অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত নামাযের আভ্যন্তরীণ শর্ত কি কি

        নামাযে খুশু ও অন্তরের উপস্থিতি শর্ত। এর প্রমাণ অনেক। আল্লাহ বলেন:

اقِمِ الصَّلوةَ لِذِكْرِى .

        অর্থাৎ, আমার স্মরণের জন্যে নামায কায়েম কর।

        এ থেকে বাহ্যতঃ বুঝা যায়, নামাযে অন্তরের উপস্থিতি ওয়াজেব। নামাযে গাফেল থাকা স্মরণের বিপরীত। অতএব যেব্যক্তি সমগ্র নামাযে গাফেল থাকে, সে আল্লাহর স্মরণের জন্যে নামায কায়েমকারী কিরূপে হবে?

وَلَا تَكُن مِّنَ الْغَفِلِينَ .

        অর্থাৎ, গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

        এখানে নিষেধ পদবাচ্য ব্যবহৃত হয়েছে, যদ্দ্বারা বুঝা যায়, গাফেল হওয়া হারাম।

حتى تَعْلَمُونَ مَا تَقُولُونَ .

 অর্থাৎ, যে পর্যন্ত যা বল, তা না বুঝ।

        এতে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকেও নামায পড়তে নিষেধ করার কারণ ব্যক্ত করা হয়েছে। এ কারণ সেই ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যে গাফেল, কুমন্ত্রণায় মগ্ন এবং পার্থিব চিন্তা-ভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। রসূলে করীম (সাঃ) বলেন:

        নামায তো অসহায়ত্ব ও অনুনয় বৈ কিছুই নয়। হাদীসের শব্দাবলী থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, সেটাই নামায, যার মধ্যে অসহায়ত্ব ও অনুনয়-বিনয় থাকে। এক হাদীসে আছে, যেব্যক্তির নামায তাকে মন্দ ও অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে না, সেই নামায তার মধ্যে ও আল্লাহ তাআলার মধ্যে দূরত্বই বৃদ্ধি করে। বলাবাহুল্য, গাফেল ব্যক্তির নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজের পথে অন্তরায় নয়। এরশাদ হয়েছে- অনেক নামাযী এমন, তাদের নামায থেকে তারা কেবল কষ্ট ও শ্রমের অংশই পায়। এতে গাফেল ছাড়া অন্য কোন নামাযী উদ্দেশ্য নয়। আরও বলা হয়েছে- বান্দা তার নামাযের ততটুকুই পাবে, যতটুকু সে বুঝে।

        এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত বক্তব্য, নামাযী তার পরওয়ারদেগারের সাথে মোনাজাত (কানাকানি) করে। হাদীসে এ বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে। গাফিলতি সহকারে যে কথা বলা হয়, তা নিশ্চিতই মোনাজাত হবে না। যাকাত, রোযা ও হজ্জ এমন ফরয কর্ম, যেগুলো গাফিলতি সহকারে আদায় করলেও আসল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যায়। যাকাত প্রদান স্বয়ং মানুষের ধনলিন্সার বিপরীত এবং মনের জন্যে কঠিন কাজ। এমনিভাবে রোযা মানুষের পাশবিক শক্তিকে দাবিয়ে রাখে এবং যে খাহেশ দুশমন ইবলীসের হাতিয়ার, সেই খাহেশ ভেঙ্গে চুরমার করে। হজ্জও তেমনি কষ্টকর ও কঠিন কাজ। এতে এত পরিশ্রম আছে যদ্ধারা পরীক্ষা অর্জিত হয়ে যায়- সম্পাদনের সময় অন্তর উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক। কিন্তু নামাযে যিকির, কেরাআত, রুকু, সেজদা, দণ্ডায়মান হওয়া ও বসা ছাড়া কিছুই নেই। এখন দেখতে হবে, যিকিরের উদ্দেশ্য সম্বোধন ও বাক্যালাপ করা, না কেবল মুখে অক্ষর ও স্বর উচ্চারণ করা, শেষোক্ত বিষয়টি যিকিরের উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেননা, গাফেল ব্যক্তির জন্যে প্রলাপ বকার সময় জিহ্বা নাড়াচাড়া করা মোটেই কঠিন নয়। এরূপ যিকির পরীক্ষা হতে পারে না। বরং যিকিরের উদ্দেশ্য হবে মনের ভাব প্রকাশ করে বাক্যালাপ করা। এটা অন্তর উপস্থিত না করে অর্জিত হতে পারে না। উদাহরণতঃ মনকে গাফেল রেখে মুখে اهدنا الص الْمُسْتَقِيمَ উচ্চারণ করলে একে কেউ প্রার্থনা বলবে না। সুতরাং যিকির দ্বারা অনুনয়-বিনয় ও দোয়া উদ্দেশ্য না হলে গাফিলতির সাথে জিহ্বা নাড়াচাড়া করা কঠিন হবে কি? অভ্যাস হয়ে যাওয়ার পর এটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। এরূপ ব্যক্তি নামাযের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ অন্তর স্বচ্ছ হওয়া ও ঈমানের বন্ধন সুদৃঢ় হওয়া থেকে অনেক দূরে থাকবে। এটা হল কেরাআত ও যিকির সম্পর্কে কথা। এখন রুকু ও সেজদার উদ্দেশ্য তাযীম তথা শ্রদ্ধা ভক্তি প্রদর্শন। মানুষ যদি তার কাজ দ্বারা আল্লাহ থেকে গাফিল হয়ে আল্লাহর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারে, তবে সে তার কাজ দ্বারা গাফেল অবস্থায় সম্মুখে রক্ষিত কোন মূর্তির প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারবে এবং এটা বিশুদ্ধ হবে। রুকু ও সেজদা যখন ভক্তি প্রদর্শন থেকে শূন্য হবে, তখন থেকে যাবে কেবল পিঠ ও মাথার নাড়াচাড়া। এটা এতটুকু কঠিন কাজ নয়, এর দ্বারা বান্দার পরীক্ষা উদ্দেশ্য হতে পারে অথবা একে ধর্মের স্তম্ভ করা যেতে পারে, কুফুর ও ইসলামের পার্থক্য সাব্যস্ত করা যেতে পারে এবং হজ্জ ও অন্যান্য সকল এবাদতের অগ্রে স্থান দেয়া যেতে পারে। নামাযের এই মাহাত্ম্য কেবল তার বাহ্যিক ক্রিয়াকর্মের কারণে, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। হাঁ, মোনাজাত তথা আল্লাহর সাথে সংগোপনে কথা বলার উদ্দেশ্য যোগ হলে নামায রোযা, হজ্জ এবং যাকাত অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ এবাদত হয়ে যায়; বরং কোরবানীর চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবাদত হচ্ছে নামায। আর্থিক ক্ষতি স্বীকারের মাধ্যমে নফলের মোজাহাদা করার জন্যে আল্লাহ তাআলা কোরবানীর বিধান দিয়েছেন এবং এ সম্পর্কে বলেছেন-

لَنْ تَنَالَ اللهُ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاءُهَا وَلَكِنْ تَنَالُهُ التقوى مِنْكُمْ .

        অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে এসব জন্তুর মাংস ও রক্ত পৌঁছে না; কিন্তু তোমাদের তাক্তয়া তাঁর কাছে পৌঁছে।

        এখানে তাকওয়া অর্থ এমন গুণ, যা অন্তরের উপর প্রবল হয়ে আদেশ পালনের কারণ হয়। কোরবানীতে এটাই উদ্দেশ্য। সুতরাং এটা নামাযের উদ্দেশ্য হবে না কিরূপে?

        মোট কথা, উপরোক্ত রেওয়ায়েতসমূহ একথা জ্ঞাপন করে যে, নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্যে অন্তরের উপস্থিতি শর্ত। কিন্তু ফেকাহবিদগণ বলেন, কেবল আল্লাহু আকবার বলার সময় অন্তরের উপস্থিতি শর্ত। অতএব আমার উপস্থাপিত বক্তব্য নিঃসন্দেহে তাঁদের বিপরীত। এর জওয়াব এই, ফেকাহবিদগণ মানুষের বাতেন তথা অন্তর সম্পর্কে কোন আলোচনা করেন না এবং তাঁরা অন্তর চিরে আভ্যন্তরীণ অবস্থা জানার চেষ্টাও করেন না; বরং তাঁরা ধর্মের বাহ্যিক বিধানাবলীকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক কর্মের উপর ভিত্তিশীল করেন। তাঁদের মতে, বাহ্যিক ক্রিয়াকর্মই জাগতিক শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। এখন এই বাহ্যিক ক্রিয়াকর্ম আখেরাতে গ্রহণযোগ্য ও উপকারী হবে কি-না, এ আলোচনা ফেকাহর গণ্ডির বাইরে।

        এছাড়া অন্তরের উপস্থিতি ছাড়া আমল পূর্ণ হওয়ার উপর কোন ইজমা দাবী করা যায় না। সুফিয়ান সওরী (রঃ) বলেন: যেব্যক্তি খুশু সহকারে নামায পড়ে না, তার নামায ফাসেদ। এক রেওয়ায়েতে হযরত হাসান বসরী (রঃ)-এর উক্তি বর্ণিত আছে, যে নামাযে অন্তর উপস্থিত নয়, সেই নামায দ্রুত আযাবের দিকে নিয়ে যায়। হযরত মু'আয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, যেব্যক্তি নামাযে থেকে ইচ্ছাপূর্বক ডান ও বামের ব্যক্তিকে চিনতে পারে, তার নামায হবে না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: বান্দা নামায পড়ে অথচ তা থেকে তার জন্যে ছয় ভাগের এক ও দশ ভাগের এক অংশও লিখিত হয় না। কেবল ততটুকুই লেখা হয়, যতটুকু সে বুঝে শুনে পড়ে। আবদুল ওয়াহেদ ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন: আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, বান্দা তার নামাযের ততটুকু অংশই পায় যতটুকু সে অন্তরে উপস্থিত রেখে পড়ে। তিনি তো অন্তরের উপস্থিতির উপর ইজমাই দাবী করলেন। পরহেযগার ফেকাহবিদ ও আখেরাতের আলেমগণের পক্ষ থেকে এ ধরনের অসংখ্য উক্তি বর্ণিত আছে। সত্য এই, শরীয়তের প্রমাণাদি দেখা উচিত। হাদীস ও মনীষীবর্গের উক্তি থেকে বাহ্যতঃ এটাই বুঝা যায় যে, অন্তরের উপস্থিতি শর্ত। কিন্তু বাহ্যিক বিধানাবলীতে ফতোয়ার স্থান মানুষের ধারণা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। এদিক দিয়ে মানুষের জন্যে সমগ্র নামাযে অন্তর উপস্থিত রাখা শর্ত করে দেয়া সম্ভবপর নয়। কেননা, এটা করতে স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া সকলেই অক্ষম। সমগ্র নামাযে শর্ত করা যখন সম্ভবপর হল না, তখন বাধ্য হয়েই এমনভাবে শর্ত করতে হল যে, একটি মুহূর্তে যেন অন্তর উপস্থিত থাকে। নামাযের অন্য সব মুহূর্তের তুলনায় আল্লাহু আকবার বলার মুহূর্তটি এ শর্তের জন্যে অধিক উপযুক্ত। তাই ফতোয়ায় কেবল এ মুহূর্তটিই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও আমরা আশাবাদী, যেব্যক্তি সমগ্র নামাযে গাফেল থাকে, তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মত খারাপ হবে না, যে নামাযই পড়ে না। কেননা, গাফেল তো বাহ্যতঃ কিছু কর্মের উদ্যোগ নিয়েছে এবং অন্তরকে এক মুহূর্ত হলেও উপস্থিত করেছে। যেব্যক্তি ভুলবশতঃ ওযু ছাড়া নামায পড়ে নেয়, তার নামায আল্লাহ তাআলার কাছে বাতিল। কিন্তু তার কাজ ও ওযর অনুযায়ী কিছু সওয়াব সে পাবে। এতদসত্ত্বেও ফেকাহবিদগণ গাফিলতি সহকারে নামায দুরস্ত হওয়ার যে ফতোয়া দেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোন ফতোয়া দিতে পারি না। কেননা, এ ফতোয়া মুফতীকে বাধ্য হয়েই দিতে হয়; যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নামাযের রহস্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ব্যক্তির জানা উচিত, গাফিলতি নামাযের জন্যে ক্ষতিকর।

        সারকথা, অন্তরের উপস্থিতি নামাযের প্রাণ। এ প্রাণ অবশিষ্ট থাকার সর্বনিম্ন পরিমাণ হচ্ছে আল্লাহু আকবার বলার সময় অন্তর উপস্থিত থাকা। এর যতবেশী অন্তর উপস্থিত থাকবে, ততই নামাযের অঙ্গে অঙ্গে প্রাণ সঞ্চারিত হবে। যে জীবিত ব্যক্তির নড়াচাড়া নেই, সে মৃতের কাছাকাছি। সুতরাং যেব্যক্তি সমগ্র নামাযে গাফেল থেকে কেবল আল্লাহু আকবার বলার সময় অন্তর উপস্থিত রাখে, তার নামায ঐ জীবিত ব্যক্তির মত, যার নড়াচাড়া নেই। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন গাফিলতি দূর করা এবং অন্তরের উপস্থিতি অর্জনের ব্যাপারে আমাদেরকে উত্তমরূপে সাহায্য করেন।

Post a Comment

0 Comments