পাঠক-পাঠিক। জেনে রাখ, যে অত্যাচার-ই কারও কাছ থেকে আগত হয় তার সাথে তদনুরূপ ব্যবহার করা জায়েয নয়। পরনিন্দার বদলে পরনিন্দা করা, গোয়েন্দাগীরীর বদলে গোয়েন্দাগীরী করা, তিরস্কারের বিনিময়ে তিরস্কার করা নাজয়েয। কেননা সমস্ত পাপেরই একই অবস্থা। শরীয়তে নির্দিষ্ট পরিমাণ অনুসারে প্রতিশোধ গ্রহণ করা জায়েয তা' আমি ফিকাহর কিতাবে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। তিরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার করা জায়েয নেই। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যদি কোন লোক তোমার মধ্যে যা আছে তজ্জন্য তোমার নিন্দা করে, তার বিনিময়ে তার মধ্যে যে দোষ আছে তজ্জন্য তুমি তাকে নিন্দা করো না। তিনি আরও বলেছেন,দুজন পরস্পর পরস্পরকে তিরস্কার করলে প্রথম যে তিরস্কার করে তার উপর পাল বর্তে, যে পর্যন্ত না তিরস্কৃত ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে। পরস্পর তিরস্কারকারী দুটি শয়তান সদৃশ। তারা পরস্পরের উপর মিথ্যার দোষারোপ করে।
একদা একব্যক্তি হযরত আবুবকর (রাঃ)কে গালি দিতে লাগল, তিনি অনেকক্ষণ নীরব ছিলেন। তারপর যখন তিনি প্রতিশোধ নিতে শুরু করলেন, তখন হুযুরে পাক (দঃ) উঠে দাঁড়ালেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল। লোকটি যতক্ষণ আমাকে গালি দিল, আপনি নীরবে বসে থাকলেন। কিন্তু যখন আমি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করলাম, অমনি আপনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, যে পর্যন্ত তুমি নীরব ছিলে, ফিরেশতাগণ তোমার পক্ষ থেকে উত্তর দিতেছিল। কিন্তু যখন তুমি নিজেই প্রতিশোধ নিতে আরজ করলে তখন ফিরেশতার এখান থেকে চলে গেল এবং শয়তান এসে উপস্থিত হল। সুতরাং যে মজলিসে শয়তান থাকে আমি সে মজলিসে বসে থাকতে পারি না।
একদল আলিমের মত হল, যে কথার মধ্যে মিথ্যা নেই, তার উত্তর দেয়া জায়েয। হুযুরে পাক (দঃ) তিরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার করতে যে নিষেধ করেছেন, তা' সতর্কতামূলক, অর্থাৎ এরূপ বাক্য ব্যবহার ত্যাগ করা উত্তম। যদি তা' বল, তার জন্য গুনাহগার হবে না। "তুমি কে, তুমি কি অমুক লোকের বংশধর নও?" এ কথা বলা জায়েয। হযরত সা'দ (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি হোজায়েলের বংশধর নও? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বললেন, তুমি কি বনু উমাইয়ার বংশধর নও? তদ্রূপ কেউ যদি বলে হে নির্বোধ। তা' জায়েয হবে। মুতাররিফ বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির ও তার প্রভুর মধ্যবর্তী যা আছে সে বিষয়ে সে নির্বোধ। তবে কতক লোক কতক লোকের চেয়ে কম নির্বোধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করে শেষে বলেছেন, আল্লাহর সত্তার বিষয়ে প্রত্যেক লোকই নির্বোধ। তদ্রূপ কেউ যদি বলে "হে জাহিল।" তবে তা' জয়েয হবে। কেননা এমন কেউ নেই। মোটকথা এসব কথা দ্বারা অন্যায় কষ্ট দেয়া হয় না, যাদিও প্রকৃত পক্ষে তা' মিথ্যা কথা নয়। তদ্রূপ যদি কেউ বলে, হে মন্দস্বভাব বিশিষ্ট লোক। হে বেআদব, হে বেতমীজ, বেহায়া, নির্লজ্জ, অসভ্য, অপদার্থ। ক্রোধের সময় এসব শব্দ বলা যেতে পারে। যদি কেউ বলে, তোমার মধ্যে যদি সৎগুণ থাকত, তুমি এরূপ কথা বলতে না। আল্লাহ তোমাকে অপমান করুক। আমি তোমার উপর প্রতিশোধ নেব। এসব কথাও জায়েয হবে। কূটনামী করা, পরনিন্দা করা, মিথ্যা কথা বলা, পিতামাতাকে গালি দেয়া সর্বমতে নিষিদ্ধ।
কথিত আছে যে, হযরত খালেদ ইবনে আলী এবং সা'দ (রাঃ) এর মধ্যে কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। একব্যক্তি হযরত খালেদের কথা হযরত সা'দের নিকট বললে হযরত সা'দ বললেন, আামাদের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি হয়েছে তা' আমাদের ধর্মের ব্যাপারে পৌঁছেনি। অর্থাৎ আমাদের কারও গুনাহ হয় নি। মোটকথা তিনি মন্দকথা শুনেন নি। সুতরাং তা' বিকৃত করে বলা কিরূপে জায়েয হবে? যা' মিথ্যা এবং হারাম নয়, তা' বলা জায়েয হবার এটাই প্রমাণ। যদি জিনা, অশ্লীল কথা এবং তিরস্কারের অপবাদ দেয়া হয়, তাহলে উত্তর দেয়া জায়েয। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) এর পত্নীগণ একদা হযরত ফাতেমা (রাঃ)কে তাঁর নিকট প্রেরণ করলেন। তিনি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (দঃ)! আপনার পত্নীগণ আমাকে আপনার নিকট এই বলে পাঠিয়েছেন যে, আপনি যেন তাদের প্রত্যেককে সমান ভালবাসেন। হযুরে পাক (দঃ) তখন শয্যায় শায়িত ছিলেন। তিনি বললেন, হে স্নেহের ফাতেমা। আমি যাকে ভালবাসি, তুমি কি তাকে ভালবাস না? হযরত ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ ভালবাসি। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তাহলে আয়েশাকে ভালবাস। তারপর হযরত ফাতেমা (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর পত্নীদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদেরকে এই সংবাদ দিলে তারা বললেন, তুমি আমাদের কোন উপকার করতে পারলে না। তারপর তাঁরা জাহাশের কন্যা আমার সপত্নী জয়নবকে পাঠিয়ে দিল। আমার ন্যায় তাকেও তিনি ভালবাসতেন। সে এসেই আমাকে লক্ষ্য করে কড়া কড়া কথা বলতে লাগল। আবুবকর (রাঃ) এর কন্যা এরূপ সেরূপ ইত্যাদি। কিন্তু আমি কোন কথা বললাম না, বরং আমি হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর উত্তর দানের অপেক্ষা করতেছিলাম। তারপর তিনি আমাকে অনুমতি দিলে আমি তাকে তিরস্কার করতে লাগলাম। এমন কি তার কথার উত্তর দিতে দিতে আমার রসনা শুকিয়ে গিয়েছিল। তারপর হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, ইনিই আবুবকরের কন্যা। তুমি কখনই তাকে হারাতে পারবে না। এখানে তিরস্কারের অর্থ অশ্লীল বাক্য নয়; বরং তাঁর কথার উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) সত্য কথা বলেছিলেন।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, দুজন পরস্পর বিবাদকারীর বিবাদের পাপ আরম্ভকারীর উপরে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয়জন সীমাতিক্রম করলে সে মজলুম হয় এবং তখন তার পাপ বিপক্ষের উপর পড়ে। মজলুম তখন সাহায্য পাইতে থাকে, যে পর্যন্ত সে সীমা অতিক্রম না করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি সীমার মধ্যে থেকে যত উত্তর দিক না কেন, তাতে তার গুনাহ হবে না। কিন্তু উত্তর না দেয়াই উত্তম। কেননা সৈ তখন পুণ্য পাইতে থাকে। কিন্তু তার পক্ষে সত্যের সীমার মধ্যে থাকা এবং কথার উত্তর না দেয়া সম্ভব নয়। অনেকেই ভাবে যে, প্রথমেই উত্তর দেয়া এবং শরীয়তের সীমার মধ্যে থাকা সহজ। কিন্তু অনেক লোক ক্রোধের আতিশয্যে নিজের প্রকৃতিকে দমন রাখতে পারে না এবং সত্ত্বরই তার উত্তর দিয়ে বসে। আবার অনেক লোক আছে যারা প্রথমে নিজেকে সংবরণ করে রাখে। কিন্তু তাদের অন্তরে বিষোদগীরণ হতে থাকে।
0 Comments