কেইয়ামতের ময়দানে ঘর্ম প্রসঙ্গ

        এখন তুমি দুনিয়ার সব সৃষ্টজীব সমবেত হওয়ার বিষয়টি চিন্তা কর। এমন কি সপ্ত আকাশ ও সপ্ত যমিনের যত রকমের জীব-জন্তু আছে, তা' সবই একই স্থানে সমবেত হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জ্বিন, মানব, শয়তান এবং পশু-পক্ষী ইত্যাদি। দীর্ঘ দিন অর্থাৎ পাঁচ শ' বছর অতিবাহিত হওয়ার পর পুনরায় সূর্য আত্মপ্রকাশ করবে এবং তীব্র রশ্মি বিকিরণ করতে থাকবে। মোটকথা সূর্যের রশ্মির তাপ বহুগুণ বৃদ্ধি করা হবে। দুনিয়ার তাপের তার সাথে কোন তুলনা করা চলে না। সূর্যকে জীবসমূহের মস্তকের অতি নিকটবর্তী করা হবে। তা' মাত্র দুটো তীরের দূরত্বে থাকবে। যমিনের উপর কোন ছায়া থাকবে না। কেবল মাত্র বিশ্বপালকের আরশের ছায়া থাকবে। আল্লাহর নিকটবর্তীগণ ব্যতীত অন্য কারুরই সে ছায়ার আশ্রয় গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। যারা আরশের ছায়া ও সূর্যের রশ্মির উষ্ণতার মধ্যবর্তী স্থানে থাকবে তারা সেই উষ্ণতার কারণে সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। তাদের দুঃখ ও কষ্টের সীমা থাকবে না। মানুষের অসম্ভব ভীড়ের কারণে একজন অন্যজনকে হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাবে, তখন লজ্জা ও ভয়ের অগ্নিতে প্রত্যেকের হৃদয় দন্ধীভূত হ ত থাকবে। আর সবার শরীর থেকে অসম্ভব ঘর্ম নির্গত হতে থাকবে। এমন কি শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ থেকে ঘর্মধারা প্রবাহিত হবে যা' স্রোতাকারে হাশরের ময়দানে প্রবাহিত হয়ে এক ভীষণ অবস্থার সৃষ্টি করবে। প্রত্যেকের শরীর থেকে নির্গত সেই ঘর্মধারার পরিমাণ এত অধিক হবে যে, তা' ময়দানে পুঞ্জীভূত হয়ে মানুষের কর্মের অবস্থানুসারে কারও জানুদ্বয়, কারও কোমর এবং কারও কর্ণ পর্যন্ত উত্থিত হবে। কেউ কেউ ঘর্মের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার অবস্থায় পৌছে যাবে।

        কোনকোন হাদীসে বর্ণিত আছে যে, কোথাও কোথাও ঘর্মের উচ্চতা সত্তর হাত পর্যন্ত উঠবে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে এভাবে বর্ণিত আছে। অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে যে, সমবেত লোকগণ একই স্থানে দাঁড়িয়ে চল্লিশ বছর পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। ওকবাহ ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে সূর্য যমিনের অত্যন্ত নিকটবর্তী হবে এবং অবিরল ধারে মানুষের ঘর্ম নির্গত হতে থাকবে। কারও ঘর্ম তার পদদ্বয় পর্যন্ত পৌছবে, কারও জানুদ্বয় পর্যন্ত, কারও কোমর পর্যন্ত এবং কারও বা ওষ্ঠদ্বয় পর্যন্ত পৌছে যাবে। এই কথা বলে তিনি স্বীয় মুখ ধরলেন। কাউকে আবার ঘর্ম সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করে ফেলবে। এই কথা বলে তিনি স্বীয় মস্তকে হস্ত স্থাপন করলেন। এখন হে বেচারা। তুমি কিয়ামতের ময়দানে এরূপ অকল্পনীয় ঘর্মধারা নির্গত হওয়ার কারণটি চিন্তা কর। কোন কোন লোক এ সময় ঘর্মের মধ্যে অবস্থান করে দিশেহারা হয়ে চীৎকার করে বলে উঠবে, হে প্রভু! তুমি আমাদেরকে এরূপ কষ্টের মধ্যে না রেখে মুক্তি দান কর। যদি আমাদেরকে দোযখে প্রবেশ করতে হয় তা-ও আমাদের জন্য ভাল। এই ঘটনা মানুষের হিসাব-নিকাশ এবং শান্তির পূর্বে হবে। হে বেচারা! তুমি জান না যে, তোমার ঘর্ম কোন পর্যন্ত উঠবে। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় আল্লাহর পথে হজ্জ, জিহাদ, রোষা, নামায এবং মুসলমানের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহের চেষ্টা বা সৎ কার্যে উপদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করার চেষ্টায় ধর্ম নির্গত না করে থাকে কিয়ামতের ময়দানে এভাবে ধর্ম নির্গত হতে থাকরে এবং তাতে তার অসহ্যকর কষ্ট ও ক্লেশ পোহাতে হবে। যদি আদম সন্তান অজতা ও এম থেকে নিরাপদ থাকে তাহলে তারা জেনে রাখুক যে, ইবাদাতে কষ্ট ও দুঃখ ভোগ করা এবং তজ্জন্য কিছু ঘর্ম নির্গত করা খুবই স্বল্প সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং তা' সহ্য করে নেয়া অতি সহজ। কিন্তু হাশরের ময়দানের উক্ত দুঃখ-ক্লেশ দীর্ঘকাল স্থায়ী।

        কিয়ামতের ময়দানে সব জীব-জন্তুই উর্দু দিকে তাকিয়ে থাকবে। প্রত্যেকেরই অন্তর ভীত-সন্তপ্ত থাকবে। কেউ কোন কথা বলবে না। অনেকের নিজেদের ব্যাপার সম্বন্ধেই লক্ষ্য থাকবে না। একাধারে তিন শ' বছর পর্যন্ত তদবস্থায় সেখানে অপেক্ষা করতে থাকবে। তথায় তারা খাদ্য ভক্ষণ করবে না, কোন কিছু পান করবে না, এতটুকু মাত্র বাতাস উপভোগ করবে না।

         হযরত কা'ব (রাঃ) ও হযরত কাতাদাহ (রাঃ) বলেছেন, যেদিন মানুষ বিশ্ব প্রভুর সম্মুখে দণ্ডায়মান হবে, তারা তিনশ' বছর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন যে, "কাইফা বিকুম ইযা জামাআকুমুল্লাহ" অর্থাৎ "আল্লাহ তোমাদেরকে একত্র করবেন।" তারপর তিনি বললেন, তখন তোমাদের কি অবস্থা হবে? তোমদেরকে একত্র করা হবে, যেরূপ তীর তুনের মধ্যে একত্র করা হয়। পঞ্চাশ হাজার বছর পর্যন্ত এই দিনটির দীর্ঘতা হবে। তিনি তোমাদের প্রতি লক্ষ্য করবেন না। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, ঐ দিনটি সম্বন্ধে তোমাদের কি ধারণা, যেদিন লোকগণ তাদের পায়ের উপর পঞ্চাশ হাজার বছর দণ্ডায়মান থাকবে? তথায় তারা কোন কিছু ভক্ষণ করবে না, কোন কিছু পান করবে না, এমনকি যখন পানির তৃষ্ণায় তাদের গ্রীবাদেশ ভেঙ্গে যাবে এবং ক্ষুধায় উদর জ্বলে যাবে, তখন আল্লাহ তাদেরকে দোযখের দিকে নিয়ে যাবেন। তখন তারা উত্তপ্ত ফোয়ারার পানি পান করবে। তখন তাদের যে অবস্থা হবে, তা' বুর্গনা করা যায় না। তারা সে কঠোর শাস্তি সহ্য করতে না পেরে একে অপরকে বলবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সম্মানিত এবং সুপারিশ করতে পারবে, চল আমরা তাঁর নিকট যাই। এই কথা বলে তারা একে একে সব নবীর নিকট উপস্থিত হবে। কিন্তু যে নবীর নিকটই তারা যাবে, প্রত্যেকেই তাদেরকে তাড়িয়ে দেবেন যে, আমরা আজ তোমাদের জন্য সুপারিশ করব কি করে, প্রত্যেকেই আমরা নিজ নিজ ভাবনায় আছি। এই কথা বলে সত্যিই তাঁরা ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী অর্থাৎ আমাকে বাঁচাও আমাকে বাঁচাও আওয়াজ করতে থাকবেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহর শাস্তির ভয়ে কম্পিত হতে থাকবেন। তাঁরা বলবেন যে, আজ আল্লাহ আমাদের উপর এত অসন্তুষ্ট, এর পূর্বে কোন দিন তিনি এত অসন্তুষ্ট হননি এবং পরেও কোন দিন হবেন না। পরিশেষে আমাদের নবী হুযুরে পাক (দঃ) তাদের জন্য সুপারিশ করবেন। যার জন্য সুপারিশ করতে অনুমতি দেয়া হয়। রহমান যাকে অনুমতি দেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট। তিনি ব্যতীত আর কারও সুপারিশের ক্ষমতা থাকবে না। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছে, "লাইয়ামলিকুনাশ শাফায়াতা ইল্লা মান আযিনা লাহুররাহমানু ওয়া রাদ্বিয়া লাহু কাওলা।"

        এখন এই দিবসের দীর্ঘতা এবং অত্যধিক কষ্ট-ক্লেশের সাথে দীর্ঘ অপেক্ষার বিষয় চিন্তা কর। যদি এই দুনিয়ায় তোমার সংক্ষিপ্ত জীবনে তুমি পাপ থেকে বিরত থাক, তাহলে তা' তোমার উপর সহজ হবে। জেনে রাখ যে, যে ব্যক্তি মোহ ও খাহেশ থেকে ধৈর্যের কষ্টের দরুন দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যুর অপেক্ষা করতেছিল সেদিন তার প্রতীক্ষা কম হবে। হুযুরে পাক (দঃ)কে যখন সেই দিনের দীর্ঘতার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, যাঁর হস্তে আমার জীবন তাঁর শপথ। ঐ দীর্ঘতা মুমিনের জন্য সহজ করা হবে। এমন কি তা' ফজর নামায অপেক্ষাও সহজ ও সংক্ষেপ হবে। এখন তুমি ঐসব মুমিনের অন্তর্ভুক্ত হবার চেষ্টা কর। কেননা যে পর্যন্ত তোমার জীবনের একটি নিশ্বাসও বাকী থাকে, সে পর্যন্ত ব্যাপার তোমার স্বাধীন ইচ্ছার মধ্যে আছে এবং তজ্জন্য প্রস্তুতির লাগামও তোমার হস্তে রয়েছে; সুতরাং সেই ভয়াবহ দিনের জন্য দ্রুত সম্বল গ্রহণ কর। তাতে তোমার এমন উপকার হবে যে, তার আনন্দের সীমা থাকবে না। যার তুলনায় দুনিয়ার সাত হাজার বছর বয়সকেও তুচ্ছ মনে করবে। যদি তুমি এই সাত হাজার বছর ধৈর্যধারণ করে থাকতে পার তবে সেই দিনের পঞ্চাশ হাজার বছরের কষ্ট থেকে তুমি মুক্তি পাবে। তখন তোমার উপকার হবে অনেক কিন্তু কষ্ট হবে কম।

Post a Comment

0 Comments