পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, ক্ষমার অর্থ তোমার প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা' না নেয়া এবং তাকে ক্ষতিপূরণ, হত্যার পণ ইত্যাদি অনিষ্ট হতে মুক্তিদান করা। এটা ধৈর্য বা ক্রোধ দমন নয়, এজন্য আমরা এটাকে পৃথকভাবে বর্ণনা করছি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "খুষিল আফওয়া আ'মুর বিল মারুফি অ আ'রিজ আনিল জাহিলীন।" অর্থাৎ ক্ষমা গ্রহণ কর, সৎ উপদেশ দাও এবং মূর্খদের থেকে বিমুখ হও।"
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমার ক্ষমা করা আল্লাহতায়ালার অধিক নিকবর্তী। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যার হস্তে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ, যদি আমি শপথকারী হতাম, আমি তিন বিষয়ে শপথ গ্রহণ করতাম। যথাঃ (১) দানে ধন কমে না, সুতরাং দান কর। (২) যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণে অপরাধ ক্ষমা করে, আল্লাহতায়ালা রোজ কিয়ামতে তাকে অধিক সম্মান প্রদান করবেন। (৩) যে ব্যক্তি নিজের জন্য ভিক্ষার দুয়ার খুলে লয়, মহাপ্রভু তার উপর দরিদ্রতার দুয়ার খুলে দেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, নম্রতা কোন লোকের উন্নতি ব্যতীত কিছু বৃদ্ধি করে না, সুতরাং নম্রতা অবলম্বন কর। আল্লাহ তোমাদেরকে উন্নত করবেন, ক্ষমা কোন লোকের সম্মান ব্যতীত কিছু বৃদ্ধি করে না। সুতরাং ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদেরকে সম্মান দান করবেন। দানে ধন সম্পদ বৃদ্ধি ব্যতীত হ্রাস হয় না, সুতরাং দান কর। আল্লাহ তোমাদের উপর করুণা করবেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে কখনও কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে দেখিনি যে পর্যন্ত না কেউ কোন আল্লাহর হারাম কাজ করত। যখন কেউ আল্লাহর হারাম কার্য করত, তখন তাঁর ক্রোধের সীমা থাকত না। ছটি কার্য একই সময়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হলে তিনি তন্মধ্যে অধিক সহজ কার্যকে মনোনীত করে নিতেন, যে পর্যন্ত তার মধ্যে কোন পাপের কাজ না থাকত। হযরত ওকবাহ (রাঃ) বলেছেন, একদা আমি হুযুরে পাক (দঃ)এর সাথে সাক্ষাত করলে আমি তাড়াতাড়ি ভক্তির সাথে তাঁর হস্ত ধারণ করলে তিনি বললেন, হে ওকবাহ। আমি কি তোমাকে ইহ-পারলৌকিক পথিকদের অসীম কল্যাণজনক স্বভাবের কথা জানাব না? তোমার সাথে কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে তুমি তা' সংযুক্ত করবে। তোমাকে কেউ কিছু হতে বঞ্চিত করলে তুমি তাকে কিছু দান করবে। তোমার সাথে কেউ কোনরূপ অন্যায় করলে তুমি তাকে ক্ষমা করবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে প্রভু। তোমার বান্দাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি তোমার নিকট অধিক সম্মানিত? তিনি বললেন, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ক্ষমা করে। তদ্রূপ হযরত আবু দারদা (রাঃ) কে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে তাকে আল্লাহ সম্মান করবেন। একদা একব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে একব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্যায়ের অভিযোগ করল। হুযুরে পাক (দঃ) তাকে আসন গ্রহণ করতে বললেন। লোকটি মনে করল যে, হয়তো তিনি তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে তাকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু হুযুরে পাক (দঃ) লোকটিকে বললেন, অত্যাচারিত ব্যক্তিগণ রোজ কিয়ামতে মুক্তি লাভ করবে। যখন লোকটি এ হাদীস শুনতে পেল, সে অভিযুক্ত ব্যক্তি থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছে পরিত্যাগ করল। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অত্যাচারিকে বদদোয়া করে সে যেন তার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নিল।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যখন আল্লাহতায়ালা রোজ কিয়ামতে সমস্ত সৃষ্টজীবকে উত্থিত করবেন, তখন একজন ঘোষণাকারী আরশে মুআল্লার নীচ থেকে ঘোষণা করবে। হে। তাওহীদপন্থীগণ। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। সুতরাং তোমরা একে অন্যকে ক্ষমা কর।
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) মক্কা বিজয়ের পর খানায়ে কা'বা তাওয়াফ করে দু'রাকাত নামায পড়লেন। তারপর কা'বা গৃহে প্রবেশ করে তার দরজায় হস্ত স্থাপনপূর্বক কুরায়েশদেরকে বললেন, তোমরা কি দেখছ এবং কি ব্যবহার পাবার প্রত্যাশা করছ? কুরায়েশগণ বলল, আমরা আপনার ভ্রাতা বা সহিষ্ণু, দয়ালু পিতৃব্যের সন্তান-সন্ততি। তারা এ কথাটি তিনবার বলল। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হযরত ইউসুফ (আঃ) তাঁর ভ্রাতাগণকে যা বলেছিলেন, আমিও আজ তোমাদেরকে সে কথাই বলছি, "লা তাছরীবা আলাইকুমুল ইয়াওম।" অর্থাৎ আজ তোমাদের উপর কোন তিরস্কার বা ধমকী নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাময় ও দয়ালু। তারপর তারা বের হয়ে চলে গেল। যেন সবাই কবর থেকে উঠে গেল। এরপর তারা সবাই মিলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। হযরত সোহায়েল ইবনে আমর (রাঃ) বলেছেন, যখন হুযুরে পাক (দঃ) মক্কা শরীফ পদার্পণ করলেন, তিনি তাঁর হস্ত কা'বাগৃহের দরজায় স্থাপন করলেন এবং লোকজন তাঁর চতুর্দিকে সমবেত ছিল। তিনি বললেন, আল্লাহ ব্যতীত কেউ উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্য বলে প্রমাণ করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সম্মিলিত সৈন্যদলকে একাই পরাভূত করেছেন। তারপর তিনি বললেন, হে সমবেত কুরায়েশ সম্প্রদায়। তোমরা কি বলছ এবং কিরূপ ব্যবহার আশা করছ? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা মঙ্গল প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি সম্মানিত ভ্রাতা এবং দয়ালু পিতৃব্যের পুত্র। এখন সর্বক্ষমতা আপনার হস্তে। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, আমার ভাই হযরত ইউসুফ (আঃ) যা বলেছিলেন, তা-ই আমি বলব। অদ্য তোমাদের উপর কোন তিরস্কার নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যখন সমস্ত লোক হাশর ময়দানে অপেক্ষা করতে থাকবে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, যাদের আল্লাহর নিকট পুরস্কার পাওনা আছে তারা চলে এস এবং বেহেশতে প্রবেশ কর। বলা হবে, এরূপ এরূপ ব্যক্তি কোথায় যার পুরস্কার আল্লাহর নিকট পাওনা আছে? তখন বলা হবে, ঐসব লোক যারা মানুষকে ক্ষমা করত। তখন হাজার হাজার লোক উঠে দাঁড়িয়ে যাবে। তাদেরকে তখন বিনা হিসাবে বেহেশতে নিয়ে যাওয়া হবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কোন বিচারকের সামনে কোন অপরাধীকে আনা হলে সে তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য নয়। আল্লাহতায়ালা ক্ষমাকে ভালবাসেন এবং তিনি ক্ষমাশীল। তারপর তিনি অত্র আয়াত পাঠ করলেন, "ক্ষমা ও মার্জনা কর।"
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ঈমানের সাথে যে ব্যক্তির তিনটি গুণ থাকে সে তার ইচ্ছেমত যে কোন দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে। তার ইচ্ছেমত যে কোন কৃষ্ণনয়না হরের সঙ্গে তার বিবাহ হবে। গুণ তিনটি হল, যে ব্যক্তি গোপনে তার ঋণ পরিশোধ করে, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাযের পরে এগারবার সূরা ইখলাছ পাঠ করে এবং যে ব্যক্তি তাঁর হত্যাকারীকে হত্যার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়। হযরত আবুবকর (রাঃ) একবার হুযুরে পাক (দঃ) কে বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তন্মধ্যে একটি গুণ থাকলেও কি এই পুরষ্কার পাওয়া যাবে? তিনি বললেন, হাঁ একটি গুণ থাকলেও পাওয়া যাবে।
বুষর্গদের বাণীঃ হযরত ইব্রাহীম তাইমী (রহঃ) বলেছেন, কোন লোক আমার প্রতি অন্যায় করলে আমি তার উপর দয়া করি। এটা ক্ষমার অতিরিক্ত করুণা প্রদর্শন। কেননা অন্যায় কার্যে যখন সে তার হৃদয়কে ব্যস্ত রাখে সে সময় সে আল্লাহর নির্ধারিত পাপ থেকে সরে থাকে। রোজ কিয়ামতে যখন তার প্রতিশোধ নেয়া হবে, তার কোন উত্তর থাকবে না। কোন বিজ্ঞ লোক বলেছেন, যখন দয়াময় আল্লাহতায়ালা কোন বান্দাকে উপঢৌকন দেয়ার ইচ্ছে করেন, তার জন্য এমন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন যে তার প্রতি অত্যাচার করে। একদা একব্যক্তি খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযের নিকট গিয়ে তাকে যে অত্যাচার করেছিল, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে লাগল। খলীফা তাকে বললেন, আল্লাহর সঙ্গে তোমার এ অন্যায়ের অভিযোগ নিয়ে সাক্ষাত করা আমা থেকে তার প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করবার চেয়ে উত্তম।
হযরত ইয়াযিদ ইবনে মাইছারা (রহঃ) বলেছেন, যে তোমার সাথে অন্যায় করেছে তাকে যদি তুমি বদদোয়া কর, তবে আল্লাহতায়ালা বলেন, তুমি অন্যের সাথে যে অন্যায় করেছ সেও তোমার প্রতি বদদোয়া করবে। তুমি ইচ্ছে করলে আমি তার বিরুদ্ধে তোমার দোয়া কবুল করব এবং তোমার বিরুদ্ধে তার দোয়া কুবল করব। আর যদি ইচ্ছে কর, আমি তোমাদের উভয়ের দোয়া কিয়ামত পর্যন্ত কবুল করতে বিলম্ব করব এবং উভয়কে ক্ষমা করব। এক ব্যক্তি তার অত্যাচারীর উপর বদদোয়া করলে হযরত মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রহঃ) তাকে বললেন, তুমি তার উপর যে বদদোয়া করেছ তার চেয়ে অধিক দ্রুত অত্যাচারীর উপর অত্যাচার ফিরে আসবে। যদি তাকে ক্ষমা করা হয় তা' আসে না। সুতরাং বদদোয়া করা সঙ্গত নয়। হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেছেন, আমরা শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা রোজ কিয়ামতে একজন ঘোষণাকারীকে ঘোষণা করতে আদেশ দেবেন এবং সে ঘোষণা করবে, আল্লাহর নিকট যার যা পাওনা আছে তারা উঠে দাঁড়িয়ে যাক। তখন ক্ষমাশীলগণ উঠে দাঁড়িয়ে যাবে এবং তাদের ক্ষমার পরিমাণ অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ক্ষমার পুরস্কার দেবেন। হযরত হেশাম ইবনে মুহাম্মদ (রহঃ) বলেছেন, দুজন পাপী লোককে শাসনকর্তা নো'মান ইবনে মুনজেরের নিকট উপস্থিত করা হল। তন্মধ্যে একজন ঘোরতর পাপী ছিল। তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু যে ব্যক্তির পাপ লঘু ছিল, তাকে তিনি শাস্তি দিয়ে বললেন, নরপতিগণ এভাবেই কখনও কোন গুরুতর অপরাধকে দয়াবশতঃ ক্ষমা করে দেয়। আবার কখনও কাউকে সামান্য দোষেও গুরুদন্ড প্রদান করে। এর কারণ এই যে, প্রজাগণ তার ধৈর্য ও কোমলতা এবং প্রয়োজনে কঠোরতা দুটোরই পরিচয় পেয়ে যাক। মূলতঃ এ কাজ নরপতির কোন খেয়ালের বশে নয়, অবশ্যই এর অন্তর্নিহিত গুরুতর রহস্য আছে।
হযরত মুবারক (রহঃ) বলেছেন, বছরাবাসীদের একটি প্রতিনিধি দলের মধ্যে ইবনে আবদুল্লাহ নামক একব্যক্তি খলীফা আবুজাফর মনসুরের নিকট উপস্থিত হলেন। আমি তার নিকট ছিলাম। এ সময় তার নিকট একব্যক্তিকে উপস্থিত করা হলে তিনি তাকে হত্যা করবার আদেশ দিলেন। আমি মনে মনে বুঝলাম, আমার সামনে এই মুসলমান ব্যক্তি নিহত হবে। তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মু'মিনীন। আমি কি আপনাকে একটি কথা শুনাতে পারি? আমি তা' হযরত হাসান বছরী (রহঃ) থেকে শুনেছি। যখন কিয়ামত হবে, দয়াময় আল্লাহতায়ালা সমস্ত লোককে এমন এক উচ্চস্থানে একত্র করবেন যেখান থেকে তারা সবকিছু দেখতে পাবে ও ঘোষণা কারীর ঘোষণা শুনতে পাবে। তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে, আল্লাহর নিকট যাদের যা পাওনা আছে তারা যেন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। তখন যারা ক্ষমাকারী তারা উঠে দাঁড়িয়ে যাবে। একথা বলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি এই বাণী হযরত হাসান বছরী (রহঃ) থেকে শুনেছি। তারপর খলীফা বললেন, যাও আমি তাকে মুক্তি দিলাম। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) বলেছেন, তোমরা ধৈর্যের সাথে ক্রোধের উত্তেজনা সহ্য কর। যে পর্যন্ত তোমরা শান্তিলাভ না কর। তারপর যখন তোমরা শান্ত হও তখন ক্ষমা কর ও পুণ্য অর্জন কর।
বর্ণিত আছে যে, জনৈক খৃষ্টান সাধক খলীফা হেশামের দরবারে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি যুলকারনাইন সম্বন্ধে চিন্তা করেছ? তিনি কি নবী ছিলেন? সাধক বলল, তিনি নবী ছিলেন না। কিন্তু তাকে চারটি স্বভাব দেয়া হয়েছিল। যেমনঃ (১) তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমা করতেন। (২) তিনি কোন প্রতিজ্ঞা করলে তা' পূর্ণ করতেন। (৩) তিনি সত্য কথা বলতেন এবং (৪) অদ্যকার কাজ তিনি কালকের জন্য ফেলে রাখতেন না।
জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, যে ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়েও তা' সহ্য করে থাকে কিন্তু ক্ষমতা এলেই প্রতিশোধ গ্রহণ করে, তাকে সহিষ্ণু বলে না। বরং যে ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়েও সহ্য করে থাকে এবং ক্ষমতা পেলেও ক্ষমা করে দেয়, সে ব্যক্তি সহিষ্ণু। হযরত যিয়াদ বলেছেন, ক্ষমতা ক্রোধ-বিদ্বেষকে দূর করে দেয়। খলীফা হেশামের নিকট জনৈক অপরাধীকে উপস্থিত করা হলে সে কোনরূপ প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই তার দোষ প্রমাণের ব্যাপারে কথা শুরু করল। তখন খলীফা হেশাম তাকে দোষের বিষয় জিজ্ঞেস করলে সে খলীফাকে বলল, হে আমীরুল মু'মিনীন। আল্লাহ বলেন: "ইয়াওমা তা'তী কুন্তু নাফসিন তুজাদিলু আন নাফসিহা" অর্থাৎ সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের জন্য তর্ক করতে করতে আসবে।
অর্থাৎ সে কঠিন বিচারের দিন প্রত্যেকেই নিজ নিজ দোষ দূর করবার জন্য আল্লাহর সামনে তর্ক করতে থাকবে। কিন্তু আপনার সম্মুখে আমি তর্ক করতে পারব না কেন? খলীফা বললেন, আচ্ছা তোমার কি বলবার আছে বল।
বর্ণিত আছে যে, একদা ছিফফীনের যুদ্ধক্ষেত্রে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রাঃ) এর তাঁবুতে একটি চোর প্রবেশ করল। তাকে পাকড়াও করা হলে আম্মার (রাঃ) কে তার হাত কেটে দিতে বলা হল। চোর তাদের শত্রুপক্ষের লোক ছিল। হযরত আম্মার (রাঃ) বললেন, তার দোষ গোপন করে রাখ। তাতে হয়ত আল্লাহ তোমার দোষ কিয়ামতে গোপন রাখবেন। একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁর পাগড়ীর মধ্যে কিছু অর্থ বেঁধে নিয়ে বাজার থেকে কিছু দ্রব্য ক্রয়ের জন্য গেলেন। বাজারে গিয়ে কিছু দ্রব্য ক্রয় করে তিনি তাঁর পাগড়ীর মধ্যে হাত দিয়ে দেখলেন যে, তাতে অর্থ নেই। পাগড়ীর বাঁধন খোলা। তিনি তখন দ্রব্যের মালিককে বললেন, আমার পাগড়ীর মধ্যে অর্থ বাঁধা ছিল। সব লোক তখন চোরকে অভিশাপ দিয়ে বলতে লাগল, হে মাবুদ! চোরের হাত কেটে দাও। তাকে এরূপ সাজা দাও, ওরূপ কর ইত্যাদি। কিন্তু হযরত অবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, হে মাবুদ। চোর যদি অভাবে পড়ে আমার অর্থ নিয়ে থাকে তবে তাকে কল্যাণ দাও আর যদি সে পাপের লিন্দায় এ কাজ করে থাকে, তবে এ পাপকে তার আমলনামায় শেষ পাপ বলে লিপিবদ্ধ কর।
হযরত ফোজায়ল ইবনে ইয়াজ (রহঃ) বলেছেন, আমি খোরাসানবাসী একটি লোকের চেয়ে এতবেশী সংসার বিরাগী আর দেখিনি। তিনি খানায় কা'বার হরম শরীফে আমার সাথে উপবিষ্ট ছিলেন। তারপর তাওয়াফ করবার জন্য উঠে দেখলেন, চোর তার সঙ্গের দীনারগুলো চুরি করে নিয়েছে। তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি এ সামান্য কয়টি দীনারের জন্য কাঁদছেন? তিনি বললেন, আমি সেজন্য কাঁদছি না। আমি দেখছি, সে চোর যেন আল্লাহর সামনে আমার সাথে বিচারের জন্য দন্ডায়মান। কিন্তু সে তার চুরি করবার কারণ সম্বন্ধে কোন সদুত্তর দিতে পারল না। তার এ দুরবস্থা দেখে করুণাবশতঃ আমার হৃদয়ে কান্নার উদ্রেক হচ্ছে। হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন, একরাত্রে আমরা বছরার শাসনকর্তা হাকীম ইবনে আইউবের গৃহে আগমন করলাম। হযরত হাসান বছরী (রহঃ)ও আমাদের সাথে ছিলেন।
হযরত হাসান বছরী (রহঃ) আমাদের পক্ষ থেকে বছরার আমীরকে লক্ষ্য করে কথাবার্তা শুরু করলেন। তিনি প্রথমেই তাকে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী শুনাতে লাগলেন যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) এর ভ্রাতাগণ তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছিল। তাকে তারা কূপে নিক্ষেপ করেছিল। বণিকগণ তাকে কূপ থেকে উদ্ধার করে বিক্রয় করে ফেলেছিল। তাঁর পিতাকে তাঁর ভ্রাতাগণ কত দুঃখ ও কষ্ট দিয়েছিল। তারপর তিনি মিসরের এক স্ত্রীলোকের চক্রান্তে পড়ে কারাগারে কি কষ্টে কালাতিপাত করেছিলেন এসব ঘটনা তিনি আমীরকে শুনালেন। তারপর তিনি বললেন, হে আমীর। পক্ষান্তরে আল্লাহতায়ালা হযরত ইউসুফ (আঃ)এর সাথে কি ব্যবহার করেছিলেন তিনি তাঁর যশঃকে উজ্জ্বল করেছিলেন। তাঁকে প্রথমে মিসরের খাজাঞ্চী, পরে রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তারপর এক সময়ে তিনি তাঁর ভ্রাতাগণকে বলেছিলেন, তোমাদের উপর আজ কোন তিরস্কার নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাময় ও দয়ালু। তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীগণকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আমীর এ কাহিনী শুনে বললেন, আমিও একথা বলছি। অদ্য তোমাদের উপর কোন তিরস্কার নেই। যদি আমার নিকট পরিহিত বস্ত্র ব্যতীত অন্য কিছু থাকত তাহলে আমি তাও তোমাদেরকে দান করে দিতাম।
একদা হযরত মুকাফাহ (রহঃ) তার এক বন্ধুর নিকট কোন এক মুসলমান ভ্রাতাকে ক্ষমা করবার জন্য পত্র লিখলেন। পত্রে লিখা ছিলঃ অমুক ব্যক্তি কোন এক অপরাধ করে তোমার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করছে। সে তোমার ক্রোধের ভয় করে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছে। পত্রের মর্মে অনুভব করা যাচ্ছে যে পাপ যতই বড় হোক না কেন ক্ষমার মাহাত্ম্য ততই অধিক। একদা খলীফা আবদুল মালেকের নিকট ইবনে আশআছ সম্প্রদায়ের কতিপয় যুদ্ধবন্দী আনীত হলে তিনি রাজা ইবনে হায়াতকে বললেন, এ বন্দীদের সম্বন্ধে তোমার কি মতামত? তিনি বললেন, মহান আল্লাহতায়ালা আপনাকে আপনার আকাঙক্ষানুযায়ী যুদ্ধে বিজয়ী করেছেন। সুতরাং আল্লাহর পছন্দ অনুযায়ী তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। তার মতানুযায়ী খলীফা তাদেরকে ক্ষমা করে মুক্তি দিলেন।
বর্ণিত আছে যে, হযরত যিয়াদ (রহঃ) খারেজীদের একব্যক্তিকে ধৃত করে আনলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে সে তার নিকট থেকে পালিয়ে গেল। তখন যিয়াদ (রহঃ) তার ভ্রাতাকে ধৃত করে বললেন, হয় তুমি তোমার ভ্রাতাকে উপস্থিত করবে, নতুবা আমি তোমাকে হত্যা করব। সে বলল, আমি যদি আমীরুল মু'মিনীন থেকে মুক্তিপত্র আনতে পারি তবে কি আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন? তিনি বললেন, হাঁ তাহলে মুক্তি দেব। তখন সে বলল, আমি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহ থেকে এই মুক্তিপত্র এনেছি এবং আমি হযরত ইব্রাহীম ও হযরত মুসা (আঃ) এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। তারপর তিনি পাঠ করলেন, তিনি কি মুসা ও ইব্রাহীমের (যিনি ওয়াদা পূর্ণ করেছিলেন) পত্রের মধ্যে কি আছে তা' জানাবেন না, কোন বান্দা অন্যের বোঝা বহন করবে না। তখন যিয়াদ (রহঃ) বললেন, তোমরা একে মুক্ত করে দাও। এই ব্যক্তি তার মুক্তিপ্রাপ্তির প্রমাণ দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, ইঞ্জীল গ্রন্থে উক্ত হয়েছে, যে ব্যক্তি অত্যাচারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে সে শয়তানকে পরাভূত করে।
0 Comments