পূর্বযুগের বুযর্গগণ বর্ণনা করেছেন যে, কৌশ এলবাকা ব্যবহারে মিথ্য বলা হয় হয় না। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি হিলা বা কৌশল বাক্য ব্যবহার করে তাতে সে মিথ্যাবাদী হয় না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ এ বিষয় বর্ণনা করেছেন। যখন মানুষ মিথ্যা বলতে বাধ্য হয় তখন সে কখনও এই কৌশল বাক্য ব্যবহার করতে ইচ্ছা করে। যখন তার প্রয়োজন থাকে না তখন এই কৌশলবাক্য ব্যবহার বা পরিষ্কার ভাবে মিথ্যা বলা জায়েয নেই। তবে কৌশলবাক্য ব্যবহার করা মন্দের ভাল।
কৌশলবাক্যের দৃষ্টান্তঃ (১) হযরত মুতাররাফ (রহঃ) অত্যাচারী শাসনকর্তা যিয়াদের নিকট উপস্থিত হলে সে তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি এত বিলম্ব করে এলেন কেন? তিনি তাকে নিজের অসুখের অবস্থা দেখাবার জন্য কৌশল বাক্য ব্যবহার করে বললেন, আমি আপনার দরবার থেকে যাবার পর আমার পার্শ্ব শয্যা থেকে উঠাতে পারি নি। আল্লাহ এখন আমাকে শয্যা থেকে উঠিয়েছেন। একথাটি সম্পূর্ণ সত্য। অথচ শাসনকর্তা বুঝেছিলেন যে, তিনি রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (রহঃ) বলেছেন, যখন কোন লোকের নিকট তোমার সম্বন্ধে কেউ কানভারী করে এবং যদি তুমি মিথ্যা কথা বলতে ইচ্ছা না কর তাহলে বলবে, আল্লাহতায়ালাই জানেন। ঐ সম্বন্ধে আমি কিছুই বলি নি। শ্রবণকারীর নিকট এটা অস্বীকারসূচক কথা মনে হবে। কিন্তু তার নিকট তা' স্বীকারসূচক বাক্য হবে। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ) এর যাকাতের তহশিলদার ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মস্থান থেকে ফিরে এলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলল, অন্যান্য লোক যেরূপ বাড়ী আসবার সময় অনেক জিনিসপত্র নিয়ে আসে তুমি তদ্রূপ কিছু এনেছ? মূলতঃ তিনি তার জন্য কিছুই আনেন নি। তিনি বললেন, আমার সাথে প্রহরী রয়েছে। তজ্জন্য আমি কিছুই আনতে পারি নি। তাঁর স্ত্রী বলল, তুমি হুযুরে পাক (দঃ) এবং হযরত আবুবকর (রাঃ) এর নিকট যথেষ্ট বিশ্বাসের পাত্র ছিলে। তা' সত্ত্বেও হযরত ওমর (রাঃ) তোমার জন্য প্রহরী পাঠিয়েছেন? অতঃপর সে কতিপয় স্ত্রীলোক সমভিব্যহারে হযরত ওমর (রাঃ) এর নিকট গিয়ে অভিযোগ করল। যখন তিনি তার অেভিযোগ শুনলেন, তিনি মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) কে ডেকে এনে বললেন, আমি কি তোমার জন্য কোন প্রহরী পাঠিয়েছি? মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বললেন, আমি আমার স্ত্রীর নিকট এ কথা বলা ব্যতীত অন্য কোন পথ দেখি নি। তাঁর কথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) হেসে উঠলেন এবং তাঁকে উপঢৌকন দিয়ে বললেন, যাও তোমার স্ত্রীকে এগুলো দিয়ে সন্তুষ্ট কর। উল্লেখ্য যে, হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) এখানে প্রহরী অর্থে সর্বদর্শী আল্লাহতায়ালাকেই গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত নাথয়ী (রহঃ) তাঁর কন্যাকে একথা বলতেন না যে, আমি তোমার জন্য মিষ্টি কিনে আনব; বরং বলতেন, আমি দেখব তোমার জন্য মিষ্টি কিনে আনতে পারি কিনা। হযরত ইব্রাহীম নাখয়ী (রহঃ) গৃহে থাকাকালীন যখন কোন লোক তাঁর অনুসন্ধান করতে আসত এবং তিনি তখন যদি তাঁর সাথে বাইরে যাবার ইচ্ছা না করতেন, তবে তিনি তাঁর দাসীকে এরূপ বলতে বলে দিতেন যে, আপনি মসজিদে নিয়ে তাঁকে তালাস করুন। এখানে তিনি নেই একথা বলতে নিষেধ করতেন। কেননা তা' মিথ্যা হবে। হযরত শো'বী (রাঃ)কে গৃহে তালাস করা হলে তিনি যদি তালাসকারীর সাথে সাক্ষাত করতে ইচ্ছা না করতেন তবে তিনি তাঁর দাসীকে বলতেন, একটি গোল বৃত্ত অংকন করে তন্মধ্যে শাহাদাত অঙ্গুলী স্থাপন করে বলবে তিনি এখানে নেই। এই শ্রেণীর কৌশল বাক্য পূর্বযুগে প্রয়োজনের সময় বলা হত। প্রয়োজনের সময় ব্যতীত অন্য সময় বলা হত না। কেননা তাতে এগুলো মিথ্যা হবে। যদি মিথ্যা একান্ত পক্ষে নাও হয় তবু নিন্দনীয় হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওৎবাহ বলেন যে, আমি আমার পিতার সাথে ওমর ইবনে ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) এর নিকট গিয়েছিলাম। আমি সুন্দর পোশাক পরে বের হলে লোকগণ আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, এই সুন্দর পোশাকই কি তোমাকে আমীরুল মু'মিনীন উপহারস্বরূপ দিয়েছেন। আমি বলতে লাগলাম আল্লাহতায়ালা আমীরুল মু'মিনীনকে মঙ্গল দান করুন। যদিও ঐ কথাটি মিথ্যা ছিল না তবুও পিতা আমাকে বললেন, হে বৎস। মিথ্যা এবং মিথ্যার অনুরূপ কথাকে ভয় করবে। তিনি তাকে এই ধারণায় ঐ রূপ বলতে নিষেধ করলেন যে, বাদশাহ বা খলীফা থেকে পুরস্কার পেলে সাধারণতঃ দোয়া করা হয় হয়। মানুষ উত্ত উক্ত কথা কথা থেকে ধারণা করবে যে, বাদশাহই ঐ পোশাক দিয়েছেন। তাতে একটি মিথ্যা কথা বলা হয়। তার উদ্দেশ্য অসত্য এবং তার মধ্যে কোন উপকার নেই।
সত্য বটে লঘু প্রয়োজনে অর্থাৎ কৌতুকচ্ছলে অন্যের হৃদয়কে শাস্তি দানের মধ্যে কৌশলবাক্য ব্যবহার করা হালাল। যেমন হুযুরে পাক (দঃ) বলেছিলেন, বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বেহেশতে যাবে না বা যেরূপ তিনি বলেছিলেন, তোমার স্বামীর চোখে শুভ্রবর্ণ আছে। বা যেরূপ বলেছিলেন, আমরা তোমাকে উটের বাচ্চার উপর বহন করে নেব। প্রকাশ্য মিথ্যা কথায় যদি মনঃকষ্ট দেয়া হয় বা কোন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তা' হারাম হবে। মনে কর কেউ বলল, অমুক স্ত্রীলোক তোমাকে ভালবাসে। এরূপ কৌতুকজনক কথা বলে প্রতারণা করা উচিত নয়। যদি তাতে অন্য ক্ষতি না হয়, মন সেই স্ত্রীলোকের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। যদিও তাতে সে মহাপাপী না হয়। তবুও তাকে ঈমানের উচ্চমর্যাদা থেকে নিম্নে নেমে যেতে হয়। হাদীস শরীফে আছে হযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ হয় না যে পর্যন্ত না সে নিজের জন্য যা ভালবাসে অপরের জন্যও তা' ভালবাসে এবং যে পর্যন্ত না সে তার কৌতুকের মধ্যে মিথ্যা ত্যাগ করে। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের হাস্য উদ্রেক করবার জন্য কথা বলে তা' তাকে দোযখের অগ্নিতে নিক্ষেপ করে। এর উদ্দেশ্য মুসলমানের নিন্দা করা অথবা হাস্য কৌতুক করতঃ মনে কষ্ট দেয়া।
মানুষ সচরাচর যে সাধারণ মিথ্যা কথা বলে থাকে এবং যা' তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে তাতে মহাপাপ হয় না। যেমন কেউ কাউকে লক্ষ্য করে বলল, আমি তোমাকে শতবার একথা বলেছি। আমি তোমাকে একশ বার তালাস করেছি। এখানে একশ বা শত শব্দে একশত সংখ্যা বুঝাবার ইচ্ছা করা হয় না; বরং এর দ্বারা বহুবারের অর্থ বুঝানো হয়ে থাকে। তবে সে ব্যক্তি যদি বহুবার অনুসন্ধান না করে বা বহুন খানা। হুবার ঐ কথা না বলে, তাহ। গুলে বা একশতবার কথাটি উল্লেখ করা মিথ্যা হবে। আর যদি তার হয়ে কয়েকবারও হয়ে থাকে তাহলে তার ঐরূপ বলায় পাপ হবে না।
হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বলেছেন, ওমায়রের কন্যা আসমা বলেন, যে রাত্রে হযরত আয়েশা (রাঃ)কে হুযুরে পাক (দঃ)এর গৃহে নেয়া হল, আমি হযরত অয়েশা (রাঃ)এর সঙ্গে ছিলাম আমার সঙ্গে আরও অনেক স্ত্রীলোক ছিল। আল্লাহর কসম আমাদেরকে অভ্যর্থনা করবার জন এক পেয়ালা দুধ ব্যতীত হুযুরে পাক (দঃ)এর আর কিছুই ছিল না। তিনি নিজে কিছু পান। এন করে হযরত আয়েশা (রাঃ) কে গ্রহণ করতে বললেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) আমাকে দেখে লজ্জিত ভাবে বললেন, হুযুরে পাক (দঃ) এর হস্ত নষ্ট করো না। এ থেকে কিছু পান কর। আমি সলজ্জভাবে তাঁর নিকট থেকে কিছু গ্রহণ করে পান করলাম। তারপর হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমার সঙ্গীগণকেও কিছু দাও। কিন্তু তারা বলল, অমাদের এখন দুগ্ধ পান করবার ইচ্ছে নেই। তাদের কথা শুনে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন এ মিথ্যা ও ক্ষুধাকে একত্র করো না। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমাদের মধ্যে কেউ যদি বলে, আমার ক্ষুধা আছে বা আমার ক্ষুধা নেই তবে তাও কি মিথ্যা বলে গণ্য হবে? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, নিশ্চয়ই তা' মিথ্যা বলে লিপিবদ্ধ হবে। পরহেজগার লোকগণ এ ধরনের মিথ্যা কথা থেকেও সতর্ক থাকেন।
হযরত ঈসা ইবনে সা'দ (রহঃ) বলেছেন, হযরত সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব (রহঃ) এর চক্ষু থেকে শ্বেত পদার্থ নির্গত হতেছিল। তাকে বলা হল, তুমি যদি তোমার চক্ষু মুছে ফেলতে তা' হলে উত্তম হত। তিনি বললেন, যদি তাই করি তবে চিকিৎসকের উপদেশ কি ভাবে পালিত হয়? অর্থাৎ তিনি যে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন যে, চক্ষু স্পর্শ করব না। তা' মিথ্যা হয়ে যাবে। এটাই পরহেজগারের সতর্কতা। যে ব্যক্তি সতর্কতা অবলম্বন না করে তার, রসনা ইচ্ছামত মিথ্যা বলতে শুরু করে দেয়; এবং তা' তার অমঙ্গলের কারণ হয়।
হযরত খাওয়াত তাইমী (রহঃ) বলেছেন, রবী ইবনে খায়ছাম (রহঃ) এর ভগ্নি আমার কন্যার অসুখ দেখতে এসে তার উপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, হে বৎস! তুমি কেমন আছ? তার ভ্রাতা রবী (রহঃ) বললেন, তুমি কি বালিকাকে দুগ্ধ পান করিয়েছ? সে বলল, না পান করাই নি। রবী (রহঃ) বললেন, তাহলে সে তোমার সন্তান হল কিরূপে। তাকে তুমি বৎস বললে কেন? যদি তাকে তুমি ভ্রাতুষ্পুত্রী বলতে, তা' হলে সত্য কথা হত। আসলে এগুলো মানুষের অভ্যাস, প্রচলন।
হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, যে বিষয় যে জানে না সে সম্পর্কে বলা আল্লাহ জানেন, এটা আল্লাহর নিকট নাপছন্দ নিয়ত। মানুষ স্বপ্নের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে অনেক সময়ই বড় পাপ করে ফেলে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে দাবী করা অথবা যে ব্যক্তি যা' দেখেনি তা' সে দেখেছে বলা অথবা যা' কোন ব্যক্তি বলেনি তা' সে বলেছে বলা অত্যন্ত বড় অপবাদ। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বপ্নের কথা মিথ্যা বানিয়ে বলে রোজ কিয়ামতে তাকে দুটো যবের দানায় গিরা দিতে বলা হবে। কিন্তু কোন মতেই তা' তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
0 Comments