আকায়েদের বিবরণ আল্লাহ তাআলা কর্তৃক রসূলগণের সত্যায়ন প্রমাণ করার


        চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা কর্তৃক রসূলগণের সত্যায়ন প্রমাণ করার 

        প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, হাশর ও নশর হবে। শরীয়তে এর খবর বর্ণিত হয়েছে। একে সত্য বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। বিবেকের বিচারে এর অস্তিত্ব সম্ভবপর। এর অর্থ হচ্ছে, মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা যে কুদরতের বলে প্রথম সৃষ্টি করেছেন, সেই কুদরতের বলেই পুনরায় জীবিত করবেন। তিনি নিজেই বলেন:

قَالَ مَنْ تُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ قُلْ يُحْيِبُهَا الَّذِي أَنْشَاهَا أَول مرة.

        অর্থাৎ "কাফের বলল, অস্থিসমূহ পচে যাওয়ার পর ওগুলো কে জীবিত করবে? বলে দিন: যিনি এগুলো প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তিনিই জীবিত করবেন।" এতে প্রথমবার সৃষ্টিকে পুনরুজ্জীবনের প্রমাণরূপে পেশ করা হয়েছে। অন্যত্র বলেন: مَا خَلْقُكُمْ وَلَا بَعْدُكُمْ إِلَّا كَنَفْسٍ وَاحِدَةٍ .

        অর্থাৎ, "তোমাদের সকলের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একই সত্তার সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের মতই।"

        বলাবাহুল্য, পুনরায় সৃষ্টি দ্বিতীয় সূচনা। সুতরাং এটা প্রথম সূচনার মতই সম্ভবপর।

        দ্বিতীয় মূলনীতি, মুনকার নকীরের প্রশ্নকে সত্যায়ন করা ওয়াজেব। এটি বিবেকের দৃষ্টিতেও সম্ভবপর। কেননা, এতে জরুরী হয় যে, জীবন পুনরায় এমন এক পর্যায়ে পৌছে যাবে, যেখানে সম্বোধন করা সম্ভবপর। এতে আপত্তি করা যায় না যে, মৃত ব্যক্তির অঙ্গসমূহ স্থির থাকে এবং মুনকার নকীরের প্রশ্ন শুনতে পায় না। কেননা, নিদ্রিত ব্যক্তিও বাহ্যতঃ স্থির থাকে, কিন্তু অভ্যন্তরে এমন কষ্ট ও স্বাদ অনুভব করে, যার প্রভাব জাগ্রত হওয়ার পরও অব্যাহত থাকে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত জিব্রাঈলের কথাবার্তা শুনতেন এবং তাঁকে দেখতেন। কিন্তু যারা তাঁর সঙ্গে থাকত তারা শুনত না এবং দেখত না। এমনকি কিছু জানতেও পারত না।

        তৃতীয় মূলনীতি, কবরের আযাব শরীয়তে প্রমাণিত। 

         "তাদেরকে অগ্নিতে পেশ করা হয় সকাল-সন্ধ্যায়। যেদিন কেয়ামত কায়েম হবে (বলা হবে), ফেরাউনের বংশধরকে কঠোরতম শাস্তিতে দাখিল কর।"

        রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সকল পূর্ববর্তী মনীষী থেকে বর্ণিত আছে, তাঁরা কবর আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।

        কবরের আযাব সম্ভবপর। একে সত্য বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। মৃত ব্যক্তির খণ্ড-বিখণ্ড অংশ হিংস্র জন্তুদের পেটে এবং পক্ষীদের চঞ্চুতে বিভক্ত হয়ে যাওয়া কবরের আযাব সত্য হওয়ার পরিপন্থী নয়। কেননা, আযাবের ব্যথা প্রাণীর বিশেষ অংশে অনুভূত হয়। প্রাণীর এসব বিক্ষিপ্ত অংশের মধ্যে অনুভব শক্তি সৃষ্টি করে দেয়া আল্লাহ তাআলার কুদরতের অন্তর্ভুক্ত।

         চতুর্থ মূলনীতি মীযান তথা দাঁড়িপাল্লা। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক

বলেন:

وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ.
 অর্থাৎ, "আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করব।"

فَمَنْ تَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ -

        অর্থাৎ, "অতঃপর যার পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। আর যার পাল্লা হাল্কা হবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তারা চিরকাল দোযখে থাকবে।'

        আল্লাহ তাআলার কাছে আমলের মর্যাদা যত বেশী হবে, আমলনামার ওজন তত বেশী হবে। এতে বান্দা তার আমলের পরিমাণ জেনে যাবে এবং সে স্পষ্ট বুঝবে, আল্লাহ তাআলা শাস্তি দিলে তা ন্যায়বিচার হবে এবং সওয়াব দিলে তা হবে অনুগ্রহ।

        পঞ্চম মূলনীতি পুলসেরাত, যা জাহান্নামের উপর নির্মিত এবং চুলের চেয়েও অধিক সূক্ষ্ম ও তরবারির চেয়ে অধিক ধারালো।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

فَاهْدُوهُمْ إِلَى صِرَاطِ الْجَحِيمَ وَقِفُوهُمْ إِنَّهُم مسْئُولُونَ .

        অর্থাৎ, অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত কর এবং তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দাও। নিশ্চয় তারা জিজ্ঞাসিত হবে।" এ পুল সম্ভবপর। তাই একে সত্য বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। যে আল্লাহ পাখীকে শূন্যে উড়াতে সক্ষম, তিনি মানুষকে এ পুলের উপর দিয়ে চালাতেও সক্ষম হবেন।

        ষষ্ঠ মূলনীতি, জান্নাত ও জাহান্নাম আল্লাহ তাআলার সৃজিত। আল্ল্হ তাআলা বলেন:

وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ والْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ .

        অর্থাৎ "তোমরা ধাবিত হও তোমাদের পালনকর্তার মাগফেরাতের দিকে এবং জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীব্যাপী। এটা খোদাভীরুদের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে।”

        "প্রস্তুত করা হয়েছে" শব্দ থেকে জানা যায়, জান্নাত সৃজিত। তাই একে আক্ষরিক অর্থে থাকতে দেয়া ওয়াজেব। যদি কেউ বলে, বিচার দিবসের পূর্বে জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই, তবে এর জওয়াব, আল্লাহ তাআলা যা কিছু করেন তজ্জন্য তার কোন জওয়াবদিহি নেই। বান্দার কৃতকর্মের জওয়াবদিহি আছে।

        সপ্তম মূলনীতি, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পরে সত্যপন্থী ইমাম (শাসক) হলেন হযরত আবু বকর (রাঃ), তাঁর পরে হযরত ওমর (রাঃ), তাঁর পরে হযরত ওসমান (রাঃ) এবং তাঁর পরে হযরত আলী (রাঃ)। তাঁর পরে ইমাম কে হবেন, সে সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সাঃ) অকাট্য কোন কথা বলেননি। যদি বলতেন, তবে তা অবশ্যই সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেত; যেমন বিভিন্ন শহরে তিনি যাঁদেরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁদের বিষয় অজানা থাকেনি। এর তুলনায় ইমামের বিষয়টি আরও অধিক প্রকাশ পাওয়া উচিত ছিল। এটা কিরূপে গোপন রইল? আর যদি প্রকাশ পেয়ে থাকে, তা হলে তা মিটে গেল কিরূপে? আমাদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছল না কেন? সারকথা, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) জনগণের পছন্দের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বয়াতের তরীকায় খলীফা হয়েছেন। যদি বলা হয়, রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর এরশাদ অন্যের জন্যে ছিল, তবে সকল সাহাবায়ে কেরামকে দোষী সাব্যস্ত করতে হয় যে, তাঁরা রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। একমাত্র রাফেযী সম্প্রদায় ছাড়া কেউ এ ব্যাপারে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেনি। আহলে সুন্নতের আকীদা হচ্ছে, সকল সাহাবীকে ভাল বলতে হবে। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূল যেমন তাঁদের প্রশংসা করেছেন, তেমনি প্রশংসা করতে হবে। হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রাঃ): ও হযরত আলী (রাঃ)-এর মধ্যে যে মতপার্থক্য হয়েছে, তা সবই ছিল ইজতিহাদ ভিত্তিক, হযরত মোয়াবিয়ার ক্ষমতালিপ্সার কারণে নয়। হযরত আলী (রাঃ) ধারণা করেছিলেন, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ঘাতকদেরকে আমীর মোয়াবিয়া (রাঃ)-এর হাতে সোপর্দ করার পরিণতিতে গোলযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ, তাদের গোত্রের লোক সংখ্যা অনেক বেশী এবং সেনাবাহিনীতে মিশে রয়েছে। তাই অপরাধীদেরকে সোপর্দ করার বিষয়টি তিনি বিলম্বিত করা উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন। অপর দিকে হযরত আমীর মোয়াবিয়া (রাঃ) মনে করেছেন, এত বড় অন্যায় সত্ত্বেও অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারটি বিলম্বিত করার অর্থ তাদেরকে প্রশ্রয় দেয়া এবং এই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের সমর্থন করা। বড় বড় আলেমগণ বলেন, প্রত্যেক মুজতাহিদই সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন, তবে সত্যে উপনীত হন একজনই। হযরত আলী (রাঃ) ভুলের উপর ছিলেন- একথা কোন আলেম বলেন না।

        অষ্টম মূলনীতি, সাহাবায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠত্ব খেলাফতের ক্রমানুযায়ী। কেননা, আল্লাহ তাআলার কাছে যা শ্রেষ্ঠত্ব, সেটাই বাস্তব শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহ তাআলার কাছে শ্রেষ্ঠত্ব কোন্টি এটা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভবপর নয়। সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসায় অনেক আয়াত ও হাদীস বর্ণিত আছে। শ্রেষ্ঠত্বের সূক্ষ্ম বিষয়াদি এবং ক্রম তাঁরাই জানেন। যাঁরা কোরআনের অবতরণ প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা শ্রেষ্ঠত্বের এ ধারাবাহিকতা না বুঝে থাকলে খেলাফতকে এভাবে সাজাতেন না। কেননা, তাঁরা আল্লাহ তাআলার কাজে কোন ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনার পরওয়া করতেন না এবং কোন বাধাই তাঁদেরকে সত্য পথ থেকে বিরত রাখতে পারত না।

        নবম মূলনীতি, মুসলমান, বালেগ, বুদ্ধিমান ও স্বাধীন খলীফা হওয়ার জন্যে পাঁচটি শর্ত: পুরুষ হওয়া, পরহেযগার হওয়া, আলেম হওয়া, স্বাবলম্বী হওয়া ও কোরায়শী হওয়া। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: الأئمة من قريش অর্থাৎ, খলীফা কোরায়শদের মধ্য থেকে হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই পঞ্চগুণসম্পন্ন অনেক লোক বিদ্যমান থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তি খলীফা হবেন। যেব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের বিরোধিতা করে, সে বিদ্রোহী।

        দশম মূলনীতি, খোদাভীরু এবং আলেম না হয়েও যেব্যক্তি খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকে, তাকে পদচ্যুত করলে যদি জনগণের জন্যে অসহনীয় ফেতনা দেখা দেয়, তবে আমরা বলব, তার খেলাফত বৈধ। কেননা, তাকে পদচ্যুত করার পর অন্য কেউ খলীফা হবে কিংবা খেলাফতের পদ শূন্য থাকবে। অন্য কেউ খলীফা হলে ফেতনা সৃষ্টি - হওয়ার কারণে মুসলমানদের যে ক্ষতি হবে তা বর্তমান খলীফার মধ্যে কিছু শর্তের অনুপস্থিতির ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশী হবে। বলাবাহুল্য, অধিক উপযোগিতা লাভের খাতিরেই এসব শর্ত। এখন অধিক উপযোগিতা অর্জিত না হওয়ার ভয়ে মূল উপযোগিতা হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পক্ষান্তরে খেলাফতের পদ শূন্য থাকলে শাসনকার্য অচল হয়ে পড়বে। তাই পূর্বাবস্থা বহাল থাকাই সঙ্গত।

        মোট কথা, উপরোক্ত চারটি স্তম্ভে বর্ণিত চল্লিশটি মূলনীতিই হচ্ছে আকায়েদ। কেউ এগুলো বিশ্বাস করলে সে আহলে সুন্নতের অনুসারী এবং বেদআতী সম্প্রদায় থেকে আলাদা থাকবে। আমরা দোয়া করি- আল্লাহ স্বীয় তওফীক দ্বারা আমাদেরকে সত্যের উপর কায়েম রাখুন এবং স্বীয় অনুগ্রহ ও কৃপায় আমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করুন।

Post a Comment

0 Comments