খোলাফায় রাশেদীনের প্রথম খলীফা হযরত আবুবকর (রাঃ) যিনি হুযুরে পাক (দঃ) এর শ্রেষ্ঠতম সহচর-তাঁর যখন অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত হল, তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর নিকটে ছিলেন। তিনি তাঁর পিতার মৃত্যু আগমনে এই কবিতাটি আবৃত্তি করলেনঃ
জীবনের শপথ, এই পার্থিব জীবন
নিশার স্বপন ব্যতীত আর কিছু নয়
ধনবল, জনবল সব কিছু বৃথা
যখন মৃত্যু-শমন উপস্থিত হয়।
মৃত্যুপথযাত্রী হযরত আবুবকর (রাঃ) স্বীয় মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, মাতঃ। ও কথা বল না বরং বল, "অ জায়াত সাকরাতুল মাওতি বিল হাকুক্তি যালিকা মা কুনতা মিনহু তাহীদ" অর্থাৎ মৃত্যু যন্ত্রণা সত্য সত্য উপস্থিত হয়েছে, এ থেকে তোমাকে সতর্ক করা হয়েছে। মা আমার এই বস্ত্র দুখানা দেখ, এ দুখানা পরিষ্কার করে নিয়ে এর দ্বারাই আমার কাফনের ব্যবস্থা কর। কেননা মৃতের চেয়ে জীবিত লোকেরই নতুন বস্ত্রের অধিক প্রয়োজন। হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর পিতার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে নিম্নোক্ত পংক্তি দুটোও আবৃত্তি করলেনঃ
সৌম্য প্রশান্ত, উজ্জ্বল মুখমণ্ডল
আর বারিধারা ধৌত সুন্দর চেহারা
এরই কাছে নিত আশ্রয় অনাথিনী নারী,
ইয়াতিম, দুঃস্থ ও অভাব পীড়িত যারা।
কন্য আয়েশা (রাঃ)এর মুখে এরূপ প্রশস্তি শুনে হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, মা। তুমি যা বললে এ সবই তো আল্লাহর রাসূল (দঃ) এর গুণ। লোকজন এসে হযরত আবুবকর (রাঃ)এর নিকট অনুমতি চাইল, খলীফা। আমরা আপনার জন্য কোন চিকিৎসক ডাকব কি? তিনি বললেন, আমার প্রকৃত চিকিৎসক আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে কি বলেছেন জান কি? তিনি বলেছেনঃ "ইন্নী ফাঅ্যালুল লিমা ইয়ুরীদ" অর্থাৎ আমি যা ইচ্ছা করি, তা-ই করি। হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)কে দেখতে এসে বললেন, হে খলীফা! আপনি আমাদেরকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য দুনিয়া উন্মুক্ত করে দেবেন। তন্মধ্যে যা তোমাদের প্রয়োজন, তা-ই তোমরা গ্রহণ করবে। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি ফজরের নামায আদায় করে, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে। তোমরা আল্লাহর যিম্মাকে সামান্য মনে করো না, যদি তা-ই মনে কর, তবে তোমাদের মুখমন্ডলের উপর তোমাদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।
যখন হযরত আবুবকর (রাঃ)এর রোগ আশংকাজনক অবস্থায় পৌছে গেল এবং লোকগণ পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করল, তিনি তখন হযরত ওমর (রাঃ) কে খলীফা মনোনীত করলেন। তখন লোকগণ বললেন, আপনি আমাদের উপর একজন এমন কড়া মেজাযী ও রুক্ষ প্রকৃতিবিশিষ্ট লোককে খলীফা মনোনীত করলেন? হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর নিকট বলব যে, হে মাবুদ! আমি তোমার বান্দাদের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য এবং উত্তম লোককে তাদের উপর খলীফা মনোনীত করে এসেছি। তারপর তিনি হযরত ওমর (রাঃ) কে তাঁর নিকট নিয়ে আসার জন্য তাঁর নিকট লোক পাঠালেন। যথাসময়ে তিনি উপস্থিত হলে তাঁকে লক্ষ্য করে খলীফা বললেন, ওমর। আমি তোমাকে একটি অছিয়ত করছি। জেনে রাখবে, দিবসে আল্লাহর প্রতি তোমার যা' কর্তব্য আছে, তিনি তা' রাত্রে কবুল করেন না। তোমার আল্লাহর প্রতি রাত্রে যে কর্তব্য আছে, তিনি তা' দিবসে কবুল করেন না। ফরজ কার্য আদায় না করা পর্যন্ত তিনি নফল কার্য গ্রহণ করেন না। দুনিয়ায় সত্যানুসরণ করে চললে রোজ কিয়ামতে যাদের পাল্লা ভারী হবে, তাদের পাল্লা ভারী-ই থাকবে। পাল্লার কর্তব্য এই যে তন্মধ্যে সত্য স্থাপন করলে তা' ভারী হবে। ব্যর্থ বস্তু অনুসরণ করার ফলে যাদের মীযান রোজ কিয়ামতে হালকা হবে, তাদের মীযান হালকা-ই থাকবে, আল্লাহতায়ালাও তাদের উপর তা' হালকা করবেন। মীযানের কর্তব্যই এই যে, কোন ব্যর্থ বস্তু তাতে স্থাপন করা হলে তা' হালকা হবে। আল্লাহতায়ালা বেহেশতবাসীকে উত্তম কার্যের জন্য বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন যে, তিনি তাদের পাপরাশিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা রহমতের ও শাস্তির আয়াতের উল্লেখ করেছেন, যেন মুমিন ব্যক্তি আখেরাতে আগ্রহান্বিত ও সংসারত্যাগী হয়। তার নিজের হাত দ্বারা সে যেন ধ্বংসের দিকে নিজেকে নিক্ষেপ না করে এবং সত্য ব্যতীত আল্লাহর নিকট আর কিছু আশা না করে। যদি আমার এই অছিয়ত রক্ষা কর, তা' হলে মৃত্যুর চেয়ে তোমার নিকট অন্য কোন অদৃশ্য বস্তু অধিক প্রিয় হবে না। মৃত্যু তো তোমার নিকট আসবেই। যদি আমার অছিয়ত নষ্ট কর, তোমার নিকট মৃত্যুর চেয়ে অন্য কোন অদৃশ্য বস্তু অধিক অপ্রিয় হবে না। মৃত্যু তোমার নিকট আসবেই, তুমি তা' ব্যর্থ করে দিতে পারবে না।
হযরত সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব (রহঃ) বলেছেন, যখন হযরত আবুবকর (রাঃ) এর মৃত্যু নিকটবর্তী হল, ছাহাবীগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে রাসূলের খলীফা। আপনি আমাদেরকে উপদেশ দিন। মনে হয় আপনি আমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি এইসব কথা বলে প্রাণত্যাগ করে, আল্লাহ তার প্রাণ প্রকাশ্যে শূন্যে রেখে দেন। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, প্রকাশ্য শূন্য কাকে বলে? তিনি বললেন, আরশের সম্মুখে এক বিস্তৃত ময়দান, তার মধ্যে আল্লাহর উদ্যান, নদনদী ও বৃক্ষরাজি রয়েছে। প্রত্যহ একশ করুণা তা' আবৃত করে রাখে। যে ব্যক্তি এই কথা বলে, আল্লাহ তার রুহকে সেই স্থানে রাখেন। হে মাবুদ। তুমিই সৃষ্টকে সৃষ্টি করেছ, এদের দ্বারা তোমার কোনই প্রয়োজন ছিল না। তারপর তুমি তাদেরকে দু' ভাগে বিভক্ত করেছ। একভাগ বেহেশতের জন্য এবং অন্য ভাগ দোযখের জন্য। আমাকে বেহেশতের ভাগে ফেল, দোযখের ভাগে ফেল না। হে মাবুদ। তুমি সৃষ্টিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে সৃষ্টি করেছ এবং তাদেরকে সৃষ্টি করার পূর্বে তাদের মধ্যে পার্থক্য করেছ। তুমি তাদের দুর্ভাগ্যশীল, সৌভাগ্যশীল, পথপ্রাপ্ত, পথভ্রষ্ট করেছ, আমাকে তুমি পাপ দ্বারা দুর্ভাগ্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করো না।
হে মাবুদ। তুমি কোন ব্যক্তিকে সৃষ্টি করার পূর্বে সে কি কি অর্জন করবে, তুমি তা' জান, তোমার ইবাদাতে যাদেরকে তুমি নিমগ্ন রাখবে, আমাকে তাদের অন্তর্গত কর, হে মাবুদ! তুমি ইচ্ছা না করা পর্যন্ত কোন লোক কোন ইচ্ছা করে না। হে মাবুদ! আমি তোমার নিকট সেই বস্তু চাই, যা আমাকে তোমার নিকটবর্তী করে দেয়। হে মাবুদ! তুমি মানুষের চলার বিধান দিয়েছ। কোন বস্তুই তোমার অনুমতি ব্যতীত নড়াচড়া করে না। আমার চলাচলকে তোমার ভয়ের মধ্যে স্থাপন কর। হে মাবুদ! তুমি ভাল ও মন্দ সৃষ্টি করেছ এবং প্রত্যেকটির জন্য লোক সৃষ্টি করেছ। আমাকে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে উত্তম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত কর। হে মাবুদ! তুমি বেহেশত ও দোযখ সৃষ্টি করেছ এবং এতদুভয়ের জন্য অধিবাসীও সৃষ্টি করেছ। আমাকে তোমার বেহেশতের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত কর। হে মাবুদ! তুমি একদল লোককে পথভ্রষ্ট করতে ইচ্ছা কর ও তাদের বক্ষ সংকীর্ণ কর। আমার বক্ষ ঈমানের জন্য প্রসারিত কর এবং তাকে আমার হৃদয় মধ্যে সুশোভিত কর। হে মাবুদ। তুমিই সব ব্যাপারের সুবন্দোবস্ত কর এবং তোমার নিকট প্রত্যাবর্তন করাও, মৃত্যু দ্বারা আমাকে পবিত্র জীবন দিও এবং তোমার অতীব নিকটবর্তী করো। হে মাবুদ! যে কোন ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় অন্যের আশা নিয়ে কালযাপন করে কিন্তু আমার আশা ও ভরসা তুমি। তোমার শক্তি ও সামর্থ্য ব্যতীত আর কারও শক্তি ও সামর্থ্য নেই। হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেছেন এই উপদেশ সবই আল্লাহর কিতাবে আছে।
0 Comments