উপরোক্ত ভয়াবহ ঘটনার পরে আল্লাহর এই আয়াতের বিষয়ে চিন্তা কর। স্মরণ কর, যেদিন রহমানের নিকট আল্লাহ-ভীরুগণকে দলে দলে একত্র করা হবে এবং পাপীদেরকে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নেয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তাদেরকে দোযখের পথে চালিয়ে নিয়ে একটি স্থানে বসিয়ে রাখ, কেননা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এই ঘটনার পর তাদেরকে পুলছিরাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। দোযখের উপরিভাগে এটা একটা দীর্ঘ সেতু বা পুল। তা' তীক্ষ্ণ ধারাল অসি থেকেও অধিক ধারাল এবং কেশ থেকেও বেশী সূক্ষ্ম। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সরল-সোজা পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে, সে আখেরাতের ঐ সেতু সহজে পার হয়ে যাবে এবং মুক্তি লাভ করবে। আর যে এই দুনিয়ায় সোজা পথ থেকে বিপথে যায়, আর যার পৃষ্ঠদেশ পাপের বোঝায় ভারী হয়ে যায়, সে ঐ পুলের উপর তার পা রাখার সাথে সাথেই তার পা পিছলে সে নিম্নে পতিত হবে। তুমি এখন চিন্তা কর, যখন তুমি ঐ পুলের ধারের তীক্ষ্ণতা ও তার সূক্ষ্মতা দেখবে, তখন তোমার মনে কি ভয় এবং ত্রাসের উদ্রেক হবে, তারপর তুমি সেই পুলের নিম্নদেশ থেকে জাহান্নামের ধূম্র উদগীরণ হতে দেখবে এবং তাছাড়া জাহান্নামের আগুনের দাউ দাউ শব্দ তোমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে। কিন্তু তোমার মনের এই নাযুক অবস্থা সত্ত্বেও তোমাকে ঐ পুল পার হয়ে যেতে বলা হবে। তখন তোমার পদদ্বয় প্রকম্পিত হতে থাকবে। পৃষ্ঠে পাপের বোঝা থাকবে। যখন তুমি পুলের উপর তোমার এক পা রাখবে এবং পুলের ধারের তীক্ষ্ণতা অনুভব করবে, তখন তোমার অবস্থা কি হবে? তোমার সম্মুখে অন্যান্য লোক পুলের উপর দিয়ে পদস্খলিত হয়ে গেলে দোযখের ফিরেশতাগণ সাঁড়াশী দিয়ে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি তাদের দিকে চেয়ে থাকবে। তুমি দেখতে পাবে যে, কিরূপে তারা পড়ে যাচ্ছে এবং তাদের মস্তক নীচের দিকে ও পদদ্বয় উপরের দিকে থাকবে।
এখন তুমি তোমার নিজের অবস্থা চিন্তা কর, যখন তুমি পুলের উপর আরোহণ করবে, তোমার পৃষ্ঠদেশে ভারী বোঝা, তুমি দক্ষিণ ও বাম দিকের লোকদের প্রতি লক্ষ্য করছ যে, তারা পুলের উপর দিয়ে গড়িয়ে দোযখে পতিত হচ্ছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলবেন, হে প্রভু! সাল্লিম, সাল্লিম (নিরাপদ নিরাপদ) তাদের আক্ষেপ ও হা-হুতাশ ধানি জাহান্নামের তলদেশ থেকে তোমার নিকট পৌছাবে। তখন যদি তোমার পদস্খলন হয়, তবে তোমার অবস্থা কি হবে? তখন তোমার অনুতাপে কোন ফল হবে না যদিও তুমি আক্ষেপ এবং হা-হুতাশ কর। তখন তুমি বলবে, আমি একে ভয় করেছিলাম, হায় আফসুস। আমার জন্য আমি কি পাঠিয়েছি। আক্ষেপ। আমি যদি আল্লাহর রাসূলের পথ ধরতাম। হায় আফসুস। আমি যদি অমুককে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম। হায় আফসুস। আমি যদি মৃত্তিকায় পরিণত হতাম। হায়। আমার মাতা যদি আমাকে প্রসব না করত। এ সময় দোযখের অগ্নি শিখা তোমায় হঠাৎ ধরে নিয়ে যাবে। আমরা আল্লাহর নিকট এ থেকে আশ্রয় চাই। এ সময় একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, এর মধ্যে প্রবেশ কর, কথা বলো না। তখন চীৎকার, হা-হুতাশ এবং করুণ আবেদন ব্যতীত আর কিছুই থাকবে না। উক্ত বিষয়গুলো তোমার সম্মুখে আছে, যদি তুমি এসব বিশ্বাস না কর, তুমি দোযখের অতল তলে কাফিরদের সাথে কত দীর্ঘকাল অবস্থান করবে, তা' জানা নেই, যদি তুমি তা' বিশ্বাস করে তাতে উদাসীন থাক এবং তজ্জন্য প্রস্তুত না হও, তবে তোমার ক্ষতি ও নাফরমানী কত বড়। তোমার ঈমান তোমার কি উপকার করবে, যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষনে এবং পাপ ত্যাগে 'তা' তোমাকে কষ্টের জন্য উৎসাহ না দেয়। যদি তোমার সম্মুখে পুলছিরাতের ভয় এবং ভীষণ শাস্তিতে মন পেরেশান থাকে, তা-ই তোমার শাস্তির পক্ষে যথেষ্ট।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, জাহান্নামের পৃষ্ঠে পুলছিরাতকে স্থাপন করা হবে। আমিই আমার উম্মতসহ রাসূলগণের মধ্যে সর্বপ্রথম তা' অতিক্রম করব। রাসূলগণ ব্যতীত সেই দিনে আর কেউই কথা বলতে পারবে না। তখন রাসূলগণের ধ্বনি হবে, "আল্লাহুম্মা সাল্লিম, আল্লাহুম্মা সাল্লিম” (হে আল্লাহ! মুক্তি দাও) জাহান্নামের মধ্যে ছা'দানের কাঁটার ন্যায় কাঁটা থাকবে তোমরা ছা'দানের কাঁটা দেখেছ? ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। দেখেছি। তিনি বললেন, তা' ছা'দানের কাঁটার ন্যায়। তবে আল্লাহ ব্যতীত তাদের বৃহত্ত কেউই জানে না, মানুষের আমল অনুসারে তারা মানুষকে ধরে নিয়ে যাবে। কেউ কেউ তাদের আমলসহ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কেউ কেউ হোঁচট খেতে মুক্তি পাবে।
হযরত আবু সাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, জাহান্নামের সেতুর উপর দিয়ে লোকজন চলে যাবে, তার উপর কাঁটা, সাঁড়াশী এবং লৌহ পেরেক থাকবে। তা' ডানে ও বামে মানুষদেরকে ধরে নেবে। তার দুই পার্শ্বে ফিরেশতাগণ থাকবে। তারা বলবে, হে মাবুদ! মুক্তি দাও, হে মাবুদ! মুক্তি দাও। কেউ কেউ তা' বিদ্যুতের ন্যায় অতিক্রম করবে। কেউ কেউ বায়ু প্রবাহের ন্যায়, কেউ অশ্বের ন্যায়, কেউ দৌড়িয়ে, কেউ হেঁটে হেঁটে, কেউ কেউ বুকে হামাগুড়ি দিয়ে তা' পার হবে। দোযখীগণ জীবিত থাকবে না, তাদের মৃত্যুও হবে না। মানুষকে তাদের পাপ এবং দোষের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। আগুনে দন্ধীভূত করা হবে, তার ফলে তারা অঙ্গারের ন্যায় ভস্মীভূত হবে। তারপর শাফায়াতের জন্য অনুমতি দেয়া হবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা পূর্বাপর সবাকেই নির্দিষ্ট দিনের জন্য সমবেত করবেন। এই অবস্থায় সবাই-ই চল্লিশ বছর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বিচারের জন্য অপেক্ষা করবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) সমগ্র হাদীসটি মুমিনদের সিজদাহ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন, তারপর মুমিনদেরকে বলা হবে যে, তোমরা মস্তক উত্তোলন কর। তখন তারা তাদের মস্তক উত্তোলন করবে। তখন তাদেরকে তাদের আমল অনুসারে নূর দেয়া হবে। কাউকে একটি বৃহৎ পর্বত তুল্য নূর দেয়া হবে। তা' তাদের সম্মুখে দৌড়াতে থাকবে। আবার কাউকে তা' থেকে কম নূর দেয়া হবে। কাউকে একটি খেজুর তুল্য নূর দেয়া হবে। কাউকে তার চেয়েও কম নূর দেয়া হবে। এমন কি সর্বশেষ ব্যক্তিকে তার পায়ের আঙ্গুল পরিমাণ নূর দেয়া হবে। তা' কখনও জ্বলে উঠবে, আবার কখনও তার আলো ক্ষীণ হয়ে যাবে। যখন আলো জ্বলে উঠবে, তখন সে হাঁটবে। যখন আলো ক্ষীণ হয়ে যাবে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারপর তিনি পুলছিরাতের উপর তাদের অতিক্রমের বিবরণ দিলেন। মোটকথা যার যার নূর অনুসারে সে পুলছিরাতের উপর চলবে। কেউ চক্ষুর নিমিষে চলে যাবে। কেউ বিদ্যুৎ বেগে, কেউ মেঘ চলাচলের ন্যায়, কেউ তারা পতিত হওয়ার ন্যায়, কেউ অশ্ববেগে, কেউ মানুষের দৌড়াবার ন্যায় পুল পার হবে। এমন কি যাকে পায়ের আঙ্গুল পরিমাণ নূর দেয়া হবে, সে তার মুখ, হস্ত ও পায়ের উপর হামাগুড়ি দিয়ে পুল পার হবে। যেমন সে এক পায়ে চলবে, অন্য পা লটকান থাকবে। এক হাতে চলবে, অন্য হাত লটকান থাকবে। যার দুই পার্শ্ব অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করবে, সে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ঐ অবস্থায় থাকবে। যখন সে মুক্তি পাবে, তখন সে বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি অন্যকে যা দেননি বরং আমাকে দিয়েছেন। তিনি আমাকে মুক্তিদান করেছেন। তারপর তাকে বেহেশতের দরজায় একটি পুষ্করিণীতে নেয়া হবে এবং তথায় তাকে গোসল করানো হবে।
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে বলতে শুনেছি, পুলছিরাত তরবারীর ন্যায় ধারাল এবং কেশের অনুরূপ চিকন। ফিরেশতাগণ মুমিন নর ও নারীদেরকে মুক্তি দেবে। জিব্রাইল আমার কোমর ধরে থাকবে আর আমি বলতে থাকব, প্রভু! আমাকে মুক্তি দাও, আমাকে মুক্তি দাও। যাদের পদস্খলন ঘটবে, তাদের সংখ্যাই অধিক।
যা' বলা হল, তা-ই পুলছিরাতের ঘটনা। এ সম্বন্ধে তোমার অধিক চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। যে ব্যক্তি রোজ কিয়ামতের কথা অধিক চিন্তা করে, সে সেই দিনের ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবে। কেননা আল্লাহতায়ালা কোন বান্দার জন্য দুটি ভয় একত্র করবেন না। যে ব্যক্তি দুনিয়ায়ই এই বিপদাপদের ভয় করে থাকে, সে আখেরাতে নিরাপদ থাকবে। এ ভয়ের দ্বারা আমি তোমাদের স্ত্রীলোকদের ন্যায় কোমল চিত্ত হওয়া বা সর্বদা চোখ থেকে অশ্রু বিসর্জন করা বুঝাতে চাচ্ছি না। কারণ একে ভয় বলে না। ভয়ের অর্থ হল, যে যা করে, সে তা' থেকে পালিয়ে যায় বা তা' থেকে পরিত্রাণ লাভের পথ অন্বেষণ করে। আর যে ব্যক্তি যার আশা করে, সে তা' তালাস করে। ভয় ব্যতীত কারুরই মুক্তি নেই। সেই ভয় তোমাকে আল্লাহর নিষিদ্ধ কার্য থেকে বিরত রাখবে এবং তাঁর ইবাদাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান করবে।
নির্বোধ ব্যক্তির ভয় স্ত্রীলোকদের ভয় থেকেও অধিক, কেননা তারা ঘটনা শুনে তাদের রসনা দ্বারা অতোয় প্রার্থনা করে। কেউ বলে, আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই, হে আল্লাহ। তুমি যুক্তি মাও, তুমি মুক্তি দাও, অথচ সে আবার পাপ কার্যে রত হয়। যা' তার যুক্তি দূরের কথা পাংসের কারণ হয়। শয়তান তার এইরূপ প্রার্থনায় হাস্য করতে থাকে। তার আশ্রয় প্রার্থনা ঐ ব্যক্তির আশ্রয় প্রার্থনার ন্যায়, যে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে হিংস্র জন্তু দেখে এবং তার দন্ত ও নখর দেখে দূরে থেকে তার রসনার দ্বারা বলে, আমি এই পর্বতের আড়ালের আশ্রয় চাচ্ছি বা কোন সুদৃঢ় ও সুউচ্চ প্রাচীরের আশ্রয় চাচ্ছি। অথচ সে তা' শুধু মুখেই বলে কিন্তু সে সেখান থেকে আশ্রয় স্থানের দিকে দ্রুত ছুটে না গিয়ে যথাস্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এমতাবস্থায় সে হিংস্র জন্তু থেকে কিরূপে রক্ষা পাবে? আখেরাতের ঘটনাও তদ্রূপ। কালেমা তাইয়্যেব লাইলাহা ইল্লাল্লাহকে মুখে বলে তা' অন্তরে বিশ্বাস করতে হবে এবং ঐ কালেমার প্রকৃত অর্থ তার কার্যের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে; কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস না রেখে কাজে প্রমাণ না করে শুধু মুখে বললে তাতে কোন ফল হবে না। ঐ কালেমাকে সত্য জানা ও অন্তরে বিশ্বাস করার নিদর্শন হল, সত্যিই ঐ কালেমা পাঠকারীর অন্য কোন উপাস্য থাকবে না। এক আল্লাহ ব্যতীত তার আর কেউ উদ্দেশ্য থাকবে না।
যদি তুমি মনকে ঐভাবে তৈরী করতে না পার, তবে হুযুরে পাক (দঃ) কে মনে-প্রাণে প্রিয় করে নাও, তাঁর সুন্নতকে অবলম্বন কর। তাঁর প্রিয় উম্মতদের অনুসরণ কর ও তাদের থেকে দোয়া গ্রহণ কর। তাতে হয়ত তুমি তাদের সুপারিশ লাভ করতে পারবে এবং যার দরুন তোমার মুক্তি লাভের উপায় হয়ে যাবে।
0 Comments