দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার গুণাবলী সপ্রমাণ করার
প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান এবং এ উক্তিতে সত্যবাদী-
وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ .
অর্থাৎ, “তিনি সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান।"
এর কারণ, এ বিশ্ব কারিগরি দিক দিয়ে অত্যন্ত মজবুত এবং সৃষ্টিগতভাবে সুনিপুণ ব্যবস্থাপনার অধীন। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি চমৎকার বয়নযুক্ত, কারুকার্যখচিত ও সুসজ্জিত রেশমী বস্ত্র দেখে ধারণা করে, এটা কোন মৃত ব্যক্তি বয়ন করে থাকবে, যে কিছু করতে পারে না, তাহলে সে কি নির্বোধ মূর্খ বলে গণ্য হবে না? তেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা নির্মিত বিশ্বকে দেখেও তাঁর কুদরত অস্বীকার করা নিছক বোকামি বৈ নয়।
দ্বিতীয় মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা স্বীয় জ্ঞান দ্বারা সমগ্র বিশ্বকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন। আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোন অনুকণা নেই, যা তাঁর জ্ঞানে অনুপস্থিত। তিনি এ উক্তিতে সত্যবাদী-
وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ .
অর্থাৎ, তিনি সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী। তিনি আরও বলেন- الَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ .
অর্থাৎ, "যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানবেন না, অথচ তিনি রহস্যজ্ঞানী সর্বজ্ঞ?" এতে নির্দেশ করেছেন, সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর জ্ঞান উপলব্ধি করে নাও। কেননা, সামান্য বস্তুর মধ্যেও নিপুণ সৃষ্টি ও সাজানো গোছানো শিল্পকর্ম দেখে নিঃসন্দেহে শিল্পীর ব্যবস্থাপনা জ্ঞান উপলদ্ধি করা যায়।
তৃতীয় মূলনীতি, আল্লাহ্ তাআলা জীবিত। কেননা, যার জ্ঞান ও কুদরত প্রমাণিত, তার জীবনও অবশ্যই প্রমাণিত হবে। যার কুদরত চলমান এবং যার জ্ঞান ও কৌশল অব্যাহত, তাকে যদি জীবিত নয় বলে কল্পনা করা যায়, তবে গতিশীল ও স্থিতিশীল থাকা অবস্থায় জীবজন্তুর জীবন সম্পর্কেও সন্দেহ হতে পারে; বরং কারিগর, শিল্পী, শহরে ও বনে ঘুরাফেরাকারী এবং দেশ বিদেশের যত মুসাফির রয়েছে তাদের সকলের জীবন সম্পর্কেই সন্দেহ হতে পারে। এটা পথভ্রষ্টতা বৈ কিছু নয়।
চতুর্থ মূলনীতি, আল্লাহ তআলা স্বীয় কর্মের ইচ্ছা করেন। অর্থাৎ, যা কিছু বিদ্যমান রয়েছে তা তাঁর ইচ্ছায় অস্তিত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। তিনি প্রথমে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন। কারণ, যে কাজ তাঁর পক্ষ থেকে প্রকাশ পায়, তার বিপরীত কাজটিও প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কুদরত উভয় কাজের সাথে একই রূপ সম্পর্ক রাখে। সুতরাং উভয় কাজের মধ্য থেকে এক কাজের দিকে কুদরতকে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটি ইচ্ছা থাকা একান্ত দরকার।
পঞ্চম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। অন্তরের কুমন্ত্রণা, চিন্তাভাবনা ও ধারণার মত গোপন বিষয়ও তাঁর দৃষ্টিতে অনুপস্থিত নয় এবং অন্ধকার রাতে শক্ত পাথরের উপর কাল পিঁপড়ার শব্দও তাঁর শ্রবণের বাইরে নয়। কেননা, শ্রবণ ও দর্শন পূর্ণতার গুণ, অপূর্ণতার গুণ নয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলার জন্যে শ্রবণ ও দর্শন স্বীকার না করলে তাঁর সৃষ্টি হয়ে যাবে পূর্ণ এবং তিনি অপূর্ণ হয়ে যাবেন। এছাড়া
পিতার সামনে পেশকৃত হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রমাণও বৈধ হবে না। তাঁর পিতা অজ্ঞতাবশতঃ প্রতিমা পূজা করত। তিনি পিতাকে বললেন
لم تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا.
অর্থাৎ, "আপনি এমন প্রতিমার পূজা কেন করেন, যে শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকার করে না।"
সুতরাং তুমিও যদি পিতার উপাস্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও, তবে তোমার প্রমাণাদি বাতিল হয়ে যাবে এবং আল্লাহর উক্তির সত্যতাও প্রতিশ্তিত হবে না ।
অর্থাৎ, “এটা আমার প্রমাণ, যা আমি ইব্রাহীমকে তার কওমের মোকাবিলায় দান করেছি।"
যেমন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়াই আল্লাহ তাআলার কর্তা হওয়া এবং অন্তর ও মস্তিষ্ক ছাড়া জ্ঞানী হওয়া প্রতীয়মান হয়েছে, তেমনি চক্ষুকোটর ছাড়া তাঁর দর্শক হওয়া এবং কর্ণকুহর ছাড়া শ্রোতা হওয়াও বুঝে নেয়া উচিত। এতদুভয়ের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
ষষ্ঠ মূলনীতি, আল্লাহ্ তাআলা কথা বলেন এবং তাঁর কালাম (কথা) তাঁর সত্তার সাথে সম্পৃক্ত একটি সিফত। এ কালাম কণ্ঠস্বরও নয় এবং অক্ষরও নয়। তাঁর কালাম অন্যের কালামের অনুরূপ নয়, যেমন তাঁর সত্তা অন্যের সত্তার মত নয়। আসলে মনের কালামই সত্যিকার কালাম। অক্ষর ও কণ্ঠস্বর তো কেবল ব্যক্ত করার জন্য। যেমন, নড়াচড়া ও ইশারা দ্বারাও মাঝে মাঝে ব্যক্ত করা যায়। জানি না, কোন কোন লোকের কাছে এ বিষয়টি কেন দুর্বোধ্য হয়ে গেল। অথচ জাহেলিয়াত যুগের কবিদের কাছেও এটা দুর্বোধ্য ছিল না। তাই জনৈক কবি বলেন: কালামের অস্তিত্ব কেবল অন্তরের মধ্যে। জিহ্বা এর প্রমাণ মাত্র। তবে কতক লোককে এসব বিষয় থেকে দূরে রাখার মধ্যে আল্লাহ তাআলার কোন প্রজ্ঞা নিহিত রয়েছে। তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত করতে পারে না। হযরত মূসা (আঃ) দুনিয়াতে কণ্ঠস্বর ও অক্ষরবিহীন কালাম শ্রবণ করেছেন- যেব্যক্তি একথা অসম্ভব মনে করে, তবে তার উচিত আখেরাতে দেহ ও রংবিহীন বস্তু দেখার সম্ভাবনা অস্বীকার করা। কিন্তু এটা সে স্বীকার করে থাকে, যদিও এ পর্যন্ত এমন কোন বস্তু দেখেনি। সুতরাং দেখার ব্যাপারেও তাই স্বীকার করা উচিত, যা শ্রবণের ব্যাপারে বুঝে আসে।
সপ্তম মূলনীতি, আল্লাহর পবিত্র সত্তার সাথে সম্পৃক্ত কালাম চিরন্তন। তার সকল সিফতও তেমনি। কেননা, অনিত্য বস্তুসমূহের পাত্র হওয়া আল্লাহ তাআলার শানের পরিপন্থী। কারণ, অনিত্য বস্তুসমূহ পরিবর্তিত হতে থাকে। অথচ আল্লাহ তাআলার মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই।
অষ্টম মূলনীতি, আল্লাহ্ তাআলার এলেম চিরন্তন। অর্থাৎ, তিনি সর্বদা আপন সত্তা, সিফত এবং যা কিছু সৃষ্টি করেন, সকলকে অনাদিকাল থেকে জানেন। যখন কোন বস্তু সৃষ্টি করেন তখন তার এলেম নতুন অর্জিত হয় না; বরং অনাদি-অনন্তকালব্যাপী তা তাঁর রয়েছে।
নবম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা চিরন্তন। বিশেষ ও উপযুক্ত সময়ে সৃষ্টি কর্মের সাথে পূর্ব জ্ঞান অনুযায়ী অনাদিকালেই এ ইচ্ছার সম্পর্ক হয়ে আছে। কেননা, তাঁর ইচ্ছা অনিত্য হলে তিনি অনিত্য বস্তুসমূহের পাত্র সাব্যস্ত হবেন, যা তাঁর শানের পরিপন্থী।
দশম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা এলেম সহকারে আলেম, জীবন সহকারে জীবিত, শক্তি সামর্থ্য সহকারে শক্তিমান, ইচ্ছা সহকারে ইচ্ছাকারী, কালাম সহকারে মুতাকাল্লিম (বক্তা), শ্রবণ সহকারে শ্রোতা এবং দর্শক সহকারে দ্রষ্টা। এগুলো তাঁর চিরন্তন সিফত। অতএব যারা তাঁকে এলেম ব্যতিরেকে আলেম বলে, তারা যেন কাউকে ধন ব্যতিরেকে ধনী বলে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব।
0 Comments