জানাজা, কবর ও কবর যিয়ারত সম্বন্ধে আরিফগণের বাণী

         প্রিয় পাঠক-পাঠিকা জেনে রাখ যে, মৃতদেহ চক্ষুষ্মান লোকের জন্য উপদেশ এবং যারা উদাসীন, গাফিল তাদের জন্য তন্মধ্যে যথেষ্ট সতর্কতার বিষয় আছে। শবদেহ দেখতে দেখতে তাদের হৃদয়ের কাঠিন্য বৃদ্ধি পায়। কেননা তারা ভাবে যে, তারা শুধু অন্যের মৃত দেহ-ই দেখতে থাকবে। একথা ভাবে না যে, তাদের নিজেদের শবদেহও অন্যে এভাবে দেখতে আসবে এবং কাঁধে বহন করে নিয়ে যাবে অথবা তারা এরূপ ভাবে যে, শীঘ্রই তাদের এরূপ দশা হবে না। তারা একথা মোটেই ভাবে না যে, লাশবাহী খাটের উপর যাদের শবদেহ বহন করা হচ্ছে, তারাও আমাদেরই মত এরূপ ভাবতো, কিন্তু তাদের সেই ভাবনা, ধারণা ব্যর্থ এবং মিথ্যা হয়েছে। তাদের সময় নিকটবর্তী হয়েছে। তখন কোন লোক অন্যের শব আর দেখতে পায়নি তাদের শবই একের পর অন্যকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোট কথা আজ হোক বা কাল হোক মৃত্যুবরণ করতেই হবে।

        বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) যখন কোন মৃতদেহ দেখতেন, তিনি বলতেন, চলে যাও, আমরা তোমার পিছনে আসছি। হযরত মকবুল দামেশকী (রহঃ) যখন কোন শবদেহ দেখতেন, তখন তিনি বলতেন, তোমরা এই সকালেই চলে যাও আমরা সন্ধ্যায় চলে আসছি।

        যখন নাফে' ইবনে দীনার (রহঃ)এর ভ্রাতার মৃত্যু হল, তখন হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) তার ভ্রাতার জানাজায় বের হয়ে রোদন করতে করতে বলতে লাগলেন, আল্লাহর কসম! আমার হৃদয় শান্ত হবে না ও চক্ষু শীতল হবে না, যে পর্যন্ত না আমি জানতে পারি যে, কোথায় গিয়েয় এবং যে পার্যন্ত না আমি জানতে পারি যে, আমি জীবিত থাকব না মৃত্যুবরণ করব।

        হযরত আ'মাশ (রাঃ) বলেছেন, আমরা জানাজায় উপস্থিত হতাম, কিন্তু জানতাম না যে, কার জন্য সুঃখ প্রকাশ বলেছেন, চাশ করব। কেননা সবারই দুঃখ একই সমান। হযরত ছাবেত বুলানী (রহঃ) জানাজায় উপস্থিত হতাম এবং সবাকেই ক্রন্দনরত দেখতে পেতাম। প্রত্যেকেরই মনে মৃত্যুর ভয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে ব্যাপার তার বিপরীত হয়েছে। এখন লোভ জানাজায় উপস্থিত হয় কিন্তু তারা হাস্যরসে লিও থাকে এবং মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তির ভোদ ওয়ারিশ কতটুকু পাবে তারই আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হয়। মৃত ব্যক্তির বন্ধু-বান্ধবশণ ও আত্মীয় স্বজন সে যা রেখে গেছে তা' আত্মসাৎ করার কৌশল অবলম্বনে যথাশীঘ্র নিমগ্ন হ৪। অথচ তাদের মধ্যে কেউ-ই নিজের মৃত্যুর কথা একবারও চিন্তা করে না। মানুষের গাফলতির কারণই মানুষকে এভাবে ভুলিয়ে রেখেছে। আমাদের সামনে যে ভীষণ বিপদ রয়েছে, তাতে আমরা অন্যমনস্ক থাকি এবং যা আমাদের কোন উপকারে আসবে না, তা' নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আমরা আল্লাহর নিকট এই গাফলতি থেকে জাগ্রত হবার জন্য প্রার্থনা করি। বর্তমানে জানাজায় যারা উপস্থিত হয়, মৃতের জন্য ক্রন্দনই তাদের উত্তম অবস্থা। যদি তারা নিগূঢ়ভাবে চিন্তা করে দেখত তবে তারা নিশ্চয়ই নিজেদের জন্য রোদন করত, মৃতের জন্য নয়। 

        হযরত ইব্রাহীম জাইয়াদ (রহঃ) একবার কতগুলি লোককে মৃত বাক্তির জন্য শোকগাথা গাইতে দেখে বললেন, যদি তোমরা অন্যের জন্য শোক গাথা না গেয়ে নিজ নিজ শোকগীতি গাইতে তা-ই তোমাদের জন্য উত্তম হত। মৃত ব্যক্তি তিনটি বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছে। যথাঃ (১) সে মালাকুল মওতের মুখ দেখেছে, (২) সে মৃত্যুর কঠিন সময় অতিক্রম করেছে, (৩) সে অন্তিম সময়ের ভয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছে এবং নিরাপদ হয়েছে। হযরত আবু আমের ইবনে আলা (রহঃ) বলেছেন একদা আমি হযরত জারীর (রহঃ) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি তার লিখককে একটি কবিতা বলতেছিলেন, ঠিক এই মুহূর্তে একটি শব বহন করে আনা হল; এবং তিনি কবিতা বলা থেকে বিরত হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! এই মৃতদেহ-ই আমাকে বৃদ্ধ করেছে। তিনি তখন তার প্রথম কবিতা বলা স্থগিত করে নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো বলতে লাগলেন,

        " মৃতদেহ সম্মুখে দেখলে আমার প্রাণে দারুণ ভয়ের উদ্রেক হয়। কিন্তু সম্মুখ থেকে তা' চলে গেলে আমি পুনরায় ক্রীড়া কৌতুকে মত্ত হই। ভেড়ার পাল ব্যাঘ্রের উপস্থিতি দেখলে দ্রুত পালিয়ে যায় কিন্তু ব্যাঘ্র চলে গেলে তারা আবার যথাস্থানে ফিরে আসে।" যখন তোমাদের সামনে জানাজা উপস্থিত হয় তখন চিন্তা করা, মৃত্যুর গাফলতী থেকে সতর্ক হওয়া, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং বিনম্রভাবে মৃত লাশের সামনে পদব্রজে গমন করা, এসব রীতিনীতি রক্ষা করবে। আর একটি নিয়ম এই যে, মৃতের সম্বন্ধে উত্তম ধারণা পোষণ করবে। যদি সে পাপী হয় এবং সে তার নিজের সম্বন্ধে মন্দ ধারণা রাখে তবে হয়তো বা সে মৃত্যুর সময় তার প্রভুর নিকট করুণভাবে ক্ষমা ভিক্ষা করেছে। একথা শুধু সে নিজে ও তার প্রভুই জানে। অন্য কারুরই তা' জানার কথা নয়। এজন্যে হযরত ওমর ইবনে যর থেকে বর্ণিত আছে যে, তার এক প্রতিবেশীর মৃত্যু হয়েছিল, সে তার আত্মার উপর অত্যধিক অত্যাচার করেছিল। তাই বহু লোকই তার জানাজায় শরীক হওয়া থেকে বিরত থাকল। কিন্তু হযরত ওমর ইবনে যর উপস্থিত হয়ে তার জানাজা আদায় করলেন। যখন মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখা হল, তিনি ভার কবরের উপ উপর দাঁড়িয়ে বল্লেন, আল্লাহ তোমার উপর করুণা বর্ষণ করুন, তুমি নিশ্চয়ই তাওহীদের উপর রয়েছ এবং তোমার মুখমন্ডলকে সিজদাহ দ্বারা সুশোভিত করেছ। যদি লোকগণ তোমাকে পাপী বলে, আমাদের মধ্যে কে পাপমুক্ত এবং ত্রুটিশূন্য আছে?

        বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি সমাজে অত্যন্ত অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়াত। লোকটি বসরার উপকন্ঠে প্রাণত্যাগ করলে তার স্ত্রী স্বামীর জানাযা পড়ার জন্য একজন লোকও পেল না কেননা তার প্রতিবেশীগণ তার অত্যধিক পাপ কাজের জন্য তার কাফন দাফন কার্যে শরীক হতে মোটেই রাজী ছিল না; সুতরাং বাধ্য হয়ে লোকটির স্ত্রী কয়েকজন মজুর নিযুক্ত করল। তারা তাকে বহন করে লোকদের নিকট নিয়ে গেল কিন্তু তারা কেউই তার জানাযা আদায় করল না। তখন তার স্ত্রী তাকে দাফনের জন্য এক বিশাল প্রান্তরে নিয়ে গেল। প্রান্তরের পার্শ্বে, একটি উপত্যকা ছিল। তার উপর এক সংসার ত্যাগী পুরুষ অবস্থান করতেন। স্ত্রীলোকটি তাঁকে দেখতে পেয়ে তার স্বামীর জানাযা আদায় করার জন্য ঐ ব্যক্তির নিকট অনুরোধ জানাল। তিনি তার অনুরোধে রাজী হয়ে লোকটির জানাযা পড়তে ইচ্ছা করলেন। এ-সংবাদ শহরে রটে গেল যে, ঐ সংসার ত্যাগী পুরুষ উক্ত মৃত লোকটির জানাযা পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। তখন শহরবাসীগণ সবাই-ই বের হয়ে আসল এবং ঐ ব্যক্তির সাথে মিলে মৃত লোকটির জানাজা আদায় করল। জানাজা নামায আদায় করে উক্ত সংসারত্যাগী লোকটির নিকট জিজ্ঞেস করল যে, আপনি এই পাপী লোকটির জানাজা কিরূপে আদায় করলেন? তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, অমুক স্থানে গমন করেছি। তথায় একটি মৃতদেহ দেখতে পেলাম। তার নিকট শুধু তার স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন লোক ছিল না। তখন ঐ স্ত্রীলোকটি একাই তার স্বামীর জানাযা পড়ল। কেননা পাপী লোকটিকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। সংসার বিরাগী লোকটির স্বপ্নের বিবরণ শুনে লোকগণ অত্যধিক আশ্চর্যান্বিত হল। তখন সংসার বিরাগী ব্যক্তি উক্ত স্ত্রীলোকটিকে ডেকে তার স্বামীর অবস্থা এবং তার স্বভাব চরিত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন। স্ত্রীলোকটি বলল যে, সে সারাদিন মদপানে রত থাকত। তিনি বললেন, তুমি একটু চিন্তা করে বল, তার কোন মঙ্গল কার্যের বিষয় তোমার জানা আছে কিনা? স্ত্রীলোকটি বলল, আমি জানি তার মধ্যে তিনটি নেক আমল ছিল। প্রতিদিন ফজরের সময় সে নিদ্রা থেকে উঠে তার বস্ত্র পরিবর্তন করত, অজু করত এবং জামাতের সাথে ফজরের নামায আদায় করত, আবার নামাযান্তে সে মদপানের মজলিসে গিয়ে মদ পান করত এবং অন্যান্য গুনাহর কাজে লিপ্ত হত। তার আর একটি সৎকার্য এই ছিল যে, তার গৃহ কখনও কোন না কোন ইয়াতীমশূন্য থাকত না, সে তার সন্তানদেরকে যতটা স্নেহ করত তার চেয়ে অধিক স্নেহ সে অন্যের ইয়াতীম সন্তানদেরকে করত। বহু ইয়াতীম সন্তানেরই সে তত্ত্বাবধান ও দেখাশুনা করত। তার তৃতীয় সৎ কাজটি এই ছিল যে, কোন কোন দিন রাতের অন্ধকারে সে একাকী জাগ্রত হয়ে রোদন করত এবং আল্লাহর নিকট এভাবে বলত, হে প্রভু! জানি না তুমি জাহান্নামের কোন গভীর জহায় এ মহাপানীর স্থান রেখেছ। স্ত্রীলোকটির কথা শুনে সংসার বিরাগী লোকটির নিকট মৃত লোকটির ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, এবং তিনি উপস্থিত লোকদের নিকট থেকে উঠে চলে গেলেন।

Post a Comment

0 Comments