ধৈর্যের কল্যাণ কি

        পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ যে, ধৈর্য ক্রোধ দমন থেকেও উত্তম। কেননা ক্রোধ দমনে ধৈর্যকে কষ্ট করে আনতে হয়। ক্রোধ দমনের জন্য ধৈর্যের আবশ্যক হয় এবং তাতে বহু পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। ক্রোধ দমন করলে তা' অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন তার ক্রোধের সঞ্চার হয় না। সঞ্চার হলেও তা' দমন করতে আর বেগ পেতে হয় না। তা-ই জ্ঞান পূর্ণ হওয়া বা কামালিয়াতের চিহ্ন। ক্রোধ তখন বশীভূত হয়ে যায়। ক্রোধের শক্তি ভঙ্গ হয় এবং তা' জ্ঞানের আয়ত্তাধীন হয়ে আসে। কিন্তু ধৈর্যের পূর্বে ধৈর্যের জন্য পরিশ্রম করতে হয় এবং বহু কষ্ট করে ক্রোধকে দমন করতে হয়।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, জ্ঞান কষ্ট করে অর্জন করতে হয় এবং ধৈর্যও কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। যে ব্যক্তি সৎকার্য পছন্দ করে লয়, তা' তাকে দেয়া হয়, যে ব্যক্তি পাপ থেকে আত্মরক্ষা করে, সে রক্ষা পায়, এ থেকেই বুঝা যাচ্ছে যে, ধৈর্য অর্জন করতে হলে প্রথমে পরিশ্রমের পন্থা অবলম্বন করা দরকার। বিদ্যার্জনের ন্যায়ই ধৈর্য অর্জন করতে হয়। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, বিদ্যা অন্বেষণ কর, বিদ্যান্বেষণের সাথে শান্তি ও ধৈর্য অন্বেষণ কর। যাদের নিকট থেকে শিক্ষা কর, তাদের সাথে নম্র ব্যবহার কর। উদ্ধত আলিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। তাহলে তোমাদের অজ্ঞতা তোমাদের ধৈর্যের উপর জয়ী হবে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, আত্মাভিমান ও উদ্ধত স্বভাব থেকে ক্রোধ জন্মে এবং ধৈর্য ও বিনম্র ব্যবহারের প্রতিবন্ধক হয়।

        হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর দোয়ায় বলেছেন, হে মাবুদ। আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর, ধৈর্য দ্বারা আমাকে সুশোভিত কর, তাকওয়া (খোদাভীতি) দ্বারা আমাকে সম্মানিত কর। শান্তি দ্বারা আমার গৌরব বৃদ্ধি কর। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদা অন্বেষণ কর। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। তা' কি? তিনি বললেন, যে তোমার সাথে সম্বন্ধ ছিন্ন করে, তুমি তা' সংযুক্ত করবে। যে তোমাকে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে দান করবে, যে তোমার প্রতি অত্যাচার করে, তুমি তাতে ধৈর্য ধারণ দান করবে। তিনি আরও বলেছেন, নবীদের পাঁচটি স্বভাব আছে। যেমন লজ্জা, ধৈর্য, শিক্ষা, মেসওয়াক করা এবং আতর ব্যবহার করা।

        হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, মুসলমান ব্যক্তি ধৈর্য দ্বারা ছায়েমুদ্দাহার বা সারা বছর রোযা রাখার এবং কায়েমুল্লাইল বা সারা রাত্রি নামায পড়ার মর্যাদা লাভ করে। কেউ অত্যাচারী ও উদ্ধত লোক বলে লিপিবদ্ধ হয় কিন্তু গৃহের লোক ব্যতীত অন্য লোকের উপর তার কর্তৃত্ব থাকে না।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, একব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমার আত্মীয় স্বজন আছে এবং আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি কিন্তু তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের উপকার করি; কিন্তু তারা আমার অপকার করে। তারা আমাকে অবজ্ঞা করে; কিন্তু আমি ধৈর্য ধারণ করে থাকি। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি যা বলছ, তার উপর যদি তুমি থাক, তুমি যেন তাদের উদর তুষের আগুন দ্বারা পূর্ণ করছ এবং যে পর্যন্ত সে আগুন তার মধ্যে থাকে, সে পর্যন্ত আল্লাহর তরফ হতে তোমার জন্য সাহায্যকারী থাকবে। একজন মুসলমান ব্যক্তি প্রার্থনা করছিল হে মাবুদ! আমার এমন কোন অর্থ নেই যে, আমি দান করতে পারি। যে ব্যক্তি আমার সম্মান নষ্ট করে, তা-ই আমার দানরূপে গণ্য করবে। তখন আল্লাহতায়ালা সেই যমানার নবীর উপর এই অহী পাঠালেন, তুমি অমুক ব্যক্তিকে বল, আমি তার পাপ মার্জনা করেছি।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আবু জমজমের ন্যায় হতে পারে না? ছাহাবীগণ আরজ করল, সে কে? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, আবু জমজম নামক একব্যক্তি ছিল। ভোরবেলা সে প্রার্থনা করত, হে মাবুদ। যে আমাকে অত্যাচার করেছে, তাকে অদ্য আমার সম্মান দান করলাম। আল্লাহর পবিত্র কালামের শব্দ রাব্বানিয়‍্যীনের" অর্থে ধৈর্যশীল আলিমের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর আয়াত "যখন মূর্খগণ তাদেরকে সম্বোধন করে, তখন তারা বলে 'সালাম' যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছে "অইযা খাতাবাহুমুল জাহিল্না কাল্ সালামা।"

        হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, এখানে ধৈর্যশীলদের কথা বলা হয়েছে, যদি তাদেরকে অবজ্ঞা করা হয়, তারা প্রত্যুত্তরে অবজ্ঞা করে না।

        হযরত আতা ইবনে আবি রেবা নিম্নোক্ত আয়াতের "হাওনা" এর অর্থ ধৈর্য বলেছেন (আয়াত এইঃ ইয়ামশূনা আলাম আরদ্বি হাওনা (....) অর্থাৎ তারা দুনিয়ায় বিনম্র হয়ে চলে। "কাহলাম্মি নাচ্ছালিহীন'। অর্থাৎ পূর্ণ নেককার লোক" কুরআনের এ আয়াতে কাহলান শব্দের অর্থ ইবনে হাবীবের মতানুযায়ী পূর্ণ ধৈর্যশীল লোক। "যখন তারা অনর্থক কথার সম্মুখীন হয়, তারা সম্মানের সাথে বের হয়ে যায়। হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বলেছেন যে, এর অর্থ যখন তাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়, তারা ক্ষমা করে দেয়। বর্ণিত আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) অনর্থক কথার এক মজলিসের নিকট দিয়ে যাবার কালে হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ইবনে মামউদ সকালে গাত্রোত্থান করেছে কিন্তু সন্ধ্যায় সম্মানিত লোক হয়ে গেছে। তারপর রাবী হযরত ইব্রাহীম (রাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন, "যখন তারা অনর্থক কথার নিকট দিয়ে যায়, তারা সসম্মানে বের হয়ে যায়"।

         হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, হে মাবুদ! যে যুগের লোক আলিমের অনুসরণ করবে না, ধৈর্যশীল লোকদের নিকট লজ্জিত হবে না, যাদের হৃদয় আজম (ভিন্ন) দেশীয় কিন্তু ভাষা আরবী, আমি যেন সে যুগ না পাই এবং সে যুগ আমাকে না পায়। তিনি আরও বলেছেন, তোমাদের মধ্যে এমন লোক আমার সঙ্গে আছে, যারা ধৈর্যশীল, সংযমী, তারপর তাদের পরবর্তী লোকগণ, তারপর তাদের পরবর্তী লোকগণ। তোমরা মতভেদ করো না। তাতে তোমাদের হৃদয় পৃথক পৃথক হয়ে যাবে। তোমরা বাজারের আপদের বিষয়ে সতর্ক হবে।

        আশাজ নামক একব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট প্রতিনিধিরূপে এসেছিল। সে তার নাসিকায় রশি বেঁধে রাখল। সে তার পরিহিত বস্ত্র বদল করে গাঠুরী হতে দু' খন্ড সুন্দর বস্ত্র বের করে তা' পরিধান করল, তার কার্যকলাপ হুযুরে পাক (দঃ) সচক্ষে দেখলেন। তারপর সে হুযুরে পাক (দঃ) এর সম্মুখীন হলে তিনি তাকে বললেন, আশাজ। তোমার মধ্যে দুটি স্বভাব আছে, যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে ভালবাসেন। সে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল। আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কুরবান হোক। বলুন সে স্বভাব দুটো কি? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, ধৈর্য এবং গাম্ভীর্য। সে বলল, এ দুই স্বভাব কি আমি অর্জন করেছি, না জন্ম হতে আমার মধ্যে আছে? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, এ স্বভাব দুটো আল্লাহতায়ালা তোমাকে প্রদান করেছেন। সে বলল, অসংখ্য প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে এমন দুটি গুণ দিয়েছেন যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালবাসেন।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, করুণাময় আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীল, লজ্জাশীল, স্বাধীনচেতা, বহুপরিবার বিশিষ্ট হয়েও ভিক্ষা নিবৃত্তিশীল এবং খোদাভীরু লোককে ভালবাসেন। তিনি অশ্লীল, কঠিন হৃদয়, সাগ্রহে যাঞাকারী এবং নির্বোধ লোককে ঘৃণা করেন। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তির তিনটি গুণের একটি গুণও না থাকে, তার কোন ইবাদাতই গ্রাহ্য হবে না। যথাঃ (১) এমন আল্লাহর ভয়, যা পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে (২) এমন ধৈর্য যা নির্বোধকে বিরত রাখে এবং (৩) এমন স্বভাব যার সাথে লোক বসবাস করতে পারে। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন বিচারের দিন আল্লাহতায়ালা সমস্ত মানুষ একত্র করবেন, তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে যে, পদমর্যাদাবিশিষ্ট লোকগণ কোথায়? তখন একদল লোক খুব তাড়াতাড়ি বেহেশতের দিকে যেতে থাকবে। তাদের সাথে ফিরেশতাদের সাক্ষাত হলে ফিরেশতাগণ তাদেরকে বলবে, তোমরা যে খুব দ্রুত গতিতে বেহেশতের দিকে যাচ্ছ? তারা বলবে, আমরা পদমর্যাদাসম্পন্ন লোক। আমরা অত্যাচারিত হয়েও ধৈর্যধারণ করেছি। আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা সত্ত্বেও আমরা ক্ষমা করেছি। আমাদেরকে অবজ্ঞা করা হলেও আমরা সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছি। তখন তাদেরকে বলা হবে, যাও তোমরা বেহেশতে চলে যাও। সৎকার্যকারীদের পুরস্কারই এরূপ উত্তম।

        বুযর্গদের বাণীঃ হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, বিদ্যা অর্জন কর এবং বিদ্যার জন্য মনের শান্তি ও ধৈর্য অবলম্বন কর। হযরত আলী (রঃ) বলেছেন, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধিতে তোমার কোন মঙ্গল নেই। জ্ঞান ও ধৈর্য বৃদ্ধি এবং আল্লাহর ইবাদাতে গৌরব না করবার মধ্যে মঙ্গল নিহিত। যখন উত্তম কার্য করবে তখন আল্লাহর প্রশংসা করবে। যখন পাপ করবে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, বিদ্যান্বেষণ কর এবং গাম্ভীর্য ও ধৈর্যের দ্বারা তাকে সুশোভিত কর। হযরত আকছাব ইবনে ছায়ফী (রহঃ) বলেছেন, বুদ্ধির ভিত্তি ধৈর্য এবং সমস্ত বিষয়ের মূল সহিষ্ণুতা। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, আমি লোকজনকে কন্টকশূন্য পত্ররূপে দেখেছিলাম। কিন্তু এখন তাদেরকে পত্রশূন্য কন্টকরূপে দেখছি। যদি তোমার সাথে তাদের পরিচয় হয় তারা তোমাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবে। তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চললেও তারা তোমাকে ছেড়ে দেবে না। লোকগণ জিজ্ঞেস করল, আমরা তাদের সাথে কি ব্যবহার করব? তিনি বললেন, তোমাকে কেউ গালি দিলে তুমি গালি দিও না। রোজ কিয়ামতে যখন তুমি অভাবগ্রস্ত হবে, তখন তা' উপকারে আসবে। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, ধৈর্যশীল লোক ধৈর্যের জন্য সর্বপ্রথম যে পুণ্য পাবে তা' ঐ সকল মূর্খদের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করবে। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেছেন, যে পর্যন্ত মানুষের ধৈর্য অজ্ঞতার উপর এবং সহিষ্ণুতা আকাঙ্ক্ষার উপর প্রবল না হবে সে পর্যন্ত সে ইজতেহাদ ও রায়ের পদমর্যাদায় পৌঁছবে না এবং বিদ্যার শক্তি ব্যতীত সে ঐ মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে না। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হযরত আমর ইবনে আছকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ সাহসী? তিনি বললেন, যে তার ধৈর্যের দ্বারা তার অজ্ঞতাকে দূর করে দেয়। তিনি আরও জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ দাতা? তিনি বললেন, যে তার ধর্মের মঙ্গলের জন্য তার সংসারকে ত্যাগ করে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন; "সুতরাং তোমার ও তার মধ্যে যে শত্রুতা আছে, তা' দূর হয়ে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেল"। হযরত আনাস (রাঃ) এ আয়াতের অর্থ সম্বন্ধে বলেন, তার ভ্রাতা তাকে তিরস্কার করেছিল। তারপর তিনি বললেন, যদি তুমি মিথ্যা কথা বলে থাক, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। যদি তুমি সত্যবাদী হও আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, আমি বছরাবাসী এক ব্যক্তিকে গালি দিলে তিনি ধৈর্যধারণ করে থাকলেন। এতে তিনি যেন আমাকে দীর্ঘদিনের জন্য ক্রয় করে নিলেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হযরত আবাবাহ ইবনে ইউসুফকে বলেছিলেন, হে আবাবাহ। তুমি কিরূপে তোমার কাওমের প্রধান হয়েছ? সে বলল, হে আমীরুল মু'মিনীন। আমি তাদের মধ্যে মূর্খদের ব্যবহারে ধৈর্যধারণ করে থাকি। তাদের মধ্যে ভিক্ষুকলে দান করি এবং তাদের প্রয়োজনে সাহায্য করি।যে ব্যক্তি আমার ন্যায় কার্য করে সে আমারই অনুরূপ। আর যে ব্যক্তি আমার উপরে চলে গেছে সে আমা থেকে উত্তম আর যে আমার নিম্নে আছে আমি তা' থেকে উত্তম।


একব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)কে গালি দিয়েছিল। লোকটি গালি শেষ করবার পর তিনি বললেন, হে আকরামাহ। লোকটির কি কোন প্রয়োজন আছে যে, আমি তা' পূর্ণ করব। একথা শুনে লোকটি মস্তক নাড়ল। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলল না।

        একব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযকে বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি মহাপাপী। তিনি বললেন, তোমার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত জয়নাল আবেদীন (রহঃ) বলেছেন যে, একব্যক্তি তাঁকে গালি দিলে তিনি তাঁকে একখন্ড পরিধানের বস্ত্র দিয়ে দিলেন এবং তাকে এক হাজার দেরহাম দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। এক ব্যক্তি বলেছে যে, হযরত জয়নাল আবেদীন (রহঃ) এর মধ্যে পাঁচটি প্রশংসনীয় স্বভাব আছে। যথাঃ ধৈর্য, অন্যের দুঃখকষ্ট দূর করা, যে কথা আল্লাহ থেকে অন্যকে দূর করে তা' থেকে মুক্তি লাভ, অনুতাপ ও তাওবাহ করা। তিরস্কারের পর তাকে প্রশংসা করা, সংসারের একটি বিষয়ের (খেলাফতের) বিনিময়ে তিনি এ সমস্ত অর্জন করেছিলেন। একব্যক্তি হযরত জাফর (রহঃ) কে বলেছিল, আমার সাথে একদল লোকের কোন বিষয় নিয়ে বিবাদ হল, আমি তা' ত্যাগ করতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে একথা বলা হবে ভেবে ভয় করলাম যে, যদি তুমি এ বিবাদ ত্যাগ কর, তাহলে অপদস্থ হবে। তখন যাফর (রহঃ) বললেন, অপদস্থ হয় অত্যাচারীগণই। হযরত খলীল ইবনে আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, এটা সর্ববিদিত যে, যে ব্যক্তি মন্দ ব্যবহার করে তার উপকার করলে তার হৃদয়মধ্যে এমন একটি ভাব সৃষ্টি হয় যে, সে আর মন্দ ব্যবহার করে না।

         হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস (রহঃ) বলেছেন, আমি ধৈর্যশীল নই, তবে আমি ধৈর্য 'শিক্ষা করছি। হযরত ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি করুণা প্রদর্শন করে, তার প্রতি করুণা প্রদর্শন করা হয়। যে ব্যক্তি নীরব থাকে, সে নিরাপত্তা লাভ করে। যে ব্যক্তি অবজ্ঞা করে, সে পরাভূত হয়। যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে, তার ভুলভ্রান্তি হয়। যে ব্যক্তি মন্দকাজের লোভ করে, তার নিরাপত্তা থাকে না। যে ব্যক্তি ঝগড়া-বিবাদ ত্যাগ করে না, সে তিরস্কৃত হয়। যে ব্যক্তি পাপকে ঘৃণা করে না, তার দ্বারা পাপকার্য সংঘটিত হয়। যে ব্যক্তি পাপকে ঘৃণা করে, সে নিষ্পাপ হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপদেশ অনুযায়ী চলে, সে রক্ষাপ্রাপ্ত হয়। যে আল্লাহকে ভয় করে, সে নিরাপদ হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বন্ধু বলে গ্রহণ করে, সব লোকই তার বন্ধু হয়। যে আল্লার নিকট প্রার্থনা করে না, তার অভাব হয়। যে আল্লাহর শাস্তির ভয় করে না, সে অপমানিত হয়। যে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তার জন্য বিষয় অর্জিত হয়।

        একব্যক্তি মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) কে বলেছিল, আমি শুনেছি যে, আপনি আমার নিন্দা করেছেন। তিনি বললেন, তাহলে তুমি আমার চেয়ে অনেক সম্মানিত। যদি তাই আমি করে থাকি তাহলে আমার পুণ্য তোমাকে উপহার দিয়েছি। জনৈক আলিম বলেছেন, বুদ্ধির চেয়ে ধৈর্য অনেক উচ্চ। কেননা আল্লাহতায়ালা ধৈর্য দ্বারা নিজের নামকরণ করেছেন।

        জনৈক ব্যক্তি কোন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম আমি তোমাকে এমন ভীষণ গালি দেব যা তোমার সাথে কবরে প্রবেশ করবে। তিনি বললেন তা' তোমার সাথে করতে প্রবেশ করবে, আমার সাথে নয়। একদা হযরত ঈসা (আঃ) একদল ইয়াহুদীদের নিকট দিয়ে 'যাবার কালে তারা তাঁকে তিরস্কার করল। তিনি তাদের জন্য মঙ্গল এবং কল্যাণের দোয়া করলেন। তখন কেউ তাঁকে বলল, আপনাকে তারা তিরস্কার করছে আর আপনি তাদের জন্য কল্যাণ কামনা করছেন? তিনি বললেন, যাদের সাথে যা আছে তারা তাই ব্যয় করতে পারে। হাকীম লোকমান বলেছেন, তিনটি সময় ব্যতীত গুণের পরিচয় পাওয়া যায় না। যথাঃ (১) ক্রোধের সময় ব্যতীত সহিষ্ণু লোক চেনা যায় না। (২) যুদ্ধের সময় ব্যতীত সাহসী লোক চেনা যায় না। (৩) প্রয়োজনের সময় ব্যতীত বন্ধু চেনা যায় না।

        একদা একবন্ধু কোন বুযর্গ ব্যক্তির নিকট এলে, তিনি তার সামনে খাদ্য পরিবেশন করলেন। উক্ত বুযর্গ ব্যক্তির স্ত্রী খুবই বদমেজাজী ছিলেন। সে এসে লোকটির সামনে থেকে খাদ্যদ্রব্য উঠিয়ে নিয়ে গেল এবং তার ফলে তার স্বামী তাকে গালি দিতে লাগল এবং তার বন্ধু লোকটি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ হৃদয়ে বের হয়ে গেল। তখন উক্ত বুযর্গ ব্যক্তি ঐ লোকটির অনুসরণ করে তাকে বলল, বন্ধু। তোমার কি সেদিনের কথা স্মরণ আছে যে, আমি তোমার গৃহে খাদ্য ভক্ষণ করতেছিলাম, হঠাৎ খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে উপর থেকে একটি মুরগী লাফিয়ে পড়ে খাদ্যদ্রব্য নস্ট করে দিল। কিন্তু তাতে কেউ আমরা রাগান্বিত হই নি। লোকটি বলল, হাঁ, স্মরণ আছে। তখন বুযর্গ ব্যক্তি বললেন, অদ্যকার এ ব্যাপারটিকে আমি মনে করছি, তোমার গৃহের সেদিনকার ব্যাপারটির ন্যায়। বুযর্গ ব্যক্তির কথা শুনে বন্ধু লোকটির হৃদয়ের ক্ষোভ ও ক্রোধ দূর হয়ে গেল। অতঃপর সে চলে যাবার কালে বলল, জনৈক বিজ্ঞ সত্যই বলেছেন, ধৈর্য প্রত্যেক কষ্টের দাওয়াই।

        একব্যক্তি আর একব্যক্তির পদে আঘাত করলে, সে অত্যন্ত বেদনা বোধ করতে লাগল। কিন্তু তার মনে কোনরূপ ক্রোধ উপস্থিত হল না। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে বলল, আমি মনে করলাম যে, আমার পা' কোন প্রস্তর খন্ড থেকে পিছলিয়ে গেছে। এভাবেই আমি ক্রোধকে দমন করলাম।

Post a Comment

0 Comments