হাশরের ময়দান ও সমবেত প্রাণীগণ হিসাব নিকাশ

        পুনরুত্থানের পর লক্ষ্য কর, লোকদেরকে কিভাবে নগ্নপদে উলঙ্গ অবস্থায় হাশরের ময়দানের দিকে তাড়িয়ে নেয়া হবে। সেই সমবেত প্রাণীদের অবস্থান-স্থল হবে শ্বেত বর্ণ বিশিষ্ট, সমতল তাতে উঁচু-নীচু থাকবে না। তার মধ্যে বক্রতা বা কোনরূপ ভাঁজও থাকবে না। যার পিছনে মানুষ পালিয়ে থাকতে পারে। হাশরের ময়দানে কোন গর্ত থাকবে না যাতে প্রবেশ করে কো কেউ চোখের আড়াল হয়ে থাকতে পারে। বরং তা' একই বিস্তৃত সমতল ভূমি হবে। ঐ ময়দার দলে দলে লোকদেরকে তাড়িয়ে নেয়া হবে। সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি অসংখ্য শ্রেণীর সৃষ্ট জীবকে সেই বিরাট প্রান্তরে দুনিয়ার সব এলাকা থেকে এনে একত্র করবেন। এট এটা হবে তাঁর প্রথমবারের এক ফুৎকারে। তারপর দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়া হবে। কুরআনে পাকের মধ্যে যে, 'রাজিফাহ' শব্দ এসেছে তার অর্থ প্রথম ফুৎকার। তারপর যে, 'রাদিফাহ' শব্দ এসেছে, তার অর্থ দ্বিতীয় ফুৎকার। এই ফুৎকারের পর সেদিন প্রত্যেক মানুষের অন্তঃকরণ ভীত ও সন্ত্রস্ত হবে এবং তাদের চোখের দৃষ্টি ভয়সস্কুল হবে।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে মানুষকে এমন এক ময়দানে একত্র করা হবে, যা' শ্বেত বর্ণবিশিষ্ট, নির্মল এবং রুটির ন্যায় গোলাকার। এসময় কারও নিকট কোন নিশান বা পতাকা থাকবে না। বর্ণনাকারী বলেছেন যে, 'আফরার' অর্থ শ্বেত বর্ণ। কিন্তু তা' বরফের ন্যায় শুভ্র নয়। এখানে নির্মলতার অর্থ উক্ত হাশরের ময়দানে কোন আবর্জনা, তরুলতা বা তৃণ, ঘাস ইত্যাদি থাকবে না। নিশান বা পতাকার অর্থ কারও কোন অট্টালিকা বা গৃহ ইত্যাদি থাকবে না, যার মধ্যে আশ্রয় নেয়া যায়। চক্ষুর অগ্রাহ্যকারী কোন দূরত্ব থাকবে না। তোমরা একথা মনে করো না যে, সেই যমিন দুনিয়ার যমিনের ন্যায় হবে; বরং দুনিয়ার যমিনের নাম ব্যতীত তার তুলনা করার কিছুই থাকবে না। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ইয়াওমা তুবাদ্দালুল আরদু গাইরাল আরদ্বি ওয়াসসামাওয়াতু" অর্থাৎ এই যমিন ও আসমান সেদিন অন্য দুনিয়ায় পরিবর্তিত হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে অব্বাস (রাঃ) বলেছেন, তা' বর্ধিত বা হ্রাস করা হবে। দুনিয়ার বৃক্ষরাজি, পাহাড়-পর্বত এবং যা' কিছু আছে তা' থাকবে না। আসমানের সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সবকিছু চলে যাবে।

        ওহে বেচারা। সেইদিনের ভয়াবহ অবস্থার বিষয় চিন্তা কর, যেদিন সব সৃষ্টজীব সেই ভীষণ ময়দানে একত্র হবে, তাদের মাথার উপর আকাশের তারকারাজি বিস্তৃত করা হবে, কিন্তু সূর্য ও চন্দ্রের রশ্মি চলে যাবে, ঐ ময়দানে কোন আলো থাকবে না, সব কিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে, যখন প্রাণীগণ এই অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে তখন তাদের মস্তকের উপর আসমানসমূহ ঘূর্ণিত হতে থাকবে। পাঁচশ' বছর এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে অতিবাহিত হবে। এসময় ফিরেশতাগণ কেউ বা তাদের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকবে, আবার কেউ বা এদিকে-সেদিকে পায়চারি ও হাঁটাচলা করবে। তাদের পদশব্দে তোমার কর্ণকুহরে ভীষণ ও ভয়ঙ্কর আওয়াজ উত্থিত হবে। সেদিনের ভয়াবহ অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না। আসমান অত্যধিক কঠিন বস্তু হওয়া সত্ত্বেও তা' খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে যাবে এবং তা' বিগলিত রৌপ্যের ন্যায় প্রবাহিত হতে থাকবে। ঐ বিগলিত বস্তু গলিত তাম্রের বর্ণের ন্যায় সৃষ্ট হবে। আকাশের খণ্ডগুলো তুলার ন্যায় এবং পাহাড়-পর্বতগুলো ধুনিত পশমের ন্যায় শূন্যে উড়তে থাকবে। মানুষ নগ্ন পদে উলঙ্গাবস্থায় দণ্ডায়মান থাকবে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, সব মানুষকে সেদিন নগ্ন এবং খাতনাশূন্য অবস্থায় উত্থান করা হবে। তাদের শরীর থেকে নির্গত ঘর্ম হাশরের ময়দানে পুঞ্জীভূত হবে এবং তা' প্রত্যেকের কর্ণের পাতা পর্যন্ত পৌছবে।

        উন্মুল মু'মিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (সঃ)এর নিকট জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমরা উলঙ্গাবস্থায় থাকলে একে অন্যের প্রতি কি লক্ষ্য করবে নাঃ হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, প্রত্যেক লোকেরই যেদিন এমন অবস্থা হবে যে, নিজেকে ব্যতীত অন্যের সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করার কোন অবস্থা বা অবসর থাকবে না। সুতরাং সে দিনটি বড়ই ভয়াবহ। সেদিন সব গুপ্ত বস্তু প্রকাশ পাবে। তাই কেউই নিরাপদ থাকবে না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে মানুষকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করে একত্র করা হবে। কেউ যানবাহনে, কেউ বা পদব্রজে, কেউ বা মুখের উপর হেঁটে আসবে। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। মানুষ মুখমণ্ডলের উপর হাঁটবে কি করে? তিনি বললেন, যিনি মানুষকে তাদের পদদ্বয়ের উপর হাঁটাতে পারেন, তিনি তাদের মুখগুলের উপরও তাদেরকে চালাতে পারবেন।

        মানুষ যাতে অভ্যস্ত নয়, সে তা' অস্বীকার করে। যদি মানুষ সর্পকে তার বুকের উপর বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুত গতিতে চলতে না দেখত তাহলে কোন ইতর প্রাণী যে এত তেজে চলতে পারে তা' বিশ্বাস করত না। যে পদদ্বারা চলে, সে-ও পদদ্বারা চলাকে কষ্টকর মনে করত, যদি সে তা' না দেখত। সুতরাং তোমরা কিয়ামতের ভয়াবহ ঘটনাকে অবিশ্বাস করো না। যদি তুমি এই দুনিয়ার আশ্চর্য বিষয়সমূহ না দেখতে এবং তা' দেখার পূর্বে যদি তা' তোমার নিকট উপস্থিত করা হত, তুমি তা' দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে। তুমি একবার তোমার ছবিটি মনের মধ্যে উপস্থিত কর। যখন তুমি উলঙ্গাবস্থায় অপদস্থ হয়ে সন্ত্রস্ত, ভীত এবং হতভম্ব অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে এবং তোমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ফলাফল জানার জন্য উদ্ল্লীব থাকবে, এ অবস্থাকে তোমার অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মনে করা উচিত। কেননা কিয়ামতের ব্যাপারগুলো সত্যিই বড় ভয়াবহ।

Post a Comment

0 Comments