প্রকাশ থাকে যে, মুমিনের জন্য জরুরী আল্লাহ তা'আলার প্রতি ভক্তি রাখা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর কাছে প্রত্যাশা রাখা এবং আপন ত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হওয়া। অর্থাৎ, ঈমানের পর এসব অবস্থা থেকে মুমিন পৃথক হবে না, যদিও এগুলোর শক্তি তার বিশ্বাসের শক্তি অনুযায়ী হবে। সুতরাং নামাযের মধ্যে এসব অবস্থার অনুপস্থিতি এ কারণেই হবে যে, নামাযীর চিন্তা বিক্ষিপ্ত, ধ্যান বিভক্ত, অন্তর মোনাজাতে অনুপস্থিত এবং মন নামায থেকে গাফেল। নামায থেকে গাফিলতি কুমন্ত্রণার কারণে হয়, যা মনের উপর নেমে এসে মনকে ব্যাপৃত করে দেয়। এমতাবস্থায় কুমন্ত্রণা দূর করাই অন্তরের উপস্থিতি লাভের উপায়। কোন বস্তু তখনই দূর হয়, যখন তার কারণ দূর হয়। তাই এখন কুমন্ত্রণার কারণ জানা দরকার। কুমন্ত্রণার কারণ হয় কানে ও চোখে পড়ে এমন কোন বিষয় হবে, না হয় কোন গোপন বিষয় হবে। কানেও চোখে পড়ে এমন বস্তুও মাঝে মাঝে চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চিন্তা এসব বস্তুর পেছনে পড়ে সেগুলো থেকে অন্য বস্তুর দিকে আকৃষ্ট হয়। উচ্চ মর্যাদাশীল ও উচ্চ সাহসী ব্যক্তির ইন্দ্রিয়ের সামনে কোন বস্তু থাকলে তা তাকে গাফেল করে না, কিন্তু দুর্বল ব্যক্তির চিন্তা বিক্ষিপ্ত না হয়ে পারে না। এর প্রতিকার হচ্ছে এ ধরনের বস্তুর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা- চোখ বন্ধ করে অথবা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামায পড়া। এর জন্যে প্রাচীরের কাছে নামায পড়াও উত্তম, যাতে দৃষ্টির দূরত্ব দূরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। রাস্তায়, চিত্র ও কারুকার্যের স্থানে এবং রঙ্গিন বিছানায় নামায পড়া উচিত নয়। এ কারণেই আবেদগণ ক্ষুদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামায পড়তেন, যাতে কেবল সেজদা করার স্থান সংকুলান হত। শক্তিশালী আবেদগণ মসজিদে উপস্থিত হয়ে দৃষ্টি নত করে নিতেন এবং দৃষ্টিকে সেজদার জায়গার বাইরে যেতে দিতেন না। ডান ও বামের মুসল্লীকে না চেনাই ছিল তাদের মতে নামাযের পূর্ণতা। হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) সেজদার জায়গায় না তরবারি রাখতেন, না কালামে মজীদ। কিছু লেখা পেলে তা মিটিয়ে দিতেন।
কুমন্ত্রণার কারণ কোন গোপন বিষয় হলে সেটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কেননা, যেব্যক্তির চিন্তা জাগতিক ব্যাপারাদিতে ছড়িয়ে পড়ে, তার চিন্তা এক বিষয়ে সীমিত থাকে না; বরং সর্বদাই এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ের দিকে ধাবমান থাকে। দৃষ্টি নত করা তার জন্যে যথেষ্ট হয় না। এরূপ কুমন্ত্রণা দূর করার উপায় হচ্ছে মনকে জোর করে নামাযে পঠিত বিষয় বুঝার মধ্যে লাগিয়ে রাখা এর জন্য সহায়ক বিষয়। নিয়ত বাঁধার পূর্বে মনকে নতুন করে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেবে, আল্লাহ তাআলার সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার বিপদ এবং মৃত্যু পরবর্তী ভয়ংকর অবস্থা মনের সামনে পেশ করবে। মনকে সকল চিন্তার বিষয় থেকে মুক্ত করবে এবং এমন কোন ব্যস্ততা রাখবে না, যার দিকে মন আকৃষ্ট হয়। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ওসমান ইববে আবী শায়বাকে বলেছিলেন-
অর্থাৎ, আমি তোমাকে গৃহের হাঁড়ির মুখ বন্ধ করার কথা বলতে ভুলে গেছি। কেননা, গৃহে এমন বস্তু না থাকা উচিত, যা মানুষকে নামাযে বাধা দেয়।
মোট কথা, এগুলো হচ্ছে চিন্তা স্থির রাখার উপায়। যদি এসব ব্যবস্থা অবলম্বন করার পর চিন্তা স্থির না হয়, তবে রোগের মূলোৎপাটনকারী জোলাব ছাড়া নাজাতের কোন পথ নেই। জোলাব এই যে, যেসব বিষয় মনকে অন্যত্র ব্যাপৃত করে দেয় এবং অন্তরের উপস্থিতি বিনষ্ট করে, সেগুলো থেকে হাত গুটিয়ে নেবে এবং সেগুলোর খাহেশ সম্পূর্ণ ছিন্ন করে দেবে। কেননা, যে বিষয় মানুষকে নামাযে বাধা দেয়, সে বিষয় তার ধর্মের বিপরীত এবং দুশমন ইবলীসের বাহিনী। কাজেই একে সম্পূর্ণ দূর না করে বাধা দিতে থাকা অধিক ক্ষতিকর। একে আলাদা করে দেয়ার মধ্যেই এর কুপ্রভাব থেকে মুক্তি নিহিত। বর্ণিত আছে, রসূলে করীম (সঃ)-এর কাছে আবু জহম দু'পাড়বিশিষ্ট একটি কাল চাদর প্রেরণ করলে তিনি তা পরিধান করে নামায পড়লেন। নামাযের পর চাদরটি খুলে বললেন: এটি আবু জহমের কাছে নিয়ে যাও। সে আমাকে নামায থেকে গাফেল করে দিয়েছে। আমাকে আমার সাদা চাদর এনে দাও। একবার রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জুতায় নতুন চামড়ার টুকরা সংযোজনের আদেশ দেন। এর পর নামাযে তার দিকে তাকান। নামায শেষে তিনি টুকরাটি খুলে পুরাতন টুকরা সংযোজন করতে বলেন। একবার তিনি এক জোড়া জুতা পরিধান করলেন, যা তাঁর কাছে ভাল মনে হল। তিনি সেজদা করলেন এবং বললেন: আমি আমার পরওয়ারদেগারের সামনে অনুনয় বিনয় করেছি, যাতে তিনি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ না হন। এর পর জুতা জোড়াটি বাইরে নিয়ে প্রথমে যে প্রার্থী পেলেন, তাকে দিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে আদেশ করলেন: আমার জন্যে নরম চামড়ার পুরাতন জুতা জোড়া ক্রয় কর। অতঃপর সে জোড়াই তিনি পরিধান করলেন। হারাম হওয়ার পূর্বে একবার রসূলুল্লাহ (সাঃ) সোনার আংটি পরে মিম্বরে উঠলেন, এরপর সেটি নিক্ষেপ করে বললেন: এটি আমাকে ব্যাপৃত রেখেছে। কখনও এটি দেখি এবং কখনও তোমাদেরকে দেখি। বর্ণিত আছে, হযরত আবু তালহা (রাঃ) তাঁর বাগানে নামায পড়লেন। একটি বেগুনী রংয়ের পাখী বৃক্ষের উপর যাওয়ার জন্যে উড়ল। পাখীটি তাঁর কাছে খুবই সুন্দর মনে হল। তিনি এক মুহূর্ত সেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফলে কত রাকআত নামায পড়লেন তা মনে রইল না। এর পর রসূলে করীম (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হয়ে এ ফেতনার কথা উল্লেখ করলেন এবং আরজ করলেন: আমি বাগানটি সদকা করে দিলাম। যেখানে ইচ্ছা ব্যয় করুন। অন্য এক ব্যক্তির কথা বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর বাগানে নামায পড়ছিলেন। বাগানের বৃক্ষসমূহ ফলভারে নুয়ে পড়ছিল। এ দৃশ্য নামাযের মধ্যেই তার কাছে খুব ভাল লাগল। ফলে তিনি নামাযের রাকআত সংখ্যা ভুলে গেলেন। বিষয়টি তিনি হযরত ওসমান গনী (রাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করে আরজ করলেন: বাগানটি সদকা করে দিলাম। একে আল্লাহর পথে ব্যয় করুন। হযরত ওসমান (রাঃ) বাগানটি পঞ্চাশ হাজার দেরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করলেন।
মোট কথা, পূর্ববর্তী মনীষীগণ চিন্তার মূল কর্তন করার জন্যে এসব উপায় অবলম্বন করতেন। বাস্তবে চিন্তার কারণের মূলোৎপাটন করার পদ্ধতি এটাই। এছাড়া অন্য কোন কৌশল উপকারী হবে না। কেননা, মনকে নরমভাবে স্থির করার যে কথা আমরা লেখেছি, তা দুর্বল চিন্তার ক্ষেত্রে উপকারী। কিন্তু খাহেশ ও চিন্তা জোরদার হলে তাতে তা উপকারী নয়; বরং খাহেশ তোমাকে টানবে এবং তুমি খাহেশকে টানবে। শেষ পর্যন্ত খাহেশই প্রবল হবে এবং সমগ্র নামায এই দ্বন্দ্বের মাঝে অতিবাহিত হয়ে যাবে। এর দৃষ্টান্ত এই, এক ব্যক্তি বৃক্ষের নীচে বসে তার চিন্তা সাফ রাখতে চায়। কিন্তু বৃক্ষের উপর পাখীরা বসে চেঁচামেচি করে তার চিন্তা বিক্ষিপ্ত করে দেয়। লোকটি একটি লাঠি হাতে নিয়ে পাখীদেরকে উড়িয়ে দেয় এবং পুনরায় আপন চিন্তায় মশগুল হয়। পাখীরা আবার এসে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। এমতাবস্থায় কেউ এসে লোকটিকে বলল: যে কৌশল তুমি অবলম্বন করেছ তা কখনও সফল হবে না। যদি তুমি এ থেকে নিষ্কৃতি চাও, তবে বৃক্ষটি উৎপাটিত করে দাও। খাহেশরূপী বৃক্ষের অবস্থাও তদ্রূপ। এর শাখা-প্রশাখা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন এর উপর চিন্তা পাখীদের ন্যায় দাপাদাপি করে অথবা আবর্জনার উপর মাছির ন্যায় ভন্ড করে। মাছিকে তাড়িয়ে দিলে আবার আসে। মনের কুমন্ত্রণাও তেমনি। খাহেশ অনেক। মানুষ এ থেকে খুব কম মুক্ত। সবগুলোর মূল শিকড় এক, অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত। যার অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত রয়েছে এবং যে দুনিয়ার কোন বস্তুর প্রতি আগ্রহান্বিত, তার নামাযে নিবিষ্টতার স্বচ্ছ আনন্দ অর্জিত হওয়ার আশা করা উচিত নয়। তবুও তার মোজাহাদা তথা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত, যেভাবেই হোক মনকে নামাযের দিকে ফেরানো এবং চিন্তার কারণসমূহ হ্রাস করা উচিত। এ ওষুধ তিক্ত এবং মনের কাছে বিস্বাদ। কিন্তু রোগ পুরাতন ও দুরারোগ্য হয়ে গেছে। এমনকি, বুযুর্গগণ এমন দু'রাকআত নামায পড়ার ইচ্ছা করেছেন, যাতে দুনিয়ার বিষয়সমূহ মনে না আসে। কিন্তু এটা সম্ভবপর হয়নি। তাঁরাই যখন এরূপ দু'রাকআত নামায পড়তে সক্ষম হলেন না, তখন আমাদের মত লোক এটা আশা করতে পারে কি? আমরা যদি কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত অর্ধেক কিংবা তিন ভাগের একা ভাগ নামাযও পাই, তবে তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি, যারা সৎকর্মের সাথে কুকর্মও মিশ্রিত করে দিয়েছে। মোট কথা, দুনিয়ার চিন্তা ও পরকালের সাহস এমন, যেমন তেলপূর্ণ পেয়ালায় পানি ঢাললে যে পরিমাণ পানি পেয়ালায় যাবে, সেই পরিমাণ তেল নিশ্চিতই বের হয়ে পড়বে। উভয়ের একত্র মিলন সম্ভবপর হবে না।
0 Comments