প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নত থেকে অ তাদেরকে আলো ও অভিজ্ঞতার ফল লাভ করা যায় তা-ই আমাদে অর্জিত যে অন্তর্দৃষ্টির মৃত লোকের অবস্থা এবং তাদের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের বিষয় জানিয়ে দেয়। তবে সাধারণ লোকের যথা যায়েদ ও আমরের অবস্থা মূলতঃ অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা জানা যায় না। কেননা যদি আমরা যায়েদ ও আমরের ঈমানের উপর বিশ্বাস করি আমরা জানি না তারা কোন অবস্থার উপর প্রাণত্যাগ করেছে এবং তাদের খাতেমা বিল খায়ের হয়েছে কিনা। যদিও আমরা তাদের প্রকাশ্য পুণ্য দেখি, তাদের আল্লাহ ভয়ের স্থানটি দেখি না। কেননা তার স্থান হৃদয়, তা' গুপ্ত। তা' এত গুপ্ত ও সূক্ষ্ম যে, তা' আল্লাহভীরু ব্যক্তির নিকটও গুপ্ত থাকে। অন্যের নিকট ত কথাই নেই। গুপ্ত আল্লাহ-ভয় ব্যতীত শুধু প্রকাশ্য আল্লাহ-ভয়ের উপর বিধান দেয়া যায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, "ইন্নামা ইয়াতাক্বাব্বালুল্লাহু মিনাল মুত্তাক্বীন" অর্থাৎ আল্লাহতম্মালা আল্লাহভীরুদের নিকট থেকে কবুল করেন; সুতরাং যায়েদ ও আমরের অবস্থার বিধান তাদের আল্লাহ ভয়ের অবস্থা না দেখে দেয়া যায় না।
যখন কারও মৃত্যু হয় তখন জড় জগত থেকে অদৃশ্য করে তাকে আধ্যাত্মিক জগতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা তাঁ' দেখা যায় না। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের মধ্যে সেই চক্ষু সৃষ্টি হয় এবং মানুষ তার উপর পর্দা মোহের ঘন বস্ত্র এবং পার্থিব আসক্তি দিয়ে তা' আবৃত করে রেখেছে, এজনই সে দেখতে পায় না। আধ্যাত্মিক জগতের কোন বস্তু এই বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না, যে পর্যন্ত সে পর্দা কলবের চক্ষুর উপর থেকে অপসারিত না হয়। সেই পর্দা নবীদের হৃদয় চক্ষু থেকে অপসারিত হয় বলে তারা আধ্যাত্মিক জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারেন এবং আধ্যাত্মিক জগতের নানাবিধ আশ্চর্য বিষয়বস্তু এবং মৃতাত্মাদেরকে দেখে থাকেন। তারা তা' দেখে আমাদেরকে সংবাদ দেন। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) সা'দ ইবনে মুআয (রাঃ) এবং তাঁর কন্যা জয়নাবের ক্ষেত্রে মাটির চাপের বিষয় দেখেছিলেন। তদ্রূপ হযরত জাবেরের পিতা যখন শহীদ হয়েছিলেন, তখন তিনি জাবেরের অবস্থা দেখে বলে দিয়েছিলেন যে, অ্যল্লাহতায়ালা তাকে তাঁর সম্মুখে বসিয়েছিলেন এবং তাঁদের উভয়ের মধ্যে কোন পর্দা ছিল না। এরূপ চাক্ষুষ দর্শন নবীগণ এবং নবীগণের নিকটবর্তী আল্লাহর বন্ধুগণ ব্যতীত অন্য কারুরই নছীব হয় না।
স্বপ্নে দর্শনঃ প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। আমাদের ন্যায় লোকের স্বপ্নে দর্শন সম্ভব কিন্তু তা' দুবল। মূলতঃ স্বপ্নে দর্শন নবীদের দর্শনের একটি পন্থা। তা' নবুয়তের আলোর একটি অংশ। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছিচল্লিশ অংশের এক অংশ। তাও আবার হৃদয় থেকে পর্দা অপসারণ না করলে তা' অর্জিত হয় না। এজন্যই সৎ লোকের স্বপ্ন ব্যতীত বিশ্বাস করা যায় না। যার মিথ্যা অধিক, তার স্বপ্ন বিশ্বাস করা যায় না। যে অধিক অশান্তি সৃষ্টি করে ও যার পাপ অধিক, সে তার আত্মাকে অত্যাচার করে; সুতরাং সে যা' দেখে তা' বাজে ও এলোমেলো স্বপ্ন।
হযুরে পাক (দঃ) এ কারণেই অজু করে নিদ্রা যাওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন, যেন সে পবিত্রাবস্থায় নিদ্রা যেতে পারে। এতে আভ্যন্তরীণ পবিত্রতার দিকেও ইঙ্গিৎ করা হয়েছে। তা-ই মূল পবিত্রতা। প্রকাশ্য পবিত্রতার উদ্দেশ্য আন্তরিক পবিত্রতা আনয়ন। যখন অন্তর পবিত্র হয়, তখন ভবিষ্যতে কি ঘটবে, তা' হৃদয়ের মধ্যে প্রকাশ পায়, যেরূপ হুযুরে পাক (দঃ) স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি মক্কা মুয়াযযামায় প্রবেশ করেছেন। আল্লাতায়ালা এই প্রসঙ্গে বলেনঃ "লাবাদ ছাদাচ্ছাল্লাহ রাসূলুহুররুইয়া বিল হাকুত্ত্বি।" অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর রাসুলের স্বপ্নকে সত্য প্রমাণ করেছেন। অতি অল্প লোকই স্বপ্ন থেকে মুক্ত থাকে, এমন স্বপ্ন যা সত্যে পরিণত হয়। স্বপ্ন এবং ভবিষ্যতের বিষয় স্বপ্নে অবগত হওয়া আল্লাহর একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার এবং মানুষের স্বাভাবিক একটি অলৌকিক ব্যাপার। এটাই আধ্যাত্মিক জগতের অস্তিত্বের একটি স্পষ্ট প্রমাণ কিন্তু মানুষ তা' লক্ষ্য করে না, যেরূপ সে হৃদয়ের অলৌকিক ঘটনা সম্বন্ধে লক্ষ্য করে না। স্বপ্নের প্রকৃতি পরিচয় আধ্যাত্মিক বিদ্যার সূক্ষ্ম তত্ত্বের অন্তর্গত। এই ব্যবহারিক বিদ্যা দ্বারা তা' প্রকাশ্যভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়; কিন্তু তার আংশিক ব্যাখ্যা সম্ভব হইতে পারে। একটি দৃষ্টান্ত তা' আংশিক ব্যাখ্যা করতে পারে। তা এইঃ
আত্মা আয়নার ন্যায় স্বচ্ছ পদার্থ। প্রত্যেক ব্যাপারের প্রকৃত পরিচয় এবং আকৃতি তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। সৃষ্টি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যা ঘটবে তা' মহান আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তার নাম কখনও লাওহে মাহফুজ, কখনও প্রকাশ্য অদৃশ্য লিপ্পি, কখনও প্রকাশ্য ইমাম বলে কুরআনে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দুনিয়ায় যা ঘটেছে বা ঘটবে, তা' সবই তাতে লিপিবদ্ধ আছে বা চিত্র করা আছে। তা এই বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না। মনে করো না যে, সেই লাওহে মাহফুজ একটি তক্তা বা লৌহ দ্বারা নির্মিত অথবা তা' একটি কিতাব যা কাগজ বা পাতার দ্বারা পূর্ণ, সরাসরিভাবে বুঝে নাও যে, আল্লাহর লাওহে মাহফুজ এই জড় জগতের তক্তা নয়, অথবা আল্লাহর কিতাব নয়, যেরূপ তার অস্তিত্ব ও গুণাবলী মানুষের অস্তিত্ব ও গুণাবলীর ন্যায় নয়। তবে যদি তার দৃষ্টান্ত তালাস কর, তা' তোমার বুঝে আসার নিকটবর্তী হবে।
পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ যে, লাওহে মাহফুজে অদৃষ্টলিপি মুখস্তকারীর মস্তিস্কের মধ্যে এবং মনের মধ্যে কুরআনে পাক এবং তার অক্ষরগুলি অঙ্কিত থাকার ন্যায়। যখন সে তা' পড়তে থাকে। সে তার দিকে লক্ষ্য করে। যদি তার মস্তিষ্ক খুলে তন্ন তন্ন করা হয় তার মধ্যে কোন চিত্র বা অক্ষরের অঙ্কন দেখতে পাবে না। যদি তার মধ্যে কোন অক্ষরের অঙ্কন না দেখা যায় তাহলেও বিশ্ব সংসারের সমস্ত ব্যাপার যে, লাওহে মাহয় এরূপভাবে বুঝে নেবে, বাহ্যিক চিত্র যেরূপ আয়নার সম্মুখে রাখলে আয়নায় তা' দেখা যায়, লওহে মাহফুজের চিত্রও হৃদয় আয়নার সামনে রাখলে হৃদয় আয়নায় তা' প্রকাশিত হয়। তবে আয়নার উপর ময়লা বা পর্দা থাকলে যেরূপ তা' দেখা যায় না, তদ্রূপ হৃদয় আয়নার উপর । মোহ বা সংসারাসক্তিরূপ বা পাপরূপ ময়লা থাকলে লাওহে মাহফুজের চিত্র তার উপর প্রতিফলিত হয় না।
হৃদয় একটি আয়না স্বরূপ। তার মধ্যে জ্ঞানের প্রভাব পতিত হয়। লাওহে মাহফুজও একটি আয়না স্বরূপ। তার মধ্যে সমস্ত জ্ঞানের প্রভাব পতিত হয়ে আছে। হৃদয়ের উপর লো লোভ ও এজন্য লাওহে মাহফুজের মধ্যে কি আছে মোহের প্রভাব এই দুই আয়নার মধ্যে পর্দার স্বরূপ। এই তা' এই আত্মার মধ্যে প্রতিফলিত হয় না। তা' আধ্যাত্মিক রাজ্যের অন্তর্গত। যদি বায়ু প্রব দরুন এই পর্দা কিছু অপসারিত হয় তখন হৃদয় আয়নায় আধ্যাত্মিক জগত থেকে বিদ প্রবাহের বিদ্যুতের ন্যায় কিছু প্রতিফলিত হয়। তবে প্রতিফলিত হয়ে দীর্ঘ সময় থাকে বা থাকে না। যে পর্যর সর্যন্ত সে জাগ্রত থাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় তাকে এই জড়জগতের ব্যাপার দ্বারা ব্যস্ত রাখে, তা-ই আধ্যাত্মিক জগতের অন্তরায় বা পর্দা। নিদ্রার অর্থ এই ইন্দ্রিয়গুলি নিস্তেজ হয়ে থাকা। তা' আত্মার উপর কিছু প্রভাব বিস্তার করে না। যখন হৃদয় এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং কল্পনা থেকে মুক্ত হয় আর তার মূলও পরিষ্কার ও নির্মল হয়, তখন লাওহে মাহফুজও তার মধ্যবর্তী পর্দা উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তার হৃদয়ে লাওহে মাহফুজ থেকে কিছু চিত্র পতিত হয়। যেরূপ এক আয়নার ছবি চিত্রহীন অন্য আয়নায় পড়লে ছবির কিছু দেখা যায়। নিদ্রা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্য থেকে মনকে অবসর রাখে। কিন্তু কার্যের খেয়াল থেকে মুক্ত রাখলে হৃদয়ে যা পতিত হয় কল্পনা তার দিকে ছুটে যায়। এর দৃষ্টান্ত এর নিকটবর্তী বস্তুর দ্বারা দেয়া যায়। এই কল্পনা মস্তিষ্কের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তা' স্থায়ী আসন গ্রহণ করে। যখন সে জাগ্রত হয় তখন সেই কল্পনাকে স্মরণ করে এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারীর এই কল্পনার দিকে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। যারা স্বপ্ন ব্যাখ্যা বিদ্যায় পারদর্শী তাদের নিকট এই দৃষ্টান্ত স্পষ্ট।
তোমার জন্য একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে। তা এইঃ এক ব্যক্তি হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) কে বলেছিল, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমার হাতে একটি মোহর আছে। তদ্দ্বারা আমি মানুষের মুখ এবং রমণীদের স্ত্রী অঙ্গ মোহর করছি। ইবনে সীরীন বললেন, তুমি মুয়াযযিন, ফজরের পূর্বে রমযানের মাসে আযান দেবে। সে বলল, আপনি সত্য বলেছেন। এখন লক্ষ্য কর, মোহরের প্রকৃত অর্থ নিষেধ করা। তজ্জন্যই তাকে মোহর বলা হয়। লাওহে মাহফুজে যা' আছে তা' থেকে লোকটির অবস্থা হৃদয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। লোকদেরকে পানাহার করতে নিষেধ করা-ই সেই বস্তু।
সীলমোহর দ্বারা আবদ্ধ করার অর্থ নিষেধ করা; সুতরাং ধারণাজনিত আকৃতির দ্বারা তার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তা-ই প্রকৃত অর্থ। এই ধারণাজনিত চিত্র ব্যতীত মস্তিষ্কের মধ্যে আর কিছুই যাকে না। স্বপ্ন জ্ঞানসমুদ্রের এটা-ই সামান্য ব্যাখ্যা। সেই সমুদ্রের আশ্চর্য ব্যাপার সীমাবদ্ধ নয়। তা' কেন সীমাবদ্ধ থাকবে, যখন নিদ্রা মৃত্যুর ভ্রাতা এবং মৃত্যু আশ্চর্য বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম। স্বপ্ন এবং মৃত্যুর মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। কেননা উভয়ের মধ্যে অদৃশ্য জগতের আভাস পাওয়া যায়। এমন কি নিদ্রিত ব্যক্তি ভবিষ্যতে কি হবে তা' জানতে পারে। মৃত্যুতে সম্পূর্ণরূপে সেই বস্তু উন্মোচিত হয়। এমন কি মানুষ নিজের প্রাণ যাবার সময় অতি দ্রুত নিজেকে অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্যে দেখতে পায়। আমরা আল্লাহর নিকট তা' থেকে আশ্রয় চাই। অথবা সে নিজেকে স্থায়ী সুখ এবং বিস্তৃত স্থানের মধ্যে দেখতে পায় যার শেষ নেই। এ সময় দুর্ভাগ্যশীলদেরকে বলা হয়, "লাক্বাদ কুনতা ফী গাফলাতিম মিন হাযা ফাকাশাফনা আনকা নিত্বায়াকা ফাবাছারুকাল ইয়াওমা হাদীদ।" অর্থাৎ তুমি এই অবস্থা থেকে অসতর্ক ছিলে। তোমার নিকট থেকে পর্দা দূর করে দিয়েছি। অদ্য তোমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাকে বলা হবে, এটা কি যাদু, না কি তোমরা দেখছ না? তোমরা তাতে প্রবেশ কর। তোমরা ধৈর্যধারণ কর বা না-ই কর, তোমাদের জন্য সব সমান। তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল পাবে। এতে আল্লাহর এই আয়াতের দিকে ইঙ্গিত আছে "ওয়া বাদা লাহুম মিনাল্লাহি মালাম ইয়াকুনু ইয়াহতাসিবুন"। অর্থাৎ তারা যা কল্পনা করতে পারেনি আল্লাহর নিকট থেকে তা-ই তাদের নিকট প্রকাশ পায়। যে ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ও বিবেচক তার নিকট মৃত্যুর পর এমন আশ্চর্য বিষয় ও চিহ্নসমূহ প্রকাশ পাবে, যা সে কখনও কল্পনা করতে পারেনি বা কখনও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। যদি কোন জ্ঞানী লোকের সেই বিপদের অবস্থার চিন্তা ব্যতীত কোন দুঃখ ও কষ্ট না থাকে এবং অনুসন্ধান করে যে, পর্দা কোন বস্তু থেকে উঠবে, স্থায়ী দুর্ভাগ্য থেকে বা সৌভাগ্য থেকে। তাহলে এই চিন্তা-ই তার সারা জীবনের জন্য যথেষ্ট। এটা বড়ই বিশ্বয়ের ব্যাপার যে, এই বিষয় আমাদের সম্মুখে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমরা উদাসীন।
এ থেকেও অধিক বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, আমরা আমাদের ধন-দৌলত, পরিজনবর্গ, বিষয় সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি নিয়ে মত্ত হয়ে আছি; বরং আমরা আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চক্ষু ও কর্ণতেও লিপ্ত আছি। যদিও আমরা জানি যে, এসব বস্তুকে আমাদের নিশ্চয় ত্যাগ করতে হবে। ঐ ব্যক্তি কোথায় যার হৃদয়ের মধ্যে পবিত্র আত্মার ফুৎকার দেয় এবং বলে, যা নবীশ্রেষ্ঠ বলেছেন, যা ইচ্ছা ভালবাস কিন্তু তা' তোমার ত্যাগ করতেই হবে। যতদিন ইচ্ছা জীবিত থাক, কিন্তু তোমাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। যা ইচ্ছা কর, তার প্রতিফল পেতেই হবে। যখন তোমার নিশ্চয়তার চোখের সামনে তা' প্রকাশ পাবে, তুমি দুনিয়ায় মুসাফিরের ন্যায় থাকবে। এক ইটের উপর আর এক ইট রাখবে না এবং এক কাষ্ঠের উপর অন্য কাষ্ঠ রাখবে না। দীনার ও দিরহাম রাখতে যাবে না। অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে কাউকে গ্রহণ করবে না। সত্য বটে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছিলেন, আমি যদি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম তবে আবুবকরকে গ্রহণ করতাম, কিন্তু তোমাদের সঙ্গী করুণাময়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এতে দেখা যায় করুণাময়ের বন্ধুত্ব তাঁর হৃদয়ের অন্তস্থলে অবস্থিত ছিল এবং তার ভালবাসাই হুযুরে পাক (দঃ)এর অন্তরের মধ্যে অন্যের জন্য ভালবাসার স্থান বাকী রাখেনি। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর উম্মতগণকে বলেছেন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছে, "ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনী ইয়ুহবিকুমুল্লাহু।"
যে হুযুরে পাক (দঃ)-এর অনুসরণ করে, সে তাঁর উম্মত। যে দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে আখেরাতের দিকে অগ্রসর হয় সে-ই তাঁকে অনুসরণ করে। সে আল্লাহ ও আখেরাত ব্যতীত তা' ত্যাগ করে না এবং সংসারও তার সুখ-সম্পদ যা সে ত্যাগ করে তা' ঐ পরিমাণ অনুযায়ী হয়, যে পরিমাণ সে দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে আখেরাতের দিকে অগ্রসর হয়। তিনি যে পথে চলেছেন সে সেই পথে চলে, যে পরিমাণ সে তাঁর পথে চলে সে সেই পরিমাণ তাঁর অনুসরণ করে, যে অনুসরণ করে না, সেই পরিমাণ সে তার পথ থেকে সরে পড়ে এবং তাঁর প্রতি অনাসক্ত হয় এবং "ঐ লোকের সাথে একত্র হয়; যাদের সম্বন্ধে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ফাআম্মা মান ত্বাগা ওয়া আারাল হাইওয়াতাদ্দুনিয়া ফাইন্নাল জাহীমা হিয়াল মা'ওয়া।" অর্থাৎ যে ব্যক্তি নাফরমানী করে এবং পার্থিব জীবনকে পছন্দ করে তার বিশ্রামাগার দোষখ। যদি তুমি ভ্রান্ত পথ থেকে বের হও এবং নিজের সুবিবেচনা কর তুমি নিশ্চয়ই জানতে পারবে যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি এই পার্থিব সুখ-সম্পদের জন্য অনবরত চেষ্টা করছ। তোমার বিচরণ শুধু সংসারের জন্য। তুমি আশা কর যে, আগামী কল্য হুযুরে পাক (দঃ)এর অনুসরণকারী এবং প্রকৃত উম্মত হতে পারবে। তোমার ধারণা কত দূরবর্তী, তোমার আশা কত মন্থর। আমি কি মুসলমানদেরকে অপরাধির ন্যায় করিনি? তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা সুবিচার করছ না?
এখন আমরা আমাদের মূল কথায় প্রত্যাবর্তন করব। কেননা আমরা আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। অতএব আমাদের বর্ণনার কলেবর আর দীর্ঘ না করে এবার আমরা আমাদের মূল বিষয়ে ফিরে আসছি। আমরা মৃত ব্যক্তির অবস্থা স্বপ্নে প্রকাশ পাওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করব। এর উপকার অনেক অধিক। কেননা নবুওত শেষ হয়ে গেছে, এখন শুধু সুসংবাদ অর্থাৎ সত্যস্বপ্ন অবশিষ্ট আছে।
0 Comments