প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, হুযুরে পাক (দঃ)এর মধ্যে তাঁর জীবিত বা মৃত অবস্থায়, তাঁর বাক্যে ও কার্যে, সুন্দর ও শ্রেষ্ঠতম আদর্শ নিহিত। তাঁর জীবনের সব কার্যই দর্শকদের জন্য মহা আদর্শস্বরূপ; এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য জ্ঞানগর্ভ উপদেশ সদৃশ। কেননা তাঁর চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত ব্যক্তি আর কেউ নেই। তিনি ছিলেন আল্লাহতায়ালার প্রিয়তম বন্ধু, অন্তরঙ্গ প্রেমাস্পদ, তাঁর সাথে গুপ্ত পরামর্শকারী। তিনি ছিলেন তাঁর পরম পছন্দনীয় বান্দা, রাসূল ও নবী। তাঁর দিকে লক্ষ্য কর, আল্লাহতায়ালা কি তাঁকে তাঁর নির্দিষ্ট সময় হওয়ার পর এক মুহূর্তও অবসর দিয়েছিলেন? তিনি তা' দেন নি; বরং তিনি তাঁর সম্মানিত ও ভারপ্রাপ্ত ফিরেশতাদেরকে তাঁর পবিত্র আত্মা নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তারা তাঁর পবিত্র ও সম্মানিত আত্মা গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিল এবং তাঁর পবিত্র শরীর থেকে পবিত্র আত্মা আল্লাহর রহমত, সন্তুষ্টি, উত্তম এবং মঙ্গলের দিকে বরং রহমানের সান্নিধ্যে সত্যের দ্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিল। এতদসত্ত্বেও তাঁর প্রাণ বের হতে তাঁর কষ্টবোধ হয়েছিল এবং তা' তাঁর মুখমণ্ডলে প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর শব্দ উচ্চে উঠেছিল, তাঁর বর্ণ পরিবর্তিত হয়েছিল, ললাটমণ্ডল ঘর্মসিক্ত হয়েছিল, হস্তদ্বয় ছড়িয়ে গিয়ে তাঁর দক্ষিণ ও বাম পার্শ্বে বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। যারা তখন তাঁর নিকটে উপস্থিত ছিল তারা তাঁর মৃত্যুতে ক্রন্দন করতে লাগল এবং তাঁর কষ্ট দেখে পরিশ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে গেল; সুতরাং দেখা গেল যে, নবুওত ও রেসালাত প্রাপ্তি সত্ত্বেত্ত তাঁর তআকদীর রদ হয়নি। সত্যের সাহায্যকারী, মানুষের সুসংবাদ বহনকারী ও সতর্ককারী হওয়া সত্ত্বেও কি তাঁকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে? না তা' হয়নি; বরং মৃত্যুদূতের উপর যা' আদেশ হয়েছে সে তা' পালন করেছে এবং লাওহে মাহফুজে বা সুরক্ষিত ফলকে যা' লিপিবদ্ধ আছে তদনুযায়ী সে তার কাজ করেছে।
এই-ই হল হুযুরে পাক (দঃ) এর অবস্থা। অথচ তিনি আল্লাহর নিকট প্রশংসিত, মর্যাদা ও হাওজে কাওছারের অধিকারী। রোজ কিয়ামতে তিনি সর্বপ্রথম কবর থেকে উত্থিত হবেন। হাশরের মাঠে তিনি শাফায়াতের অধিকারী হবেন। এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা তাঁর অবস্থা দেখে উপদেশ গ্রহণ করি না এবং আমরা সে অবস্থাসমূহ বিশ্বাস করি না; বরং আমরা প্রবৃত্তির পূজারী, পাপের সারথী। আমাদের মন কেন এই নবীশ্রেষ্ঠ হুযুরে পাক (দঃ) এর অবস্থা দেখে উপদেশ গ্রহণ করে না? তিনি ধর্মভীরুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জন এবং বিশ্বপালকের প্রিয়তম বন্ধু। আমরা কি চিরদিন জীবিত থাকব? আল্লাহর নিকট আমাদের মন্দ কার্য সত্ত্বেও আমরা কি সম্মানিত হব? তা' কখনও-ই হতে পারে না; বরং আমাদের বিশ্বাস আমরা সবাই দোযখের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। তারপর তা' থেকে ধর্মভীরু ব্যতীত আর কেউই নাজাত পাবে না। আমরা তাতে যার বলে ধারণা করি; কিন্তু তা' থেকে বের হতেও আশা করি। আমরা আমাদের আত্মার উপর অত্যাচার করেছি। আল্লাহর কসম, আমরা আল্লাহ-ভীরু নই।
মহাপ্রভু আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তাঁর নিকট না আসবে। তা' তোমাদের প্রভুর পক্ষে একটি পূর্ব নির্দিষ্ট ব্যাপার। তারপর যারা আল্লাহ-ভীরু, তাদেরকে আমি মুক্তি দেব এবং পাপীদেরকে তথায় অপমাণিত করে ত্যাগ করব; সুতরাং প্রত্যেক লোকই তার নিজের দিকে যেন লক্ষ্য করে দেখে যে, সে পাপীদের অধিক নিকটবর্তী না ধর্মভীরুদের অধিক নিকটবর্তী। পূর্ববর্তী সৎ লোকদের স্বভাব চরিত্রের দিকে দৃষ্টি করার পর তোমার নিজের স্বভাব চরিত্রের দিকে লক্ষ্য কর। তাঁরা ধর্মভীরু ছিলেন। তারপর মহানবী (দঃ) এর দিকে লক্ষ্য কর। তিনি তাঁর আদেশের উপর দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কেননা তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, ধর্মভীরুদের নেতা ছিলেন। তারপর চিন্তা কর, দুনিয়া ত্যাগ করাকালে কিরূপ কষ্ট হয়েছিল এবং চিরস্থায়ী বেহেশতের পথে গমনকালে তাঁর উপর কিরূপ কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য আমরা হযরত আয়েশা (রাঃ) এর গৃহে নিরাপদে প্রবেশ করলাম। যখন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত আসন্ন হয়ে এল, তিনি আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে দু' চোখের অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। তারপর তিনি বললেন, তোমাদের প্রতি আশীর্বাদ, আল্লাহ তোমাদেরকে আসানে রাখুন, তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিন, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করুন। আমি তোমাদেরকে আল্লাহ-ভয়ের জন্য শেষ উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কোন শহর বন্দর, তার অধিবাসী এবং তোমাদের প্রভুর উপর কোনরূপ ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না। আমার বিদায়ের মুহূর্ত অত্যাসন্ন। আমাকে আল্লাহর নিকট, ছিদরাতুল মুস্তাহার নিকট, বেহেশতের নিকট, হাওজে কাওছারের নিকট গমন করতে হবে, নিজেদের লোকদেরকে তোমরা আমার এ বাণী শুনিয়ে দিও এবং আমার পর যারা তোমাদের এ ধর্মে প্রবেশ করবে, তাদেরকেও একথা শুনিয়ে দিও। আমার পক্ষ থেকে সবার জন্য সালাম ও আল্লাহর রহমত।
বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) ফিরেশতা জিব্রাইলকে তাঁর মৃত্যুর সময়ে বলেছিলেন, আমার পরে আমার উম্মতের জন্য কে থাকবে? তখন আল্লাহতায়ালা ফিরেশতা জিব্রাইলের নিকট জানিয়ে দিলেন, হে জিব্রাইল। তুমি আমার বন্ধুকে এই সুসংবাদটি জানিয়ে দাও যে, আমি তার উম্মতকে কোন শাস্তি প্রদান করব না এবং তাকে আরও সুসংবাদ প্রদান কর যে, সর্বপ্রথম তাকেই কবর থেকে বের করা হবে, যখন লোকদেরকে পুনরুত্থান করা হবে। আর সে-ই তোমাদের সবার সর্দার হবে। তার উম্মত বেহেশতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত অন্যান্য উম্মতের বেহেশতে প্রবেশ করা হারাম হবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলে গেছেন যে, জিব্রাইলের মুখে একথা শুনে আমার চক্ষু শীতল হয়েছিল।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর মৃত্যুরোগের সময় বলেছিলেন যে, তোমরা সাতটি মশক থেকে সাতটি পাত্রে পানি উঠিয়ে তদ্দ্বারা আমাকে গোসল করাবে, আমরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাই করেছিলাম। তিনি তাতে শান্তি লাভ করে গৃহ থেকে বের হলেন এবং মসজিদে মুছল্লিদের নামায পড়ালেন। তিনি ওহোদের যোদ্ধাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং দোয়া করলেন, তিনি আনছারদের সম্বন্ধে অছিয়ত করলেন যে, হে মুহাজিরগণ। তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আনছারদের সংখ্যা যা এখন আছে, তা-ই থাকবে। বৃদ্ধি পাবে না, আনছারগণ আমার বিশিষ্ট উম্মত, তাদের নিকট আমি আশ্রয় নিয়েছি। তাদের সম্মানিত অর্থাৎ ধার্মিক লোকদেরকে সম্মান করবে এবং তাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দেবে।
তারপর তিনি বললেন, আল্লাহর এক বান্দাকে দুনিয়া এবং আল্লাহর নিকট যা আছে, এই দুটো বন্ধুর মধ্যে একটিকে পছন্দ করতে বলা হয়েছে। সে যা আল্লাহর নিকট আছে তা-ই পছন্দ করেছে। একথা শুনে হযরত আবুবকর (রাঃ) আঝোরে ক্রন্দন করতে লাগলেন, কেননা তিনি ঐ কথা দ্বারা হুযুরে পাক (দঃ)এর নিজের কথাই বুঝে নিয়েছিলেন। হনুরে পাক (দঃ) বলেছিলেন, হে আবুবকর। মসজিদের দিকের এসব দুয়ার বন্ধ করে দাও, শুধু আবুবকরের দুয়ার বন্ধ করো না, কেননা আবুবকরের চেয়ে উত্তম ছাহাবী সম্বন্ধে আমার জানা নেই।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) আমার গৃহে, আমার পালার দিনে এবং আমার বক্ষ ও কণ্ঠের মধ্যবর্তীস্থানে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর সময়ে তাঁর থু থু ও আমার পু খুকে একত্র করেছিলেন। আমার ভ্রাতা আবদুর রহমান একটি, মেসওয়াক নিয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করলেন। হুযুরে পাক (দঃ) তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। আমি বুঝলাম যে, তিনি মেসওয়াক দেখে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, মেসওয়াকটি কি আপনার জন্য গ্রহণ করব? তিনি মস্তক দ্বারা ইশারা করলেন। তখন মেসওয়াকটি আমি আমার প্রাতার নিকট হতে গ্রহণ করে তা' হুযুরে পাক (দঃ) এর মুখের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলাম। কিন্তু মেসওয়াকটি খুবই শক্তবোধ হওয়ার কারণে আমি বললাম, মেসওয়াকটি আমি চিবাইয়া আপনার জন্য নরম করিয়া দেই। তাতে তিনি তাঁর মস্তক নেড়ে সম্মতি জনালে আমি মেসওয়াকটি চিবাইয়া তাঁর জন্য নরম করে দিলাম। অতঃপর তিনি তদ্দ্বারা মেসওয়াক করলেন। তাঁর সম্মুখে একটি পানির পাত্র ছিল। তিনি তার মধ্যে নিজের হস্ত প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, আল্লাহ ব্যতীও উপায় নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর যন্ত্রণা আছে। অতঃপর তিনি তাঁর হস্ত স্থির করে রেখে বলতে লাগলেন। "ইলা রাফীকুিল আ'লা” অর্থাৎ উচ্চতম বন্ধুর সমীপে। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর কসম, তিনি আমাদেরকে এখন পছন্দ করলেন না। হযরত সাঈদ ইবনে আবদুল্লাহ (রহঃ) এর পিতা বলেছেন, যখন আনছারগণ মসজিদের মধ্যে অবস্থানকালে হুযুরে পাক (দঃ)কে কিছুটা সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেলেন, তখন হযরত আব্বাস (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে তাঁদের মনের কথা তাঁকে জানালেন। হযরত আলী (রাঃ)ও তাঁকে একই কথা জানালেন, তারপর হযরত ফজল (রাঃ)ও হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে তা' তাঁর নিকট বললেন। তখন তিনি তাঁর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা আমার হাত ধর। এসময় উপস্থিত নারী-পুরুষগণ তাঁর দুর্বল অবস্থা লক্ষ্য করে চীৎকার দিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর শয্যা থেকে উঠে হযরত আলী (রাঃ) ও ফজল (রাঃ)এর কাঁধের উপর ভর দিয়ে নিজ হুজরা থেকে বের হলেন। এ সময় হযরত আব্বাস (রাঃ) তাঁর সম্মুখে ছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) এর মস্তক এ সময় বস্ত্রদ্বারা বাঁধা ছিল।তিনি খুব ধির পদক্ষেপে মসজিদে প্রবেশ করে মিম্বরের নিকট গিয়ে উপবিষ্ট হলেন। উপস্থিত লোকগণ প্রায় সবাই তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসলেন।
হুযুরে পাক (দঃ) প্রথমে আল্লাহতায়ালার প্রশংসাবাদ প্রকাশ করে বলতে লাগলেন, হে লোকগণ। আমি শুনেছি যে, তোমরা আমার মৃত্যুকে ভয় করছ। মনে হচ্ছে যেন তোমরা মৃত্যুকে ভালবাস না, তোমরা তোমাদের নবীর মৃত্যু কি অসম্ভব মনে করছ এবং তজ্জন্যই তা' অস্বীকার করছ? আমি কি তোমাদেরকে আমার মৃত্যু সম্বন্ধে সংবাদ দেইনি এবং তোমাদের প্রত্যেকেরও যে, মৃতু হবে সে কথা তোমাদেরকে কি বলিনি? বল তো আমার পূর্বে যত নবী রাসূল আগমন করেছিলেন তাদের মধ্যে কোন একজন কি চিরজীবি হয়েছে? তোমরা এ ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য কর ও চিন্তা কর। আমিও আমার পরমপ্রিয় প্রভুর সাথে সাক্ষাত করব এবং আজ হোক কি কাল হোক তোমরাও তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।
আমি তোমাদেরকে প্রাথমিক মুহাজিরদের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি। আমি মুহাজিরদের মধ্যে যা আছে তার সম্বন্ধে অছিয়ত করে যাচ্ছি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ""সময়ের শপথ"। মানুষ নিশ্চয়ই ক্ষতির মধ্যে আছে। তবে যারা ঈমান আনে এবং সৎকার্য করে তারা ব্যতীত। আল্লাহর আদেশ অনুসারে সমস্ত ব্যাপার সংঘটিত হয়। কোন ব্যাপার বিলম্বিত হলে, তা' ত্বরান্বিত করার জন্য যেন তোমরা অধিক উৎসাহিত না হয়ে পড়। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা কখনও অন্যের তৎপরতায় তৎপর হন না। জেনে রাখবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর জয়ী হতে চায় নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে পরাভূত করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে প্রবঞ্চনা করে অবশ্য আল্লাহ তাকে প্রবঞ্চিত করবেন। তোমরা কি দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করবে? তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্কের সূত্র ছিন্ন করে ফেলবে?
হে উপস্থিত লোকগণ। আমি তোমাদেরকে আনছারদের সাথে সদ্ব্যব্যবহার করার অছিয়ত করছি। হে মুহাজিরগণ। মনে রেখ, আনছারগণই তোমাদেরকে পরম আদর ও যত্নে আশ্রয় দিয়েছে এবং তারাই তোমাদের পূর্বে ঈমানের আশ্রয় নিয়েছে। তোমরা তাদের সাথে অবশ্যই উত্তম ব্যবহার করবে। তারা কি তোমাদেরকে তাদের ফল ও শস্যের অংশীদার করেনি? তারা কি তাদের গৃহে তোমাদেরকে স্থান দেয়নি? তারা কি তাদের অভাবের সময় তোমাদের প্রয়োজনকে নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় অগ্রবর্তী করেনি? তোমরা সতর্ক হও, কোন ব্যক্তিকে দুই ব্যক্তির উপর শাসন কর্তৃত্ব দেয়া হলে সে তাদের মঙ্গল সাধন করবে এবং তাদের মন্দ কার্য ক্ষমা করবে। সতর্ক হও, আমি তোমাদের প্রহরীতুল্য। তোমরা আমার সাথে মিলিত হবে।
উপস্থিত জনতা! সতর্ক হও, তোমাদের জন্য যে হাওজের প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে তা' আমার হাওজ। তা' শামদেশের অন্তর্গত বছরা শহর ও ইয়েমেনের অন্তর্গত ছানায়া শহরের মধ্যে যে দূরত্ব রয়েছে তা' থেকেও অধিক বিস্তৃত। ঐ হাওজের মধ্য থেকে কাওছারের ফোয়ারা প্রবাহিত। তার পানি দুগ্ধ থেকেও অধিক শুভ্র, মাখন থেকেও কোমল এবং মধু থেকেও অধিক মিষ্ট। যে তার পানি পান করে সে আর কখনও তৃষ্ণার্ত হয় না। তার প্রস্তরগুলি মনি-মুক্তা, তার তলদেশ মহা মূল্যবান প্রস্তর নির্মিত। যে তা' থেকে রোজ কিয়ামতে বঞ্চিত হবে, সে সমস্ত মঙ্গল থেকে বঞ্চিত হবে। সতর্ক হও, যে ব্যক্তি রোজ কিয়ামতে সেখানে আমার নিকট থাকতে ভালবাসে সে যেন তার রসনা বন্ধ করে রাখে। অবশ্য যে কথা বলা আবশ্যক তা' বলতে বাধা নেই।
এসময় হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী। কুরায়েশদের সম্বন্ধে আমাদেরকে অছিয়ত করুন। তিনি বললেন, এই ব্যাপারে কুরায়েশদেরকে অছিয়ত করছি। মানুষ কুরায়েশদের অনুসরণকারী, ধার্মিক লোকগণ তাদের ধার্মিকদের এবং পাপী লোকগণ তাদের পাপীদের অনুসরণকারী। হে কুরায়েশগণ! তোমরা মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। হে লোকগণ। পাপ সম্পদকে পরিবর্তন করে এবং কু-স্বভাব চরিত্রকে মন্দ করে, যখন সাধারণ লোকগণ সৎ হয় তখন তাদের নেতাগণও সৎ হয়। যখন সাধারণ লোকগণ অসৎ হয় তাদের নেতাগণও অসৎ হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ওয়া কাযালিকা নুয়াল্লী বা'দ্বাজ জালিমীনা বা'দ্বাম বিমা কানু ইয়াকসিবুন।" অর্থাৎ, এরূপে আমি কোন কোন পাপীদেরকে অন্য পাপীদের উপর প্রাধান্য দেব। এটা তাদেরই অর্জিত বস্তুর জন্য।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) কে বলেছিলেন হে আবুবকর। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি উপস্থিত। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হে আবুবকর! মৃত্যু উপস্থিত এবং তা' সত্য। হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর নবী! আল্লাহর নিকট যে রহমত রয়েছে তদ্বারা আপনাকে অভ্যর্থনা করার জন্য এই মৃত্যু। অবশ্য আমাদের জানা নেই যে, আপনি কোথায় চলে যাবেন? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, প্রভু আল্লাহর সকাশে, ছিদরাতুল মুনতাহার দিকে, তারপর জান্নাতুল মাওয়া-এর সর্বোচ্চ বেহেশত ফেরদৌসের দিকে, পূর্ণ হাওজ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ বন্ধুর দিকে তার পরম সুখ শান্তির দিকে। হযরত আবুবকর (রাঃ) তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে আপনাকে গোসল করাবে? তিনি বললেন, আমার পরিবারবর্গের মধ্যে নিকটতর ব্যক্তি এবং তন্মধ্যে সর্বাধিক নিকটতর ব্যক্তি। হযরত আবুবকর (রাঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন বস্ত্র দ্বারা আপনাকে কাফন করাবো? তিনি বললেন, আমার এই পরিধানের বস্ত্র দ্বারা। ইয়েমেন নির্মিত জুব্বা দ্বারা এবং মিসরের শুভ্র বস্ত্র দ্বারা। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আপনার জানাজা কিরূপে আদায় করব? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, আমরা এসময় রোদন করতেছিলাম এবং আমাদের নবীও ক্রন্দন করতেছিলেন। তারপর তিনি বললেন, তোমরা থাম। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তোমাদের নবী থেকে আল্লাহ তোমাদেরকে মঙ্গল দান করুন। যখন তোমরা আমাকে গোসল করাবে এবং কাফন পরাবে এবং আমার গৃহের মধ্যে আমাকে খাটে স্থাপন করাবে তখন তোমরা কিছু সময়ের জন্য আমার নিকট থেকে দূরে সরে থাকবে। কেননা সর্বপ্রথম আমার উপর যিনি দরূদ পড়তেন তিনি মহান ও গৌরবান্বিত আল্লাহ। ঐ সময় তিনি এবং তাঁর ফিরেশতাগণ আমার উপর দরূদ পাঠ করবেন। তারপর তিনি তাঁর ফিরেশতাগণকে আমার উপর নামায পড়তে বলবেন। আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিজগতের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম আমার উপর জানাজার নামায আদায় করতে আসবেন, তিনি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দূত ফিরেশতা জিব্রাইল। তারপর জানাজা আদায় করতে আসবেন ফিরেশতা মিকাইল, তারপর আসবেন ফিরেশতা ইস্রাফীল। এদের নামায আদায়ের পর অসংখ্য দলবলসহ আসবেন মালাকুল মওত বা ফিরেশতা আজ্রাইল। তারপর অন্যান্য সমস্ত ফিরেশতা আমার জানাজার নামায আদায় করতে আসবেন। তারা দলে দলে আমার জানাজার নামায পড়বে এবং আমাকে সালাম জানাবে।
যখন ফিরেশতাদের নামায আদায় করা শেষ হবে তখন তোমরা দলে দলে আমার জানাজা আদায় করো ও আমাকে সালাম জানিও। কিন্তু সাবধান। তোমরা বিলাপ, চীৎকার করে বা ক্রন্দনের রোল উঠিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। প্রথম আমার পরিবারস্থ পুরুষগণ, তারপর পরিবারের স্ত্রীলোকগণ, তারপর পরিবারের বালক-বালিকাগণ জানাজার নামায আদায় করবে। হযরত আবুবকর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনাকে কবরে স্থাপন করবে? তিনি বললেন, বহু ফিরেশতা একাজে শরীক হবে। তার সাথে আমার পরিবারবর্গের নিকটতম লোকগণ এ কাজ করবে। ফিরেশতাদেরকে অবশ্য তোমরা দেখতে পাবে না কিন্তু তারা তোমাদেরকে দেখতে পাবে। এখন তোমরা আমার নিকট থেকে উঠে যাও। যারা এর পরে তোমাদের নিকট আগমন করবে আমার পক্ষ থেকে তোমরা তাদেরকে ধর্মের বাণীসমূহ পৌঁছে দেবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাময়া (রহঃ) বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম তারিখে হযরত বেলাল (রাঃ) এসে নামায আদায়ের অনুমতি চাইলে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, আবুবরকরকে জামাতের ইমামতী করতে বল। আমি তখন বের হয়ে একদল লোকের মধ্যে ওমর (রাঃ) ব্যতীত আর কাউকে দেখলাম না। তন্মধ্যে হযরত আবুবকর (রাঃ) ছিলেন না। তখন আমি বললাম, হে ওমর। উঠুন এবং নামাযের ইমামতী করুন। তখন হযরত ওমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে তাকবীর বলা মাত্র (তাঁর স্বর উচ্চ ছিল এবং হুযুরে পাক (দঃ) তার স্বর শুনেছিলেন) হুযুরে পাক (দঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আবুবকর কোথায়? আল্লাহ এবং মুসলমাগণ তা' (ওমরের ইমামতী) স্বীকার করবেন না। তিনি পর পর তিনবার বললেন, আবুবকরকে ইমামতী করতে বল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। আবুবকর কোমল হৃদয় ব্যক্তি, তিনি যখন আপনার স্থানে দাঁড়াবেন, তাঁর ক্রন্দন থামাতে পারবেন না। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা ইউসুফের সাথী। আবুবকরকে নামাযে ইমামতী করতে বল।
হযরত ওমর (রাঃ) এর নামাযের পর হযরত আবুবকর (রাঃ) নামায পড়ালেন। তখন হযরত ওমর (রাঃ) আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ ইবনে জাময়া। তোমার জন্য দুঃখ, তুমি আমার সাথে কি ব্যবহার করলে বল ত! আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি মনে করলাম যে, হুযুরে পাক (দঃ) আমার নিকট তোমাকে ইমামতী করার জন্য আদেশ করেছেন, আমি ওমর (রাঃ) কে বললাম, এই কাজের জন্য আমি তোমাকে ব্যতীত আর কাউকে যোগ্য এবং উত্তম মনে করিনি। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আবুবকর (রাঃ)এর পক্ষ হতে যে আপত্তি করেছিলাম, তার কারণ হল, তিনি সংসারত্যাগী ছিলেন, নেতৃত্ব ও শাসনকার্যের বহু বিপ্লব ও অশান্তি থাকে। তবে আল্লাহ যাকে নিরাপদ রাখেন, তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। আমি ভয় করেছিলাম যে, জনসাধারণও হুযুরে পাক (দঃ) এর জীবিতাবস্থায় ভালবাসবে না যে, হুযুরে পাক (সঃ)এর স্থানে অন্য কেউ নামায আদায় করে, তবে যদি আল্লাহ অন্য ইচ্ছা না করেন। আবুবকর নামায পড়লে তারা তাঁকে ঈর্ষা করবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং তাঁকে মন্দ বলবে। যখন আল্লাহর আদেশ হয় এবং তাঁর বিধান হয় আল্লাহ-ই তাকে ইহলোকে ও ধর্মের ব্যাপারে রক্ষা করবেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, হুযুরে পাক (দঃ)এর ইন্তেকালের দিনের প্রথম ভাগে তাঁকে একটু সুস্থ দেখা যেতে লাগল। লোকগণ তাঁর নিকট থেকে বিদায় হয়ে যার যার গৃহে চলে গেল এবং নিজ নিজ কাজে লিপ্ত হল। তখন হুযুরে পাক (দঃ)এর নিকট আমরা শুধু তাঁর বিবিগণই ছিলাম। আমরা তখন এমন আশা ভূ আনন্দের মধ্যে ছিলাম, যেমনটা আমাদের জীবনে খুবই কম হয়েছে। এক সময়ে হুযুরে পাক (দঃ) আমাদেরকে বললেন, তোমরা একটু বাইরে যাও, একজন ফিরেশতা আমার নিকট আসবার অনুমতি চাইছে। তখন আমি ব্যতীত অন্যান্য সব মহিলাই বাইরে চলে গেলেন। এসময় হুযুরে পাক (দঃ) এর মস্তক আমার ক্রোড়ে ছিল। তিনি উঠে বসলেন, এবার আমিও উঠে গৃহের এক কোণে চলে গেলাম। ফিরেশতা এসে বহুক্ষণ ধরে হুযুরে পাক (দঃ)এর সাথে গোপনে আলাপ করলেন। কিছুক্ষণ পর হুযুরে পাক (দঃ) আমাকে ডাকলেন। আমি তার নিকট চলে এলে তিনি আবার তাঁর মস্তক আমার ক্রোড়ে স্থাপন করলেন। অতঃপর তিনি স্ত্রীলোগণকে তাঁর নিকটে ডাকলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! যিনি আপনার নিকট এলেন, ইনি তো জিব্রাইল ফিরেশতা নন। হযুরে পাক (দঃ) বললেন, হে আয়েশা। ইনি মালাকুল মওত।
মালাকুল মওত আমার নিকট বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহান আল্লাহ আমাকে আপনার নিকট প্রেরণ করেছেন এবং আপনার অনুমতি ব্যতীত আপনার নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, যদি আপনি আমাকে অনুমতি না দেন, তবে যেন আমি ফিরে চলে যাই। আর যদি অনুমতি দেন, তবে আপনার নিকটবর্তী হব। আর আপনি আদেশ না করা পর্যন্ত আপনার রূহের প্রতি হস্তক্ষেপ করব না, আল্লাহ আমাকে এরূপও আদেশ করেছেন। এখন আপনি আমাকে কি আদেশ করেন? আমি তাকে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন। ফিরেশতা জিব্রাইলকে আসতে দিন, তার আগমনের সময় হয়ে গেছে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) এর কথা শুনে আমাদের সামনে এমন ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, যার কোন তদবীর বা প্রতিকার করার মত কিছু আমাদের হাতে রইল না। আমাদের মনে হল, আমরা সবাই মিলে চীৎকার করে উঠি ও আমাদের পাগুলি মাটিতে আছড়াতে থাকি। এ সময় আহলে বাইতের সবাই নীরব নিস্তব্ধ, যেন মৃতবৎ নিষ্প্রাণ নিস্পন্দ হয়ে গেল। এমন দৃশ্যের অবতারণা হল, যা কেউ কোনদিন দেখেনি।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইতোমধ্যে ফিরেশতা জিব্রাইল এসে হুযুরে পাক (দঃ) কে সালাম করলেন। আমি তার আগমন অনুভব করলাম। আহলে বাইত বা নবীগৃহের সব লোক পুনরায় বের হয়ে গেলেন। জিব্রাইল গৃহ মধ্যে প্রবেশ করে বললেন, মহীয়ান ও গরীয়ান আল্লাহতায়ালা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন, আপনি কেমন আছেন? অথচ তিনি আপনার অবস্থা সম্যক অবগত আছেন। তিনি আপনার সম্মান ও মর্যাদাকে পূর্ণ করতে ইচ্ছা করেছেন এবং তা' আপনার উম্মতের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা করেছেন। তিনি বললেন, আমি যন্ত্রণা পাচ্ছি। তিনি বললেন, সুসংবাদ নিন। আল্লাহতায়ালা আপনার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছেন তাতে আপনাকে পৌঁছে দিতে ইচ্ছা করেছেন।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, হে জিব্রাইল। মৃত্যুর ফিরেশতা আমার অনুমতি প্রার্থনা করছে, তখন ফিরেশতা জিব্রাইল বললেন, হে মুহাম্মদ (দঃ) নিশ্চয়ই আপনার প্রভু আপনার সাথে সাক্ষাত করতে উদগ্রীব। তিনি যে আপনার সাথে সাক্ষাত করতে ইচ্ছা করেন, আমি কি তা' আপনাকে জানাইনি? আল্লাহর কসম মালাকুল মণ্ডত কখনও কারও প্রাণ হরন করার সময়ে তার থেকে তার অনুমতি প্রার্থনা করেনি এবং করবেও না। তবে আপনার প্রভু আপনার সম্মানকে পূর্ণ করবেন এবং তিনি আপনার জন্য উদগীব। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তা' হলে মালাকুল মওত আগমন না করা পর্যন্ত আপনি এখান থেকে চলে যাবেন না।
অতঃপর তিনি আবার স্ত্রীলোকগণকে তাঁর নিকটে ডাকলেন। কন্যা হযরত ফাতেমা যোহরা (রাঃ) কে ডেকে বললেন, মা আমার! তুমি আমার নিকটে এসে বস। তখন হযরত ফাতেমা (রাঃ) তাঁর একান্ত নিকটবর্তী হলে তিনি তার কর্ণের কাছে স্বীয় মুখ নিয়ে নিম্নস্বরে কি যেন। বললেন। সে কথা শুনে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর দুচোখ থেকে অশ্রুর ধারা ছুটল। তিনি ক্রন্দন শুরু করলেন, তাঁর অবস্থা দিশাহারা লোকের ন্যায় হল। তাঁর রসনা থেকে কোন কথাই আর বের হল না। কন্যার এরূপ পেরেশান অবস্থা দেখে হুযুরে পাক (দঃ)ও যেন আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি ইশারায় তাঁর মস্তক নত করতে বললেন। তিনি পিতার আদেশ পালন করলেন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) আবার কন্যার কানের নিকট মুখ নিয়ে পুনরায় কি যেন বললেন, এবার দেখা গেল এক বিপরীত অবস্থা। যে ভাবী পিতৃবিচ্ছেদাশংকায় শোকাভিভূতা ফাতেমা (রাঃ) কেঁদে আকুল হয়েছিলেন, তাঁর কানে কানে গোপনে সেই পিতা কি বলে দিলেন, যার ফলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মুখে হাস্যরেখা ফুটে উঠল। কিন্তু তিনি মুখে কিছু বললেন না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা এ দৃশ্য অবলোকন করে বিস্ময়াপন্ন হলাম এবং হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর নিকট এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, পিতাজী আমার কানে কানে প্রথমবার বলেছিলেন যে, আমার তোমাদের নিকট থেকে চিরবিদায় আসন্ন। তারপর দ্বিতীয়বার তিনি আমার কানে কানে বললেন, মা আমি তোমার জন্য দোয়া করছি, তুমি আমার বিয়োগে অস্তির হয়ো না। ধৈর্য ধারণ কর। আমি আল্লাহর নিকট দোয়া করেছি আমার পরিজনদের মধ্যে অতি শীঘ্র সর্বপ্রথম তুমিই আমার সাথে গিয়ে মিলিত হবে এবং আমার সাথে বসবাস করবে। এতে আমার মন প্রফুল্ল হল ও তার ফলেই আমার অধরে হাস্য রেখা ফুটে উঠেছিল।
ক্রমেই যখন হুযুরে পাক (দঃ) এর অবস্থা নাযুক এবং করুণ হয়ে আসছিল, হযরত ফাতেমা (রাঃ) তাঁর প্রিয় পুত্রদ্বয় ইমাম হাসান ও ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কে তাঁদের বিদায়মান মাতামহের নিকট নিয়ে এলেন। তিনি তাঁর পরম স্নেহের পাত্র কলিজার টুকরা দৌহিত্রদ্বয়কে জীবনের শেষবারের মত স্নেহ ও আদর করলেন। একটু পরেই মালাকুল মওত উপস্থিত হয়ে হুযুরে পাক (দঃ)কে সালাম করলেন এবং তাঁর নিকট অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে অনুমতি দান করলেন। মালাকুল মওত বসলেন, তিনি বললেন, আপনি এখন আমাকে আমার পরম প্রভুর সাথে সাক্ষাত করিয়ে দিন। মালাকুল মওত বললেন, হাঁ, আপনার প্রভুও আজ আপনার সাথে সাক্ষাত করার জন্য বড়ই উন্মীব। আপনার সম্বন্ধে আপনার প্রভুর যে ইতস্ততা ছিল, আর কারও সম্বন্ধে কখনও তদ্রূপ হয়নি। তিনি অন্য কারুরই প্রাণ হরণ করতে আমাকে তার অনুমতি গ্রহণ করতে বলেন নি। আপনার চরম মুহূর্ত একটু পরেই। একথা বলেই তিনি বের হয়ে গেলেন, ঠিক তন্মুহূর্তে ফিরেশতা জিব্রাইল এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। আপনার প্রতি সালাম, দুনিয়ায় এই আমার সর্বশেষ অবতরণ, অহীর নযুল শেষ হয়ে গেছে। আপনার অবর্তমানে দুনিয়ায় আমার আর কোন প্রয়োজন নেই। এখন থেকে আমি আমার স্থানেই অবস্থান করব।
হযরত, আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)এর পবিত্র মস্তক আমার বক্ষের মধ্যস্থলে স্থাপন করে তাঁর বক্ষদেশ ধরে রাখলাম। তিনি তখন পুনঃ পুনঃ অচৈতন্য হয়ে পড়তেছিলেন। তাঁর ললাটদেশ থেকে এতবেশী ঘর্ম নির্গত হতে লাগল যে, আমি কখনও কাউকে এমনভাবে ঘর্মাক্ত হতে দেখিনি। আমি বার বার তাঁর ঘর্ম মুছতেছিলাম আমি সেই ঘর্মের সুঘ্রাণের ন্যায় আর কোন কিছু থেকে ঐরূপ সুঘ্রাণ পাইনি। একবার যখন তাঁর হুঁশ ফিরে এল, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমার পিতামাতা, আমার নফস ও আমার পরিজনবর্গ আপনার উপর কুরবান হোক। আপনার শরীর থেকে এত ঘর্ম নির্গত হয় কেন? তিনি বললেন, হে আয়েশা। মু'মিনের প্রাণ ঘর্ম নিয়ে বের হয় এবং কাফিরের প্রাণ গর্দভের প্রাণের ন্যায় দু'পার্শ্ব থেকে বের হয়ে যায়। এসময়ে আমরা দিশাহারার মত এদিকে সেদিকে ছুটাছুটি করতে লাগলাম এবং আমি আমার পিতৃগৃহে লোক পাঠালাম। প্রথম যে ব্যক্তি আমাদের নিকট এল, সে আমার ভ্রাতা, কিন্তু সেও হুযুরে পাক (দঃ)এর প্রাণবিয়োগের কালে উপস্থিত ছিল না। আমার পিতাকে আনবার জন্য তাকে পাঠিয়ে দিলাম। অন্য কেউ আসবার পূর্বেই হুযুরে পাক (দঃ) আমাদের নিকট থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। মনে হয় যেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই হুযুরে পাক (দঃ) এর দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ কালে সব লোককে তাঁর থেকে দূরে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন এবং ফিরেশতা জিব্রাইল ও মিকাইলকে তাঁর পরিচর্যার ব্যাপারে তাঁর কাছে নিয়োজিত রেখেছিলেন। যখন হুযুরে পাক (দঃ) বেহুঁশ হয়ে যেতেন, তিনি বলে উঠতেন; বরং উচ্চতম বন্ধুর সকাশে। তাতে বুঝা যাচ্ছিল যে, তাকে দু' পন্থার এক পন্থা পছন্দ করতে বলা হয়েছিল, তিনি যে পন্থা পছন্দ করেছিলেন তা-ই তাঁর রসনা থেকে উচ্চারিত হতেছিল। যখন তিনি কথা বলতে পারতেন, তখন বলতেন, নামায, নামায, তোমরা সবাই নামায পড়তে থাকলে কখনও পরাভূত হবে না। তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত নামাযের জন্য অছিয়ত করে গেছেন। এমনকি মৃত্যুর সময়ও তিনি নামায নামায বলতেছিলেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) সোমবার দিবা এক প্রহর ও দ্বিপ্রহরের মধ্যবর্তী সময়ে হুযুরে পাক (দঃ) প্রাণত্যাগ করেছিলেন, হযরত ফাতেমা (রাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহর কসম, সোমবার এলেই মনে করতাম যে, এই উম্মতের ভীষণ বিপদ হবে, এদিনটি মুবারক নয়। হযরত উম্মে কুলছুম (রাঃ) বলেছেন, যেদিন হযরত আলী (রাঃ)কে কুফায় ছুরিকাঘাত করা হল, সেদিনও ছিল সোমবার-যে দিন হুযুরে পাক (সঃ)এর প্রাণবিয়োদ ঘটেছিল। এদিন আমার স্বামী ওমর (রাঃ) নিহত হয়েছিলেন, এদিনেই আমার পিতা হযরত আলী (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেছিলেন। সোমবার দিনে আমার কোন মঙ্গল নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, যখন হুযুরে পাক (দঃ)এর ওফাত হয়ে গেল, মানুষের মধ্যে এক করুণ শোরগোল উত্থিত হল। হুযুরে পাক (দঃ)কে আমার বস্তদ্বারা ফিরেশতাগণ আবৃত করে রাখল। মানুষের মধ্যে নানা অবস্থার সৃষ্টি হল, মতভেদ দেখা দিল, কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করল না। কারও কারও বুদ্ধিবিভ্রম ঘটল। কারও কারও মুখ থেকে কোন কথাই বেরুল না। কেউ কেউ নিস্তব্ধভাবে বসে রইল, যেন তাদের নিকট এই দুনিয়া শূন্য হয়ে গেছে। যারা হুযুরে পাক (দঃ) এর মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করলেন না হযরত ওমর (রাঃ) ছিলেন সেই দলের অন্যতম। যারা দিগভ্রান্তের মত বসে পড়েছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ)ও ছিলেন। যাদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, হযরত ওসমান (রাঃ) ছিলেন তাদেরই একজন। হযরত ওমর (রাঃ) এমনই দিগভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি লোকদের মধ্যে বের হয়ে বললেন, আমার রাসূল (দঃ) নিশ্চয়ই প্রাণত্যাগ করেন নি, তিনি সাময়িকভাবে তাঁর প্রভুর সাক্ষাতে গমন করেছেন, নিশ্চয় তাঁকে আল্লাহ আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবেন। তাঁর মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু হতে পারে না। তিনি ফিরে এসে মুনাফিকদের হস্তপদ কর্তন করবেন। যারা হুযুরে পাক (দঃ) এর মৃত্যুর আশা করে। আল্লাহ যেরূপ হযরত মূসা (আঃ)কে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি তদ্রূপ আমাদের নবী (দঃ) কে ওয়াদা করেছেন। তিনি তোমাদের মধ্যে আসবেন। অন্য বর্ণনায় আছে, হযরত ওমর (রাঃ) উলঙ্গ তরবারী নিয়ে লোকদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে লোকগণ! তোমরা রাসূল (দঃ) এর মৃত্যু সম্বন্ধে রসনা সংযত কর, কেননা তিনি প্রাণত্যাগ করেন নি। আল্লাহর কসম, আমি যেন কাউকে বলতে না শুনি যে, হুযুরে পাক (দঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন। যদি কেউ এরূপ কথা বলে, তাকে আমি এই তরবারীর আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলব।
হযরত আলী (রাঃ) গৃহের মধ্যে মুক হয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, হযরত ওসমান (রাঃ) কারও সাথে কোন কথাই বললেন না, লোকগণ তাঁর হাত ধরে এদিক ওদিক নিয়ে যেতে লাগল। মোটকথা হযরত আবুবকর (রাঃ) ও হযরত আব্বাস (রাঃ)এর অবস্থার ন্যায় কোন মুসলমানের অবস্থা ছিল না। আল্লাহতায়ালা তাঁদের উভয়কে ধৈর্য এবং স্থৈর্য দান করেছিলেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) যথোচিত সান্ত্বনা বাক্যে মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এবং হযরত আব্বাস (রাঃ) এসে লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। হুযুরে পাক (দঃ) মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর জীবদ্দশায়ও তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন, "ইন্নাকা মাইয়্যিতুন অ আন্নাহুম মাইয়্যিতুনা ছুম্মা ইন্নাকুম ইয়াওমাল কিয়ামাতি ইনদা রাব্বিকুম তাখতাছিমূন" অর্থাৎ নিশ্চয় তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে। তারপর রোজ কিয়ামতে তোমরা তোমাদের প্রভুর সামনে বিবাদ করতে থাকবে। হজরত বুবকর (রাঃ) বনু হারেছ ইবনে খাজরাজের নিকট ছিলেন। সেখানে তিনি হুযুরে পাক (দঃ)এর মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলেন। এ খবর শুনামাত্র তিনি দ্রুত তথা থেকে চলে এসে আল্লাহর রাসুল (দঃ)এর নিকট চলে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি তাঁর দিকে এক সৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অবনত হয়ে তাঁর ললাট দেশে চুম্বন করলেন। তারপর তিনি বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসূল (দঃ)। আমার পিতামাতা আপনার উপর কুরবান হোক, আল্লাহ আপনাকে দুবার মৃত্যু দেবেন না। আল্লাহর কসম, আপনার মৃত্যু হয়েছে। অতঃপর তিনি প্রণত জনসাধারণের নিকট চলে গেলেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, হে লোকগণ। যে ব্যক্তি মুহাম্মদের ইবাদাত করে, সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মদের প্রভুর ইবাদাত করে সেও জ্ঞাত হোক যে তিনি চিরঞ্জীব তাঁর মৃত্যু নেই। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, মুহাম্মদ রাসূল ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তাঁর পূর্বেও রাসূলগণ গত হয়ে গেছেন। যদি তাঁর মৃত্যু হয় অথবা তিনি নিহত হন তোমরা কি তোমাদের পশ্চাতে ফিরে যাবে? যেমন কুরআনে পাকে রয়েছে, "ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসুলুন জ্বাদ খালাত মিন কাবলিহির রাসূল আফাইম মাতা আও কুতিলান জ্বালাবতুম আলা আত্মাবিকুম"। হযরত আবুবকর (রাঃ) এর মুখে উচ্চারিত এ পবিত্র আয়াত শুনে এমন অবস্থা হল যে, সে আয়াত যেন ঐ দিন ব্যতীত তারা পূর্বে আর কখনও শ্রবণ করেনি। অন্য বর্ণনায় আছে যখন হুযুরে পাক (দঃ)এর মৃত্যু সংবাদ হযরত আবুবকর (রাঃ) এর নিকট পৌছল, তিনি তাঁর উপর দরূদ পড়তে পড়তে গৃহে প্রবেশ করলেন। তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল এবং তাঁর গ্রন্থির শব্দ কড়াইর মধ্যে উত্তপ্ত পানির টগবগ শব্দের ন্যায় উত্থিত হচ্ছিল। তা' সত্ত্বেও তাঁর কার্য ও বাক্য সময়ানুরূপ ছিল। কোনরূপ আবেগ, উচ্ছ্বাস বা হতাশার নিদর্শন ছিল না তার কোন আচরণে। তিনি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকটবর্তী হয়ে ঝুকে পড়ে হুযুরে পাক (দঃ) এর মুখের উপর দিয়ে চাদর সরালেন এবং তাঁর ললাট ও দুই গণ্ডে চুম্বন করলেন। এ সময় তিনি স্বীয় মুখমণ্ডল মুছতেছিলেন এবং রোদন করতেছিলেন। তিনি বললেন, আমার পিতামাতা, আমার প্রাণ ও আমার পরিবার পরিজন আপনার উপর কুরবান হোক। আপনি জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায়ই অত্যুত্তম। আপনার মৃত্যুতে নবুওত খতম হয়েছে যা অন্যান্য নবীদের মৃত্যুতে হয়নি। অর্থাৎ নবুয়ত আপনার মর্যাদা থেকে অধিক এবং আমাদের ক্রন্দন থেকে বড়। আপনি বিশেষ নবী ছিলেন, কেননা আপনি সবার যিম্মাদার। যদি আপনার মৃত্যু আপনার ইচ্ছামত না হত তাহলে আপনার শোকে আমাদের প্রাণ উৎসর্গ হত। যদি আপনি ক্রন্দন করতে নিষেধ না করতেন তবে নিশ্চয়ই আপনার জন্য আমাদের অশ্রুর ধারা কখনই শেষ হত না। আপনি আপনার প্রভুর নিকট আমাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। আপনি যদি আমাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করে না যেতেন আমরা পশুত্বের মধ্যে এখনও বিচরণ করতাম। কিন্তু আপনারই হেদায়েতের ফলে আমরা পশুত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি। হে মাবুদ! তুমি আমাদের পক্ষ থেকে এই সংবাদ তোমার নবীর নিকট জানিয়ে দাও এবং তোমার নবীর নীতি ও আদর্শ আমাদের মধ্যে সর্বতোভাবে রক্ষা কর।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তখন হয়রত আবুবকর (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ)এর গৃহে প্রবেশ করে দরূদ ও আল্লাহর প্রশংসাবাদ করতে লাগলেন, গৃহের অধিবাসীগণ তখন এমন শোরগোল করতেছিলেন যে, মসজিদে নামাযদর মুসুল্লিদের কানেও তা' গিয়ে পৌছল। হযরত আবুবকর (রাঃ) যখনই কোনকিছু বলতে শুরু করতেন, শোরগোল আরও বৃদ্ধি পেত। এই মুহূর্তে একব্যক্তি গৃহদ্বারে দণ্ডায়মান হয়ে নিম্নোক্ত উপদেশবাণী উচ্চারণ করণে শোরগোল কিছুটা বন্ধ হল। ঐ ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, হে আহলেবায়েত। আপনাদের উপর সালাম। প্রত্যেক ব্যক্তিরই মৃত্যু হবে। প্রত্যেক লোকেরই আল্লাহর বিষয়ে একজন প্রতিনিধি থাকে, প্রত্যেক আশা-আকাঙক্ষার স্কুল থাকে এবং প্রত্যেক ভয়ের যুক্তি থাকে। আপনারা আল্লাহর উপর ভরসা করুন এবং তাঁর উপর সবকিছু সোপর্দ করুন। এই বাণী শ্রবণ করে গৃহবাসীগণ একথা কে বলছে তা' বুঝতে পারল না; কিন্তু তাদের ক্রন্দন তখন বন্ধ হল। যখন তাদের ক্রন্দন থেমে গেল, কোন একজন গৃহ থেকে বাইরে এসে চারদিকে দেখতে লাগল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। লোকটি গৃহমধ্যে ফিরে গেলে, গৃহের অধিবাসীগণ আবার ক্রন্দন শরু করল, আবার শোরগোল আরম্ভ হয়ে গেল। সাথে সাথে গৃহের বাইরে থেকে অন্য আর এক ব্যক্তির স্বরে এই অদৃশ্যবাণী উচ্চারিত হল, হে আহলেবায়েত। আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং প্রত্যেক অবস্থায়ই তাঁর প্রশংসা করুন। তবেই আপনারা নিঃশ্বার্থ ইবাদাতকারী হবেন। প্রত্যেক বিপদে আল্লাহর পক্ষ থেকে সান্ত্বনা আছে এবং প্রত্যেক বাঞ্ছিত বস্তুতে প্রতিনিধি আছে। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করুন, তাঁর আদেশ পালন করুন এবং যথাযথভাবে আমল করতে থাকুন। হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেছেন যে, এই ব্যক্তি হযরত খিজির (আঃ) ছিলেন এবং পূর্বোক্ত ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন। এরা উভয়ই হুযুরে পাক (দঃ)এর জানাজায় শরীক হয়েছিলেন।
হযরত কা'কা ইবনে আমর (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)এর খুৎবাহ পূর্বরূপে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, হযরত আবুবকর (রাঃ) জনসাধারণের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি সময়োচিত ভাষণ দিলেন। তাঁর সে ভাষণ শুনে সবাই-ই রোদন করতেছিলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসাবাদ ঘোষণা করে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি মহান ও অদ্বিতীয়, তিনি তাঁর একত্বকে সত্য করে দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তিনি সম্মিলিত শত্রুকে পরাভূত করেছেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি এক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল, তিনি সর্বশেষ নবী। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, পবিত্র কুরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই আছে এবং ধর্ম যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই রয়েছে। হাদীসসমূহ যেভাবে উক্ত হয়েছিল, তা' ঠিক সেভাবেই আছে। কথা যেভাবে বলা হয়েছিল, তাও ঠিক সেভাবেই রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রকাশ্য সত্য। হে মাবুদ! তোমার বান্দা, তোমার রাসূল, তোমার নবী, তোমার বন্ধু, তোমার পছন্দনীয় দাস, তোমার মনোনীত দাস হযরত মুহাম্মদ (দঃ)এর উপর দরূদ পাঠাও। এমন দরূদ যা তোমার সৃষ্টির মধ্যে অন্য কোন বান্দার উপর পাঠাওনি। হে মাবুদ। তোমার আশীর্বাদ, তোমার ক্ষমা, তোমার রহমত এবং তোমার বরকতকে নবীশ্রেষ্ঠ শেষ নবী, ধর্মভীরুদের নেতা, হযরত মুহাম্মদ (দঃ)এর উপর বর্ষণ কর। তিনি কল্যাণ ও মঙ্গলের নিকটবর্তী ও সম্মাণিত কল্যাণ ও মঙ্গলের পথপ্রদর্শক এবং দয়ালু রাসূল। হে মাবুদ! তাঁর মর্যাদা তোমার নি কর, তাঁর প্রমাণকে বড় কর। তার স্থানকে সম্মাণিত কর এবং তাঁকে প্রশংসিত জকিয়ামতে স্থানে পৌছে দাও। পূর্ব ও পরের মহামনীষীগণের যেন তিনি ঈর্ষার পাত্র হন। রোজকি তাঁর প্রশংসিত স্থানের উপকার আমাদেরকে দান কর। ইহলোকে ও পরলোকে আমাদের মধ্যে তাঁকে প্রতিনিধি কর এবং তাঁকে বেহেশতের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদা দান কর এবং তাঁকে আমাদের অবলম্বনীয় কর। হে মাবুদ। হযরত মুহাম্মদ (দঃ)এর উপর এবং তাঁর পরিবারবা উপর বরকত দান কর। যেরূপ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মাঃ) এর উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গে বরকত দান করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত ও সম্মানিত।
হে মানবমণ্ডলী! যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর ইবাদাত করে, সে জানবে যে, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) মৃত। আর যে ব্যক্তি মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহতায়ালার ইব সে জানবে যে আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই জীবিত। তাঁর মৃত্যু নেই। আল্লাহ তার ব্যাপারে তোমাদে মাদের নিকট ল্লাহতায়ালা আশ্রয় পাঠিয়েছেন; সুতরাং তাকে ব্যর্থ করার জন্য প্রার্থনা করো না। কেননা আল্লাহ তাঁর নবীর জন্য তাঁর নিকট যা' আছে তা' পছন্দ করেছেন। তোমাদের নিকট যা' আছে তা' পছন্দ করেন নি। তিনি তার পুরস্কার দেয়ার জন্য তাঁর প্রাণ হরণ করেছেন। তিনি তোমাদের মধ্যে তাঁর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নত রেখে গিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ দুটো বিষয় মজবুতভাবে ধরে রাখবে সে প্রকৃত ঈমানদার। যে এ দু'বিষয়ে পার্থক্য করবে সে অস্বীকারকারী। হে মুমিন মুসলিমগণ। তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। তোমাদের নবীর মৃত্যুতে শয়তান যেন তোমারকে অন্যমনস্ক না করতে পারে, তোমাদের ধর্ম থেকে তোমারকে ফিরিয়ে না নিতে পারে। মঙ্গলজনক কার্য দ্বারা শয়তানের সাথে সাক্ষাত করলে তোমরা শয়তানকে ব্যর্থ করে দিতে পারবে। তোমরা তার দিকে ফিরে তাকাবে না। অন্যথায় সে তোমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে ফেলবে এবং তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, যখন হযরত আবুবকর (রাঃ) তাঁর ভাষণ শেষ করলেন, তখন তিনি হযরত ওমর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বললেন, হে ওমর। তুমি-ই আমার নিকট বলেছ যে, হযরত মুহাম্মদ (দঃ)এর মৃত্যু হয় নি। তবে তুমি কি লক্ষ্য করছ না যে, তিনি নিজেই কোনদিন কি কথাগুলো বলে গেছেন? তদুপরি আল্লাহতায়ালা স্বয়ং তাঁর পাক কালামে বলেছেন, তোমার মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে। হযরত আবুবকর (রাঃ) এর মুখে কুরআনে পাকের উক্ত বাণী শ্রবণ করে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হল যেন কুরআনে পাকের ঐ পবিত্র বাণী আজকার দিনের পূর্বে আমি আর কখনই শ্রবণ করিনি। কিতাবে যেরূপ অবতীর্ণ হয়েছে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তা' ঠিক তদ্রূপই আছে। হুযুরে পাক (দঃ) যেরূপ হাদীস বলেছেন, তা' তদ্রূপই আছে। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা জীবিত, তাঁর মৃত্যু নেই। আমরা সবাই-ই আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন। আল্লাহর রাসূলের উপর আল্লাহর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এবং আমরা আল্লাহর নিকট আল্লাহর রাসূলকে দেখতে আশা করি। এই কথা বলে হযরত ওমর (রাঃ) হারের অনুবক পার্শ্বে উপবিষ্ট হলেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, যখন লোকজন হুযুরে পাক (দঃ)এর গোসলের জন্য সমব্মবে হল, তারা বলল, আল্লাহর কসম। আমরা কিরূপে তাঁর গোসল করান তা জানি না। তাঁর পরিধানের বস্তু কি উন্মোচন করব, যেরূপ আমরা আমাদের অন্যান্য ব্যক্তিদের বেলায় করে থাকি? না তাঁর পরিধানের বস্ত্রের উপরই গোসল করানো? হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, কি বিস্ময়কর ঘটনা। এসময় সবলোকের চক্ষুই তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়ল। আল্লায় তাদের উপর এমন তন্দ্রা পাঠালেন যে, এমন একজন লোকও ছিল না যে তারা কিছুক্ষণের জন্য তন্ত্রায় চলে পড়েনি। এমনি সময় কে একজন লোক এসে বলল, আল্লাহর রাসূলের পরিধানের বস্তুসহ তাঁকে গোসল করাও। একথা উপস্থিত সবাই শুনতে পেল, যদিও তারা তন্দ্রাভিভূত হয়েছিল। অতঃপর তারা জাগ্রত হয়ে ঐ নির্দেশানুযায়ী হুযুরে পাক (দঃ)এর গোসলকার্য সমাধা করল। তাঁকে তাঁর পরিহিত বস্ত্রসহ-ই গোসল করানো হল। গোসলকার্য সমাধা করতঃ লোকগণ তাঁকে কাফন পরালো। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, আমরা তাঁর পরিহিত জামা খুলতে ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু তখন আমাদের প্রতি ঘোষণা হল, হুযুরে পাক (দঃ)এর বস্ত্র উন্মোচন করো না। অন্যান্য লোকগণকে যেরূপ আমরা দেহ উলোট পালট করে গোসল করাই তাঁর ক্ষেত্রেও আমরা অন্ত্রপ করতে গেলাম, কিন্তু যখনই আমরা তাঁর দেহের এক অংশ উল্টাতে গেলাম, তখনই তা' আল্লাহর কুদরাতে আপনা আপনি উল্টে গেল। এরূপে আমরা তাঁর গোসলকার্য শেষ করলাম। এ সময় মৃদু বায়ু প্রবাহের শব্দের ন্যায় গৃহের মধ্যে মৃদু শব্দের স্বর শুনতে পেলাম, তোমরা আল্লাহর রাসূলের প্রতি বিনম্র হও, কেননা তোমাদের কষ্ট ও পরিশ্রম কিছুই করতে হবে না। হুযুরে পাক (দঃ)কে যখন দাফন করা হল, তখন তাঁর এমন কোন বস্তুই ছিল না, যা' তাঁর সাথে দাফন করা হয়নি। হযরত আবু জাফর বলেছেন, কবরের মধ্যে হুযুরে পাক (দঃ) এর শয্যা ও চাদর বিছানো হয়েছিল। তিনি জীবদ্দশায় যে বস্ত্র ও শয্যা ব্যবহার করতেন তা-ই পরিয়ে এবং বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঐ শয্যার উপরই তাঁর পবিত্র দেহ স্থাপন করা হয়েছিল। মৃত্যুকালে হুযুরে পাক (দঃ)এর ব্যক্তিগত কোন মালই রেখে দেয়া হয়নি। যা সামান্য কিছু ছিল সবই বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাঁর জীবদ্দশায় ইষ্টক বা প্রস্তর দ্বারা তার জন্য কোন গৃহ নির্মাণ করা হয় নি, কোন কাষ্ঠ দ্বারাও কোনরূপ উত্তম গৃহ তৈরি করা হয়নি। তাঁর সারা জীবনের কার্যাবলীতে মুসলমানদের জন্য যেরূপ আদর্শাবলী রয়েছে। তদ্রূপ তাঁর মৃত্যুকালীন ঘটনা ও কার্যাবলীতেও আদর্শ বিদ্যমান।
0 Comments