যায়নাব বিন্তে খুযায়মা (রা)
যায়নাব বিনতে খুযায়মা ইবনে আল হারিস আল-হিলালিয়া ছিলেন বনু বার ইবনে হাওয়াযিনের কন্যা। তাঁর উপাধি ছিল 'উম্মুল মাসাকীন'। উহুদ যুদ্ধে তাঁর স্বামী শাহাদাত বরণ করলে ঐ বছরই রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে বিয়ে করেন এবং তিনি উম্মুল মুমিনীন-এর মর্যাদার অধিকারিণী হন।
আবুল হাসান আলী আল-জুরজানীর মতে, রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বিয়ের আগে তাঁর প্রথম স্বামী ছিলেন তুফাইল ইবনে আল হারিস। তুফাইল তালাক দিলে তাঁর ভাই উবায়দা ইবনে আল-হারিস তাঁকে বিয়ে করেন। বদরের যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে আস-সাফরাতে মারা যান। তখন 'উবায়দার বয়স ৬৪ বছর।
তৃতীয় হিজরীর রমজান মাসের প্রথম দিকে রাসূল (সা) তাঁকে বিয়ে করেন এবং দেনমোহর বাবদ বারো উকিয়া স্বর্ণ দান করেন। ইবন হিশাম বলেন, চার শো দিরহাম দেনমোহরের বিনিময়ে রাসূল (সা) তাঁকে বিয়ে করেন। এ বিয়ের মধ্যস্থতা করেন কুরায়সা ইবনে 'আমর হিলালী (রা)। রাসুলুল্লাহর (সা) সাথে বিয়ের কয়েকমাস পর ৪র্থ হিজরীর রবী'উস সানী মাসের শেষ দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল তিরিশ বছর। রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রীদের মধ্যে তিনিই তাঁর জীবদ্দশায় হযরত খাদীজার পর প্রথম জান্নাতবাসিনী হন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং মদীনার জান্নাতুল বাকী নামক গোরস্তানে দাফন করেন।
উম্মে সালামা বিন্তে আবী উমাইয়া (রা)
নাম ও বংশপরিচয়ঃ
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার (রা) প্রকৃত নাম 'হিন্দা' ডাকনাম 'উম্মে সালামা' এবং এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। অনেকে তাঁর নাম 'রামলা' বলেছেন, কিন্তু মুহাদ্দিসগণ একে ভিত্তিহীন মনে করেছেন। মূলত রামলা উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবার (রা) নাম। উন্মে সালামার (রা) পিতা আবু উমাইয়্যা ইবনে মুগীরা। আবু উমাইয়ার আসল নাম 'হুজাইফা'। তবে তিনি 'আবু উমাইয়া' নামেই খ্যাত। মক্কার দানশীল ও অতিথি সেবকদের মধ্যে তাঁর এক বিশেষ স্থান ছিল। তিনি যখন কোন কাফেলার সাথে কোথাও বের হতেন তখন গোটা কাফেলার খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। উম্মে সালামার (রা) মাতার নাম 'আতিকা বিনতে 'আমি আল-কিনানিয়া।
উম্মে সালামার প্রথম বিয়েঃ
উম্মে সালামার (রা) প্রথম বিয়ে হয় আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ আল-মাখযুমীর সাথে তিনি আবু সালামা নামেই প্রসিদ্ধ। আবু সালামার (রা) পিতামহ হিলাল এবং উন্মে সালামার (রা) পিতামহ মৃগীরা দুই ভাই। আবু সালামার পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা) এর ফুফা। রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফু বারাকে তিনি বিয়ে করেন। তাঁরই ছেলে আবু সালামা (রা)।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ছিলেন 'কাদীমুল ইসলাম' বা প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী। ইসলামের সূচনা পর্বে যখন মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দুের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল একটি দুরুহ কাজ তখন এই দম্পতি ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর বনু মাখযুম হযরত আবু সালামার (রা) উপর নির্দয় অত্যাচার চালাতে থাকলে এক পর্যায়ে তিনি আবু তালিবের আশ্রয়ে চলে আসেন। বনু মাখযুমের লোকেরা বললো। আবু তালিব। এতদিন আপনি আপনার ভাতিজার সাহায্য সমর্থন করছিলেন, এখন আপনার আশ্রয়ে থাকা আমাদের ভাইয়ের ছেলেকেও আমাদের হাতে সমর্পণ করছেন না। আবু তালিব বললেনঃ যে বিপদ থেকে আমার ভাইয়ের ছেলেকে রক্ষা করছি, সেই একই বিপদ থেকে আমার বোনের ছেলেকেও রক্ষা করছি। হিজরতের হুকুম হলে তিনিই সর্বপ্রথম সস্ত্রীক হাবশায় হিজরত করেন।
পর পর দুইবার হাবশায় হিজরত এবং কিছু দিন অবস্থান করার পর তাঁরা আবার মক্কায় ফিরে আসেন। তারপর আবার মদীনার দিকে যাত্রা করেন। মদীনায় হিজরতের সময় উন্মে সালামা (রা) এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হন।
'আবু সালামা যখন মদীনায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তাঁর কাছে মাত্র একটি উট ছিল। তিনি সেই উটের উপর আমাকে ও তাঁর ছেলে সালামাকে উঠায়ে নিজে উটের। লাগাম ধরে চলতে আরম্ভ করেন। বনু মুগীরার লোকেরা আবু সালামাকে বাধা দিয়ে বললো, আমাদের মেয়েকে এমন খারাপ অবস্থায় যেতে দেব না। আবু সালামার হাত থেকে তারা উটের লাগাম ছিনিয়ে নিল এবং আমাকে সংগে করে নিয়ে চললো। অপরদিকে বনু 'আবদুল আসাদের লোকেরা এসে আমার সন্তান সালামাকে নিয়ে নেয়। তারা বনু মুগীরাকে বললো, তোমরা যদি তোমাদের মেয়েকে তার স্বামীর সাথে যেতে না দাও তাহলে আমরা আমাদের সন্তানকে তোমাদের মেয়ের কাছে থাকতে দেব না। এভাবে আমি, স্বামী ও সন্তান-তিনজন তিনদিকে ছিটকে পড়লাম। স্বামী-সন্তানের বিচ্ছেদ ব্যথায় আমার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়লো।
একদিন বনু মুগীরার এক ব্যক্তি আমার এ দুরবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পেলেন। তিনি বনু মুগীরার লোকদের সম্বোধন করে বললেন: 'আপনারা এ অসহায় মেয়েটিকে মুক্তি দিচ্ছেন না কেন? তাকে কেন তার স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। তাকে মুক্তি দিন এবং স্বামী-সন্তানের সাথে মিলিত হতে দিন।' তিনি কথাগুলি অত্যন্ত আবেগভরা শব্দে প্রকাশ করেন এতে আমার পিতৃগোত্রের লোকদের অন্তরে করুণার সঞ্চার হয়। তাঁরা আমাকে স্বামীর কাছে যাওয়ার অনুমতি দেন। এ খবর শুনে বনু আবদুল আসাদও আমার সন্তানটিকে আমার কাছে। পাঠিয়ে দেয়। আমি সালামাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা বের হয়ে তান'ঈম পৌছলাম। সেখানে কা'বার চাবি রক্ষক 'উসমান ইবনে তালহার সাথে দেখা হলো। আমার ইচ্ছার কথা শুনে তিনি উটের লাগাম ধরে টানতে টানতে উটের আগে আগে চলতে লাগলেন।
যখন আমরা কোন মানযিলে পৌছতাম, তিনি উট বসিয়ে দিয়ে দূরে কোন গাছের আড়ালে চলে যেতেন। আবার চলার সময় হলে, তিনি উট প্রস্তুত করে আমার কাছে এসে বলতেন, 'উঠে বস।' আমি উটের পিঠে বসার পর তিনি লাগাম ধরে আগে আগে চলতে থাকতেন। যখন আমরা মদীনার বনু আমর পল্লী কুবায় পৌঁছলাম, উসমান ইবনে তালহা আমাকে বললেন, তোমার স্বামী এই পল্লীতে আছেন। আবু সালামা সেখানে অবস্থান করছিলেন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে পল্লীতে প্রবেশ করেই আবু সালামার দেখা পেয়ে গেলাম। এভাবে উসমান ইবনে তালহা আমাকে আবু সালামার সন্ধান দিয়ে আবার মক্কার দিকে যাত্রা করেন।
উম্মে সালামা (রা) আত্মমর্যাদা-বোধ সম্পন্না এক মহিলা ছিলেন। তাঁর পিতা আবু উমাইয়্যা ছিলেন কুরাইশদের একজন খ্যাতিমান ও মর্যাদাবান ব্যক্তি। উম্মে সালামা (রা) যখন কুবায় পৌছেন তখন লোকেরা তাঁর পরিচয় জানতে চাইতো। তিনি পিতার নাম বললে কেউ বিশ্বাস করতে চাইতো না। কারণ, সে যুগেও তাঁর মত কোন সম্ভ্রান্ত মহিলা একাকী এভাবে ভ্রমণ করতো না। ইসলামের প্রতি দরদ এবং আল্লাহর নির্দেশ পালন তিনি অপরিহার্য বলে বিশ্বাস করতেন। এ কারণে তিনি কারও কোন কথায় কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন না। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতেন। হজ্জের মওসুমে যখন কিছু লোক কুবা থেকে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা দিল, তিনি তাদেরকে পিতার ঠিকানা দিয়ে দিলেন। তখন সবাই তাঁর আভিজাত্য বিশ্বাস করলো।
হিজরতের দুর্ভোগের স্মৃতি তখনও তাঁদের মন থেকে মুছে যায় নি এবং স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ এক সাথে বেশী দিন বসবাসের সুযোগও হয়নি, এরই মধ্যে উহুদ যুদ্ধের প্রস্তুতি। আবু সালামা (রা) যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধের ময়দানে একই নামের প্রতি পক্ষের অপর ব্যক্তি আবু সালামা হাশমীর নিক্ষিপ্ত একটি তীরে তাঁর বাহু আহত হয় এবং কিছুদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যান। হিজরী ৪র্থ সনের সফর মাসে তাঁর সেই পুরানো ক্ষত আবার বেড়ে গেলে জীবন আশঙ্কা দেখা দেয়। একই বছর জমাদিউস সানী মাসে তিনি ইনতিকাল করেন। উম্মে সালামা (রা) স্বামীর মৃত্যুর খবর রাসূলুল্লাহকে (সা) দিতে আসেন। তিনি বারবার শুধু বলছিলেন 'হায়, এ কেমন মৃত্যু হলো।' রাসূল (সা) তাঁকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিয়ে বলেন, তোমরা তাঁর মাগফিরাত কামনা করে দু'আ কর। আর বল- 'হে আল্লাহ, আত্মকে তাঁর চেয়ে ভালো কোন বিকল্প দান করুন।'
তারপর রাসূলুল্লাহর (সা) আবু সালামার লাশের কাছে যান এবং জানাযার নামায আদায় করেন। সেই নামাযে তিনি নয়টি তাকবীর বলেন। উপস্থিত লোকেরা মনে করেছিলেন হয়তো ভুল হয়েছে। তাঁরা বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) আপনার ভুল হয়নি তো রাসূলুল্লাহর (সা) বললেন: এ ব্যক্তি হাজার তাকবীর লাভের যোগ্য ছিলেন। মৃত্যুর সময় আবু সালামার চোখ দুইটি খোলা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজের দুইটি পবিত্র হাত দিয়ে চোখ দুইটি বন্ধ করে দেন।
0 Comments