ক্রোধ সঞ্চার হওয়ার পরবর্তী দাওয়াই

        পাঠক পাঠিকা। উপরে আমরা ক্রোধের কারন এবং দূর করার পন্থা সম্বন্ধে বর্ণনা করলাম এখন আমরা ক্রোধ সঞ্চার হওয়ার পর তা' উপশম করবার পন্থা কি কি যে সম্বন্ধে বর্ণনা করব। ক্রোধ সঞ্চার হলে ইলম বা জ্ঞানমূলক দাওয়াই এবং তার সাথে আমল বা আনুষ্ঠানিক পাওয়াই এই দু' দাওয়াই সংমিশ্রন করে সেবন করলে তা দূর করা যায়।

জ্ঞানমূলক দাওয়াই ছয় প্রকার

        প্রথম প্রকার দাওয়াইঃ ক্রোধ দমন, সংযম, ধৈর্যা ও ক্ষমার কল্যাণ সম্বন্ধে যে সব কুরআনের আয়াত ও হাদীস এসেছে এবং সেই সম্বন্ধে যে ছওয়াব ও পুণ্যের উল্লেখ আছে, তার বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করবে। ক্রোধ দমনে ছওয়াব প্রাপ্তির লোভ তোমাকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বারন করবে এবং ক্রোধ প্রশান্ত করবে। হযরত মালেক ইবনে আউস (রাঃ) বলেছেন, হযরত ওমর (রাঃ) এক ব্যক্তির উপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে প্রহার করবার জন্য আদেশ দিলে আমি বললাম, হে আমিরুল মু'মেনীন। ক্ষমা করুন। সৎকার্যে আদেশ দিন এবং মূর্খদের কার্য থেকে বিরত থাকুন। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, "ক্ষমা গ্রহণ কর। সৎকার্যে আদেশ দাও এবং মূর্খদের নিকট থেকে বিরত থাক।" তিনি যেন এ আয়াত সম্বন্ধে চিন্তা করতে ছিলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল যখনই তিনি কুরআনের আয়াত শুনতেন সে বিষয় গভীর চিন্তা করতেন। তারপর তিনি লোকটিকে মুক্ত করে দিলেন।

        একদা খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয একটি লোককে প্রহার করবার জন্য আদেশ দিলে লোকটি এই আয়াত পাঠ করল, "যারা ক্রোধ দমন করে--আয়াত। তারপর তিনি তাঁর গোলামকে বললেন, একে ছেড়ে দাও।

        দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞানমূলক দাওয়াইঃ এটা হল, আল্লাহর শাস্তির ভয় করা এবং এই চিন্তা মনে আনা যে, এই ব্যক্তির উপর আমার ক্ষমতা অপেক্ষা আমার উপর আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশী। যদি আমি এই ব্যক্তির উপর ক্রোধের প্রতিশোধ নেই রোজ কিয়ামতে আল্লাহ আমার উপর প্রতিশোধ নিবেন। আল্লাহ তায়ালা কোন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে বলেছেন, হে আদমসন্তান! যখন তোমার ক্রোধ হয়, আমাকে স্মরণ কর। তাহলে যখন আমার ক্রোধ হয় তখন আমি তোমাকে স্মরণ করব। আমি যাদেরকে ধ্বংস করব তোমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করব না।

        একদা হযরত রাসূলে করীম (দঃ) কোন এক কাজের জন্য তাঁর ভৃত্যকে নিয়োগ করলেন। ভৃত্য অনেক বিলম্ব করে ফিরে এলে তিনি বললেন, যদি পরকালে প্রতিশোধ নেয়া না হত। আমি তোমাকে প্রহার করতাম। কথিত আছে যে, বনু ইস্রাইলের প্রত্যেক নরপতিরই একজন করে বিজ্ঞ মন্ত্রি থাকত। যখন নরপতির ক্রোধহত মন্ত্রী তাকে একটি লিখা দেখাতো। তা' ছিল এই যে, দরিদ্রকে ভয় কর। মৃত্যুকে ভয় কর এবং আখেরাতকে স্মরণ কর। নরপতির ক্রোধ উপসম না হওয়া পর্যন্ত সে তা' পাঠ করত।

        তৃতীয় প্রকার জ্ঞানমূলক দাওয়াইঃ এটা হল, নিজের উপর শত্রুতার শাস্তি ও প্রতিশোধের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা। তুমি শত্রুকে সামনে পেয়ে আনন্দিত হও; তার উদ্দেশ্য বার্থ করে দেয়ার জন্য চেষ্টা কর এবং তার বিপদে তুমি সন্তুষ্ট হও। তুমিও তদ্রুপ বিপদ আপদ থেকে মুক্ত নও। দুনিয়ায় তোমার শত্রু তোমাকে ক্রোধের প্রতিশোধ নিতে পারে বলে ভয় ভরবে। আখেরাতেও সে তোমার উপর প্রতিশোধ নিতে পারে। এতে ক্রোধের উপর আকাঙ্খা প্রবল হয়ে ফিরে আসে। এটা পরকালের কার্যের অন্তর্গত নয়। তাতে কোন পূর্ণ নেই। কেননা সে এই দুনিয়ার সুখসম্পদের মধ্যে উভয় ব্যাপারে লিপ্ত থাকে। সে দুনিয়ার একটি মন্দকে অন্য মন্দকার্যের চিন্তার দ্বারা হটিয়ে দেয়।। এজন্য তা' আখেরাতের কার্যের মধ্যে গণ্য হবে না। আতে কোন পূন্যও হবে না। সত্য বটে যে, দুনিয়ার ঝঞ্ঝাটের দরুন জ্ঞান ও অনুষ্ঠানের জন্য তোমার অবসর যদি না হয় এবং আখেরাতের জন্য সাহায্য না পাও তাহলে দুনিয়ার এই ঝঞ্ঝাট দূর করবার জন্য তোমার পূণ্য হবে।

        চতুর্থ প্রকার জ্ঞানমূলক দাওয়াইঃ এটা হল, ক্রুদ্ধ ব্যক্তির ক্রোধের সময় চেহারা বিকৃতির বিষয় চিন্তা করবে। ক্রোধের সময় অন্যের চেহারা বিকৃতির কথা স্মরণ করে নিজের ক্রোধের সময় নিজের বিকৃত চেহারার কথা স্মরণ করবে। হিংস্র পশু শিকারী কুকুরের ন্যায় ক্রুদ্ধ ব্যক্তির চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে তার আকৃতি নবী, আলী আল্লাহ, আলিম ও বিজ্ঞব্যক্তির আকৃতির ন্যায় হয়। সুতরাং ভেবে নাও যে, হিংস্র পশু ও শিকারী কুকুরের ন্যায় নিকৃষ্ট হবে অথবা ক্রোধ দমন করে নবী, আলী আল্লাহ ও আলিমের চেহারার ন্যায় নিজের চেহারাকে সুন্দর করবে।

        পঞ্চম প্রকার জ্ঞানমূলক দাওয়াইঃ এটা হল, যে কারণ প্রতিশোধ গ্রহণ করতে এবং ক্রোধ দমন না করতে আহবান করে, সে বিষয় চিন্তা করবে। শয়তানের কথার ন্যায় নিশ্চয়ই তার কারণ আছে। শয়তান ক্রোধের সময় তাকে এভাবে বুঝতে থাকে, তোমার ক্রোধের উপষম হলে, তোমার দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। তুমি মানুষের চোখে হেয় হবে। মানুষ তোমাকে অপদার্থ বলে জ্ঞান করবে। মানুষের দৃষ্টিতে তুমি তুচ্ছ হয়ে যাবে। তখন তুমি নিজেকে এরূপ উপদেশ দেবে বিচারের কি আশ্চর্যের বিষয় যে, তুমি বর্তমানে হেয় হবে না। কিন্তু বিচারের দিন অপমান ও লাঞ্চনা ভোগ করবে। কেননা ক্রোধভরে তুমি অন্যের উপর প্রতিশোধ গ্রহন করেছ। তুমি লোকের চক্ষে হেয় ও অপদার্থ হবার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেছ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর ফিরেশতাগণ ও তাঁর নবীদের সামনে তোমাকে যখন অপদস্থ ও হেয় করা হবে সে বিষয়ে তুমি সতর্কতা অবলম্বন করনি। পরকালে গিয়ে আল্লাহর দরবারে তুচ্ছ ও হেয় অপেক্ষা অদ্য এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ায় তুচ্ছ ও হেয় হওয়া সহজ। সুতরাং যখনই ক্রোধকে দমন করবে আল্লাহর জন্যই তা' দমন করবে। যখন রোজ কিয়ামতে ঘোষনা করা হবে, আল্লাহর নিকট যার পূন্য পাওনা আছে সে উঠ এবং পুরস্কার নাও। যে ব্যক্তি ক্ষমা করেছে, সে ব্যক্তিই তখন উঠবে। তুমি কি ইচ্ছা কর না যে, তুমি সে দলের অন্তর্ভুক্ত হও? এসব কথা চিন্তা করে বুঝ গ্রহণ করাই ঈমানের চিহ্ন। এটা হৃদয়ে বদ্ধমূল করা দরকার।

        যষ্ঠ প্রকার জ্ঞানমূলক দাওয়াইঃ এটা হল, মনে মনে জেনে নেবে যে, ক্রোধের কারণ এ কার্যটি কেন আমার ইচ্ছানুরূপ হয়নি? আল্লাহর ইচ্ছানুরূপ কেন হল? তখন তুমি তোমার মনে মনে এ তর্ক করবে যে, ক্রোধ করবার আমার কি অধিকার আছে? কার্যটি যেভাবে সম্পন্ন করবার আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, ঠিক সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আমার ইচ্ছানুরূপ হয় নি বলে কি আমার ক্রোধের কারণ হবে? যদি তাই হয় তাহলে ত আল্লাহর প্রভুত্বের বিষয়ে আমার ঝগড়া করা হল। আমার ইচ্ছে কি আল্লাহর ইচ্ছে থেকে উত্তম? যাহোক, এতক্ষণ যে বুঝের কথাগুলো লেখা গেল তা' ক্রোধ দূর করা নামক শ্রেষ্ঠ দাওয়াইর জ্ঞানমূলক কারণ। 

        অনুষ্ঠানমূলক দাওয়াইঃ ক্রোধ দমনের অনুষ্ঠানমূলক দাওয়াই সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা গেল। (১) যখনই তোমার ক্রোধ হবে তখনই পাঠ করবে, "আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।" অর্থাৎ আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হুযুরে পাক (দঃ) এরূপ প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ক্রোধের সময় নিজেও এরূপ করতেন। যখন হযরত আয়েশা (রাঃ) এর ক্রোধ হত, তিনি তাঁর নাসিকা ধরে টানতেন এবং বলতেন, হে প্রিয় আয়েশা। বল, "আল্লাহুম্মা রাব্বিন্নারিয়্যি মহাম্মাদিন ইগফিরলী-যামবী ওয়া আজহাব গাইজোয়াল কালবী ওয়া আজিরনী মিম মুদ্ধিল্লাতিল ফিতান"। অর্থাৎ হে আল্লাহ। তুমি আমার নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর প্রভু। আমার পাপ ক্ষমা কর। আমার হৃদয়ের ক্রোধ দূর কর। আমাকে পথভ্রান্তির আপদ থেকে বাঁচাও। এরূপ প্রার্থনা করা মুস্তাহাব বা উত্তম। এতে ক্রোধ চলে না গেলে দন্ডায়মান থাকলে বসে পড়বে। উপবিষ্ট থাকলে শুয়ে পড়বে এবং মৃত্তিকার নিকটবর্তী হবে। কেননা মৃত্তিকা থেকেই তোমার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার দ্বারা তুমি তোমাকে মাটির ন্যায় শান্ত করবে। ক্রোধের কারণ উষ্ণতা এবং উষ্ণতার ফল উর্ধ্বগতি। সুতরাং তার বিপরীত কার্য মাটিতে শুয়ে পড়া; এবং শরীর শান্ত ও শীতল করা। এতে উষ্ণতা চলে যেতে পারে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ক্রোধ একটি জ্বলন্ত অঙ্গার স্বরূপ। তা' হৃদয়ের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত হয়। তোমরা ক্রুদ্ধ ব্যক্তির ভ্রূদ্বয়কে প্রসারিত এবং চক্ষুদ্বয়কে রক্তবর্ণ দেখতে পাও না? যদি তোমাদের মধ্যে কেউ এরূপ অবস্থা অনুভব করে তাহলে সে দন্ডায়মান থাকলে বসে পড়বে। উপবিষ্ট থাকলে শুয়ে পড়বে। যদি তাতেও ক্রোধ প্রশমিত না হয় তাহলে সে শীতল পানি দ্বারা অজু করবে বা গোসল করবে। কেননা পানি ব্যতীত অগ্নি নির্বাপিত হয় না। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যখন তোমাদের মধ্যে কারও ক্রোধ হয় সে যেন তখন পানি দ্বারা অজু করে। কেননা ক্রোধ অগ্নি থেকে উৎপন্ন হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, ক্রোধ শয়তান থেকে আসে এবং শয়তান আগুনের তৈরী। আগুনকে পানি দ্বারা নির্বাণ করা যায়; সুতরাং তোমাদের কারও ক্রোধ হলে সে যেন তখন অজু করে নেয়। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যখন তোমার ক্রাধ হয় তখন নির্বাক অবস্থা অবলম্বন করবে।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এর যখন ক্রোধ হত, তিনি দাঁড়ানো থাকলে বসে পড়তেন এবং বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়তেন। তখন তাঁর ক্রোধ চলে যেত। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সতর্ক হও, ক্রোধ আদম সন্তানের হৃদয়ের মধ্যে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার। তোমরা ক্রুদ্ধ ব্যক্তির রক্তচক্ষু ও প্রশস্ত ভ্রূযুগলের দিকে লক্ষ্য কর নিং যখন সে ব্যক্তি এরূপ কিছু চিহ্ন লক্ষ্য করে সে যেন তার গন্ডদেশ মাটির সাথে সংযুক্ত করে। এতে তিনি সিজদাহর দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত অংশকে সর্বাধিক হেয় বস্তু মাটির সাথে রেখে শান্ত করতে বলেছেন। তাতে নিজের অহমিকা এবং আত্মগৌরব ভঙ্গ হবে এবং এগুলোই ক্রোধের একটি কারণ।

        বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর (রাঃ) এর একদিন ক্রোধ হলে তিনি শীতল পানির আরা নাসিকা যৌত করে বলেছিলেন, ক্রোধ শয়তান থেকে আসে এবং পানি ক্রোধকে দূর করে দেয়। হযরত ওরওয়া ইবনে মুহাম্মদকে যখন ইয়েমেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হল, তিনি বলেন যে, উবাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে? আমি বললাম হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, যখন তোমার ক্রোধ উপস্থিত হবে, তখন উপরস্থ আসমানের দিকে এবং তলদেশে যমিনের দিকে লক্ষ্য করবে। তারপর আসমান ও যমিনের সৃষ্টিকর্তাকে শ্রেষ্ঠ বলে জ্ঞান করবে।

        বর্ণিত আছে যে, হযরত আবুযর গিফারী (রাঃ) এক ব্যক্তিকে ক্রোধ সহকারে বলেছিলেন, হে লোহিত মাতার পুত্র। (অর্থাৎ দাসীর পুত্র) এ সংবাদ হুযুরে পাক (দঃ)এর কর্ণগোচর হলে তিনি বললেন, হে আবুযর। আমি শুনেছি যে, তুমি অদ্য তোমার এক মুসলমান ভ্রাতাকে তার মাতার সম্বন্ধ উল্লেখ করে নিন্দা করেছ। তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর সাথে সাথে হযরত আবুযর সে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তার নিকট চলে গেলেন। সাক্ষাত হওয়া মাত্র সে লোকটি প্রথমেই হযরত আবুযর (রাঃ)কে সালাম দিল। এ সংবাদ হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, হে আবুযর। তোমার নিকট তোমার মস্তক উপরের দিকে তুলে লক্ষ্য কর। তারপর তুমি জেনে নাও যে, তুমি কিছুতেই লোহিত বা কৃষ্ণ মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নও। কার্যের দ্বারাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। তারপর তিনি বললেন, যখন তোমার ক্রোধ হয়, দন্ডায়মান থাকলে বসে পড়। বসা থাকলে শুয়ে পড়। শুয়ে থাকলে সটান হয়ে পড়।

        হযরত মু'তামার ইবনে সোলায়মান বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকের মধ্যে এক ব্যক্তির অতিরিক্ত ক্রোধ হলে তিনি তিনখানা চিঠি লিখে তিনজন লোককে তা' দিয়ে দিতেন এবং প্রথম লোককে বলতেন, যখন আমার ক্রোধ হয় তখন তুমি আমাকে এই চিঠিখানা দেবে। তারপর দ্বিতীয় লোককে বলতেন, যখন আমার ক্রোধ কিছু উপশম হয় তখন তুমি আমাকে এই চিঠিখানা দেবে। তারপর তৃতীয় লোককে বলতেন, যখন আমার ক্রোধ সম্পূর্ণ উপশম হয়, তখন তুমি আমাকে এই চিঠিখানা দেবে। অতঃপর একদিন তাঁর অতিরিক্ত ক্রোধ হলে, তাঁকে প্রথম চিঠিখানা দেয়া হল, তাতে লিখা ছিল, তোমার ক্রোধের সাথে তার সম্বন্ধ কি? তুমি তার প্রভু নও। তুমি সামান্য মানুষ মাত্র। হয়তো একদিন তোমার দেহের এক অংশ অন্য অংশকে ভক্ষণ করবে। এতে তাঁর ক্রোধ কিছু প্রশমিত হল।

        তারপর তাঁকে দ্বিতীয় পত্র দেয়া হল। তাতে লেখা ছিল, যারা দুনিয়ায় আছে, তাদেরকে দয়া প্রদর্শন কর। তাহলে যারা আসমানে আছে তারা তোমাকে দয়া প্রদর্শন করবে। তারপর তাকে তৃতীয় পত্রখানি দেয়া হল। তাতে লিখা ছিল, আল্লাহ ন্যায্য বিচার করে মানুষকে শাস্তি দেবেন। তা' ব্যতীত তিনি মানুষের মঙ্গল করেন না। অর্থাৎ তিনি মানুষের শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছেন। সে অনুসারে শাস্তি প্রদান করলেই মানুষের মঙ্গল হবে। একদা খলীফা মেহদী কোন একব্যক্তির উপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তাতে হযরত শাব্বীর বললেন, আল্লাহর জন্য ক্রোধে আল্লাহর ক্রোধ থেকে অধিক ক্রোধ দেখাবেন। তখন তিনি বললেন, তাকে ছেড়ে দাও।

 ক্রোধ দমনের মাহাত্ম্য

        আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "অল কাজিমীনাল গাইজ।" অর্থাৎ যারা ক্রোধ দমন করে, অর্থাৎ তিনি তাদেরকে প্রশংসা করে একথাটি বলেছেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, আল্লাহ তার উপর থেকে শাস্তি তুলে নেন। যে ব্যক্তি তার প্রভুর নিকট ত্রুটি স্বীকার করে, আল্লাহতায়ালা তার ত্রুটি ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি তার রসনাকে সংযত রাখে, আল্লাহ তার গুপ্ত দোষ ঢেকে রাখেন। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধের সময় নিজের প্রবৃত্তির উপর বিজয়ী হয়, সে-ই তোমাদের মধ্যে অধিক শক্তিশালী। যে ব্যক্তি ক্ষমতা পেয়েও ক্ষমা করে, সে-ই তোমাদের মধ্যে অধিক ধৈর্যশীল। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধ কার্যে পরিণত করবার ইচ্ছা করেও ক্রোধ দমন করে, রোজ কিয়ামতে আল্লাহ তার হৃদয়কে সন্তোষ দ্বারা পূর্ণ করবেন। অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তার হৃদয় ঈমান ও শান্তিদ্বারা পূর্ণ করবেন। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে ক্রোধ দমনের ঢোকের চেয়ে এতবড় ঢোক আর গলধকরণ করে না। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, দোযখের আরও বিশেষ দরজা আছে। সেই দরজা দিয়ে অবৈধ ক্রোধ প্রকাশকারী ব্যতীত অন্য কোন পাপী প্রবেশ করবে না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধ দমনের ঢোক পান করে, তা' আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। কোন বান্দা তা' হজম করলে আল্লাহ তার হৃদয় ঈমান দ্বারা পূর্ণ করেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ক্রোধকে কার্যে পরিণত করবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্রোধ হজম করে, করুণাময় আল্লাহ সমগ্র সৃষ্ট জীবের সম্মুখে তাকে ডেকে ইচ্ছেমত যে কোন হুরকে পছন্দ করতে বলবেন।

        বিজ্ঞবুযর্গদের বাণী: হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে তার ক্রোধদ্বারা পাপ করতে পারে না। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে যা ইচ্ছে তা করতে পারে না। যদি তা' না হত, তাহলে যা কিছু তুমি দেখতে পাও, তা' অন্য প্রকার হত। বিজ্ঞবর লোকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন, হে বৎস। ভিক্ষাদ্বারা তোমার মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতা নষ্ট করো না। তোমার ঘৃণার কার্যদ্বারা তোমার ক্রোধের প্রতিশোধ নিও না। তোমার সম্মান বুঝে নেবে, তাহলে তোমার জীবিকা তোমার উপকার করবে। হযরত আইউব বলেছেন, এক মুহূর্তের ধৈর্য অনেক মন্দ দূর করে দেয়। একদা হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) আবু খুজাইমা এবং ফোজায়ল (রহঃ) একত্রে সংসার বৈরাগ্য সম্বন্ধে আলোচনা করতেছিলেন। তাঁরা উত্তয়ে একবাক্যে বলেছেন যে, ক্রোধের সময়ে ধৈর্য এবং লোভের সময়ে ছবর করা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত। একব্যক্তি হযরত ওমর (রাঃ) কে বললেন, আল্লাহর কসম, তুমি সত্য বিচার কর না এবং প্রচুর পরিমাণে দান কর না। হযরত ওমর (রাঃ) এ কথায় ক্রুদ্ধ হলেন। এমন কি ক্রোসের চিহ্ন তাঁর মুখমন্ডলে প্রকাশ পেল। একব্যক্তি তাঁর নিকট আরজ করল, হে আমীরুল মু'মিনীন। আপনি কি শ্রবণ করেন নি যে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ক্ষমা অবলম্বন কর। সৎকার্যে উপদেশ দাও এবং মূর্খদের নিকট থেকে মুখ ফিরাও। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তুমি সত্যই বলেছ। আমার ক্রোধ অগ্নির রূপ ধারণ করেছিল; কিন্তু এই আয়াতে সে অগ্নি নির্বাপিত হল, মুহাম্মদ ইবনে কা'ব বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ আছে তার ঈমান পূর্ণ হয়েছে। গুণ তিনটি হল, (১) আল্লাহর প্রতি ঈমান (২) যখন সে সন্তুষ্ট হয় কোন অসত্য, তাকে বের করে নিতে পারে না এবং (৩) যখন তার শক্তি থাকে, তার জন্য তা' থাকে না, তা' সেগ্রহণ করে না।

        হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) এর নিকট একব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা। আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, তুমি ক্রোধ করো না। সে বলল, আমি তা' পারব না। তিনি বললেন, যখন তোমার ক্রোধ হয়, তখন তোমার রসনা ও হস্তকে সংযত করবে।

Post a Comment

0 Comments