ক্রোধোদয়ের দিক থেকে মানুষের শ্রেণীভেদ

        ক্রোধ উদয়ের দিক দিয়ে মানুষ চার শ্রেণীতে বিভক্ত। যথাঃ (১) কতক লোকের হঠাৎ ক্রোধ হয় এবং শীঘ্রই উপশম হয় (২) কোন কোন লোকের ক্রোধ বিলম্বে হয় আবার বিলম্বে উপশম হয়। (৩) কোন কোন লোকের ক্রোধ বিলম্বে হয় এবং শীঘ্রই থেমে যায় এবং (৪) কোন কোন লোকের ক্রোধ শীঘ্রই হয় এবং বিলম্বে উপশম হয়। এটাই নিকৃষ্ট অবস্থা। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মু'মিনের শীঘ্রই ক্রোধ হয় এবং শীঘ্রই উপশম হয়। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তির প্রতি ক্রোধ সৃষ্টির কাজ হলেও তার ক্রোধ হয় না। সে গর্দভ। যে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করা হয় কিন্তু সে সন্তুষ্ট হয় না, সে শয়তান। হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, সতর্ক হও আদম সন্তানকে বিভিন্ন প্রকৃতিসহ সৃষ্টি করা হয়েছে। তন্মধ্যে কোন লোকের বিলম্বে ক্রোধ হয় এবং শীঘ্রই থেমে যায়। কোন লোকের শীঘ্রই ক্রোধ হয় এবং শীঘ্রই থামে, একটি ক্ষতিপূরণ অন্যটির দ্বারা হয়। কতক লোকের শীঘ্রই ক্রোধ হয় কিন্তু বিলম্বে উপশম হয়। সতর্ক হও তাদের মধ্যে যার বিলম্বে ক্রোধ হয় এবং শীঘ্রই থামে সেই উত্তম। আর যার হঠাৎ ক্রোধ হয় এবং বিলম্বে উপশম হয় সে নিকৃষ্ট, অধম।

         যখন প্রত্যেক লোকের মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হয় এবং তা' প্রভাব বিস্তার করে তখন ক্রোধের অবস্থায় যা করা হয়, তজ্জন্য কাউকে বিচারকের শাস্তি দেয়া উচিত নয়। কেননা অনেক সময়ে তাতে কর্তব্যের সীমা অতিক্রম করা হয়ে থাকে। অনেক সময়ে তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয় এবং ক্রোধের যন্ত্রণা হতে নিজের আত্মাকে সান্ত্বনা দান করা হয়। সুতরাং তার প্রতিশোধ গ্রহণ শুধু আল্লাহর জন্য নয়। হযরত ওমর (রাঃ) এক মাতাল ব্যক্তিকে দেখে তাকে ধরে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করলে মাতাল ব্যক্তি তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগল। তখন হযরত ওমর (রাঃ) তথা থেকে চলে গেলেন। তাঁকে বলা হয়, হে আমীরুল মু'মিনীন। সে যখন আপনাকে তিরস্কার করছিল, আপনি কেন তাকে ছেড়ে দিলেন? তিনি বললেন, এর কারণ সে আমার মনে ক্রোধের সঞ্চার করেছিল। যদি তখন আমি তাকে শাস্তি দিতাম, তা' আমার প্রবৃত্তির বশে আমার ক্রোধের জন্য হত। ক্রোধবশে কোন মুসলমানকে প্রহার করা আমি ভালবাসি না। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযের কোন এক ব্যক্তি ক্রোধের সঞ্চার করলে তিনি তাকে বলেছিলেন, যদি তুমি আমার ক্রোধ সঞ্চার না করতে, আমি তোমাকে নিশ্চয়ই শাস্তি দিতাম।

বিদ্বেষের পরিণতি এবং ক্ষমা ও দয়ার কল্যাণ

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, যখন ক্রোধের সময় কোন ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, তখন সে ক্রোধ অন্তরে নিহিত থেকে হিংসা বিদ্বেষে পরিণত হয়। বিদ্বেষের অর্থ ক্রোধের প্রভাব হৃদয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, তজ্জন্য মনের বিরক্তি ও ঘৃণার ভাব থাকা এবং তা' মনের মধ্যে অবস্থান করা। হযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মু'মিনের বিদ্বেষ থাকে না। ক্রোধের ফল বিদ্বেষ। বিদ্বেষ থেকে আটটি দোষের সৃষ্টি হয়।

বিদ্বেষের আটটি দোষ

        (১) ঈর্ষাঃ বিদ্বেষ তোমাকে এমন একটি অবস্থার দিকে নিয়ে যাবে, যার নাম ঈর্ষা। এর ফলে তুমি আশা করবে যে, তোমার বিপক্ষের থেকে আল্লাহ প্রদত্ত সব সম্পদ চলে যাক। তার সুখে তুমি দুঃখিত হবে এবং তার দুঃখে তুমি সুখী হবে। এটা মুনাফিকের কাজ। এটা নিন্দনীয় হবার বিষয় শীঘ্রই বর্ণনা করা হবে।

        (২) পরদুঃখে আনন্দলাভঃ বিদ্বেষের দ্বিতীয় দোষ হল, অন্তরের মধ্যে বিদ্বেষ বর্ধিত হয়ে ক্রমে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যে, তখন পরদুঃখে নিজের মনে আনন্দ হবে।

        (৩) অসহযোগিতাঃ বিদ্বেষের তৃতীয় দোষ এই যে, বিদ্বেষভাজনের সাথে অসহযোগিতা করা হতে থাকে, তার সাথে আলাপ আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়, যদিও হয়ত সে তোমার প্রীতি অন্বেষণ করে।

        (৪) ঘৃণাঃ বিদ্বেষের অন্যতম দোষ ঘৃণা। বিরাগভাজন বা বিদ্বেষভাজন ব্যক্তিদের সাধারণতঃ হেয় মনে করা হয়। তাকে তুচ্ছ, অবজ্ঞা এবং ঘৃণা করা হয়।

        (৫) হারাম দোষাবলীঃ বিদ্বেষের আর এক দোষ হল নিজের মধ্যে কতগুলি হারাম দোষ প্রকাশ পায় এবং বিদ্বেষভাজন ব্যক্তি সম্বন্ধে এমন কথা বলে যা শরীয়তে কঠোর নিষিদ্ধ। যেমন, মিথ্যার দোষারোপ, গীবত, গুপ্ত কথা প্রকাশ ইত্যাদি।

        (৬) উপহাসঃ বিদ্বেষভাজন ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং ঠাট্টা-উপহাস করা হয়।

        (৭) প্রহারঃ বিদ্বেষভাজন ব্যক্তিকে প্রহার এবং মারপিট করা হয় এবং অন্যান্য প্রকার শাস্তি দেয়া হয়।

        (৮) ঋণ ধার না দেয়াঃ বিদ্বেষভাজন ব্যক্তি শরীয়ত এবং ন্যায় সঙ্গতানুযায়ী যা পেতে পারে, তা' প্রদান না করা। তার সাথে আত্মীয়তা এবং প্রতিবেশিত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। একাজগুলো হারাম বা নিষিদ্ধ।

        উল্লিখিত আটটি দোষ-বিদ্বেষ থেকে জন্ম নেয়। বিদ্বেষ থেকে রক্ষা পেলে এ দোষগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিদ্বেষের সর্বনিম্ন স্তর হল, এই আটটি দোষ থেকে সতর্ক হওয়া। তুমি মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি আল্লাহর না ফরমানির দিকে যেও না। তুমি মনে মনে কাউকে মন্দ জানতে পার। কিন্তু তোমার হৃদয় যেন তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে, তাকে ঘৃণা না করে। বরং তার প্রতি ক্রোধের পূর্বে তোমার যেরূপ আচরণ ও মনোভাব ছিল তা' বজায় রাখবে, যেমন তাকে দেখলে সন্তুষ্ট হবে তার সাথে নম্ন ব্যবহার করবে। তার প্রয়োজন মেটাবে, আল্লাহর যিকিরে তার সাথে একত্রে বসবে। তার উপকার ও সাহায্য করবে। তার জন্য দোয়া করবে। তাকে প্রশংসা করবে। তাকে সৎকার্যের উৎসাহ দেবে। তার দুঃখে সহানুভূতি প্রদর্শন করবে, এগুলো না করলে তোমার ধর্মীয় পদমর্যাদা হ্রাস পাবে এবং তা' তোমার প্রভু থেকে কল্যাণ এবং পুণ্য লাভের প্রতিবন্ধক হবে।

        মাসত্যহ নামক একব্যক্তি হযরত আবুবকর (রাঃ) এর আত্মীয় এবং পোষ্য ছিল। সে একফের ঘটনায় সংশ্লিস্ট ছিল। অর্থাৎ সে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর চরিত্র সম্বন্ধে অপবাদ রটিয়েছিল। হযরত আবুবকর (রাঃ) এ কথা শুনতে পেয়ে শপথ করলেন যে, তিনি মাসতাহর জন্য আর কোন অর্থ ব্যয় করবেন না এবং তাকে কোনরূপ সাহায্য করবেন না। তখন আল্লাহতায়ালা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করলেন, "তোমাদের মধ্যে ধনসম্পত্তির অধিকারী ব্যক্তি আত্মীয়কে, দরিদ্রকে এবং আল্লাহর পথে মুহাজিরকে অনুগ্রহ করবে না বলে যেন শপথ না করে; বরং যেন তার অপরাধ ক্ষমা ও মার্জনা করে। করুণাময় আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন, এটা কি তোমরা ভালবাস না? তখন হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, হাঁ, আমরা তা' ভালবাসি। তারপর তিনি মাসতাহর জন্য ব্যয় করতে লাগলেন।

        ক্রোধের পূর্বের অবস্থার ন্যায় থাকাই উত্তম। তবে যদি তুমি তোমার বিরাগভাজন ব্যক্তিকে অধিক উপকার করতে পার, তা' তোমার আত্মার জন্য মুজাহাদাহ বা পরিশ্রম করা হবে এবং শয়তানের নাসিকা কর্তন করে দেয়া হবে। এটাই ছিদ্দীকগণের উচ্চস্তর এবং আল্লাহর নিকটবর্তীদের কার্যের কল্যাণ।

        বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তির তিনটি অবস্থাঃ বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তির ক্ষমতার সময়ে তিনটি অবস্থা হয়। যথাঃ (১) বিদ্বেষ সত্ত্বেও তার মন অটল থাকে। অর্থাৎ বিদ্বেষভাজন ব্যক্তি পূর্বে যেরূপ তার নিকট থেকে অনুগ্রহ লাভ করত, বিদ্বেষের পরেও তদ্রূপ অনুগ্রহ পায়। বিদ্বেষের কারণে বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তির করুণার কম বৃদ্ধি হয় না, একই প্রকার থাকে এবং মনের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। এটাই সুবিচারের মধ্যম অবস্থা। (২) বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি বিদ্বেষভাজনকে ক্ষমা করে দেয় বরং তার সাথে আরও উত্তম ব্যবহার করে বা তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন আরও দৃঢ় করে। এটাই উচ্চতর স্তর এবং এর কল্যাণ অত্যধিক। (৩) বিদ্বেষপরায়ণ ব্যক্তি বিরাগভাজন ব্যক্তি অত্যাচার ও অন্যায়ের উপযুক্ত না হলেও তাকে অত্যাচার করে। এটাই নিকৃষ্ট লোকের অবস্থা। দ্বিতীয় প্রকার ছিদ্দীকগণের এবং প্রথম প্রকার ধার্মিকগণের অবস্থা।

Post a Comment

0 Comments