আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং দুনিয়ার উদ্দেশ্যে ভালবাসার পার্থক্য

 

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, আল্লাহর জন্য ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য শত্রুতা গুপ্ত বিষয়। তবে আমি এখন যা বর্ণনা করব তা' তার পর্দা উন্মোচন করে দেবে। বন্ধুত্ব দু' ভাগে বিভক্তঃ (১) আল্লাহর জন্য ভালবাসা (২) দুনিয়ার জন্য ভালবাসা।

        প্রতিবেশীর সহিত নিকটে বসবাসের জন্য ভালবাসা, মাদ্রাসায়-মক্তবে একসাথে পড়া-শুনা করবার জন্য ভালবাসা, বাজারে একসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করবার জন্য ভালবাসা, সফরে একসাথে ভ্রমণের জন্য ভালবাসা, রাজদরবারে একসাথে বসে দরবার, আলাপালোচনা করার জন্য ভালবাসা, এগুলোকে নিশ্চয় আমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা বলব না। কিন্তু এর মধ্যে যদি আল্লাহর ওয়াস্তের নিয়ত করা হয়, তাহলে এগুলোও আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা হবে। এতে সন্দেহ নেই যে, ইচ্ছাজনিত কার্য ব্যতীত কোন ছওয়াব হয় না এবং ভালবাসা ইচ্ছে থেকেই জন্যে। একত্রে উঠা-বসা, মেলা-মেশা এবং পাশাপাশি বাস করাকেই বলে সংসর্গ। ভালবাসা না হলে সংসর্গের ইচ্ছে হয় না। কেননা যা ভালবাসা যায় না, তা' ত্যাগ করা হয় এবং দূরে রাখা হয়। যা ভালবাসা যায়, তার দুটো অবস্থা হয়। যেমন প্রথমতঃ কোন বস্তুকে তার নিজের গুণের জন্য ভালবাসা হয়। তার সাহায্যে প্রেমাস্পদের নিকট পৌঁছার জন্য নয় বা পশ্চাতে কোন উদ্দেশ্যের জন্যও নয়। দ্বিতীয়তঃ তার সাহায্যে লক্ষ্যে পৌছার জন্য তাকে ভালবাসতে হয়। এই লক্ষ্যও এ দুনিয়ায় নিবন্ধ না হয়ে আখেরাতের সঙ্গে অথবা আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে। এভাবে ভালবাসা মোট চার শ্রেণীতে বিভক্ত হয়।

         প্রথম শ্রেণীঃ কোন ব্যক্তিকে শুধু তার নিজের গুণের জন্য ভালবাসা হয়। এটা সম্ভব যে, কোন ব্যক্তি স্বভাবতঃই কারও ভালবাসার পাত্র হয়। সে যখন তাকে দেখে তার পরিচয় পায় এবং তার স্বভাব-চরিত্র নিরীক্ষণ করে তাকে তার উত্তম বোধ হয়। যে ব্যক্তি তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করে তাঁর নিকট প্রত্যেক সুন্দর দ্রব্যই উপভোগের বস্তু এবং প্রত্যেক উপভোগের বস্তুই ভালবাসার পাত্র। সুন্দর মানুষকে উত্তম বলে মনে করা হয় এবং উত্তম বলে মনে করা হলেই স্বভাবের মধ্যে উত্তম মানুষের প্রতি ভালবাসা জন্মে। তারপর সেই উত্তম লোক বাহ্যিক আকৃতিতে সুন্দর হয় অথবা আভ্যন্তরীণ গুণে সুন্দর হয় অথবা বুদ্ধিতে পরিপক্ক হয় অথবা সুন্দর স্বভাববিশিষ্ট হয়। সৎস্বভাববিশিষ্ট লোক হলে তার কার্য-কলাপও সৎ হয় এবং পরিপক্ক বুদ্ধিবিশিষ্ট লোক হলে সে বহু বিদ্যায় বিদ্বান হয়। এসব গুণই সুস্থ স্বভাববিশিষ্ট লোকের এবং প্রকৃত বুদ্ধিমান লোকের নিকট উত্তম। হৃদয়ে প্রীতি স্থাপনের জন্য আর একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে। কখনও কখনও দেখা যায় দু' ব্যক্তির বন্ধুত্ব এবং ভালবাসা প্রগাঢ় হয়েছে। যদিও তাদের আকৃতি সুন্দর নয়। এক্ষেত্রে শুধু আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের জন্যই ভালবাসা এবং প্রীতি গাঢ় হয়েছে। কেননা কোন জিনিসের সাদৃশ্য স্বাভাবিকভাবে তার দিকেই আকর্ষণ করে। আভ্যন্তরীণ সাদৃশ্যের সুপ্ত এবং গুপ্ত কারণ আছে। তার অনুসন্ধান মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার নয়। হুযুরে পাক (দঃ) তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, মানুষের আত্মাগুলো সুবিন্যস্ত সৈন্যদল সদৃশ। তন্মধ্যে যার সাথে যার পরিচয় হয় তার সাথে তার ভালবাসা জন্মে। আর তন্মধ্যে যাদের পরস্পর পরিচয় হয় না, তাদের মধ্যে মতবিভেদ দেখা যায়। অপরিচিত হওয়াই এই মতভেদের কারণ এবং পরিচিত হওয়াই ভালবাসার কারণ, মোটকথা পরিচয় থেকে ভালবাসা জন্যে। তিনি আরও বলেছেন, আত্মাসমূহ সুবিন্যস্ত সৈন্যদল। এদের শূন্যে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং এরা পরস্পরের নিকটবর্তী হয়। কোন কোন আলিম এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, আল্লাহতায়ালা অত্মাসমূহকে সুষ্টি করে তন্মধ্যে কতক আত্মাকে শূন্যে উড়িয়ে দিয়েছেন, যারা আরশে মুআল্লার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শূন্যমন্ডলে যে আত্মার সাথে যে আত্মার পরিচয় হয়, তারা দুনিয়ায় পরস্পর সাক্ষাৎ করে একে অন্যের সাথে ভালবাসায় আবদ্ধ হয়। হুযুনে। পাক (দঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই দু' মুমিনের আত্মা দুদিনের দূরের পথ থেকে পরস্পর সাক্ষাৎ করে। যদিও এক আত্মা অন্য আত্মাকে কখনও দেখে নি।

        বর্ণিত আছে যে, মঞ্চায় একজন স্ত্রীলোক ছিল, যে অন্যান্য স্ত্রীলোকদেরকে নানা উপায়ে হাসাত। মদীনায় জনৈকা স্ত্রীলোকও এরূপ ছিল। মক্কার স্ত্রীলোকটি মদীনায় এসে হযরত আয়েশা (রাঃ)এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার হাসির উদ্রেক করলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় আছ? সে যার কাছে ছিল সে সঙ্গিনীর কথা বললে, তিনি বললেন, আল্লাহ এবং তার রাসূল (দঃ) সত্যই বলেছেন। যেমন আমি রাসূলুল্লাহ (দঃ) কে বলতে শুনেছি আত্মাসমূহ সুবিন্যস্ত সৈন্যদল ইত্যাদি। এ ঘটনার সত্যতায় বুঝা যাচ্ছে যে, স্বভাবের সাদৃশ্য প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। যেসব কারণ সেই সম্বন্ধকে নিশ্চিত করে তা' মানব জ্ঞানের অগোচর। আমাদের জ্ঞান- বুদ্ধি খুব সামান্যই দেয়া হয়েছে। কাজেই এগুলো বিশ্বাস এবং স্বীকার করার জন্য মোটামুটি অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যক্ষ দর্শনই যথেষ্ট। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যদি কোন একজন মুমিন একশ মুনাফিক এবং একজন মুমিনের মজলিসে প্রবেশ করে তবে সে নিশ্চয়ই উক্ত মুমিন ব্যক্তির নিকট এসে বসবে। ঠিক তদ্রূপ যদি একজন মুনাফিক এমন কোন মজলিসে প্রবেশ করে, যে মজলিসে একশ মুমিন এবং একজন মুনাফিক আছে, তবে ঐ মুনাফিক নিশ্চয়ই সে মজলিসের মুনাফিকের কাছে গিয়েই বসবে। এর দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, একই প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবেই পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করে। যদিও তারা তা' জ্ঞাত নয়। হযরত মালেক বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন, প্রত্যেক দশ জনের মধ্যে দুজনের একমত হয় না। তবে দুজনের প্রকৃতি একই হলে তাদের মতের মিল হয়। মানুষের শ্রেণীও পাখীর শ্রেণীর ন্যায়। দুটো বিভিন্ন শ্রেণীর পাখী স্বভাবতঃই একসাথে উড়ে না। একদা এক ব্যক্তি একটি কাককে একটি কবুতরের সাথে উড়তে দেখে আশ্চর্য বোধ করে বলল, কাক ও কবুতর নিশ্চয়ই একসাথে উড়বার কথা নয়। কিন্তু পরে দেখা গেল ঐ দুটো পাখীই লেংরা ছিল। তখন লোকটি বলল, এজন্যই এ দুটো পাখীর মধ্যে মিল হয়েছিল। জনৈক বিজ্ঞ লোক বলেছেন, প্রত্যেক লোকই তার আকৃতি ও প্রকৃতিবিশিষ্ট লোকের সঙ্গে মিলিত হয়। যেমন প্রত্যেক পাখী একরূপ আকৃতি ও প্রকৃতিবিশিষ্ট পাখীর সঙ্গে কখনও কখনও গিয়ে মিলিত হয়। তারপর যখন সে বুঝতে পারে যে, ঐ পাখীটি তার স্বজাতীয় নয়, তখন সে তার থেকে পৃথক হয়ে যায়। উল্লিখিত দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষ তার একই প্রকারের লোককে ভালবাসে। এ ভালবাস্য কোন উপকার পাবার জন্য নয় বা ধন-সম্পত্তি লাভের জন্যও নয়; বরং শুধু একই শ্রেণীও হবার কারণে। শুধু গুপ্ত ও আভ্যন্তরীণ স্বভাব-চরিত্রের সম্পর্কের জন্য। এই শ্রেণীর মধ্যে সৌন্দর্যের জন্য ভালবাসা আছে। যখন কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থের উদ্দেশ্য না হয়। সুন্দর আকৃতি নয়ন কৃষ্টিকর বটে, বিচিত্র ফল, ফুল ও বিভিন্ন বং দেখে চক্ষু তৃপ্তিলাভ করে। সুন্দর সবুজ বর্ণের দিকে দৃষ্টির চক্ষুর তৃপ্তি ব্যতীত আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এরূপ নয়ন তৃপ্তির জন্য ভালবাসা বলা যায় না; বরং তা' শুধু চক্ষু এবং প্রবৃত্তির তৃপ্তি। যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী নয়, তার মধ্যেও এই চক্ষুর তৃপ্তিকর জিনিষ থাকে। এ তৃপ্তিতে যখন অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তখন তা' নিন্দনীয় ও দোষণীয় হয়। যেমন সুন্দর আকৃতি দেখে কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্য কাউকে ভালবাসা। যদি তাতে কোনরূপ অসৎ উদ্দেশ্য না থাকে তখন তা' হালাল। এ ভালবাসাকে নিন্দা বা প্রশংসা কোনটাই করা যায় না। ভালবাসা তিন প্রকার। যথা প্রশংসনীয়, নিন্দনীয় এবং হালাল। যা প্রশংসা বা নিন্দার যোগ্য নয়।

        দ্বিতীয় শ্রেণীঃ মানুষ একে অন্যকে এজন্য ভালবাসে যে, তাকে ভালবাসলে অন্যের ভালবাসা পাওয়া যাবে। তখন সে ভালবাসার উছিলা বা উপকরণ হয়। প্রিয়বস্তু পাবার জন্য যা উছিলা হয় তাও প্রিয়। প্রিয়বস্তু পাবার পন্থাও প্রিয়। এজন্যই মানুষের নিকট স্বর্ণ ও রৌপ্য অধিক প্রিয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের নিজস্ব কোন গুণ নেই। কেননা তা' ভক্ষণ করা যায় না। পরিচ্ছদরূপেও ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু দুটোই প্রিয়বস্তু পাবার উছিলা বা উপায়। মানুষের মধ্যে এমন মানুষ আছে, যাকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ন্যায় ভালবাসা হয়। কেননা সে গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর উছিলা হয়। তার সাহায্যে খ্যাতি, ধন-সম্পদ অথবা বিদ্যা অর্জিত হয়। যখন কোন লোক ধন-সম্পদ ও খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে দেশের বাদশাহকে ভলবাসে তখন সে বাদশাহর প্রিয় সভাষদকেও ভালবাসে। কেননা তারা তার অবস্থা বাদশাহকে জানিয়ে দেয়।

         যে উদ্দেশ্যের জন্য প্রিয় জিনিসকে উছিলা করা হয়, যদি তার উপকার শুধু পার্থিব সম্বন্ধীয় হয়, তাহলে উছিলাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসা বলা যায় না। যদি তা' শুধু পার্থিব উপকারেই নিবদ্ধ থাকে এবং দুনিয়া ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্য না থাকে। যথা শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ভালবাসা। এটাও আল্লাহর ভালবাসা বহির্ভূত। কেননা সে ইলম অর্জনের জন্য শিক্ষককে ভালবাসে। তার প্রিয়বস্তু এখানে ইলমই মাত্র, অন্য কিছু নয়। যদি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইলম হাছিলের উদ্দেশ্য না থাকে বরং তার উদ্দেশ্য থাকে শুধু ধন-সম্পদ, যশঃ মান-খ্যাতি, লোভ-প্রীতি। এক্ষেত্রে ইলম শুধু ঐসব বস্তুর উছিলা হয়। কাজেই এ ভালবাসাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা বলা যায় না। যে ব্যক্তি মূলতঃ আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী সেও এরূপ ভালবাসা অর্জন করতে পারে। তারপর এ ভালবাসা নিন্দনীয় হয় এবং হালালও হয়ে থাকে, এর দ্বারা যদি কোন নিন্দনীয় উদ্দেশ্য থাকে যেমন বন্ধু-বান্ধবের প্রতি অত্যাচার, ইয়াতীমদের মাল আত্মসাৎ, অন্যায়ভাবে প্রজাদের উপর নিপীড়ন তখন এ ভালবাসা নিন্দনীয় হয়। আর যদি উদ্দেশ্য কোন হালাল জিনিসে উপনীত হওয়া থাকে তখন এ ভালবাসাও হালাল হয়।

        তৃতীয় শ্রেণীঃ কোন বস্তুকে ঐ বস্তুর জন্যই ভাল না বালা বরং অন্য বস্তুর উদ্দেশ্যে ভালবাসা। এই অন্য বস্তু দুনিয়ার কোন মঙ্গলের জন্য নয়, বরং তা' আখেরাতের জন্য। এটা প্রকাশ্য, গুপ্ত নয়। যেমন মুরীদের পীরকে ভালবাসা, পীর ইলম হাছিল এবং আমল সুন্দর করবার উছিল্য বা কারণ। এই ইলম ও আমলের দ্বারা তার উদ্দেশ্য পারলৌকিক সাফল্য। সুতরাং এটা আল্লাহর জন্য ভালবাসা। তদ্রূপ পীর তার মুরীদগণকে ভালবাসে। কেননা সে তাদেরকে ইলম দান করে এবং তার উসীলায় সে শিক্ষাদানের পদমর্যাদা লাভ করে। তদ্বারা সে জগতে সম্মানিত পদমর্যাদায় উন্নীত হয়। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিদ্যা শিক্ষা করে তদনুযায়ী কাজ করে এবং অপরকে বিদ্যা শিক্ষা দেয়, আধ্যাত্মিক জগতে সে মহৎ নামে আখ্যায়িত হয়। ছাত্র ব্যতীত শিক্ষা পূর্ণ হয় না। পূর্ণতা অর্জনের জন্য ছাত্রই শিক্ষকের উন্নতির মূল শিক্ষক ছাত্রকে এ কারণেই ভালবাসে। কেননা সে তার হৃদয়কে ফসলের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরূপ প্রস্তুত করে। আধ্যাত্মিক জগতে শিক্ষকের উচ্চ মর্যাদার জন্য সে উসীলা হয়। তখন আল্লাহর জন্যই সে ভালবাসার পাত্র; বরং সে আল্লাহর জন্য সমস্ত ধন দান করে দেয়। অতিথি সৎকার করে এবং তাদের জন্য সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করে, যেন সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। এই নিয়মে যে রন্ধনকারী উত্তম পাক করে সেও আল্লাহর জন্য পরম্পর ভালবাসাকারীদের অন্তর্গত। তদ্রূপ যে ব্যক্তি কারও যাকাত পাবার উপযুক্ত লোকদেরকে তা' পৌঁছে দেয়, সেও আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা রাখে; বরং এর পরেও আমরা বাড়িয়ে বলব যে, যখন সে এমন ব্যক্তিকে ভালবাসে যে তার কাপড় ধৌত করে দেয়, তার ঘর ঝাড়ু দেয়, তার খাদ্য পাকিয়ে দেয় এবং এর দ্বারা ইলম ও আমল করবার জন্য তাকে অবসর দেয় এবং যদি এসব কার্যে তা' খেদমত পাবার উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্য অবসর পাওয়া হয়, তবে সেও আল্লাহর জন্য ভালবাসার পাত্র; বরং আরও বলব যে, যে ব্যক্তি তার বন্ধুর জন্য স্বীয় ধন- সম্পদ ব্যয় করে, তার বস্ত্র তাকে পরিধান করায়, তার খাদ্য দ্বারা তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করে, তার ঘর দ্বারা তাকে বসবাসে সাহায্য করে এবং সমস্ত পার্থিব কাজ-কারবারে তার সহায়তা করে আর তার উদ্দেশ্য এই থাকে যে, বন্ধুকে ইলম ও আমলে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অবসর , তবে সেও আল্লাহর জন্য ভালবাসার পাত্র।

         পূর্বকালের একদল ধনীলোক ধার্মিক লোকদেরকে খোরাক পোশাক দিত। তারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসত। আমি আরও বলব যে, যে ব্যক্তি শয়তানের কুমন্ত্রণ। হতে বাঁচার জন্য এবং তার ধর্মকে রক্ষা করবার জন্য কোন স্ত্রীলোককে বিবাহ করে বা এমন ধার্মিক সন্তান পাবার জন্য বিবাহ করে যে, তার জন্য দোয়া করবে এবং সে তজ্জন্য তার স্ত্রীকে ভালবাসে। কেননা স্ত্রী ধর্মের এসব উদ্দেশ্য হাছিল করবার উপকরণ। সুতরাং সে আল্লাহর জন্য ভালবাসার পাত্র। এজন্যই হাদীস শরীফে পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করবার ব্যাপারে প্রভৃত পুরস্কার এবং ছওয়াবের কথা এসেছে। এমন কি স্বামী তার স্ত্রীর মুখে যে খাদ্যের গ্রাস উঠিয়ে দেয়, তাতেও ছওয়াব রয়েছে; বরং আমি বলব, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসা এবং সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ও আখেরাতে তার দীদারের উদ্দেশ্যে রাত জাগরণ করে, সে যদি অন্য কাউকে ভালবাসে, সে আল্লাহর জন্য তাকে ভালবাসে। কেননা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন কোন জিনিসকে ভালবাসা তার স্বভাব নয়, সুতরাং তার ভালবাসা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে। বরং আমি আরও বলব যে, যদি তার হৃদয়ে দু' প্রকার ভালবাসা থাকে, আল্লাহর জন্য ভালবাসা এবং দুনিয়ার জন্য ভালবাসা এবং একই ব্যক্তির মধ্যে তার সমন্বয় হয় এবং তাতে যদি আল্লাহকে ও দুনিয়াকে উত্তমরূপে পাওয়া যায় এবং সে যদি দু' দিকের মঙ্গলের জন্যই তাকে ভালবাসে, তবে সেও আল্লাহর জন্য ভালবাসার পাত্র। তার এ ভালবাসা তার সেই মুরশিদকে ভালবাসার ন্যায়, যে তাকে দ্বীনের বিষয় শিক্ষা দেয় এবং ধন-সম্পদ দিয়ে দুনিয়ার প্রয়োজনও মিটায়। যে মুরশিদ তার মুরীদের পার্থিব সুখ-সম্পদ ও আখেরাতের সৌভাগ্যের জন্য উসীলা হয়, সেও আল্লাহর জন্য ভালবাসার পাত্র। আল্লাহর জন্য ভালবাসার এমন কোন শর্ত নেই যে, দুনিয়ার কোন বিষয়কে ভালবাসা যায় না। কেননা যে দোয়া করতে নবীগণকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই রয়েছে, যেমন "রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাও অফিল আখিরাতি হাসানাহ" অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদেরকে দুনিয়ায় মঙ্গল দাও এবং আখেরাতেও মঙ্গল দাও। হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর দোয়ায় বলতেন, হে মাবুদ। আমার শত্রুদেরকে আমার উপর সন্তুষ্ট হতে দিও না, আমার বন্ধুগণকে আমার উপর নাখোশ হতে দিও না। আমার ধর্মের জন্য আমার বিপদ সৃষ্টি করো না, দুনিয়াকে আমার অধিক চিন্তার বিষয় করো না। শত্রুদের আনন্দ দুনিয়ার বিষয়-সম্পত্তি হতে দূর করে দাও। তিনি একথা বলেন নি যে, দুনিয়াকে আমার চিন্তার মূল করো না বরং তিনি বলেছেন, দুনিয়াকে আমার চিন্তার বিষয় করো না।

        হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর দোয়ার মধ্যে বলেছেন, হে মাবুদ! আমি তোমার করুণা প্রার্থনা করি, যেন তদ্বারা আমি তোমার সম্মানের গৌরব দুনিয়া ও আখেরাতে অর্জন করতে পারি। তিনি আরও বলেছেন, দুনিয়ার বিপদ-আপদ এবং আখেরাতের বিপদ-আপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর। মোটকথা যখন আখেরাতে সৌভাগ্যের ভালবাসা আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পরিপন্থী নয়, তখন পার্থিব নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, প্রচুর সম্পদ এবং মান-সম্মানের ভালবাসা কিরূপে আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পরিপন্থী হবে?

        ইহলোক ও পরলোকের অর্থ দুটো অবস্থা মাত্র। এর একটি অন্যটি হতে অধিক নিকটে। সুতরাং মানুষ আজকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভাল না বাসলে সে কি করে কালকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভালবাসবে? কালকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চয়ই তার ভালবাসা উচিত। কেননা কালকার দিন শীঘ্রই স্থায়ী অবস্থায় পরিণত হবে। সুতরাং স্থায়ী অবস্থা অনুসন্ধানের বস্তু হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। তবে এই দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দু' প্রকার। এক প্রকার আখেরাতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিপরীত এবং তার প্রতিবন্ধকস্বরূপ। নবী-রাসূল এবং অলী-আউলিয়াগণ তা' থেকে সতর্ক থাকতেন। তা' থেকে সতর্ক থাকার জন্য তাঁদেরকে আদেশ করা হয়েছিল। আর এক প্রকার পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, যা আখেরাতের সুখের পরিপন্থী নয়। তা' তাঁদের জন্য নিষেধ করা হয় নি। যেমন বিশুদ্ধ বিবাহ, হালাল ভক্ষণ ইত্যাদি। যা আখেরাতের সুখের বিপরীত এবং প্রতিবন্ধক, তা' যে কোন জ্ঞানী ব্যক্তির ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করা উচিত এবং তার প্রতি ভালবাসা করা অনুচিত। বাদশাহর জন্য সুস্বাদু খাদ্য তৈয়ার করা হলে যদি কোন লোক জানতে পারে যে, 'তা' ভক্ষণ করলে ভক্ষণকারীর হাত কাটা যাবে বা তাকে কতল করা হবে, তখন সে ঘৃণাভরে ঐ খাদ্য প্রত্যাখ্যান করবে। এর কারণ এই নয় যে, সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণ করায় আগ্রহ নেই বা তা' ভক্ষণ করলে আস্বাদ পাবে না বরং এর কারণ হল, তার বুদ্ধি ও জান তাকে ঐ খাদ্যের নিকট যেতে বাধা দেয় এবং তার মনের মধ্যে ঐ খাদ্য ভক্ষণের বিপদের কথা জাগরুক থাকে। তন্ত্রপ আখেরাতের সুখের যা পরিপন্থী তা' ঘৃণার সাথে ত্যাগ করতে হবে। এর উদ্দেশ্য এই যে, যদি ছাত্র তার ওস্তাদকে ভালবাসে। কেননা শিক্ষক তার প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শন করে এবং তাকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান করে। অথবা ওস্তাদ যদি ছাত্রকে ভালবাসে, কেননা ছাত্র তার নিকট দ্বীনি ইলম শিক্ষা লাভ করে এবং তার ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ লাভ করবে। তাহলে তারা আল্লাহর জন্য ভালবাসাকারী হবে। তবে এর একটি শর্ত রয়েছে তা' হল যদি শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষাদানে বিরত থাকে অথবা ছাত্র শিক্ষক হতে বিদ্বার্জন, ভালবাসা হতে বিরত থাকে বা তাতে কোন ওজর আপত্তি উত্থাপন করে, তজ্জন্য তার ভালবাসা নিশ্চয়ই হ্রাস পাবে। যে পরিমাণ হ্রাস পাবে সেই পরিমাণ আল্লাহর জন্য ভালবাসাও হ্রাস পাবে। তদ্রূপ যতই ইলম উক্ত নিয়তে শিখবে ও শিখাবে, ততই আল্লাহর জন্য ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। যে ব্যক্তির সাথে তোমার বহু জরুরী কাজ থাকে, তাকে তুমি খুব বেশী ভালবাসতে থাক, তবে যে পরিমাণ সে তোমার প্রয়োজন সম্পাদনে বিরত থাকবে, সেই পরিমাণ তার প্রতি তোমার ভালবাসা হ্রাস পাবে। আর যে পরিমাণ সে তোমার প্রয়োজন সম্পাদন করবে, সে পরিমাণ তোমার ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। যদি স্বর্ণ ও রৌপ্য ওজনে এক সমান হয়, স্বর্ণের প্রতি তোমার ভালবাসা রৌপ্যের প্রতি তোমার ভালবাসা হতে অনেক অধিক হবে। কেননা স্বর্ণের প্রয়োজন রৌপ্যের প্রয়োজন থেকে অনেক অধিক। যখন অধিক প্রয়োজন পরিপূর্ণ হবার জন্য ভালবাসাও বৃদ্ধি হয় এবং যখন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রয়োজনের সমন্বয় হয়, তখন তা' আল্লাহর প্রতি ভালবাসার সীমার মধ্যে পতিত হয়। আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান না থাকলে প্রত্যেক ভালবাসাই আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসার রূপ ধারণ করে 'না, ভালবাসার মধ্যে প্রত্যেক আধিক্যই তদ্রূপ।, যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান না থাকে, তাহলে সেই ভালবাসা বৃদ্ধি হয় না। আল্লাহর জন্য ভালবাসার এই বৃদ্ধি সূক্ষ্ম এবং কঠিন। হযরত জারীরী (রহঃ) বলেছেন, প্রথম শতাব্দীতে লোকজন ধর্মের সঙ্গে এমন ব্যবহার করত যে, ধর্ম তাতে বশীভূত হয়ে গিয়েছিল। তারা দ্বিতীয় শতাব্দীতে আমানতের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করত যে, আমানত চলে গিয়েছিল। তৃতীয় শতাব্দীতে তারা মনুষ্যত্বের সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করত যে, মনুষ্যত্ব চলে গিয়েছিল। বর্তমানে ভয় এবং মোহ ব্যতীত অন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই।

        চতুর্থ শ্রেণী: আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা। এটা সম্পূর্ণ নিখুঁত-নিঃস্বার্থ প্রেম ও ভালবাসা। তাতে ইলম অর্জনের উদ্দেশ্য নেই, প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্য নেই, অন্য কোন স্বার্থ সিদ্ধির আকাঙ্খা নেই। এটাই সর্বোচ্চ শ্রেণীর ভালবাসা। সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম এবং গুপ্ত। প্রেম যখন গাঢ়তর রূপ ধারণ করে, তখন প্রিয়জন ব্যতীত প্রিয়জনের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক বর্তমান, তাদের প্রতিও প্রেম বিস্তার লাভ করে। তা' বহু দূরবর্তী হলেও প্রেমিক তা' ভালবাসে। প্রেমে নিমজ্জিত হলে প্রেমিক প্রিয়জনের ভালবাসার পাত্রকেও ভালবাসে এবং প্রিয়জন যাদেরকে ভালবাসে সেও তাদেরকে ভালবাসে। যারা প্রিয়জনের পরিচর্যা করে, প্রেমিক তাদেরকেও ভালবাসে, যারা প্রিয়জনকে সন্তুষ্ট করবার জন্য চেষ্টিত, প্রেমিক তাদেরকেও ভালবাসে। বাকিয়াহ বিন অলীদ (রহঃ) বলেছেন, যখন এক মুমিন ব্যক্তি অন্য কোন মুমিন ব্যক্তিকে ভালবাসে, সে তার কুকুরটিকেও ভালবাসে। প্রেমিকের অবস্থা লক্ষ্য এবং পর্যালোচনা করেই এরূপ উক্তি করা হয়েছে। কবিদের কাব্যেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রেমিক প্রিয়জনের বসনকে নিজের নিকট রেখে দিয়ে তার স্মৃতি জাগরুক রাখে। সে তার ঘরবাড়ি ভালবাসে, তার বাসস্থানকে ভালবাসে। প্রেমিক মজনুর উক্তি থেকেই এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। সে তার নিজের ঘটনা প্রকাশ করেছেঃ

লাইলী-গৃহের দেয়াল ধরে

 খেলাম চুমো প্রেমের বশে

 না হোক সে মোর লাইলী প্রিয়া 

লাইলী গৃহের দেয়াল তো সে।

        বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যক্ষ দর্শন দ্বারা প্রমাণিত হয়, যে ভালবাসা প্রিয়জনকে অতিক্রম করে তার সাথে সম্পৃক্ত সব কিছুতেই ছড়িয়ে পড়ে, তখনই প্রেমের প্রবল স্রোতধারা প্রত্যক্ষ করা যায়। এটাই প্রেমে পূর্ণ নিমজ্জিত হবার চিহ্ন। প্রকৃত প্রেম যত প্রবল হয় ততই প্রেমের বিস্তৃতি ঘটে এবং ততই প্রিয়জন সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও বস্তুকে প্রেমিক ভালবাসতে শুরু করে। আল্লাহর প্রতি ভালবাসাও ঠিক তদ্রূপ। যখন আল্লাহর প্রতি প্রেম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখন তা' হৃদয়ের উপর কর্তৃত্ব আরম্ভ করে। প্রেমিক তখন প্রত্যেক বস্তুতেই প্রিয়জনের শক্তি, নিদর্শন এবং বিকাশ দেখতে পায়। যে ব্যক্তি কোন লোককে ভালবাসে, সে তার হস্তশিল্পের প্রতিও আকৃষ্ট হয়। সে তার লিখিত পত্রকে ভালবাসে, তার যেকোন কার্যকলাপকে ভালবাসে। এজন্যই যখন হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নিকট কোন টাটকা ফল উপস্থিত করা হত, তিনি তা' দুটো চোখের সামনে রেখে তার প্রতি সম্মান দেখাতেন এবং বলতেন, এটা আমাদের প্রভুর সাহায্যেই এসেছে, আল্লাহর প্রতি ভালবাসার ফলে। তার প্রতিজ্ঞা সত্য হবার দৃঢ় আশা করা হয় এবং পারলৌকিক নিয়ামত প্রাপ্তির প্রত্যয় জন্মে এবং এভাবে অতীত সময়ে তার বিচ্ছিন্ন করুণা ও শক্তি প্রদর্শন হয়েছিল বলে বিশ্বাস হয় এবং সেজন্য তার অস্তিত্বেরও পরিচয় লাভ করা যায়। এটাই প্রেমের সূক্ষ্ম এবং সর্বাপেক্ষা উঁচু নিদর্শন। আমি এ পুস্তকের পরিত্রাণ খন্ডে বিষয়টির উপর বর্ণনা করেছি। যখন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়, তখন আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত সব জিনিসেই তা' বিস্তার লাভ করে। এমন কি তন্মধ্যে নিন্দনীয় বস্তুগুলোতেও তা' পরিব্যাপ্ত হয়। কিন্তু ভালবাসার আবেগ ও উচ্ছ্বাস কষ্টের ও আনন্দের অনুভূতিকে বৃদ্ধি করবার ফলে প্রেমিক তখন বলে, আমার প্রিয়জনের নিকট এ ব কাজটিই প্রিয়। এ অবস্থা তার জ্বালা-যন্ত্রণা প্রশমন করে প্রিয়জনের নিকট থেকে আগত বিপদকে সে তুচ্ছ প্রহারস্বরূপ মনে করে তাতেও আনন্দ অনুভব করে। প্রেমের ক্ষেত্রে লিপন এক প্রকার লম্বু তিরস্কার বৈ নয়। প্রেমের উচ্ছ্বাস তাতে আনন্দ উৎপাদন করে। কোনরূপ কষ্ট-ক্লেশের বালাই থাকে না। কোন একদল লোকের উপর আল্লাহর প্রতি ভালবাসা এতদূর পৌছেছিল যে, তারা বলেছিল বিপদ-আপদ ও সুখ-সমৃদ্ধির মধ্যে আমরা কোন পার্থক্য দেখি না। কেননা সব কিছুই আল্লাহর নিকট হতে আসে। তার সন্তুষ্টি এবং রাজীতেই আমরা খুশী এবং আনন্দ অনুভব করি, এমনকি তাঁদের জনৈক বুযর্গ বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে গুনাহ করে আমরা তাঁর ক্ষমাপ্রাপ্তির ইচ্ছে করি না। এ প্রসঙ্গেই মহাত্মা সামনুন (রহঃ) বলেছেন,

"আমার সাথে যেই ব্যবহার 

করে তুমি হও খুশী

 সেটাই আমার কাম্য প্রিয়

তাতেই আমার সুখ বেশী।"

             যখন আল্লাহর প্রতি কারও ভালবাসা প্রবল হয় এবং সে ইলম ও আমলে, আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালনে সুদৃঢ় হয়, তাকে আল্লাহ-প্রেমিক ভালবাসে অথবা যে ব্যক্তির গুণাবলী আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং যে সৎস্বভাববিশিষ্ট অথবা যে ব্যক্তির জীবন যাপন প্রণালী শরীয়তসম্মত তাকেও সে ভালবাসে। এমন কোন মুমিন ব্যক্তি নেই, যে আখেরাতকে এবং আল্লাহকে ভালবাসলে তার সামনে যদি একজন পরহেজগার আলিম এরং একজন গুনাহগার মূর্খ লোকের উল্লেখ করা হয়, তখন তার মন উক্ত পরহেজগার আলিমের দিকে ঝুঁকে পড়ে না। তার প্রতি সেই মুমিনের আসক্তি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তার ঈমানের বৃদ্ধি ও শক্তি অনুযায়ী এবং আল্লাহর প্রতি তার ভালবাসার বৃদ্ধি ও শক্তি আনুযায়ী ঐ আসক্তি প্রবল হয়। যদিও সে নিকটে না থাকে, তবুও তার এই আসক্তি নিশ্চয়ই জন্মাবে। কেননা সে জানে যে, দুনিয়া ও আখেরাতে তার নিকট থেকে কোন মঙ্গল পৌছবে না এবং মন্দও পৌঁছবে না। এই আসক্তি শুধু আল্লাহর জন্য এবং শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ ভালবাসা। যেহেতু আল্লাহ তাকে ভালবাসে, সে আল্লাহর গৃহীত বান্দা এবং আল্লাহর ইবাদাতে বাস্ত থাকে, তজ্জন্য তার বন্ধুও তাকে ভালবাসে। এই আসক্তি দুর্বল হলে তার চিহ্নও প্রকাশ পায় না; তার জন্য ছওয়াব প্রকাশ পায় না এবং কোন পুরস্কারও প্রকাশ পায় না।

        আল্লাহর প্রতি ভালবাসার তারতম্যে বিভিন্ন লোকের মধ্যে ভালবাসার প্রভেদ হয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতে প্রিয়জনের নিকট থেকে কোন বস্তু পাবার মধ্যে যদি ভালবাসা সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে, মৃত নেককার, আলিম, দরবেশ, ছাহাবী এবং তাবেয়ীনদের প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। এমন কি মৃত নবীদের প্রতিও ভালবাসা হওয়া সম্ভব নয়। যদিও এসব মহৎ ও নেককার লোকদের জন্য ভালবাসা প্রত্যেক ধার্মিক ব্যক্তির হৃদয়ে গুপ্তভাবে নিহিত থাকে। যখন তাদের সম্পর্কে তাদের শত্রুগণ অন্যায়ভাবে দোষারোপ করে, তখন তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তাদেরকে প্রশংসা করলে ও তাদের গুণাবলী উল্লেখ করলে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তার চিহ্নও প্রকাশ পায়। একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসার কারণেই এরূপ ক্ষোভ ও আনন্দের সঞ্চার হয়। কেননা তারা আল্লাহর খাছ ও প্রিয় বান্দা ছিলেন। যে ব্যক্তি কোন রাজাকে ভালবাসে সে তার বিশেষ ভালবাসার পাত্রকেও ভালবাসে এবং তার চাকর-বাকরকেও। ভালবাসে। সে যাকে ভালবাসে এ ব্যক্তিও তাকে ভালবাসে। তবে সে নিজের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জন্য তাদেরকে ভালবাসে।

        কখনও কখনও ভালবাসা এত প্রবল হয় যে, প্রিয়জনের ইচ্ছে ব্যতীত নিজের বলতে তার কোন ইচ্ছেই থাকে না। একব্যক্তি বলেছেন, যখন বেদনা মানুষকে আনন্দ দান করে, তখন তার আর ক্ষত থাকে না। ভালবাসা কখনও কখনও এমন হয় যে, তজ্জন্য কোন কোন আমোদ-প্রমোদকে পরিত্যাগ করা হয়। কেউ কেউ প্রেমম্পদের খুশীর জন্য তার সমস্ত ধনের অর্ধেক, এক তৃতীয়াংশ বা এক দশমাংশ দান করেও সে সন্তোষ লাভ করে। প্রিয়বস্তু ত্যাগের পরিমাণ অনুসারে কারও প্রতি ভালবাসার পরিমাণের পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা ভালবাসার বস্তু ত্যাগ করাই ভালবাসা পরীক্ষার প্রকৃত মাপকাঠি। ভালবাসা প্রবল হলে প্রিয়বস্তু ত্যাগ করা সম্ভব হয়। যখন কোন জিনিসের ভালবাসা কোন ব্যক্তির সম্পূর্ণ হৃদয়কে নিমজ্জিত করে ফেলে, তখন সেই জিনিস ব্যতীত অন্য কিছুর প্রতিই তার আকর্ষণ থাকতে পারে না। হযরত আবুবকর (রাঃ) এ ভালবাসার অধিক্যে-ই সবকিছু দান করে ফেলেছিলেন। নিজের হাতে কোন কিছুই রেখে দেয়া তাঁর জন্য সম্ভব হয় নি। এমন কি তিনি তাঁর চক্ষুর পুত্তলী প্রিয় দুহিতাকেও প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর হস্তে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর সমস্ত ধন-দৌলত প্রিয় ইসলামের জন্য ত্যাগ করেছিলেন।

        হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেছেন, একদা হযরত রাসূলে করীম (দঃ)ও হযরত আবুবকর (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। এসময় হযরত আবুবকর (রাঃ) এর পরিধানে একটি খেরকামাত্র ছিল। তা' তিনি একটি খিলাল দ্বারা বক্ষের উপর আটকিয়ে রেখেছিলেন। ইতিমধ্যে ফিরেশতা জিবরাইল তথায় আগমন করলেন এবং হযরত রাসূলে করীম (দঃ)কে লক্ষ্য করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। হযরত আবুবকর (রাঃ) এর পরিধানে শুধু একটি খেরকা দেখছি কেন? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তাঁর সমস্ত ধন-সম্পত্তি আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন। তখন ফিরেশতা জিব্রাইল বললেন, আল্লাহর তরফ থেকে তাঁকে সালাম জানাবেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি কি তাঁর অভাবের কারণে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট অথবা অসন্তুষ্ট? তখন হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) এর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আবুবকর। ইনি জিব্রাইল। ইনি আল্লাহর তরফ থেকে আপনাকে সালাম জানাচ্ছেন এবং জিজ্ঞেস করছেন, আপনি কি আপনার অভাব-অনটনের জন্য আল্লাহর প্রতি খুশী আছেন, নাকি না-খোশ আছেন? আবুবকর (রাঃ) একথা শুনে কেঁদে ফেলে বললেন, আমি কি আমার প্রভুর উপর না-খোশ হতে পারি? নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।

        সারকথ। এইযে, যে যেমনভাবে আল্লাহকে ভালবাসে, তার ভালবাসার পরিমাণ অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে ছওয়াব এবং পুরস্কার লাভ করবে। এটাই আল্লাহকে ভালবাসার মূল তাৎপর্য।

Post a Comment

0 Comments