
রসনার পঞ্চদশ বিপদঃ পরনিন্দা রসনার বিপদসমূহের অন্যতম। পাঠক-পাঠিকা। পর-নিন্দার পাপ সম্বন্ধে শরীয়তে বহু সতর্ক বাণী এসেছে। অধিকাংশ লোকই এ কাজে লিপ্ত। খুব কম লোকই এ জঘন্য কাজ থেকে মুক্ত। আল্লাহ পাক বলেছেন, "ওয়ালা ইয়াগতাবু বা'দুকুম বা'দ্বান আইয়্যুহিব্বু আহাদুকুম আইয়্যাকুলা লাহমা আখীহি মাইতান ফাকারিহতুমূহু" অর্থাৎ তোমরা একে অন্যের নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার পচা মাংস ভক্ষণ করতে ভালবাসে? নিশ্চয়ই তোমরা তা' ঘৃণা কর। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "কুল্লুল মুসলিমি আ'লাল মুসলিমি হারামুন দামুহু ওয়া মালুহু ওয়া ইরছুহু" অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানের ধন, প্রাণ এবং সম্মান অন্য মুসলমানের জন্য হারাম।
পরনিন্দা সম্মানকে নষ্ট করে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ধন ও প্রাণের সাথে সম্মানকেও একত্র করে উল্লেখ করেছেন। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ঈর্ষা করো না, পরস্পর পরস্পরকে হিংসা করো না, পরস্পরের উপর পরস্পর ক্রয়-বিক্রয় করো না, পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ করো না এবং পরস্পরের নিন্দা করো না। আল্লাহর সমস্ত বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও। তিনি আরও বলেছেন, পরনিন্দা থেকে সতর্ক হবে। কেননা পরনিন্দা ব্যভিচার থেকেও জঘন্য পাপ। কোন ব্যক্তি ব্যভিচার করে তাওবাহ করলে আল্লাহ হয়ত তার তাওবাহ কবুল করতে পারেন; কিন্তু যে পর্যন্ত নিন্দিত ব্যক্তি ক্ষমা না করে পরনিন্দাকারীর তাওবাহ কবুল হয় না।
হযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে রাত্রে আমাকে মে'রাজে নেয়া হয়েছিল তখন আমি এমন একদল লোকের নিকট দিয়ে চলে গেলাম যারা নিজ নিজ মুখমন্ডলের অংশগুলো নিজেদের নখর দ্বারা ছিন্ন করতেছিল। তখন আমি ফিরেশতা জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব লোক কারা? সে বলল, যারা মানুষের নিন্দা করে বেড়াত এবং তাদের সম্মান নষ্ট করত। হযরত সোলায়মান ইবনে জাবেদ (রঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে আরজ করলাম, আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যাতে আমার উপকার হয়। তিনি বললেন, সৎ কার্য সামান্য হলেও তা' তুচ্ছ করো না। যদিও তা' তোমার বালতি থেকে অন্যের পাত্রে ঢেলে দেয়ার মত সামান্য হয় বা যদিও তা কোন সুসংবাদ সহ তোমার ভ্রাতার সাথে সাক্ষাতের ন্যায় সামান্য হয়।
হযরত বারা' (রাঃ) বলেছেন, একদা হুযুরে পাক (দঃ) আমাদের মধ্যে ওয়াজ করতেছিলেন। এমন কি তা' মুক্তি প্রাপ্ত দাস দাসীগণও তাদের গৃহ থেকে শুনতেছিল। তিনি বললেন, হে সমবেত জনমন্ডলী। যারা রসনার দ্বারা ঈমান এনেছে কিন্তু হৃদয়ের দ্বারা আনেনি ঐরূপ মুসলমানদেরও নিন্দা করো না এবং তাদের গোপনীয় বিষয়ের অনুসন্ধান করো না। কেননা যে মুসলমান তার মুসলমান ভ্রাতার গোপন বিষয় অন্বেষণ করে আল্লাহতায়ালা তার গোপন বিষয়ের অনুসন্ধান করবেন। আল্লাহ তায়ালা যার গোপন বিষয়ের অনুসন্ধান করেন তিনি তাকে গৃহের মধ্যেই অপমান করেন।
হযরত মুসা (আঃ)এর নিকট অহী এসেছিল, "যে ব্যক্তি পরনিন্দা থেকে তাওবাহ করে মৃত্যু বরণ করবে সে সবার শেষে বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাওবাহ চাওবাহ না করে মৃত্যু বরণ করবে সে সবার আগে দোযখে প্রবেশ করবে।
হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) একদিন সবাকে রোযা রাখার বললেন, আমি হুকুম না করা পর্যন্ত তোমরা কেউ রোযা ভাঙ্গবে না: সুতরাং ছাহাবীগণ প্রত্যেকেই রোযা রাখলেন, যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি রোযা রেখেছি। আমাকে এখন ইফতার করবার আদেশ দিন। এভাবে একজন একজন করে তাঁর নিকট উপস্থিত হতে লাগল এবং তিনি তাদেরকে একজন একজন করে ইফতার ইয়া রাসুলাল্লাহ। করবার আদেশ দিতে লাগলেন। তারপর একজন লোক এসে আরজ করল; ইয় আপনার পরিবারবর্গের মধ্যে দু'জন যুবতী স্ত্রীলোক রোযা রেখেছে। কিন্তু তারা লজ্জায় আপনার নিকট আসছে না, তাদেরকে রোযা ভাঙ্গতে নির্দেশ দিন। হুযুরে পাক (দঃ দঃ) তার দিক থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে লোকটি পুনরায় ঐরূপ আরজ করল। এভাবে তিনবার হল। তৃতীয় বারের সময় তিনি বললেন, তারা কেউই রোযা রাখে নি। তারা রোযা রেখেছে কিরূপে বলব? যখন তারা দিবসে মানুষের মাংস ভক্ষণ করেছে? তুমি তাদেরকে বল যে, যদি তারা রোযা রেখেই থাকে তবে যেন তারা বমি করে ফেলে। লোকটি তাদের নিকট গিয়ে তাদেরকে বমি করতে বললে তারা বমি করে ফেলল। হঠাৎ এক ঝলক করে জমাট রক্ত তাদের উদর থেকে পড়ে গেল। লোকটি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে তা' জানালে তিনি বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ, যদি তার এক বিন্দু রক্তও তাদের উদরে বাকী থেকে যেত তাহলে দোযখ তাদেরকে ভক্ষণ করত। অন্য বর্ণনায় আছে, যখন হুযুরে পাক (দঃ) লোকটির নিকট থেকে তার মুখ ফিরিয়ে নিলেন, সে তারপর ফিরে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর কসম, তারা মরণোন্মুখ হয়েছে। সেকথা শুনে তিনি বললেন, তাদেরকে আমার নিকট নিয়ে এস। তার কথা পালন করা হলে তিনি একটি পিয়ালা নিয়ে তাদের মধ্যে একজনকে বললেন, তুমি বমি কর। একজন তার মধ্যে রক্ত ও পুঁজ বমি করে ফলল। এমনকি তাতে পিয়ালা পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি অন্যজনকে বললেন, এবার তুমি বমি কর। সেও তদ্রূপ বমি করল। তারপর হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, এ দুজন স্ত্রীলোক আল্লাহর হালাল জিনিস ভক্ষণ করে রোযা রেখেছে বটে, কিন্তু তারা আল্লাহর হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করে রোযা ভঙ্গ করেছে। এ ঘটনার মর্ম এই যে, এদের একজন অন্যজনের নিকট বসে মৃত লোকের সহকারে তা' শ্রবণ করতেছিল।
হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন, একদা হুযুরে পাক (দঃ) উপদেশ দানকালে সুদের কথা উল্লেখ করে তাকে জঘন্য পাপ বলে মন্তব্য করে বললেন, এক দেরহাম পরিমাণ সুদ আল্লাহর নিকট ছত্রিশটি ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য পাপ। কিন্তু সর্বাপেক্ষা বড় সুদ মুসলমানের সম্মান নষ্ট করা।
হযরত জাবের (রাঃ) বলেছেন, একদা আমি হযরত রাসুলে করীম (দঃ)-এর ভ্রমণসঙ্গী ছিলাম। এ সময় তিনি দুটো কবরের পার্শ্ব দিয়ে গমন করা কালে বললেন, এ কবর দুটোর লোক দু'জনের উপর শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু কোন বড় পাপের জন্য তাদের শান্তি হচ্ছে না। একজন পরনিন্দা করত বলে তার শান্তি হচ্ছে। অন্যজন মলমূত্র ত্যাগ করে উত্তনরূপে এস্তেঞ্জা করত না বলে তার শাস্তি হচ্ছে। তারপর তিনি একটি তাজা বৃক্ষ শাখা ভেঙ্গে দু' টুকরা করতঃ এক টুকরা একটি কবরের উপর এবং অন্য টুকরা অন্য কবরের উপর গেড়ে রাখতে বললেন। আর তিনি এরূপ মন্তব্য করলেন যে, যত দিনে এ শাখা দু' খন্ড শুকিয়ে না যাবে ততদিন পর্যন্ত ও লোক দুটোর কবর আযাব কম হবে। মায়েজ (রাঃ) কে ব্যভিচারজনিত কারণে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুর আদেশ দেয়া হলে উপস্থিত এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে বলল, ঐ দেখ মায়েজ কুকুরের ন্যায় মৃত্যু বরণ করতেছে। অতঃপর হুযুরে পাক (দঃ) ঐ লোক দুটোসহ একটি মৃত দেহের নিকট দিয়ে যাওয়ার কালে তাদেরকে বললেন, তোমরা এই মৃতপ্রাণীর মাংস খাও। তারা আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ। মৃত প্রাণীর মাংস কিরূপে ভক্ষণ করা যায়? তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের ঐ ভ্রাতার যে পচা মাংস খেয়েছ তা' এর চেয়ে অধিক পচা ও দুর্গন্ধময়। ছাহাবায়ে কিরামগণ পরস্পর পরস্পরের সাথে সন্তুষ্টচিত্তে দেখাসাক্ষাত করতেন এবং তাঁরা পরনিন্দা শুনতেন না। এটাকেই তাঁরা উত্তম বলে মনে করতেন এবং এর বিপরীত কাজকে তাঁরা মুনাফিকদের কাজ বলে জানতেন।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইহলোকে তার ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করে, পরলোকেও তাকে সেই মাংস দেয়া হবে। তাকে বলা হবে, যেরূপ তুমি তার জীবিতাবস্থায় তার মাংস ভক্ষণ করেছ, এখন তদ্রূপ তার মৃতাবস্থায় তার মাংস ভক্ষণ কর। তখন সে তা' ভক্ষণ করতে, চর্বণ করতে এবং গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হবে।
বর্ণিত আছে যে, দু'ব্যক্তি কোন এক মসজিদের দরজায় উপবিষ্ট ছিল। তাদের নিকট দিয়ে স্ত্রীলোক বেশধারী একটি পুরুষ চলে যাচ্ছিল। লোকটি হঠাৎ স্ত্রীলোকের বেশ খুলে ফেলল। তখন লোক দুটি বলল, ঐ লোকটির ভিতর এখনও স্ত্রীলোকের স্বভাবের কিছু অবশিষ্ট আছে। তখন নামাযের একামত হয়ে গেলে তারা মসজিদে প্রবেশ করে জামাতে নামায আদায় করল। কিন্তু নামাযের মধ্যে তাদের ঐ কথা মনে পড়ল। তারপর তারা হযরত আতা (রহঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে এ বিষয় ব্যক্ত করল। তখন তিনি তাদেরকে পুনরায় অজু করে নামায পড়তে এবং রোযা রাখতে আদেশ দিলেন।
হযরত মুজাহিদ (রাঃ) "ওয়াইলুল্লি কুল্লি হুমাযাতিল লুমাযাতিনিল্লাযী" আয়াতের 'হুমাযাত' শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন, মানুষের মধ্যে অপবাদকারী এবং লুমাযাত শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন, মানুষের মাংস ভক্ষণকারী। অর্থাৎ অপবাদকারী ও পরনিন্দাকারীর জন্য আক্ষেপ। হযরত কাতাদাহ (রহঃ) বলেছেন, কবর আযাব তিন প্রকার। এক প্রকার আযাব পরনিন্দার জন্য হয়। দ্বিতীয় প্রকার আযাব একজনের কথা অন্যজনের নিকট বলে দেওয়ার কারণে হয়। তৃতীয় প্রকার আযাব প্রস্রাব করবার কালে পবিত্রতার দিকে লক্ষ্য না করবার কারণে হয়
হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম মুসলমানের ধর্মের ক্ষেত্রে পর কুপ্রভাব পতিত হয় তা' শরীরের বসন্তের ফোসকা থেকেও দ্রুত প্রসারলাভকারী। জনৈক বিজ্ঞ বুযর্গ বলেছেন, আমরা আমাদের পূর্ববর্তী বুযর্গদের দেখেছি তারা রোযা ও নামাযকে যতটা না ইবাদাত মনে করতেন, পরনিন্দ্য ত্যাগ করাকে তার চেয়ে অনেক বড় ইবাদাত মনে করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, তুমি যখন তোমার সঙ্গীর দোষ উল্লেখ করতে ইচ্ছে কর, তখন নিজের দোষের কথা উল্লেখ করবে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি তার ভ্রাতা মুসলমানের যে চোখের মধ্যে সামান্য ধূলা পতিত হলেও তা' দেখতে পায়। কিন্তু সে নিজের চোখের কঠিন প্রদাহ রোগও দেখতে পায় না।
হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলতেন, হে আদম সন্তান! তুমি ঈমানের প্রকৃত পরিচয় পাবে না, যে পর্যন্ত তোমার মধ্যে যে দোষ আছে সে দোষের জন্য মানুষকে নিন্দা কর এবং যে পর্যন্ত তা' সংশোধন করতে গিয়ে প্রথমে নিজেকে সংশোধন না কর। যখন নিজেকে সংশোধন কর তখন তা-ই তোমাকে ব্যস্ত রাখবে। যে ব্যক্তি নিজের সংশোধনে এভাবে নিযুক্ত থাকে, সে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হয়। হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন, একদা হযরত ঈসা (আঃ) স্বীয় শিষ্য সমভিব্যাহারে একটি মৃত কুকুরের দেহের নিকট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন শিষ্যগণ বলে উঠল, মৃত কুকুরটির কি পচা দুর্গন্ধ। তখন হযরত ঈসা (আঃ) বললেন, কিন্তু দেখতো তার দন্তপংক্তির শুভ্রতা কি সুন্দর। একথা দ্বারা তিনি প্রকারান্তরে শিষ্যদেরকে কুকুরের নিন্দা করতে নিষেধ করলেন এবং তাদেরকে এ বিষয়ে সজাগ করে দিলেন যে, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির মধ্যে সুন্দর ব্যতীত কোন পদার্থই সুন্দর ব্যতীত' নেই। একদা হযরত হোস্কায়েন (রাঃ) এর পুত্র হযরত যয়নাল আবেদীন (রহঃ) এক ব্যক্তিকে অন্য এক ব্যক্তির নিন্দা করতে দেখে বললেন, পরনিন্দা থেকে সতর্ক হও। কেননা পরনিন্দা মানবরূপী কুকুরের ব্যঞ্জনসদৃশ। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর যিকির করবে। কেননা তা' ওষুধস্বরূপ। তোমরা মানুষের কথা আলোচনা করো না, কেননা তা' রোগসদৃশ। আমরা আল্লাহর নিকট এ বিষয় তাওফীক প্রার্থনা করি।
0 Comments