মুনাফিক কারা মুনাফিকী কী?

        রসনার সপ্তদশ বিপদ মুনাফিকী: দ্বিমুখী ভাবাপন্ন হওয়া বা মুনাফিকী করা রসনার অন্যতম বিপদ। পরস্পর দু'জন শত্রুর নিকট যাতায়াত করা, তাদের প্রত্যেকেরই নিকট নিজেকে মিত্র বলে পরিচয় দেয়া এবং তাদের সাথে একমত হওয়া, এটাকেই মুনাফিকী বলা হয়। সুজন পরস্পর শত্রুর উভয়ের সাথে মিলিত হলে খুব কম লোকই এ দোষ থেকে মুক্তি পায়। 

        হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করে করেছেন, ইহলক যার দুটো মুখ থাকবে পরকালে তার জন্য দোযখে দুটো রসনা হবে। তিনি নি আরও রোজ কিয়ামতে তোমরা আল্লাহর সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট বান্দাকে দুটো মুখবিশিষ্ট। দেখতে তে পাবে। সে একদলের নিকট একটি কথা নিয়ে আসবে এবং অন্য দলের নিকট অন্য কথা নিয়ে যাবে। অন্য বর্ণনায় আছে যে, সে একদলের নিকট একটি মুখ নিয়ে যাবে এবং অন্য দলের নিকট অন্য মুখ নিয়ে যাবে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, দু' মুখবিশিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর নিকট বিশ্বস্ত লোক বলে লিপিবদ্ধ হবে না। হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন, আমি তাওরাতে পড়েছি যে, মানুষ তার বন্ধুদের সাথে দুটো বিপরীত রসনা নিয়ে কথা বলে। অথচ সে আবার আমানত রক্ষার দাবী করে। আল্লাহতায়ালা রোজ কিয়ামতে এই বিপরীতমুখী রসনান্বয়কে ধ্বংস করে দেবেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট জীব হবে মিথ্যাবাদীগণ, অহঙ্কারী লোকগণ এবং ঐ সমস্ত লোক যারা তাদের বন্ধুদের জন্য তাদের অন্তরে হিংসা পোষণ করত, যখন তারা তাদের সাথে সাক্ষাত করত তখন তারা তাদেরকে ঘৃণা করত, যখন তাদেরকে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দিকে ডাকা হত তারা বিলম্ব করে আসত। আর যখন তাদেরকে শয়তান এবং তার শিষ্য-সাগরেদগণের দিকে ডাকা হত তখন তারা দ্রুত চলে আসত।

         হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যেন রেকাবিয়াহ মাযহাবভুক্ত না হয়। জিজ্ঞেস করা হল, রেকাবিয়াহ মাযহাবভুক্ত কে? তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি, যে বায়ুর অনুকূলে চলে। মোটকথা সব আলিমের সম্মিলিত মত এই যে, দু' ব্যক্তির নিকট দু' মুখ নিয়ে যাতায়াত করা মুনাফিকী। মুনাফিকীর অনেকগুলো চিহ্ন রয়েছে, এটা তার অন্যতম। বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এর জনৈক ছাহাবীর মৃত্যু হলে হযরত হোযায়ফা (রাঃ) তার জানাজা নামাযে শরীক হলেন না। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর নবীর একজন ছাহাবীর মৃত্যু হয়েছে অথচ আপনি তার জানাজা পড়লেন না? তিনি বললেন, আমীরুল মু'মিনীন! সে মুনাফিকদের অন্যতম ছিল। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, আমি আপনার নিকট জিজ্ঞেস করছি, আমিও কি তাদের অন্তর্গত? হযরত হোযায়ফা (রাঃ) বললেন, আপনি নহেন। কিন্তু আপনার পরে আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।

        প্রশ্নঃ একটি লোকের দুটো রসনা কেন থাকে এবং তার তার সীমা কি? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, এ ব্যক্তি যখন পরস্পর দুজন শত্রুর নিকট যাতায়াত করে। করে এবং উভয়ের এবং যাদের সাথে কথা বলা হয় তারও সাথে উত্তম কথা বলে ও তার কথায় ও ব্যবহারে খুশী থাকে তখ তখন সে মুনাফিক হবে না এবং তখন তাকে দু'রসনাবিশিষ্ট ব্যক্তি বলা যাবে না। আবার সে যখ নিকটই সত্য কথা বলে কিন্তু তার সে পৌছে যখন দু'জনের সে সত্য কথা তত প্রবল হয় না অর্থাৎ বন্ধুত্বের পর্যায় ছে না। কেনন ননা দৃঢ় বন্ধুত্ব হলে বন্ধু বন্ধুর শত্রুর সাথে যাতায়াত বা বন্ধুত্ব থাকতে পারে না। একথা আমরা পূর্বেই বন্ধুত্বের অনুমে পরস্পর দু' শত্রুর নিকট নিয়ে যাওয়া কূটনামী। কেন জননা এর দ্বা দ্বারা একের কেনন লাগানো না হলে তাকে বলা চ্ছেদে বর্ণনা করেছি। অবশ্য সত্য বটে, যদি একই কথা ওয়া হয় তবে তা' দু' রসনার কার্য হবে এবং তা' নিকৃষ্ট অন্যের কথা কানে লাগিয়ে দেয়া হয়। আর কানকথা হয় মুনা মুনাফিকীতে একের কথা অন্যকে এবং অন্যের কথা একে বলে দেয়া হয়। সুতরাং এর দ্বারা দু'দিকের কথাই দু'দিকে লাগানো হয়। তদ্রূপ যদি তুমি দু'জন পরস্পর শত্রুকে বল, আমি তোমাকে সাহায্য করব বা যদি তাদের মধ্যে ত্যেককেই তার কার্যের জন্য প্রশংসা কর অথবা অন্যের অনুপস্থিতিতে একজনকে প্রশংসা কর প্রত্যে আর অন্যকে নিন্দা কর তখন তুমি দুটো রসনাবিশিষ্ট লোক হবে; বরং তখন তোমার নীরব থাকা উচিত। অথবা দু'জন পরস্পর শত্রুর মধ্যে যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তাকে প্রশংসা করবে এমন কি তার অসাক্ষাতে তার সামনে এবং শত্রুর সামনে তার প্রশংসা করবে।

         হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমরা আমাদের আমীরদের যে নিকট গিয়ে কথাবার্তা বলি। কিন্তু যখন তাদের নিকট থেকে বের হয়ে যাই তখন অন্য কথা বলি। এ ব্যাপার সম্বন্ধে আপনার মত কি? তিনি বললেন, আমরা হুযুরে পাক (দঃ) এর সময়ে এটাকে মুনাফিকী বলে গণ্য করতাম। তখন আমরা আমীরের নিকট যেতাম না এবং তার প্রশংসাও করতাম না। কিন্তু যখন তাদের নিকট যাতায়াত শুরু হল, তাদের প্রশংসা করা শুরু হয়ে গেল এবং এভাবে মুনাফিকী আরম্ভ হল। যদি তুমি স্বল্পেই সন্তুষ্ট থাক এবং ধন, মান- যশঃ-খ্যাতির লিপ্সা ত্যাগ কর তাহলে আমীরের নিকট যেতে হয় না এবং তাদের প্রশংসা করে মুনাফিকীতেও লিপ্ত হতে হয় না। সুতরাং তাদের নিকট এসব উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে তুমি মুনাফিক হবে। হুযুরে পাক (দঃ) এর নিম্নোক্ত হাদীসের মর্ম এটাই। তিনি বলেছেন, ধন ও যশের ভালবাসা হৃদয়ে মুনাফিকী জন্মায়। যেরূপ পানি তরুলতা জন্মায়। যে ব্যক্তি আমীরের দরবারে যাতায়াত করে এবং তাতে তার কোন উদ্দেশ্য থাকে তাহলে সে ভয় করে যে, যদি আমীরের প্রশংসা করা না হয় বা তার মনোমত কথা বলা না হয় তাহলে হয়ত তার সে উদ্দেশ্য সফল হবে না। বা এর উপর কোন বিপদও পৌছতে পারে।

        হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, কোন কোন লোকের সামনে তাদেরকে হাস্য দেখাবার জন্য আমরা হাসি। কিন্তু হৃদয় তাদেরকে লা'নত করে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, একব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, তাকে আসতে দাও; কিন্তু সে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোক। তারপর যখন সে তাঁর নিকটে এল, তিনি তার সাথে বিনম্র বাক্যে কথাবার্তা বললেন। যখন লোকটি বের হয়ে গেল সাথে আপনি এত নম্রতার সাথে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তার কথাবাত বার্তা ক বললেন, লন, এর কারণ কি? তিনি বললেন, হে আয়েশা। যে ব্যক্তির অনিষ্টের ভয় করে তাকে সম্মান করা হয়, সে-ই নিকৃষ্ট লোক। এ কথা অবশ্য সম্বর্ধনা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং মৃদু হাসি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। কিন্তু এরূপ লোককে প্রশংসা করলে তা' স্পষ্ট মিথ্যা হবে। প্রয়োজন ব্যতীত বাধ্য হয়ে প্রশংসা করা ব্যতীত তা' জায়েয নেই। তখন মিথ্যা বলাও জায়েয হয়। এরূপ অবস্থা ব্যতীত তাকে প্রশংসা করা নাজায়েয। প্রত্যেক মিথ্যা বা অসত্য কথার উপর মস্তক নেড়ে তা' সমর্থন করা জায়েয নয়। যদি কেউ তা' করে তবে সে মুনাফিক হবে। তার তা' অস্বীকার করা উচিত। তবে যদি সে তাতে সক্ষম না হয় তখন রসনাকে সংযত রাখবে এবং হৃদয়ের দ্বারা তা' ঘৃণা করবে।

Post a Comment

0 Comments