একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সকল প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যে পর্দা করা ফরয। মতপার্থক্য রয়ে যায়, কত বছর বয়স থেকে একজন লোকের পর্দার বিধান মানতে হবে।
এ প্রশ্নের জবাবে হাকীমুল উম্মাহ হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র) বলেন, মেয়েরা অন্য লোকদের সাথে সাত বছরের আগ থেকেই পর্দা করা উচিত। আর না মাহরাম আত্মীয়ের সাথে সাত বছর বয়স থেকে পর্দা করতে হবে। অনেক সময় প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা থাকে না। কেননা প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েরা লজ্জাশীলা হয়। তারা পুরুষদেরকে ততটা সুযোগ দেয় না। এছাড়া পুরুষরাও চিন্তা করে যে, এই মেয়ের বয়স হয়েছে, সে সকল কিছুই বুঝে। তার সাথে খারাপকার্য চরিতার্থ করতে গেলে সে বুঝে ফেলবে। কিন্তু অবুঝ নাবালেগ মেয়েদের বেলায় এমন বাধা থাকে না।
তাই ছোটকাল থেকেই অন্য পুরুষের সাথে মেয়েদের পর্দা করার অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক। মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর (রহঃ) মতে মেয়েরা যতদিন পর্যন্ত উদার উপযুক্ত না হবে সে পর্যন্ত তাদেরকে উত্তম কোন জামা পরানো উচিত নয়। খুবই সাদাসিদা জামা পরিধান করানো উচিত। এতে দিন দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে মুক্ত থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই পর্দা করতে হবে এজন্যে যে, প্রাপ্তবয়স্ক হলে সে যাতে পরিপূর্ণ সুশীলা একজন পর্দাওয়ালী মহিলা হতে পারে সেজন্যে। শিশুকাল হচ্ছে ভবিষ্যতের base বা বুনিয়াদ। আপনি মেয়েকে শৈশবে পর্দার বিষয়ে সতর্ক না করালে, তাকে পর্দা করার অভ্যাস না করালে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সে পর্দা করাকে ভেজাল বা বোঝা মনে করতে পারে। হতে পারে সে মেয়ে আপনার কথাকে মানতে চাইবে না। এমন আচরণ প্রকাশ পাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ তার এটা অভ্যাস নেই। সে হঠাৎ বোরকা পরাকে বন্দিদশা মনে করতে পারে।
যেমন একজন ব্যক্তি ধূমপানে আসক্ত। তাকে হঠাৎ করে যদি বলা হয় ধূমপান করা যাবে না। তাহলে নিশ্চিত সে আপনার কথার সাথে একমত হতে পারবে না। কিন্তু যদি আস্তে আস্তে ছাড়তে বলেন তাহলে তার দ্বারা সম্ভব। মহান আল্লাহ মদ্যপানে আসক্ত সাহাবীদেরকেও আকস্মিক মদ্যপান ছেড়ে দিতে বলেনি। তাই আপনাদের মেয়েদেরকে শৈশবকাল থেকেই পর্দার ট্রেনিং দিয়ে ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তোলা আবশ্যক। অনুরূপ ছেলেদের পর্দা করতে হবে। আরো বলা যেতে পারে, ছেলেরা যখন নারীদের গোপনাঙ্গের রহস্য জেনে যায় বা জানতে অরগ্রহী হয়ে ওঠে, ঠিক সে সময় থেকেই পর্দার বিধান পালন করা উচিত
নির্জনে নিজের সাথে পর্দা
তিরমিযী শরীফে বার্ণত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে লোক আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন গোসলখানায় উলঙ্গ না হয়।
হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হয়দাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছি, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কোন জায়গায় শরীর ঢেকে রাখব; আর কোন জায়গায় শরীর খোলা রাখব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, সকলের থেকে নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখ; তবে তোমার স্ত্রী ও দাসী ছাড়া। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, মানুষ যখন কোন স্থানে নির্জনে অবস্থান করে তখনও। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলনে, তখন আল্লাহকে লজ্জা করা উচিত।
উপরিউল্লিখিত হাদীস থেকে জানা গেল, বিনা প্রয়োজনে উলঙ্গ হওয়া নাজায়েয। যদি তা নিরিবিলিও হয়ে থাকে। আল্লাহ ও ফেরেশতাদের লজ্জা করা উত্তম। (ফুরুউল ঈমান)
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক পর্দা
স্বামী হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয়জন। তার সহবাসে বা অন্য যেকোন সময় একে অন্যের গোপনাঙ্গ দেখার অধিকার রাখে। স্বামীর নিকট স্ত্রীর কোন অঙ্গের পর্দা করার দরকার নেই। স্ত্রীর সামনে স্বামীর যেভাবে পর্দা করা দরকার পড়ে না, অনুরূপ স্বামীর সামনেও স্ত্রীর পর্দা করার দরকার পড়ে না। তবে বিনা প্রয়োজনে এমন করা মাকরহ বা অপছন্দনীয়।
দেবর ও ভাশুরের সাথে পর্দা
মহিলাদের জন্যে দেবর, ভাশুর, নন্দাই শ্বশুরালয়ের আত্মীয়দের সঙ্গে অবশ্যই পর্দা করতে হবে। পর্দা প্রত্যেক পর-পুরুষের সাথেই ফরয। কিন্তু তাদের সামনে আসতে এমন ভয় করা উচিত, যেমন মানুষ মৃত্যুকে ভয় করে। কেননা, এসব আত্মীয়-স্বজনদেরকে আপন মনে করে ঘরের মধ্যে প্রশ্রয় দেয়া এবং নিঃসংকোচে খোলামেলাভাবে হাসি-তামাশা করা হয়। স্বামী তাদেরকে আপন ভেবে বাধা দেয়া না। কিন্তু পরিস্থিতি আস্তে আস্তে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছে যে, তখন একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আনা-গোনার মাত্রা বেড়ে যায় কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে এমন সব কাণ্ড-ঘটে যায়, যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। কেননা একজন সাধারণ পুরুষের পক্ষে কোন স্ত্রীলোকের ওপর হস্তক্ষেপ করা এত সহজ নয়, যতটুকু সহজ এ ধরনের আত্মীয়দের পক্ষে। এসব কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, স্ত্রীলোকদের শ্বশুরালয়ের পুরুষদের সাথে বিশেষভাবে পর্দার তাকিদ দিয়েছেন এবং তাদেরকে মায়েরজাত বলেছেন। লুম'আত গ্রন্থে আছে-শ্বশুরালয়ের আত্মীয়দেরকে মৃত্যুতুল্য বলার কারণ হলো, তাদের নিকট হতে নারীদেরকে ভয় প্রদর্শন করা যেমন মৃত্যুকে ভয় করা হয়। কেননা আত্মীয়দের ভয় ও ফিৎনার সম্ভাবনা অধিক, বিনা বাধায় যখন ঘরে প্রবেশ করা নির্জনতায় সক্ষম হওয়ার কারণে।
একইভাবে পুরুষদের প্রতিও নির্দেশ রয়েছে যেন ভাবী এবং শ্যালিকা ও শ্যালক পত্নীদের সাথে খোলামেলা চলাফেরা না করে এবং চোখ তুলে না তাকায়।
অনেক স্ত্রীলোক এমনও আছে যাদেরকে ছোটবেলা হতে লালন-পালন করার কারণে বড় হলে তাদের সাথে পর্দা করে না। পর্দার মাসআলা শোনালে সাথে সাথে বলে দেন ছোটবেলা থেকে ছেলেটিকে কষ্ট করে মানুষ করেছি, তার সাথে আবার কিসের পর্দা। এখানে দুটি অপরাধ হলো একটি পর্দা না করার অপরটি গোনাহকে গোনাহ বলে না মানার। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকে মৃত্যুতুল্য বলেছেন, তার সম্মুখে আসাকে গোনাহ বলে মনে না করা কত মারাত্মক কথা।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যায় যে, অনেকে মনে করে স্বামী যার সাথে পর্দা করতে বলে তাদের সাথেই পর্দা করতে হবে। আর স্বামী যাদের সামনে আসতে বলে তাদের সাথে পর্দা করার প্রয়োজন নেই। পর্দার ক্ষেত্রে স্বামীর নির্দেশটিকে আসল মনে করে থাকেন। অথবা দেবরদের সাথে পর্দা করতে চাইলে তারা মনে কষ্ট পায়, শাশুড়ি মন খারাপ করে। তাই তারা দেবর বা ভাশুরদের সাথে পর্দা করে না। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল। কেননা পর্দা শরিয়তের বিধান। হাদীসে এসেছে-
অর্থ: স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য জায়েয নেই।
তাই প্রথমে স্বামী ও শাশুড়ীকে বুঝাতে হবে। যদি তাতে কাজ না হয় তবে শরিয়তের হুকুমের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং অন্য কোন পথ অবলম্বন করবে। কোন অবস্থায়ই তাদের সাথে আপোষ করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে হকপন্থীদের সাথে আল্লাহর সাহায্য সব সময় বিদ্যমান।
আমাদের দেশের অনেক গৃহিনীরাই দেবর-ভাশুরের সাথে পর্দা করে না। অনেক নারী তো দেবর না থাকলে বিয়েই বসতে চায় না। এজন্যেই কোন কোন এলাকায় দেবর-ভাবীর অবৈধ প্রণয়ের কথা শুনতে পাওয়া যায়। অথচ ইসলাম দেবর-ভাশুরের সাথে কঠিন পর্দা করতে বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সাহাবীদের এক প্রশ্নের জবাবে দেবর মরণতুল্য বলে ঘোষণা করেছেন। সেখানে কীভাবে দেবর-ভাবীর সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
অর্থঃ বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উকবা ইবনে আমের (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, সাবধান! তোমরা গাইরে মুহাররাম মহিলাদের গৃহে প্রবেশ করো না। জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। স্ত্রীলোকেরা শ্বশুরালয়ের পুরুষদের (দেবর-ভাশুরের) সম্পর্কে কি নির্দেশ? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শ্বশুরালয়ের পুরুষ আত্মীয় তো মৃত্যুতুল্য। (বোখারী, মুসলিম)
উপরিউক্ত হাদীসের বিশ্লেষণে আমরা বলতে পারি যে, দেবর ও ভাবী দুটি স্পর্শকাতর নাম। আবহমানকাল থেকে এ দুটি সম্পর্কে প্রচুর দুর্বলতা দেখা যায়। এখানে শয়তান যেমন ক্ষণে ক্ষণে সুযোগ কাজে লাগাতে চায়, অপরদিকে অন্যরা পরের বাড়িতে ভাবীর দুর্বলতাকে পুঁজি করে ফায়দা লুটতে চায়। তাই এ স্থানটি যথেষ্ট সন্দেহজনিত। বস্তুতঃ এসব কারণেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেবর-ভাশুরকে নারীর জন্যে মরণতুল্য বলে ঘোষণা করেছেন। মৃত্যু যে রকম অবধারিত সত্য যাকে এড়ানো যায় না তেমনি নারীর জন্যে তাকে শ্বশুর বাড়িতে দেবর-ভাশুরের সাথে পর্দা করা সে রকম গুরুত্বপূর্ণ। যাদের ব্যাপারে কোন রকম ছাড় দেয়া যায় না।
0 Comments