাছ ও সত্য নিয়ত দ্বারা এই পদমর্যাদা অর্জন কর। তাঁর সাহায্য ব্যতীত এই পদমর্যাদা অর্জন করা যাবে না। যদি অন্যথা হয় এবং তোমার আমলনামায় এমন পাপ বের হয় যাকে তুমি সহজ মনে কর, অথচ আল্লাহর নিকট তা' বড়, তার জন্যই তোমার উপর তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বলবেন, হে অসৎ বান্দা! তোমার উপর আমার অভিশাপ! তোমার ইবাদাত আমি কবুল করব না। এই কথা শ্রবণ মাত্র তার মুখমণ্ডল কালিমাময় হয়ে যাবে। তারপর ফিরেশতাগণ আল্লাহর ক্রোধের জন্য ক্রোধান্বিত হবে এবং বলবে, তোমার উপর আমাদেরও অভিশাপ এবং সমস্ত সৃষ্ট জীবেরও অভিশাপ। তখন তোমার নিকট মুদারসহ ফিরেশতাগণ উপস্থিত হবে। সৃষ্টিকর্তার ক্রোধের কারণে তারাও ক্রোধান্বিত থাকবে। তারা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে তোমার নিকট উপস্থিত হবে। তারপর তারা তোমার কেশগুচ্ছ ধরে টেনে তোমার মুখের উপর অর্থাৎ উপুড় করে তোমাকে ফেলে দেবে। তখন সব লোক তোমার মলিন মুখ এবং তোমার এরূপ আপদস্থতা তাকিয়ে দেখবে। আর তুমি তখন আর্তনাদ এবং আক্ষেপ করতে থাকবে, তারা তোমাকে বলবে, আজ তুমি এক মৃত্যুকে ডেক না বরং বহু মৃত্যুকে ডাক। ফিরেশতাগণ তখন ঘোষণা করে বলবে, এই ব্যক্তি অমুকের পুত্র অমুক, আল্লাহ তার অপমান ও অসম্মান প্রকাশ করে দেবেন এবং তার জঘন্য পাপের দরুন তাকে লা'নত করবেন। সে এমন দুর্ভাগ্যের মধ্যে পতিত হবে, যারপর আর কোন সৌভাগ্য হবে না। এই পাপ কখনও এমনভাবে করা হয় যা' কেউ জানে না, অথচ মানুষের মনে তার প্রতি ভক্তি আকর্ষণের অন্বেষণ বা তাদের নিকট অপমানিত হওয়ার ভয় করা হয়। তোমার অজ্ঞতা কত বেশী যে, তুমি দুনিয়ায় একদল মানুষের নিকট অপমানিত হওয়ার ভয়ে সতর্ক হচ্ছ, অথচ সমস্ত লোকের সামনে আল্লাহর নিকট অপমানিত, তাঁর কঠিন শাস্তি ও অসন্তুষ্টির সম্মুখীন এবং মুন্দরধারী ফিরেশতার দ্বারা বিতাড়িত হয়ে জাহান্নামের দিকে যাওয়ার অপমানকে বড় মনে করছ না। এই অবস্থা পুলছিরাতের নিকট বুঝতে পারবে।

Post a Comment

0 Comments