হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ এর শাহাদাত লাভ

            হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যার বিবরণ সুবিদিত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেছেন যে, আমি এবং আমার ভ্রাতা খলীফা ওসমান (রাঃ) কে সালাম দেয়ার জন্য এসেছিলাম, তখন তিনি বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিলেন, আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হলে তিনি বললেন, হে ভ্রাতঃ! তোমাকে অভ্যর্থনা! আমি আজ রাত্রে হুযুরে পাক (দঃ) কে স্বপ্নে দেখলাম, তিনি বলছেন, হে ওসমান। তারা তোমাকে অবরুদ্ধ করেছে? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তারা তোমাকে পানি পান করতে দেয়নি? আমি বললাম, হাঁ দেয়নি। তখন তিনি আমকে একপাত্র ভর্তি পানি দিলে আমি তা' প্রাণভরে পান করলাম। এমন কি তাতে আমার স্কন্ধ ও বক্ষ শীতল হয়ে গেল। তিনি বললেন, যদি তুমি ইচ্ছা কর, আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে সাহায্য করব। আর যদি তুমি ইচ্ছা কর, তবে আমার সাথে ইফতার করবে। আমি তাঁর সাথে ইফতার করব বললাম, ঐদিনই তাঁকে হত্যা করা হল। 

        হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ঐ লোকদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যারা হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যার সময়ে উপস্থিত ছিল যে, হযরত ওসমান (রাঃ) নিহত হওযার সময়ে কি বলেছিলেন? তারা বলল, আমরা তাঁকে বলতে শুনেছিলাম, হে মাবুদ। হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর উম্মতকে একতাবদ্ধ কর। এই কথা তিন বার বলেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেছেন, যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ, যদি তিনি দোয়া করতেন যে, তারা কখনও যেন একতাবদ্ধ না হয়, তবে কিয়ামত পর্যন্তও একতাবদ্ধ হত না।

         হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর বলেছেন, যে সময় হযরত ওসমান (রাঃ) গৃহের ছাদের উপর থেকে নিচে জনতার দিকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন আমিও তাদের মধ্যে ছিলাম। তিনি বিদ্রোহী জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদেরকে যে দুই ব্যক্তি এখানে সমবেত করেছে, তাদেরকে আমার নিকট পাঠাও। তাদেরকে পাঠানো হলে তারা উষ্ট্র অথবা গর্দভের ন্যায় উপস্থিত হল। হযরত ওসমান (রাঃ) জনতার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আল্লাহর নামে এবং ইসলামের নামে তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করছি, তোমরা কি জান না যে, মদীনার মসজিদে নবুবীতে মুছল্লিদের সঙ্কুলান হত না, তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে অমুক ব্যক্তির উদ্যান খরিদ করে মসজিদের স্থান বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে দেবে এবং তার বিনিময়ে তা' থেকে উত্তম উদ্যান বেহেশতে প্রাপ্ত হবে? তখন আমি আমার নিজস্ব অর্থ দ্বারা তা' খরিদ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কি পরিতাপ! আজ তোমরা আমাকে সেই মসজিদে দু'রাকাত নামায পড়তে দিতে বাধ সেধেছ! লোকজন বলল, তা' সত্য।

         হযরত ওসমান (রাঃ) বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহর নামে ও ইসলামের নামে জিজ্ঞেস করছি, তোমরা কি জান, হুযুরে পাক (দঃ) মক্কার এক উপত্যকায় দন্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁর সাথে হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) ও আমি ছিলাম। তখন পাহাড় কম্পিত হতে থাকলে হুযুরে পাক (দঃ) তার উপর পদাঘাত করতঃ বললেন, হে উপত্যকা। স্থির হও, তোমার উপর নবী, ছিদ্দীক এবং শহীদ ব্যতীত অন্য কেউ নেই। জনগণ বলল, তা' সত্য। হযরত ওসমান (রাঃ) বললেন, আল্লাহু আকবার, তারা আমার বাক্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছে কা'বার শপথ, আমি শহীদ।

        জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলেছেন, যখন হযরত ওসমান (রাঃ)কে আঘাত করা হল, এবং তাঁর দাড়ি বেয়ে শোণিতধারা প্রবাহিত হতে লাগল, তখন হযরত ওসমান (রাঃ) বলতে লাগলেন! হে প্রভু! তুমি ব্যতীত অন্য উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র! হে প্রভু আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি এবং আমার সমস্ত ব্যাপারে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি, তুমি আমার উপর যে বিপদ দিয়েছ, তাতে ধৈর্য ধারণের জন্য আমি তোমার নিকট তাউফীক চাচ্ছি।

হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদ

        হযরত আছবাগ হানজালী বলেছেন, যে রাত্রে ফজরের ওয়াক্ত হলে ইবনে তিয়াহ হযরত আলাপে হযরত আলী (রাঃ)এর নিকট রিকাঘা ঘাত করা হল, এসে তাঁকে নামায়ের আযানের কথা বলল। তিনি তখন শয্যায় শায়িত ছিলেন। ইবনে তিয়াহ যখন দ্বিতীয় বার আসল, তখনও তিনি সেই অবস্থায় ছিলেন। তৃতীয় বার সে এলে তখন হযরত আলী (রাঃ) উঠে পদচারণা করতে করতে বলতে লাগলেনঃ

মৃত্যুর জন্য হও তৈয়ার

মৃত্যু থেকে রক্ষা কার?

ভয় পেওনা মৃত্যুকে

দিতে হবে তাকে প্রাণটাকে

        যখন হযরত আলী (রাঃ) মসজিদের ছোট দরজার নিকট পৌঁছলেন ইবনে মোলজেম তাঁকে ছুরিকাঘাত করল। তখন হযরত আলী (রাঃ)এর কন্যা উম্মেকুলছুম ছুটে গিয়ে বললেন, হায়। ফজরের নামাযের কি হল? আমার স্বামী ওমর (রাঃ) ফজরের নামাযের মধ্যে শহীদ হলেন, আমার পিতা হযরত আলী (রাঃ)ও সেই ফজরের নামাযের মধ্যে শাহাদাত বরণ করলেন? কুরায়েশ বংশীয় জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, যখন ইবনে মোলজেম হযরত আলী (রাঃ)কে ছুরিকাঘাত কবল, হযরত আলী (রাঃ) বলে উঠলেন, কাবার প্রভুর শপথ! আমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। মুহাম্মদ ইবনে আলী বলেছেন যে, যখন তাঁকে ছুরিকাঘাত করা হল, তিনি তাঁর সন্তানদেরকে প্রয়োজনীয় অছিয়ত করলেন। তারপর তিনি আর কোন অপ্রয়োজনীয় কথা উচ্চারণ করলেন না। মৃত্যুশয্যায় শায়িতাবস্থায় শুধু কালেমা তাইয়্যেব লাইলাহা ইল্লাল্লাহু পাঠ করতে লাগলেন।

ইমাম হোসায়েন হোসায়ে (রাঃ) দ্বয়ের শাহাদত লাভ

        যখন হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) কে গভীর ষড়যন্ত্রমূলক হত্যার শিকার হতে হল এবং তাকে পানীয়ের সাথে বিষ মিশ্রিত করে তাঁকে পান করতে দেয়া হল, বিষ অত্যন্ত মারাত্মক ধরনের ছিল; সুতরাং অচিরেই তাঁর মৃত্যু নিকটবর্তী হল। হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) আশু মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পেয়ে অত্যন্ত বিমর্ষ ও ম্রিয়মান হয়ে পড়লেন। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হযরত ইমাম হোসায়ন (রাঃ) জেষ্ঠ্যভ্রাতার পার্শ্বে বসে তাঁকে প্রবোধ দিতে লাগলেন এবং নানাভাবে তাঁকে আশ্বস্ত ও উৎসাহ প্রদান করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, হে ভ্রাতঃ। তুমি সন্ত্রস্ত হচ্ছ কেন? কিছুক্ষণ মধ্যেই তো তুমি আমাদের প্রিয় নানা হুযুরে পাক (দঃ) এবং পিতা হযরত আলী (রাঃ)এর সাথে মিলিত হবে। তুমি উন্মুল মু'মিনীন হযরত খাদীজা (রাঃ) এবং মাতা- হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর সাথে মিলিত হবে। তুমি হযরত হামযাহ (রাঃ) এবং হযরত জাফর (রাঃ)এর সাথে মিলিত হবে। তাঁরা তোমার পিতামহ। সুতরাং হে ভ্রাত! তোমার অশান্তি কিসের? আমি কিন্তু তোমার অবর্তমানে শীঘ্রই এমন দুর্যোগে পতিত হব যার কোন তুলনা নেই।

        মুহাম্মদ ইবনে হাসান (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, কারবালার ময়দানে শত্রুবাহিনী যখন হযরত ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কে আক্রমণ করল, তিনি নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারলেন যে, তারা তাঁকে হত্যা করবে। তখন তিনি তাঁর সঙ্গীদের মাঝে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসাবাদের পর খুবই সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দিলেন, "এখানে যারা আমার আত্মীয় ও অনাত্মীয় পুরুষ এবং মহিলা উপস্থিত আছেন, তারা অবশ্যই দেখতে পাচ্ছেন যে, আমাদের উপর কি ভীষণ বিপদ উপস্থিত হয়েছে। দুনিয়ার অবস্থা যেন পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সবকিছুর রং পরিবর্তিত হয়ে তা' অন্য বর্ণ ধারণ করেছে। ধার্মিক লোকগণ সবাই-ই সম্মুখ থেকে পেছনে চলে গেছে। যারা দু-একজন বাকী আছে তারা যেন পানীয় পাত্রের তলস্থ গাঁদ সদৃশ অথবা অস্বাস্থ্যকর চারণক্ষেত্র সদৃশ। আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে, কোন কাজেই সত্যের অনুসরণ করা হচ্ছে না; ব্যর্থ এবং বাতুল কাজ থেকে মুখ ফিরানো হচ্ছে না, যাতে করে মু'মিন লোকদের আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের উৎসাহও কমে গেছে। এই অবস্থায় বেঁচে আর কি ফল হবে? সুতরাং এ সময় আমি আমার মৃত্যুকে সৌভাগ্য বলে মনে করি এবং অত্যাচারীদের সাথে বেঁচে থাকা আমার জন্য মন্দ কাজ বলে মনে করি।

Post a Comment

0 Comments