দোযখ আযাব কেমন

        হে উদাসীন ও গাফিল। হে ঐ ব্যক্তি। যে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে তা' অস্থায়ী ও ধ্বংসকর জেনেও সে সম্পর্কে উদাসীন। যে স্থান থেকে তোমাকে যেতে হবে তার চিন্তা ত্যাগ কর এবং যে স্থানে যেতে হবে তার দিকে মনোনিবেশ কর। তোমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, দোযখ সবারই গন্তব্যস্থল। কেননা আল্লাহ বলেন, "তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তার নিকট উপস্থিত না হবে।" এটা তোমার প্রভুর নিকট একটি স্থিরীকৃত বিষয়। তারপর যারা খোদাভীরু তাদেরকে আমি মুক্তি দেব এবং পাপীদেরকে তথায় দুরবস্থার মধ্যে রেখে দেব; সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, তুমিও তথায় উপস্থিত হবে। কিন্তু তোমার মুক্তির বিষয়ে সন্দেহ আছে। সেই স্থানটির ভয়াবহ অবস্থার কথা তুমি চিন্তা কর। হয়ত তুমি তা' থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রস্তুত হয়েছ। মানুষের অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা কর। কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে তাদের মন কঠিন হয়েছে। যখন তারা সেই দুঃখ ও বিপদের মধ্যে থাকবে, যখন অন্ধকারের গাঢ় আচ্ছন্নতা তাদেরকে বেষ্টন করবে ও দোযখের প্রজ্জ্বলিত অগ্নি তাদেরকে আবৃত করবে, তখন তারা তাদের বিপদ নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করবে। সে সময় দোযখের ফিরেশতা ঘোষণা করবে, অমুকের পুত্র অমুক কোথায়? সে দুনিয়ায় বহু আশা করেছিল, মন্দ কার্যে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছিল। ফিরেশতাগণ লৌহ মুদ্গার নিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসবে এবং এসেই ভীষণভাবে ধমকি দিতে থাকবে। তারপর তার। তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে জাহান্নামের গভীর তলদেশে নিক্ষেপ করবে। তারপর বলবে, এখন দোযখের স্বাদ গ্রহণ কর, এই সংকীর্ণ গৃহের মধ্যে বসবাস কর, যা' অন্ধকারে পরিপূর্ণ এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য শুধুই ধ্বংসকর। তার মধ্যে এই বন্দী চিরকাল বসবাস করবে। অতঃপর সেই অতল গহ্বরে ভয়ঙ্কর অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হবে। এদের পানীয় হবে ভীষণ উষ্ণ; এবং বিশ্রামস্থল হবে অগ্নিতে পরিপূর্ণ।

        দোযখের ফিরেশতা এদেরকে প্রচণ্ড শাসনে শাসন করবে। তাদের পার্থিব আশা-আকাঙক্ষার এভাবেই ইতি হবে। তারা দেখবে, তাদের চার দিকে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস। তা' থেকে তাদের মুক্তি নেই। এদের পদদ্বয় মস্তকের কেশগুচ্ছের সাথে বেঁধে দেয়া হবে। পাপের অন্ধকার এবং দোযখাগ্নির উত্তাপে তাদের মুখমণ্ডল কালিমামা হয়ে যাবে। তখন তারা চীৎকার দিয়ে বলতে থাকবে, হে দোযখের ফিরেশতা। আমাদেরকে যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা' অতীব সত্য। হে মালেক। লৌহ মুদার পৃষ্ঠদেশ ভেঙ্গে দিয়েছে। হে মালেক! আমাদের চর্ম, মাংস, অস্থি জ্বলে- পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। হে মালেক তুমি আমাদেরকে দোযখের এ কঠিন শাস্তি থেকে বের করে দাও, আমরা আর এর মধ্যে থাকতে পারছি না। দোযখের জ্বালা আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। তখন দোযখের প্রহরী বলবে, তা' আর কখনও হবে না, তোমরা আর কখনও সুখের মুখ দেখতে পাবে না। এই অপমানকর স্থান থেকে আর কোন দিনই তোমরা বের হতে পারবে না। তোমরা এখানেই কষ্ট ও দুঃখ ভোগ করতে থাক, আমরা তোমাদের আর কোন কথা শুনতে চাই না। যদি তোমাদেরকে এস্থান থেকে বের করা হয় তবে তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছিল, তোমরা আবার তা-ই করতে শুরু করবে। দোযখের প্রহরীর মুখে এরূপ কথা শুনে তারা সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়বে এবং তারা যে আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন করে আসেনি তজ্জন্য দুঃখ করতে থাকবে। অনুতাপের জ্বালায় তারা তখন দন্ত্রীভূত হবে। কিন্তু শত অনুতাপও তাদের তখন কোন উপকারে আসবে না; বরং তাদেরকে দোযখের ফিরেশতাগণ ধৃত করে উপরে উঠিয়ে সবেগে অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবে। তাদেরকে অগ্নি উপর থেকে আক্রমণ করবে, নিম্ন থেকেও আক্রমণ করবে, ডান থেকে ও বাম থেকেও অগ্নি এসে তাদেরকে আবৃত করে ফেলবে। এভাবে চারদিক থেকেই তারা অগ্নির মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাদের খাদ্য হবে অগ্নি, পানীয় হবে অগ্নি, পরিচ্ছদ হবে অগ্নি এবং তাদের শয্যাও হবে অগ্নি, তারা শুধু অগ্নির মধ্যেই অবস্থান করবে। উত্তপ্ত আলকাতরা হবে তাদের গাত্রের কম্বল। তাদের জন্য যে চাবুক ব্যবহৃত হবে তা' হবে উত্তপ্ত লৌহের, শৃঙ্খল হবে অসম্ভব ভারী। তখন তারা সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে শুধু ছটফট করতে থাকবে আর অন্ধকারের মধ্যে কেবল চীৎকার করতে থাকবে। কড়াইর মধ্যে ফুটন্ত পানির ন্যায় তাদের অগ্নিতে উত্তপ্ত ও বিগলিত দেহ টগবগ করতে থাকবে। ক্ষোভ, আর্তনাদ ও আর্তচীৎকার ব্যতীত তখন আর কিছুই শুনা যাবে না। যখন তারা একটু আরাম ও ঠাণ্ডা পানির জন্য কাকুতি-মিনতি করবে তখন তাদের মস্তকে উত্তপ্ত সলিলরাশি ঢেলে দেয়া হবে। তাদের উদরের তন্ত্রীসমূহ জ্বলে-পুড়ে একাকার হয়ে যাবে। অগ্নির এই ভীষণ শাস্তির মধ্যেই তাদের শরীরে প্রচণ্ড লৌহ মুদগরের আঘাত পড়তে থাকবে। তৃষ্ণার জ্বালায় তাদের প্লীহা ফেটে যাবে। গণ্ডের উপর দিয়ে গলিত পুঁজের ন্যায় বের হতে থাকবে। গণ্ডদ্বয়ের মাংসসমূহ স্খলিত হয়ে পড়বে। মস্তকের কেশ ও দেহের চর্ম খসে পড়বে। কিন্তু যখনই দেহের চর্ম খসে পড়বে অন্য চর্ম এনে লাগিয়ে দেয়া হবে। তাদের অস্থিতে তখন মাংস থাকবে না। এ সময় দোযখের শাস্তি অসহ্য হওয়ায় তারা তাদের মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু কোন কিছুতেই তাদের মৃত্যু হবে না।

         ওহে! যদি তুমি তাদেরকে দেখতে পেতে, চিন্তা কর, তাহলে তোমার অবস্থা কেমন হত। তাদের মুখমণ্ডল জ্বলে-পুড়ে অঙ্গারের ন্যায় হয়ে যাবে, তাদের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে যাবে, পৃষ্ঠদেশ কুজ হয়ে যাবে, অসিস্থসমূহ ভেঙ্গে যাবে, চর্ম, মাংস খণ্ডিত, স্খলিত ও বিগলিত হয়ে যাবে। তদুপরি তাদেরকে লৌহদণ্ডের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে নেয়া হবে। অগ্নির লেলিহান শিখা তাদের দেহাভ্যন্তরে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করবে। এরই মধ্যে আবার দোযখের ভীষণ বিষাক্ত সর্প ও বিচ্ছু তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পুনঃ পুনঃ দংশন করতে থাকবে। দোযখের শান্তির বিষয় এটুকুই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। তুমি

        বর্ণিত অবস্থাগুলোর বিষয় চিন্তা করার পর দোযখের উপত্যকার বিষয় চিন্তা কর। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, দোযখের মধ্যে সত্তর হাজার উপত্যকা রয়েছে। তার প্রত্যেকটি উপত্যকায় সত্তর হাজার সর্প এবং সত্তর হাজার বিচ্ছু আছে। কাফির ও মুনাফিকদের শাস্তি দেয়ার জন্য এনেরকে রাখা হয়েছে। হযরত আলী থেকে বর্ণিত আছে, হুযুরে হয়ে পাক (দঃ) বলেছেন যে, তোমরা 'জুকবুল হুখন' থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। আরজ করা। হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। 'জ্বলুল হুযন' কি? তিনি বললেন, 'জুদুল হুযন' দোযখের একটি উপত্যকা। খোদ দোযখ সত্তরবার তা' থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। আল্লাহতায়ালা তা' রিয়াকার অর্থাৎ লোক-প্রদর্শনকারীদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। এটাই দোযখের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্থান। দোযখে মানুষের স্থান তার দুনিয়ার খাহেশ এবং কাজ-কর্মের পরিমাণ ও অবস্থানুসারে হবে। দোষখগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ জাহান্নাম, তারপর সান্ধার, তারপর জাই, তারপর হতামা, তারপর সাঈর, তারপর জাহীম, তারপর হাবিয়াহ। হাবিয়াহ সবগুলো দোযখের নিম্নস্থলে অবস্থিত। এখন লক্ষ্য কর, হাবিয়াহ দোযখের গভীরতা কত অধিক। দোযখের গভীরতা মানুষের পার্থিব খাহেশের আধিক্যের পরিমাণ অনুসারে হবে, যেরূপ দুনিয়ার খাহেশের সীমা নেই, তদ্রূপ হাবিয়াহ দোষখের গভীরতারও সীমা নেই।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, একদা আমরা হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ আমরা সবাই একটা ভীষণ শব্দ শুনতে পেলাম। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা কি জান এ শব্দটা কিসের? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই এ বিষয় উত্তম অবগত। তিনি বললেন, এ একটি প্রস্তর পতনের শব্দ। দোযখের উপরিভাগ থেকে সত্তর বছর ধরে নিম্নে পতিত হতে হতে সর্বনিম্নস্থলে এই মাত্র প্রস্তরটি গিয়ে পৌছল এবং তাতে এই শব্দ হল। এখন তুমি এর দ্বারা দোযখের গভীরতা সম্বন্ধে ধারণা করতে পার। অতঃপর তুমি দোযখের স্তরের তারতম্য সম্পর্কিত চিন্তা কর। দুনিয়ায় যেরূপ মানুষের পুণ্য ও পাপের অবস্থার তারতম্য থাকে, পারলৌকিক পুরস্কার এবং শাস্তির অবস্থার মধ্যেও তদ্রুপ তারতম্য হবে। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার উপর বিন্দু পরিমাণও অত্যাচার করেন না; সুতরাং দোযখীদের প্রত্যেকেরই একইরূপ শাস্তি হবে না; বরং প্রত্যেকেরই পাপ ও দোষের পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তি হবে।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন পরকালে যে দোযখীর সর্বাপেক্ষা কম শাস্তি হবে তারও দুটো অগ্নির পাদুকা থাকবে। ঐ পাদুকা তাকে জবরদস্তি পরিয়ে দেয়া হবে। তার উত্তপ্ততায় ঐ ব্যক্তির মস্তক টগবগ করতে থাকরে। এখন চিন্তা কর, সর্বাপেক্ষা কম শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির যদি এই অবস্থা হ্যা, তবে সর্বাপেক্ষা অধিক শান্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির কি অবস্থা হতে পারে? তুমি দোযখের এই শাস্তির বর্ণনা থেকে উপদেশ গ্রহণ কর। হে উদাসীন ব্যক্তি। যদি তুমি দোযখের শাস্তিকে সামান্য বন্ধু মনে কর, তাহলে অগ্নির মধ্যে তোমার একটি অঙ্গুলি স্থাপন কর। তারপর ধারণা কর যে, দোযখের শাস্তি কিরূপ? তারপর মনে রেখ, দুনিয়ায় অগ্নির সাথে আখেরাতের অগ্নির তুলনা হয় না। দুনিয়ার মধ্যে দেহের জন্য সর্বাপেক্ষা শান্তির বস্তু প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, তা-ই দোযখের শাস্তি বুঝাতে গিয়ে অগ্নির কথা বলা হয়ে থাকে। অবশ্য দোযখে বিশেষ শাস্তি অগ্নি দ্বারাই দেয়া হবে, কিন্তু সে অগ্নি দুনিয়ার অগ্নি নয়; বরং দোযখের অগ্নির সামনে দুনিয়ার অগ্নি উপস্থিত করা হলে তা ভয়ে অস্থির হয়ে পালিয়ে যাবে। হাদীস শরীফে আছে যে, দোষগের অগ্নিকে রহমতের পানি দ্বারা সত্তর বার ধৌত করার পর তা' দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে। তারপর সেই অগ্নির যে অবস্থা হয়েছে দুনিয়ার অগ্নি সেই অবস্থারই নামান্তর, যা' এখন দুনিয়াবাসীর জন্য বিভিন্ন কার্যে ব্যবহারোপযোগী হয়েছে।

             হুযুরে পাক (দঃ) দোযখের অগ্নি সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন তা' হল এক সময় আল্লাহতায়ালা দোযখের অগ্নিকে একাধারে এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্জ্বলিত হতে আদেশ করলেন। এভাবে তা' প্রজ্জ্বলিত হয়ে অগ্নি লোহিত বর্ণ ধারণ করল। তারপর তার প্রতি আর এক হাজার বছর প্রজ্জ্বলিত হওয়ার নির্দেশ হল। সেই নির্দেশ পালন করে অগ্নি শ্বেত বর্ণ ধারণ করল। তারপর অগ্নির প্রতি পুনরায় একইরূপ নির্দেশ হল। অগ্নি পুনরায় এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্জ্বলিত হয়ে এবার সে কৃষ্ণ, বর্ণ ধারণ করল। এখন দোযখের অগ্নি সেই অন্ধকারপূর্ণ কৃষ্ণ বর্ণ অবস্থায়ই আছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন যে, একবার দোযখের অগ্নি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করল যে, হে প্রভু! আমার কিছু অংশ অন্য অংশকে ভক্ষণ করেছে, তখন আল্লাহ তাকে দুটো নিশ্বাসের আদেশ দিলেন। তার একটি নিশ্বাস শীতকালে এবং আর একটি নিশ্বাস গ্রীষ্মকালে। যারফলে গ্রীষ্মকালে এত বেশী তাপ হয় এবং শীতকালে এত বেশী শীত হয়।

         হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, কাফিরদের মধ্যে যে ব্যক্তি দুনিয়ার সুখ-সম্পদ  ভোগে লিপ্ত ছিল, তাদেরকে ডাকিয়ে বলা হবে, দোযখের অগ্নিতে ঐগুলি ডুবিয়ে দাও। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি সুখ-সম্পদ কখনও দেখেছ? তখন সে বলবে যে, না, দেখিনি। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাপেক্ষা অনিষ্টকারী ছিল, তাকে ডাকিয়ে এনে বলা হবে, তোমার সেই কাজগুলি দোযখের মধ্যে ডুবিয়ে দাও। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি কি কখনও অনিষ্ট দেখেছ? সে বলবে, না, দেখিনি। হযরত আবু হোরায়রা বলেছেন, যদি দুনিয়ায় লক্ষাধিকও লোক থাকে এবং তারপর একজন দোযখবাসী একটি নিশ্বাস ত্যাগ করে, তবে তারা প্রত্যেকে মৃত্যুবরণ করবে। কোন আলিম বলেছেন, আল্লাহর এই আয়াতের অর্থ "তাদের মুখমন্ডলকে দোযখের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করবে" একবারই দোযখের অগ্নি স্পর্শ করলে তাতে তার অস্থির উপর এমন মাংস থাকবে না, যা' তার পশ্চাতে ফেলে না দেবে। এরপর তুমি পুঁজের গন্ধের বিষয় চিন্তা কর। তা' তাদের শরীর থেকে প্রবাহিত হয়ে তাদেরকে নিমজ্জিত করে ফেলবে। হযরত আবু সাইদ (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যদি জাহান্নামের এক বালতি পুঁতি গন্ধময় পুঁজ এই দুনিয়ায় ফেলে দেয়া হয়, তবে দুনিয়ার সব কিছুই পুঁতি গন্ধময় হয়ে যাবে। আর এই পুঁজই হবে দোযখীদের পানীয়। যখন তৃষ্ণার্ত হয়ে তারা পানীয়ের জন্য চীৎকার করতে থাকবে, তখন তাদেরকে এই পুঁজ পান করতে দেয়া হবে। আবার কখনও বা তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে উত্তপ্ত গলিত সীসার ন্যায় পানীয় পান করতে দেয়া হবে। এ পানীয় মুখে রাখা মাত্র তাদের মুখ জ্বালিয়ে দেবে।

        দোযখীদের খাদ্যের দিকে লক্ষ্য কর। যাকুম হবে দোযখের প্রধান খাদ্য। যেরূপ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে পথভ্রষ্ট মিথ্যাবাদীর দল। তারপর তোমাদেরকে যাকুম বৃষ্ণের ফল ভক্ষণ করতে দেয়া হবে। তার কাঁদি শয়তানের মস্তকের ন্যায়। দোযখীরা তা' ভক্ষণ করবে। তাতে তাদের উদর পূর্ণ হবে। তাদেরকে উত্তপ্ত পানীয় পান করতে দেয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তা' একটি বৃক্ষ। যা' জাহান্নামের মূল থেকে বের হবে, যেন তার কাঁদি শয়তানের মস্তক। তা' থেকে তাঁরা ভক্ষণ করবে এবং তাদের উদর পূর্ণ হবে। তারপর তাদের উপর উত্তপ্ত পানি ঢালা হবে। তারপর তাদেরকে জাহীম নামক দোযখে নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, উত্তপ্ত অগ্নি তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে এবং অগ্নির পিয়ালায় তা' পান করতে দেয়া হবে। আল্লাহ বলেছেন, আমাদের নিকট শৃংখল এবং জাহীম আছে এবং কণ্ঠরোধকারী খাদ্য এবং কঠিন শাস্তি আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যদি যাকুমের এক বিন্দু এই দুনিয়ার সাগরে পতিত হত, তবে দুনিয়াবাসীর জীবন ধারণ দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। এখন চিন্তা কর, যাদের খাদ্য সেই যাক্কুম হবে, তাদের অবস্থা কিরূপ হবে?

        হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ যা' ভালবাসেন, তা-ই ভালবাসবে। আল্লাহতায়ালা যে শাস্তি ও বিপদ এবং জাহান্নামের কথা বলে ভয় দেখিয়েছেন, তার প্রতি সতর্ক হবে এবং তা' ভয় করবে। বেহেশতের বিন্দুমাত্র সুখও যদি তোমরা এ দুনিয়ায় ভোগ করতে, তাহলে তোমাদের সারাজীবন সুখময় হয়ে যেত এবং দোযখের এক বিন্দু শাস্তিও যদি তোমরা এ দুনিয়ায় ভোগ করতে, তাহলে তোমাদের সমগ্র পার্থিব জীবনই দুর্বিষহ হয়ে যেত। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, দোযখবাসীকে ক্ষুধা দেয়া হবে। তারা খাদ্য চাইলে তাদেরকে বিষ কণ্টক খাদ্য দেয়া হবে। তা' তাদের ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে না, উদরে শাস্তি আনবে না, বরং উদর মধ্যে প্রবল অশান্তি ও জ্বালার সৃষ্টি করবে। তখন তারা আবার খাদ্য চাইবে। কিন্তু এবার তাদেরকে গ্রীবা আবদ্ধকারী খাদ্য দেয়া হবে। তখন তারা দুনিয়ার পানীয় দ্রব্য চাইবে। কিন্তু তাদের সামনে উত্তপ্ত পানি ধরা হবে, যখন তা' তাদের মুখ দগ্ধ করে ফেলবে, যখন তা' উদরে যাবে, উদরের তন্ত্রীসমূহ কর্তিত হয়ে যাবে। তখন তারা দোযখের দারোগাকে ডেকে বলবে, ওহে! তোমাদের প্রভুকে অন্ততঃ একটি দিনের জন্য আমাদের শাস্তি লাঘব করতে বল। দারোগা বলবে, তোমাদের নিকট কি তোমাদের রাসূল আসেনি? তারা বলবে, হাঁ এসেছিল। তখন দারোগা বলবে, তোমরা আল্লাহর নিকট নিজেরাই প্রার্থনা কর। তখন দোযখবাসীরা প্রার্থনা করবে; কিন্তু কাফিরদের প্রার্থনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তখন দোযখীরা ফিরেশতা মালেককে ডেকে বলবে, ওহে মালেক! তোমার প্রভু আমাদের সম্বন্ধে তোমাকে বিচার করতে বলেছেন। তখন সে বলবে, তোমরা এই দোযখেই কাল কাটাবে।

        হযরত আ'মাশ (রাঃ) বলেছেন, গযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, তুমি জেনে রাখ, তাদের প্রার্থনা এবং তাদের প্রভুর উত্তরের মধ্যবর্তী সময় একহাজার বছরের দূরত্ব হবে। ফিরেশতাগণ বলবে, তোমাদের প্রভুর নিকট প্রার্থনা কর। তোমাদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি ব্যতীত আর কারও অধিকার নেই। তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু। আমাদের কই আমাদেরকে পরাভূত করে ফেলেছে। আমরা পথদ্রই ছিলাম। হে আমাদের প্রভু। তুমি আমাদেরকে দোষখ থেকে বের করে নাও। যদি আমতা আবার ফিরে আসি নিশ্চয়ই আমরা সুপথ প্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসব। আল্লাহ বলবেন, তোমাদের একথা সত্য নয়, তোমরা দোষখ থেকে বের হয়ে দুনিয়ায় গিয়ে আবার ফিরে আসলেও অত্যাচারী হবে। এই কথা বলে তিনি ফিরেশতাদেরকে বলবেন, তোমরা এদেরকে যথোচিত অভ্যর্থনা কর। আর এদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বলবেন, তোমরা এখানেই অপদস্থ হয়ে থাক। আর কোন কথা বলো না। তারা প্রভুর মুখে এরূপ কথা শুনে যে কোনরূপ মঙ্গলের আশা থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হবে এবং তাদের সেই নৈরাশ্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। 

        হযরত আবু উমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ বলেন, উত্তপ্ত সলিল তাদের পান করানো হবে। সে তা' গলাধঃকরণ করবে। যদিও তার মন চাইবে না। তিনি বলেছেন, উত্তপ্ত পানি তার নিকট উপস্থিত করা হবে কিন্তু সে তা' পছন্দ করবে না। যখন তা' তার নিকট উপস্থিত করা হবে এবং তার মুখে ঢেলে দেয়া হবে, তার মুখ জ্বলে-পুড়ে যাবে এবং উত্তপ্ত পানির ধাপে তার মস্তকের মগজ বিগলিত হয়ে পড়ে যাবে। তার উদরের তন্ত্রীসমূহ কর্তিত হয়ে যাবে এবং তা' তার মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, তাদেরকে উত্তপ্ত পানি পান করানো হবে। তা' তাদের পাকস্থলি কর্তন করে ফেলবে। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, যদি তারা পানি পান করতে চায়, তারা তাম্র গলানো উত্তপ্ত পানির ন্যায় পানি পাবে। তাতে তাদের মুখ জ্বলে-পুড়ে ভস্মিভূত হবে। তাদের
ক্ষুধা ও তৃষ্ণার সময় এরূপ খাদ্য ও পানীয়েরই ব্যবস্থা করা হবে। 

        এখন তুমি জাহান্নামের সর্প, বিষ্ণু এবং তাদের বিষ দংশন ও তাদের শারীরিক আকৃতির বিষয় লক্ষ্য কর। এগুলো দোযখবাসীর চির সহচর রূপে সর্বদাই নিকটে থাকবে। দোযখবাসীরা এক মুহূর্তও তাদের দংশন থেকে অব্যাহতি পাবে না। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা যাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন এবং যে তার যাকাত আদায় করে নি, রোজ কিয়ামতে সেই ধন-সম্পদ সর্পে পরিণত হবে। ঐ সর্পের চোখে দুটো কৃষ্ণ দাগ থাকবে। রোজ কিয়ামতে তা' তাদের গ্রীবাদেশ জড়িয়ে থাকবে। এই অবস্থায় সর্প তাদেরকে বলবে, আমি তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার গুপ্তধন। এই পর্যন্ত বলে হুযুরে পাক (দঃ) অত্র আয়াত পাঠ করলেন, "আল্লাহতায়ালা যাদেরকে তাঁর ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তারা তাতে কৃপণতা করলে ভেব না যে, তাতে তাদের মঙ্গল হবে; বরং তা' তাদের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে। বোজ কিয়ামতে তাদের সঞ্চয়কৃত ধন-সম্পদ তাদের জীবাদেশে সংযুক্ত করে দেয়া হবে।"

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, দোযখে বিরাট উষ্ট্রের গ্রীবার ন্যায় সুবৃহৎ বহু সর্প রয়েছে। তা' একবার দংশন করলে চল্লিশ বছর পর্যন্ত তার বিষের ক্রিয়া স্থায়ী থাকবে। তাছাড়া দোযখে বহু বড় বড় বিষ্ণু আছে। তা' এত মারাত্মক যে, একবার দংশন করলে সর্পবিষের ন্যায় তাক বিষের ক্রিয়াও চল্লিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। এসব সর্প ও বিষ্ণু ঐসব লোককে সংশ করতে থাকবে যারা দুনিয়ায় কৃপণতা করেছে। মানুষের সাথে অসৎ ব্যবহার করেছে এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়েছে। যারা দুনিয়ায় এসব কাজ থেকে বিরত থাকে তারা দোযখের ঐসব সর্প ও বিচ্ছু থেকে রক্ষা পাবে।

         এখন তুমি দোযখবাসীর শরীরের দীর্ঘতা ও প্রশস্ততা সম্বন্ধে লক্ষ্য কর। আল্লাহ এদের প্রত্যেকের শরীরের দীর্ঘতা ও প্রশস্ততা বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন। যাতে করে তাদের শাস্তি বৃদ্ধি পায় এবং দোযখের লেলিহান অগ্নিশিখা এবং সর্প ও বিচ্ছুর দংশন জ্বালা দোযখবাসী বেশী করে অনুভব করতে পারে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, দোযখে কাফিরের সম্মুখের দন্ত ওহোদ পর্বতের ন্যায় বৃহৎ হবে এবং তার চর্মের ঘনত্ব বা পুরুত্ব তিন দিনের পথের সমান হবে। তিনি আরও বলেছেন যে, তার মুখের উচ্চ অধর তার উচ্চ বক্ষের উপর পড়ে থাকবে। অধরযুগল তার মুখকে আবৃত করে রাখবে। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, সিজ্জীনের মধ্যে কাফির ব্যক্তি তার রসনা টানতে থাকবে। অন্যান্য দোযখবাসী বিশালাকৃতি বিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ঐ রসনার উপর দিয়ে গমনাগমন করবে। দোযখের অগ্নি বিশালাকৃতির দোযখবাসীকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একাকার করে দেবে। তাদের চর্ম ও মাংস অগ্নি দহনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু সাথে সাথে আবার তাকে নতুন চর্মও মাংস এনে দেয়া হবে। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) আল্লাহতায়ালার এই আয়াত, "যখনই তাদের চর্ম নষ্ট হবে, তাদেরকে আমি অন্য চর্ম দেব" পাঠ করে বলেন, অগ্নি ঐ চর্মকে প্রতিদিন সত্তর হাজার। বার ভক্ষণ করবে। যখনই ভক্ষণ করবে তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা ফিরে যাও। তারা ফিরে যাওয়া মাত্রই দোযখবাসী আবার পূর্বাবস্থা ফিরে পাবে।

        এখন তুমি দোযখীদের আর্তনাদ, আর্ত-চীৎকার, ক্রন্দন, বিলাপ এবং হা-হুতাশের বিষয় চিন্তা কর। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সেদিন জাহান্নামকে হাশরের ময়দানে উপস্থিত করা হবে, তার সত্তর হাজার লাগাম থাকবে। প্রত্যেক লাগামের সাথে সত্তর হাজার ফিরেশতা থাকবে। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ক্রন্দন হবে প্রত্যেক দোযখবাসীর জন্য অপরিহার্য। তারা কেবলই ক্রন্দন করতে থাকবে। ক্রন্দন করতে করতে চক্ষু থেকে তাদের অশ্রুর বদলে রক্ত ঝরতে থাকবে। হযরত মুহাম্মদ ইবনে কা'ব বলেছেন, দোযখবাসীর পাঁচটি প্রার্থনা থাকবে; আল্লাহতায়ালা তন্মধ্যে চারটি প্রার্থনার উত্তর দেবেন। পঞ্চম প্রার্থনা করার পর তারা আর কোন কথা বলতে পারবে না। তারা তাদের প্রভুর নিকট বলবে, হে আমাদের প্রভু। তুমি আমাদেরকে দুবার মৃত্যু দিয়েছ এবং দু'বার জীবন দান করেছ। এখন আমরা আমাদের পাপ ও অন্যায় চিনতে পেরেছি। আমাদের এখান থেকে বের হবার কি কোন পথ আছে? আল্লাহতায়ালা বলবেন, অপেক্ষা কর, আমি তোমাদের কথার উত্তর দিচ্ছি। এর কারণ এই যে, দুনিয়ায় কেউ যখন আল্লাহতায়ালাকে ডাকত, এরা তা' অস্বীকার ও অপছন্দ করত। আর যখন কেউ আল্লাহর সাথে শরীকদার স্থাপন করত এরা তা' স্বীকার করত ও পছন্দ করত; সুরতাং মহান আল্লাহতায়ালার বিধান এরূপ। তারপর তারা তাদের প্রভুকে লক্ষ্য করে বলবে, হে আমাদের প্রভু। তুমি আমাদেরকে এ কঠিন দোষখ থেকে বের করে নাও। এরপর আমরা নিশ্চয়ই সৎকাজ করব। যা' আমরা পূর্বে করেছি তা' আর কখনও করব না। তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে বলবেন, তোমরা কি তার পূর্বেও আমার সাথে এরূপ প্রতিজ্ঞা করনি? এখন আমি তোমাদের কোন কথাই শুনতে চাই না। কিন্তু তারপরও দোযখবাসীরা তাদের প্রভুর নিকট প্রার্থনা করবে, হে প্রভু! অনুগ্রহপূর্বক তুমি আমাদেরকে দোযখ থেকে বের করে নাও। সত্যিই আমরা এবার সৎকাজ করব। পূর্বে আমরা যা' করেছি এবার আমরা তা' নিশ্চয়ই করব না। তখন আল্লাহ তাদের এই প্রার্থনার উত্তরে বলবেন, আমি কি তোমাদেরকে দীর্ঘ জীবন দান করিনি? সে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তোমরা আমাকে স্মরণ করতে পারতে। তোমাদের নিকট আমি সতর্ককারী পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা সেদিকে লক্ষ্যই করনি। অতএব এখন তোমরা দোযখের কঠিন শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর। তারপর তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু। আমাদের দুঃখ-কষ্ট আমাদের উপর প্রবল আকার ধারণ করেছে। অবশ্যই আমরা পথভ্রষ্ট ছিলাম। এখন আমরা আমাদের সেই ভুল বুঝতে পেরেছি। তুমি তোমার অনুগ্রহবশতঃ আমাদেরকে এ দোযখ থেকে বের করে নাও। যদি আমরা আবার অসৎ কার্য করি, নিশ্চয়ই তখন আমরা অত্যাচারীরূপে প্রতিপন্ন হব। তখন আল্লাহ তাদেরকে জবাব দেবেন, তোমরা এখন কোন কথাই বলো না; বরং অপদস্থরূপে এই দোযখে বসবাস কর। এরপর দোযখীরা আর কোন কথাই বলতে পারবে না। এই কথা বলতে না পারাই হবে তাদের জন্য সর্বাপেক্ষা কঠোর শাস্তি।

        হযরত মালেক ইবনে আনাস (রাঃ) বলেছেন, যায়েদ ইবনে আসলাম (রাঃ) আল্লাহর এই আয়াত সম্বন্ধে বলেছেন, (আমরা অস্থির চিত্ত হই বা ধৈর্য ধারণ করি আমাদের কোন মুক্তি নেই) তারা একশ' বছর পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করেছিল। তারপর তারা একশ' বছর পর্যন্ত অস্থিরচিত্ত ছিল। তারপর একশ' বছর পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করেছিল। তারপর তারা বলল, আমরা অস্থিরচিত্ত হই বা ধৈর্য ধারণ করি তা' আমাদের নিকট একই সমান। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে মৃত্যুকে উপস্থিত করা হবে। তা' যেন শ্বেত বর্ণের মেঘ বিশিষ্ট। মৃত্যুকে উপস্থিত করে বেহেশত ও দোযখের মধ্যবর্তী স্থানে যবাই করা হবে। তারপর বলা হবে, হে বেহেশেতবাসীগণ! এখানে তোমাদের মৃত্যুহীন চিরস্থায়ী বসবাস। অতঃপর দোযখবাসীদেরকেও লক্ষ্য করে বলা হবে; হে দোযখবাসীগণ। এখানে তোমাদের মৃত্যুহীন চিরস্থায়ী বসবাস।

        হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, দোযখ থেকে এক হাজার বছর পর এক ব্যক্তি বের হবে, আমি যদি সেই ব্যক্তি হতাম। (তবু তো আমার সৌভাগ্য বলা যেত।) একদা এক ব্যক্তি হযরত হাসান বছরী (রহঃ)কে গৃহের কোণায় বসে রোদন করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি রোদন করছেন কেন? তিনি বললেন, আমাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হয় নাকি এবং তারপর আল্লাহ আমার প্রতি আর লক্ষ্য করেন কি না সেই চিন্তায় আমি রোদন করছি।

        আমি এতক্ষণ যা, বর্ণনা করলাম, জাহান্নাম ও তার শাস্তি সম্পর্কিত এটা হল সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এর বিশদ বর্ণনার কোন শেষ নেই। মোটকথা জাহান্নামীদের শাস্তি বড়ই ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ হবে। তদুপরি তাদের প্রতি আরও শাস্তি এই যে, তারা আল্লাহর দীদার থেকে বঞ্চিত হবে, বেহেশতের সুখ থেকে বঞ্চিত হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি না পাওয়াজনিত আক্ষেপ করতে হবে, নৈরাশ্যজনিত অনলে দঞ্চিভূত হতে হবে। তাদের তখন এ জ্ঞান থাকবে যে, তারা সামান্য অর্থ- সম্পদ ও সুখ-সম্ভোগের বিনিময়ে এই স্থায়ী এবং অনন্তকালীন সুখ বিক্রয় করে দিয়েছিল। তাও নিষ্কণ্টক ছিল না; বরং কণ্টক ও বিপদাপদে পরিপূর্ণ ছিল। তারা তাদের মনে মনে বলবে, হায় আক্ষেপ! আমরা আমাদের প্রভুকে অমান্য করে আমাদের কিভাবে ধ্বংস করেছি, আমরা কেন ও কিরূপে কয়টি দিন ধৈর্য ধারণ করতে পারলাম না? সে অল্প কয়েকটি দিন নিঃশেষ হয়ে যেত এবং এখন আমরা আল্লাহর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে সুখে থাকতাম। এসব লোকের জন্য আক্ষেপ। তারা যা' হারিয়েছে, এবং যে বিপদে পড়েছে, পড়েছে। পার্থিব সম্পদের কিছুই এখন তাদের নিকট নেই। যদি তারা বেহেশতের সুখ না দেখত, তাদের আক্ষেপ তত বড় হত না, কিন্তু তবুও তা' তাদের নিকট বড় আকারে উপস্থিত হবে।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে বেহেশতের কিছু সংখ্যক লোককে দোযখ থেকে আনা হবে। যখন তারা বেহেশতের নিকটবর্তী হবে এবং বেহেশতের সুঘ্রাণ উপভোগ করতে থাকবে, তার প্রাসাদসমূহ এবং বেহেশতবাসীদের জন্য যে সুখের প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে তা' তাদের দৃষ্টিপথে পতিত হবে, তাদেরকে বলা হবে, এখান থেকে ফিরে যাও, এতে তোমাদের কোন অংশ নেই। তখন তারা হতাশ হয়ে মনোকষ্টে চলে যাবে। পূর্বাপর কেউ-ই এরূপ হতাশ হয়ে ফিরে যাবে না। তারা বলবে, হে প্রভু! তোমার পুরস্কার দেখার পূর্বে এবং তুমি তোমার বন্ধুগণের জন্য যে সুখ প্রস্তুত করেছ, তা' দেখার পূর্বে যদি তুমি আমাদেরকে দোযখে ফিরিয়ে দিতে তা' আমাদের পক্ষে সহজ হত। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, এটাই তোমাদের সম্বন্ধে আমি ইচ্ছা করেছিলাম, কেননা তোমরা যখন দুনিয়ায় নির্জনে ছিলে, তোমরা আমার সম্মুখে বড় বড় পাপ করেছিলে, যখন লোকদের সংসর্গে থাকতে তাদের সাথে নির্দোষভাবে সাক্ষাত করতে, আমার জন্য তোমাদের মনে যা' ইচ্ছা না করতে, তার বিপরীত লোকদের প্রদর্শনের জন্য তা' করতে। তোমরা মানুষকে ভয় করেছ; কিন্তু আমাকে সম্মান কর নি। তোমরা লোকদের সন্তুষ্টির জন্য কর্তব্য ত্যাগ করেছ। কিন্তু আমার সন্তুষ্টির জন্য পাপ ত্যাগ করোনি। আজ আমি তোমাদেরকে ভীষণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাব এবং তোমাদেরকে স্থায়ী পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করব।

        হযরত আহমদ ইবনে হারব বলেছেন, আমরা রোদের মধ্যে ছায়াকে পছন্দ করি, কিন্তু অগ্নির মধ্যে উদ্যানকে পছন্দ করি না। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, কত অসংখ্য সুস্থ দেহ, সুন্দর মুখমণ্ডল ও বাগ্মী রসনা রোজ কিয়ামতে দোযখে অগ্নির তাকের মধ্যে জ্বলে-পুড়ে ফরিয়াদ করতে থাকবে। হযরত দাউদ (আঃ) প্রার্থনা করেছিলেন, ইলাহী। তোমার সূর্যের প্রখর রোদের সামনে আমার ধৈর্য থাকে না। তোমার দোযখের অগ্নির মধ্যে আমি কিরূপে ধৈর্য রাখব? তোমার রহমতের (বজ্রপাত) শব্দে আমার ধৈর্য থাকে না তোমার শাস্তির শব্দে আমি কিরূপে ধৈর্য ধারণ করব?

        হে দুর্ভাগা। এসব ভয়াবহ অবস্থার দিকে লক্ষ্য কর এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহতায়ালা দোযখকে তাঁর ভীষণ অবস্থাসহ সৃষ্টি করেছেন। তার কমও হবে না, বেশীও হবে না, এটা সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা উদাসীন এবং তা' বিশ্বাস করে না, এতে রোজ কিয়ামতের কথা আছে। কিয়ামতের দিনে তার আদেশ হবে না যা' অদৃষ্ট লিপিতে লেখা হয়েছে, তাই রোজ কিয়ামতে প্রকাশ পাবে। তোমাকে দেখলে আশ্চর্যবোধ হয় যে, তুমি অট্টহাস্য করছ এবং গল্প-গুজবে মত্ত আছ এবং সাংসারিক অনিত্য জিনিসে লিপ্ত আছ অথচ তোমার বেলায় ভাগ্যলিপি কি হয়েছে, তা' তুমি জান না। যদি বল, আমি কোথায় যাব, আমার আশার স্থল ও গন্তব্য স্থল কোথায় আমি জানি না, আমার বেলায় কি ভাগ্যলিপি হয়েছে, আমি জানি না। তার উত্তর এই যে, তোমার হাতে নিদর্শন আছে। তা' থেকে তোমার অবস্থা সঠিক জানতে পারবে। তা' এই যে, তোমার নিজের অবস্থা ও নিজের আমলের দিকে লক্ষ্য কর, কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির ঐ কার্য সহজ হয়, যার জন্য তা' সৃষ্ট হয়েছে। যদি মঙ্গলের পথ তোমার জন্য সহজ হয়ে থাকে, তবে সুসংবাদ, কেননা তুমি দোযখ থেকে দূরে থাকবে; কিন্তু যদি তুমি সৎ কার্যের ইচ্ছা করে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হও এবং তা' দূর করে দাও, আর যদি তুমি অসৎ কার্যের ইচ্ছা না করেও তার কারণগুলো তোমার জন্য সহজ হয়ে পড়ে তখন জেন যে, তা' তোমার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, কেন না এর প্রমাণ ফল, যেরূপ তরুলতা দেখলেই বৃষ্টি হয়েছে বুঝা যায় এবং বাষ্প দেখলেই অগ্নির অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। মহান প্রভু বলেন, নিশ্চয় ধার্মিকগণ বেহেশতে থাকবে; সুতরাং নিজেকে এই দুই নিদর্শনের সম্মুখীন কর। তুমি ইহলোকে ও পরলোকে তোমার বসবাস দেখেছ। আল্লাহতায়ালা উত্তম জ্ঞাত আছেন।

Post a Comment

0 Comments