প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ যে, হাওজ অতি সম্মানিত বস্তু। আল্লাহতায়ালা আমাদের নবীকে এ বস্তু তাঁর বিশেষ মর্যাদা হিসেবে এনায়েত করেছেন। এই সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস রয়েছে। আমরা আশা করি যে, আল্লাহতায়ালা যাদেরকে ইহলোকে এ হাওজ সম্বন্ধে জ্ঞান দান করবেন পরলোকেও তাদেরকে এর স্বাদ উপভোগ করাবেন। এই হাওজের বিশেষ গুণ এই যে, যে ব্যক্তি এর পানি পান করবে সে আর কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা হুযুরে পাক (দঃ) নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে হাস্য করতে লাগলেন। তা' দেখে ছাহাবীগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর নবী। আপনি হাসছেন কেন? তিনি বললেন, আমি হাসছি একটি আয়াতের জন্য যা' এই মাত্র আমার উপর অবতীর্ণ হল। এই কথা বলে তিনি উক্ত আয়াত পাঠ করতে লাগলেন। "রহমান ও রাহীমের নামে আরম্ভ করছি, আমি তোমাকে কাওছার দান করেছি। সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর জন্য নামায পড় এবং কুরবানী কর।" অতঃপর তিনি বললেন, কাওছার কি তা' তোমরা জান কি? সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই তা' উত্তম জানেন। তিনি বললেন, তা' একটি স্রোতস্বিনী। আল্লাহতায়ালা। বেহেশতে তা' আমাকে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রভূত মঙ্গল রয়েছে। রোজ কিয়ামতে আমার উম্মতগণ ঐ স্রোতস্বিনীর নিকট পানি পান করতে আসবে। তার নিকট আকাশের তারকার ন্যায় অসংখ্য পান-পিয়ালা থাকবে।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন আমি বেহেশতের মধ্যে ভ্রমণ করতেছিলাম, তখন আমি একটি স্রোতস্বিনীর নিকট এসে উপস্থিত হলাম। তার দু' পার্শ্ব হীরক খচিত। আমি আমার সঙ্গী জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, হে জিব্রাইল! এটা কি? জিব্রাইল বলল, এর নাম হাওজে কাওছার। আপনার প্রভু আপনাকে এই হাওজ দান করেছেন। তখন ফিরেশতা জিব্রাইল তার হস্তদ্বারা উক্ত হাওজের উপর আঘাত করলে দেখা গেল যে, তার নিম্নস্থল মেশক নির্মিত। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন যে, আমার উক্ত হাওজের উভয় তীরের দূরত্ব মদীনা থেকে ছানআর দূরত্বের ন্যায় অথবা মদীনা থেকে ওমানের দূরত্বের ন্যায়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন এই আয়াত নাযিল হল, "আমি তোমাকে কাওছার দান করেছি" তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তা' বেহেশতের মধ্যে একটি স্রোতস্বিনী, তার দু' তীর স্বর্ণ ও হীরক নির্মিত। তার পানি দুগ্ধ থেকেও শুভ্র, মধু থেকেও মিষ্ট, মেশক থেকেও সুগন্ধবিশিষ্ট। তার পানি মণি-মুক্তো ও হীরকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। হযরত ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আমার হাওজ আদন থেকে ওমান পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায় বিস্তৃত। তার পানি দুগ্ধ থেকেও শুভ্র এবং মধু থেকেও মিষ্ট। হাওজের পাত্রগুলো আকাশের তারকারাজির ন্যায় অসংখ্য। যে ব্যক্তি তা' থেকে এক কোষ পরিমাণ পানি পান করে সে এরপর আর কখনও তৃষ্ণার্ত হয় না। সর্বপ্রথম যে সব লোক এর নিকট আসবে তারা দরিদ্র মুহাজির। হযরত ওমর (রাঃ) আরজ করলেন, তাদের অবস্থা কিরূপ ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। তিনি বললেন, তাদের মস্তকের কেশ আলু-খালু, বস্তু মলিন, তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিপালিত হয়নি, তারা কোন রমণী বিবাহ করেনি, তারা জনসাধারণের নিকট কোন সম্মান পায়নি। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমি সুখে প্রতিপালিতা খলীফা আবদুল মালেকের কন্যা বিবি ফাতেমারে বিবাহ করেছি, আমার জন্য ধন ভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। তবে আল্লাহতায়ালা আমার উপর করুণা বর্ষণ করেছেন, আমি আমার কেশ শুল্ক না হওয়া পর্যন্ত তেল ব্যবহার করি না, আমার পরিধানে যে বস্তু থাকে তা' ময়লা না হওয়া পর্যন্ত ধৌত করি না।
হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেছেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। হাওজের পিয়ালার সংখ্যা কত? তিনি বললেন, যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, অন্ধকার রাত্রে আকাশের তারকারাজির সংখ্যার ন্যায় অগণিত। যে ব্যক্তি তা' থেকে কিছুমাত্র পান করে সে তার পরে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। বেহেশতের দুটো ঝরণা নির্দিষ্ট করা হবে। তার প্রশস্ততা ওমান থেকে ইলা পর্যন্ত স্থানের প্রশস্ততার ন্যায়, তার পানি দুগ্ধ থেকে অধিক শুদ্র এবং মধু থেকে অধিক মিষ্ট। হযরত সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, প্রত্যেক নবীরই হাওজ রয়েছে। তার নিকট যত লোক আসবে তা' নিয়ে তারা গৌরব করবে তবে আমি আশা করি যে, আমার উম্মতের সংখ্যাই সর্বাপেক্ষা অধিক হবে।
হুযুরে পাক (দঃ) এরূপ আশা পোষণ করছেন; সতরাং প্রত্যেক লোকই যেন তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশা করে এবং যে কোনরূপ প্রবঞ্চনা থেকে সতর্ক থাকে। শস্য কর্তনের যে আশা করে, সে শস্য বপন করে এবং শস্য ক্ষেত্র থেকে আগাছা পরিষ্কার করে, ক্ষেতে পানি সিভান করে তারপর আল্লাহর অনুগ্রহে শস্য বা ফলের আশায় বসে থাকে। যে ব্যক্তি ভূমি কর্ষণ, আগাছা দূরীকরণ এবং পানি সিঞ্চন করে না, অথচ আল্লাহর করুণায় শস্য ও ফলের আশা করে যে, তিনি তাকে শস্য ও ফল দেবেন সে প্রবঞ্চিত। অধিকাংশ লোকের আশাই এরূপ, এটাই চরম নির্বুদ্ধিতা। আমরা আল্লাহর নিকট এই প্রবঞ্চনা ও গাফলতী থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। কেননা আল্লাহ সম্পর্কিত প্রবঞ্চনা পার্থিব প্রবঞ্চনা থেকে অধিক মারাত্মক। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, পার্থিব জীবন তোমাদের যেন প্রবঞ্চিত না করে এবং ভ্রান্তি যেন তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করে।
0 Comments