হযরত দ্বাহহাক (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ)এর নিকট আরজ করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। কোন ব্যক্তি সর্বাধিক সংসার বিরাগী। তিনি বললেন যে ব্যক্তি কখনও তার মৃত্যুর কথা এবং কবরের কথা বিসৃত হয় না, যে ব্যক্তি সংসারের অতিরিক্ত সৌন্দর্য ত্যাগ করে, যে ব্যক্তি ক্ষণস্থায়ী বস্তুর চেয়ে চিরস্থায়ী বস্তুকে পছন্দ করে, যে ব্যক্তি কল্যকে নিজের জীবনের মধ্যে গণনা করে না এবং যে নিজেকে কবরের অধিবাসীরূপে গণ্য করে। হযরত আলী (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমীরুল মুমিনীন। আপনার অবস্থা কি? আপনি কি কবরস্থানের প্রতিবেশী হয়েছেন? তিনি বললেন, যাদের রসনা নির্বাক এবং যারা আখেরাতকে স্মরণ করে, আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিবেশীরূপে পেয়েছি, সত্য প্রতিবেশীরূপে পেয়েছি।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আমি যে সব ভীতিপ্রদ বস্তুর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছি সব বস্তু থেকেই কবর অধিক ভয়সস্কুল। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, একদা আমরা হুযুরে পাক (দঃ)এর সাথে কবরস্থানের দিকে চলে গেলাম। তিনি একটি কবরের পার্শ্বে বসে পড়লেন এবং আমি তার অতি নিকটেই ছিলাম। হুযুরে পাক (দঃ) সহসা রোদন করতে শুরু করলেন। তার সাথে সাথে আমিও রোদন করতে লাগলাম। দেখাদেখি উপস্থিত অন্যান্য লোকগণও ক্রন্দন করতে শুরু করল। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা রোদন করছ কেন? হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, আমি বললাম যে, আপনি, রোদন করছেন তজ্জন্যই আমরা রোদন করছি। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, এই কবরটি আমার মাতা ওয়াহহাবের কন্যা বিবি আমিনার। আমি আমার প্রভুর নিকট তাঁর কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে সেই অনুমতি দান করলেন, কিন্তু আমি আমার মাতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে তার অনুমতি দিলেন না। মাতার প্রতি সন্তানের হৃদয়ে যে কোমলতা ও মমতার উদ্রেক হয় তাই আমার হয়েছে।
হযরত ওসমান (রাঃ) যখনই কোন কবরের নিকট গিয়ে দাঁড়াতেন তিনি এত বেশী ক্রন্দন করতেন যে, তাতে তাঁর দাড়ি সম্পূর্ণই সিক্ত হয়ে যেত। তার নিকট এর কারণ জিজ্ঞেস করা হল এবং বলা হল, আপনার নিকট বেহেশত এবং দোযখের বিষয় উল্লেখ করা হলে আপনি রোদন করেন না, কিন্তু কোন কবরের নিকট দাঁড়ালেই আপনি এরূপ করেন, এর কারণ কি? হযরত ওসমান (রাঃ) বললেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে বলতে শুনেছি যে, কবর আখেরাতের মঞ্জিলগুলোর মধ্যে প্রথম মঞ্জিল। যদি কেউ প্রথম মঞ্জিল সেই কবর থেকে মুক্তি পায়, তারপর যে মঞ্জিলগুলো থাকে তা' থেকে মুক্তি লাভ করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর যদি তা' থেকে মুক্তি না পায়, তবে তার অধিকতর কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বর্ণিত আছে যে, হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) একদা এক কবরস্থানের দিকে লক্ষ্য করে সওয়ারী থেকে অবতরণ করলেন এবং তথায় দাঁড়িয়ে দু'রাকাত নামায পড়লেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি ত পূর্বে এরূপ কখনও করেননি। তিনি বললেন, কবরের অধিবাসীগণ এবং আমার ও তাদের মধ্যে যা' ঘটেছে তা' আমার স্মরণে এসে গেছে। আমি এ দুটো বিষয়ের সাহায্যে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে ইচ্ছা করেছি। হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেন কবর প্রত্যেক আদম সন্তানকে যা' বলে থাকে তা' এই যে, আমি কীট-পতঙ্গের আগার। আমি নির্জন কক্ষ, অপরিচিত ঘর এবং অন্ধকার গৃহ। আমি তোমার জন্য এই গৃহ স্বরূপ প্রস্তুত হয়ে রয়েছি, কিন্তু তুমি আমার জন্য এখানে কি প্রস্তুত করে এনেছ?
হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ দিনের কথা জানাব না? সে দিনটি হল, যেদিন আমাকে কবরে স্থাপন করা হবে। হযরত আবু দারদা (রাঃ) অনেক সময়ই কবরস্থানে বসে পড়তেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করতেন। এর কারণ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, এখানে আমি এমন একদল লোকের নিকট বসি, যারা আমাকে আমার প্রত্যাবর্তনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং যখন আমি তাদের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যাই তারা আমাকে ঈর্ষা করে না।
হযরত জাফর ইবনে মুহাম্মদ (রহঃ) প্রায়শঃ রাত্রি বেলা কবরস্থানে অবস্থান করতেন এবং বলতেন, হে কবরবাসীগণ। আমার কি হয়েছে যে, যখন আমি তোমাদেরকে ডাকি তোমরা আমার ডাকে সাড়া দাও না? তার পরক্ষণেই তিনি আবার বলতেন, আল্লাহর কসম, আমার ও তাদের কথোপকথনের মধ্যে প্রতিবন্ধক রয়েছে, তরে আমি এই আশা করি যেন আমিও তাদের ন্যায় হয়ে যাই। অতঃপর ভোর না হওয়া পর্যন্ত তিনি কবরস্থানে বসেই নামায আদায় করতেন।
খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) তার কোন এক সভাসদকে বলেছিলেন, হে ভ্রাতঃ। আমি রাত্রে কবর এবং কবরের অধিবাসীদের সম্বন্ধে চিন্তা করে রাত্র কাটিয়ে দেই। যদি তুমি কোন মৃত ব্যক্তিকে তিন দিনের পর দেখতে পেতে তার সাথে তোমার দীর্ঘ বছরের প্রীতি ও ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও তুমি তার নিকট যেতে ঘৃণা বোধ করতে; এবং তুমি দেখতে পেতে কবরের মধ্যে সর্প, বিচ্ছু বিচরণ করছে, পুঁজ প্রবাহিত হচ্ছে এবং পুঁতি গন্ধময় কীট-পতঙ্গ তাদেরকে দংশন করছে, সুগন্ধিযুক্তি কাফনের কাপড় পুরাতন এবং দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে। একথা বলেই তিনি এমন এক বিকট চীৎকার করে উঠলেন যে, সাথে স থ তিনি সংজ্ঞাশূন্য হয়ে পড়ে গেলেন।
হযরত ইয়াযিদ রাক্কাশী (রহঃ) এরূপ বলতেন যে, হে কবরগর্তের অধিবাসী এবং নির্জন গৃহে বসবাসকারী। হে ভূগর্ভের প্রেমিক! আমি জানি না, কোন আমলের জন্য তুমি সুসংবাদ গ্রহণ করেছ? কোন ভ্রাতাকে তুমি ঈর্ষা করেছ? তারপর তিনি রোদন করতে শুরু করতেন। এমন কি তাতে তার দাড়ি ভিজে যেত। তারপর তিনি বলতেন, হে মানুষ! সৎ কার্যের দ্বারা আল্লাহর নিকট থেকে সুসংবাদ লাভের প্রার্থনা কর, আল্লাহর ইবাদাতে নিযুক্ত ভ্রাতাদের সাথে ইবাদাতের প্রতিযোগিতা কর। তিনি যখন কোন কবরস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন, তখন চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় চীৎকার করে উঠতেন।
হযরত হাতেম আছেম (রহঃ) বলেছেন যে ব্যক্তি কবরস্থানের নিকট দিয়ে পথ অতিক্রম করে এবং নিজের জন্য চিন্তা করে না ও কবরবাসীর জন্য দোয়া করে না, সে নিজের প্রতি ও কবরবাসীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। হযরত বকর আবেদ (রহঃ) বলেছেন, হে মাতঃ। যদি তুমি আমাকে প্রসব না করে বন্ধ্যা হতে তবে কতই না উত্তম হত। তোমার এ পুত্রের জন্য কবরে দীর্ঘ কারাবাস আছে, তারপর আবার তাকে তথা থেকে অন্য স্থানে যেতে হবে। হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মুআয (রাঃ) বলেছেন, হে আদম সন্তান। তোমার প্রভু তোমাকে তাঁর শান্তি নিকতেনর দিকে আহবান করছে। যদি তুমি দুনিয়া থেকে সে আহ্বানে সাড়া দাও এবং তথায় যেতে প্রস্তুত হও তবে সে শান্তির আগারে যেতে পারবে না, কিন্তু যদি তুমি কবর থেকে সে ডাকে সাড়া দাও এবং যেতে প্রস্তুত হও তবে সে শান্তির আগারে প্রবেশ করেতে পারবে।
হযরত হাসান ইবনে ছালেহ (রহঃ) যখন কবরস্থানের নিকট দিয়ে কোথাও যেতেন তখন কোন সুন্দর কবর দেখে বলতেন, হে কবর! তোমার পৃষ্ঠদেশ কত সুন্দর। কিন্তু জানি না তোমার অভ্যন্তরে কি করুণ ও মারাত্মক দৃশ্য বিরাজমান? হযরত আতা সালমী (রহঃ) এর উপর যখন রাত্রি আসত, তিনি কবরস্থানের দিকে চলে যেতেন। তথায় উপস্থিত হয়ে তিনি বলতেন, হে কবরের অধিবাসীগণ! তোমাদের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু আমার মৃত্যু বাকী রয়েছে। তোমরা তোমাদের কর্মফল স্বচক্ষে দেখেছ, কিন্তু আমার কর্মফলের জন্য আমার আক্ষেপ ও অনুতাপ, হয়ত আমিও আগামীকল্য তোমাদের ন্যায় কবরের মধ্যে পুরষ্কার লাভ করব। কবরস্থানে দাঁড়িয়ে সারা রাত তিনি এরূপভাবে বলতে থাকতেন।
হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কবরকে অধিক স্মরণ করে সে নিশ্চয়ই বেহেশতের উদ্যান প্রাপ্ত হবে। আর যে ব্যক্তি স্মদকে স্মরণ করে না, মৃত্যুর পরে সে কবরকে দোযখের গর্ত হিসাবে দেখতে পাবে।
হযরত রবী ইবনে খায়ছাম (রহঃ) তাঁর গৃহের দরজায় একটি কবর খনন করে রেখেছিলেন। যখন তিনি তার হৃদয়ের কাঠিন্য অনুভব করতেন তখন তিনি ঐ কবরের মধ্যে প্রবেশ করে শয়ন করে থাকতেন। তারপর তিনি বলতেন, হে প্রভু! তুমি আমাকে আবার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দাও যেন আমি তথায় সৎ কার্য করে আসতে পারি। অতঃপর তিনি নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন, হে রবী। আমি তোমার নিকট ফিরে এসেছি। এখন আমল করতে থাক। হযরত আহমদ ইবনে হরব (রহঃ) বলেছেন, দুনিয়া ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আশ্চর্য বোধ করে যখন সে তার শয্যা পেতে তাতে শায়িত হয়ে যায়। শয্যা তখন তাকে লক্ষ্য করে বলে, হে আদম সন্তান। তুমি তোমার এ ক্ষণস্থায়ী শয্যাকে এমন সুন্দরভাবে গুছিয়ে পেতে নিচ্ছ, অথচ তোমার দীর্ঘস্থায়ী শয্যার দিকে তোমার এতটুকু লক্ষ্য নেই।
হযরত মায়মুন ইবনে মেহরান (রহঃ) বলেছেন, একদা আমি খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযসহ কবরস্থানে গিয়েছিলাম। তিনি কবরস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করে বোসন করতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, হে মায়মুন। এই কবরস্থান উমিয়া বংশীয় আমার পিতৃ পুরুষগণের। তারা কি সংসারের সুখ-সম্পদের কোন অংশীসার ছিল না? কিন্তু তুমি এখন কি তাদেরকে কবরে শায়িত দেখতে পাচ্ছ না? এখন তাসের উপর বহু বিপদাপদ পতিত। বিপদের উপর বিপদ এখন তাদের উপরে। এখন তাদের শরীর কীট-পতঙ্গ দংশন করছে। তারপর তিনি রোদন করতে করতে বললেন, আল্লাহর কসম, এই কবরস্থানের মধ্যে যারা শায়িত তাদের চেয়ে এত অধিক সুখ-সম্পদের অধিকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করেছিল।
0 Comments