পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, অন্তর দ্বারা নিন্দা করা বা মন্দ ধারণা করা রসনার দ্বারা নিন্দা করার ন্যায় নিষিদ্ধ। তোমার রসনার দ্বারা অন্যের দোষ বর্ণনা করা যেরূপ হারাম, তদ্রূপ তোমার ভ্রাতার প্রতি অন্তরে মন্দধারণা পোষণ করাও হারাম। মন্দ ধারণা পোষণ অর্থ হৃদয়ে মন্দ ধারণা বদ্ধমূল হওয়াকেই আমি বুঝি। যে মন্দ ধারণা হৃদয় মধ্যে হঠাৎ উদিত হয়, তা' ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু তবু তাতে সন্দেহ থাকে। মন্দ ধারণা হৃদয় মধ্যে থেকে গেলে তা' হারাম হয়। এর অর্থ প্রবৃত্তি সে দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং হৃদয় তার অনুরক্ত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু ইজতানিবু কাছীরাম মিনাজজান্নি ইন্না বা'দ্বাজ জান্নি ইছমুন"। অর্থাৎ হে মুমিনগণ! অধিকাংশ ধারণা পরিত্যাগ করবে। নিশ্চয়ই কোন কোন ধারণায় পাপ আছে। কোন কোন ধারণা হারাম হওয়ার কারণ এই যে, হৃদয়ের গুপ্ত কথা গাইবের মালিক ব্যতীত অন্য কেউ অবগত নয়। সুতরাং অন্যের সম্বন্ধে তোমার মন্দ ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। তবে যদি তা' তোমার চোখের সামনে এমন ভাবে প্রকাশ পায়, যাতে এর মধ্যে অন্য কোন অর্থ না থাকে, তখন ঘৃণা পোষণ করলে আত্মার ক্ষতি হয় না। এ সময়ে তুমি যা জেনেছ এবং স্বচক্ষে দেখেছ, তা' বিশ্বাস করা স্বাভাবিক। যে ঘটনা তুমি স্বচক্ষে দেখনি বা স্বকর্ণে শ্রবণ করনি তা যদি তোমার হৃদয় মধ্যে উদিত হয় তবে তা' শয়তানই তোমার হৃদয়ে নিক্ষেপ করে। সে ধারণাকে মিথ্যা বলেই তাড়িয়ে দেয়া উচিত। কেননা তা' মহাপাপগুলোর অন্যতম। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানূ ইন জায়াকুম ফাসিকুম বি নাবায়িন ফাতাবাইয়্যান্ ইন তুছীবূ ক্বাওমাম বিজাহালাতিন ফাতুছবিহু আলা মা ফাআলতুম নাদিমীন" অর্থাৎ হে মুমিনগণ! যখন কোন ফাসেক বা বড়পাপী তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তখন সত্যতা পারীক্ষা করে নেবে, যেন অজ্ঞতাবশতঃ কোন লোকের উপর তোমরা কোন অনিষ্ট না করে ফেল। তার ফলে তোমরা যা কর, তজ্জন্য অনুতপ্ত হও। সুতরাং ইবলীসকে সমর্থন করা নাজায়েয, যদি সেই ধারণার সাথে আরও অনেক ধারণা। সংযোগে থেকে যায়, তা অশান্তির পথে নিয়ে যায় বা তার বিরোধী ধারণা আসে, তা' বিশ্বাস করা নাজায়েয, কেননা মহাপাপী তার সংবাদে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য তাকীদ দেবে কিন্তু তা' সত্য বলে তোমার পক্ষে বিশ্বাস করা অসঙ্গত। এমন কি যদি কারও মুখ থেকে শুধু মদের গন্ধ। পাওয়া যায়, তাকে শান্তি দেওয়াও নাজায়েয, কেননা হতে পারে সে মদদ্বারা কুলি বা গড়াগড়া করেছে বা বাধ্য হয়ে সে মদ বহন করে নিয়ে এসেছে। সন্দেহজনক ব্যাপারের এ সব দৃষ্টান্ত হৃদয়ের সাথে বিশ্বাস করা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে মন্দ ধারণা করা অসঙ্গত এবং নাজায়েয।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা মুসলমানের ধন, প্রাণ এবং তার উপর খারাপ ধারণা হারাম করেছেন। যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছেঃ "ইন্নাল্লাহা হাররামা মিম্ মুসলিমিন দামুহু অ মালুহু অ আইয়্যাজুন্না বিহী জান্নাস সাওয়ি।"
মন্দ ধারণা করা নাজায়েয। তবে যা' স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া যায় বা ন্যায়পরায়ণ ধার্মিক সুতরাং লোকের সাক্ষাতে পাওয়া যায়, তখন মন্দ ধারণা পোষণ করায় আত্মার ক্ষতি হয় না। যখন তা' না হয় এবং মন্দ ধারণা ও ইচ্ছে তোমার মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয়, তখন তা' তোমার নিকট হতে দূর করে দিয়ে তার উপর স্থির থাকা উচিত। তোমার নিকট তার অবস্থা গুপ্ত। তুমি যা' তার সম্বন্ধে দেখেছ, তা' হয়ত ভাল-মন্দ মিশ্রিত থাকতে পারে।
প্রশ্নঃ বদ্ধমূল ধারণা এবং দৃঢ় সন্দেহকে কিভাবে জানা যাবে? তার উত্তর এই যে, কোন লোকের ব্যাপারে বদ্ধমূল মন্দ ধারণার চিহ্ন হৃদয়ে পূর্বে তার সম্বন্ধে যে ধারণা ছিল, সে ধারণার পরিবর্তন হওয়া এবং হৃদয় থেকে তার প্রতি একটি ঘৃণার ভাব জাগ্রত হওয়া। তার প্রতি হৃদয় ভারী হয়ে যায়, তার প্রতি তত লক্ষ্য বা মনোযোগ থাকে না, তাকে তত সম্মান করা হয় না, তার জন্য তা' দুঃখ ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা হয় না। এ সকল প্রবল ধারণা বদগুমান বা কুধারণার চিহ্ন।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মুমিনদের মধ্যে তিনটি বিষয় আছে, এবং তা' থেকে বের হওয়ারও পথ আছে। মন্দ ধারণা থেকে বের হওয়ার পথ তা' বিশ্বাস না করা অর্থাৎ ঐ ধারণা প্রবল হতে না দেয়া এবং তা' হৃদয়ে স্থান না দেয়া এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গে তা' প্রকাশ না করা। হৃদয় মধ্যে তা' বদ্ধমূল হওয়ার চিহ্ন তার প্রতি ঘৃণা উৎপাদন হওয়া। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তা' প্রকাশ হওয়ার চিহ্ন তা' কাজে পরিণত করা। শয়তান সামান্য কথার ফলে হৃদয়ের মধ্যে মন্দ ধারণা নিক্ষেপ করে দেয় এবং সাথে সাথে মনের মধ্যে এই কথা জানিয়ে দেয় যে, আমি কত দ্রুত তাকে আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির বলে চিনে ফেলেছি। কিন্তু মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নূরের সাহায্যে দৃষ্টিপাত করে এবং সে প্রকৃত পক্ষে শয়তানের প্রবঞ্চনা ও অন্ধকারের দিকে লক্ষ্য করে। যখন কোন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তোমাকে কোন সংবাদ দেয় এবং তোমার তা' বিশ্বাস করবার জন্য ঝুঁকে পড়ে তখন তোমার একটি কারণ থাকে। কেননা যদি তুমি তাকে মিথ্যুক বলে ধারণা কর তবে তুমি সেই ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির প্রতি মিথ্যা ধারণা করে একটি পাপ কার্য কর। এটাও একটি মন্দ ধারণা; সুতরাং একদিকে উত্তম ধারণা রণা করতঃ অন্য দিকে মন্দ ধারণা। করা উচিত নয়। এ কথা সত্য বটে, যদি তাদের মধ্যে কোন শত্রুতা এবং হিংসা বিশ্বেষ থাকে এবং তজ্জন্য তার অপবাদ করা হয় তা' তখন তর্কের বিষয়ে পরিণত হয়। কেননা শরীয়ত পুত্রের প্রতি অপবাদে ন্যায়পরায়ণ পিতার সাক্ষ্য এবং শত্রুর সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করেছে। অতএব এমন ক্ষেত্রে তোমার থেমে যাওয়া উচিত। তখন যদি সে ন্যায়পরায়ণও হয় তাকে বিশ্বাস করো না এবং অবিশ্বাসও করো না। কিন্তু তুমি মনে মনে বলবে তার অবস্থা আমার আল্লাহর গোপনীয় জিনিসের মধ্যে নিহিত এবং তার ব্যাপার আমার নিকট থেকে রুদ্ধ ঐ লোক প্রকাশ্যতঃ ন্যায়পরায়ণ কিন্তু তার মধ্যে লোকটির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ থাকে। নিকট । তখন কে। হয়ত তার এরূপ অভ্যাস থাকে যে, সে লোকের নিন্দাবাদ করে বেড়ায়। অনেক সময় এরূপ হয় যে, সে ন্যায়পরায়ণ ধার্মিক লোক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা' নয়। কেননা সে নিন্দা করে সে পাপী। যদি নিন্দা করা তার অভ্যাস হয়ে যায় তবে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
মানুষ অনেক সময় নিন্দার ব্যাপারে সহজ অভ্যাস করে লয় এবং কিছুই পরোয়া কর তোমার মনে যখনই কোন মুসলমান সম্বন্ধে মন্দ ধারণার উদয় হয় তখনই তা' দূরীভূত করে দিয়ে তার জন্য দোয়া করবে। তাতে শয়তান রাগান্বিত হবে এবং তোমা থেকে দূরে চলে যাবে। তখন শয়তান তোমার দোয়ায় নিমগ্ন হওয়ার ভয়ে মন্দ ধারণা তোমার হৃদয় মধ্যে নিক্ষেপ করবে না। তুমি যখনই কোন মুসলমান ব্যক্তির ত্রুটির বিষয় প্রমাণসহ জানতে পার, তাকে গোপনে উপদেশ দাও এমন ভাব দেখাবে না যে, তার গুপ্ত দোষ জানার জন্য তুমি আনন্দিত হয়েছ। এরূপ ভাবও দেখাবে না যে, সে যেন তোমাকে সম্মান করে এবং তুমি তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখছ; বরং তোমার উদ্দেশ্য থাকবে শুধু তাকে সংশোধন করা। তুমি তোমার নিজের ধর্মের কোন ক্ষতি হলে যে রূপ দুঃখিত হও তার জন্যও তদ্রূপ দুঃখিত হবে। তাকে উপদেশ দানপূর্বক ত্যাগ করা অপেক্ষা উপদেশ না দিয়ে ত্যাগ করা তোমার জন্য অসঙ্গত এবং অন্যায় হবে। এভাবে কার্য করার বিনিময়ে তুমি আল্লাহর নিকট ছওয়াব পাবে এবং তার বিপদে তোমার সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্যও তোমার আমলনামায় ছওয়াব লিখিত হবে।
মন্দ ধারণার কুফল হল গোপনীয় বিষয়ের অনুসন্ধান করা। কেননা সাধারণতঃ মন্দ ধারণা করেই হৃদয় শান্ত থাকে না তার প্রকৃত পরিচয় জানতে চায়। তখন মন তার বিষয় অনুসন্ধান করতে থাকে। কিন্তু এটা শরীয়তে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ওয়ালা তাজাস্সাস্" অর্থাৎ গুপ্ত বিষয়ের অনুসন্ধান করো না; সুতরাং পরনিন্দা, মন্দ ধারণা এবং গোপনীয় বিষয়ের অনুসন্ধান বা গোয়েন্দাগিরি এই একই আয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গোয়েন্দাগিরির মর্মার্থ আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহর রক্ষণাধীনে ত্যাগ না করা এবং তার অনুসন্ধান করতঃ গোপনীয়তা ভঙ্গ করে দিয়ে তা' প্রকাশ করা। যা' তার ধর্ম ও হৃদয়ের জন্য নিরাপদ নয়।
0 Comments