আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির যিনি সেরা, বা শারীরিক গঠন যার নূরে সারা জাহান পয়দা, তাঁর সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা কোন মানুষের জানা নেই। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর কুদরতী হাতের পরশে অন্তরের প্রেমের জ্যোতিতে যাকে সৃষ্টি করলেন তাঁর সৌন্দর্য মুগ্ধ নয়নে প্রত্যক্ষ করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। তথাপি সাহাবীগণ, নবীর প্রেমের পাগলগণ তার দৈহিক অবয়বের একটা রূপ রেখা অঙ্কন করেছেন যা আশেকে রাসূলগণের জন্য অমূল্য সম্পদ।
রাসূলুল্লাহ (স)-এর সৌন্দর্যকে সাহাবীগণ পূর্ণিমা চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। তাও যথার্থ হয় না। কারণ চাঁদ, সূর্য সমস্ত কিছুই তাঁর নূরে সৃষ্ট। তিনি সমস্ত সৌন্দর্যের উৎস। অন্যান্য সকল সৃষ্টির সৌন্দর্য তাঁর সৌন্দর্যের মুখাপেক্ষী তাঁরই সৌন্দর্যের অংশ। অংশ কি কখনও উৎসের সমকক্ষ হতে পারে? অংশ কি কখনও উৎসের উপমা হতে পারে? না, সমকক্ষও হতে পারে না, উপমাও হতে পারে না, তথাপি জগতবাসীর অবগতির জন্য ভাষার মাধ্যমে অংশের সৌন্দর্য হতে উপমা গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (স) -এর জামাস বর্ণনা করতে হয়েছে।
হযরত যাবের ইবনে ছামরা (রা) বর্ণনা করেন, "আমি এক জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (স) কে দেখলাম। সে সময় তাঁর পরিধানে লাল রঙের লুঙ্গী ও লাল রঙের চাদর ছিলো। আমি একবার হুজুর (স) এর দিকে তাকাই আর একবার চাঁদের দিকে তাকাই, অবশ্যই তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর।"
পূর্ণিমা রাত্রের উজ্জ্বল চাঁদের মত তাঁর পবিত্র দেহখানি ঝলমল করত। তিনি অতি দীর্ঘকায় ছিলেন না, আবার খর্বকায়ও ছিলেন না। তিনি মধ্যম আকৃতির পুরুষ ছিলেন। বহু দণ্ডায়মান জন সমাবেশে দাঁড়ালে তাঁর শির মোবারক সকলের উর্ধ্বে দৃষ্টিগোচর হত। মধ্যম আকৃতির হওয়াসত্ত্বেও এরূপ দৃষ্ট হওয়া তাঁর একটা মস্ত বড় মুজেজা।
পবিত্র শির মোবারক মানান মত বড় ছিল। কেশরাজি সামান্য কুঞ্চিত মসৃন ছিল। আপনা আপনি সিঁথি প্রকাশ পেলে রেখে দিতেন- নচেৎ সিঁথি কাটতেন না। মস্তকের কেশরাজি কানের নিম্নভাগ পর্যন্ত ঝুলতে ছিল। কখনও বা কাধের মধ্যস্থল পর্যন্ত ঝুলে পড়ত। তাঁর পবিত্র চেহারা মোবারক একেবারে গোল ছিলনা, কিঞ্চিত গোলাকৃতির ছিল। উন্নত তীক্ষ্ণ নাসিকাটিতে নূরের চমক ভেসে উঠত। হঠাৎ দেখলে তাঁকে বৃহৎ নাসিকা বিশিষ্ট মনে হত। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হত। রাসূলুল্লাহ্ (স) এর ললাট ছিল প্রশস্থ। ভ্রুযুগল পৃথক পৃথক ছিল না, সম্মিলিত ছিল। দুই ভ্রূর মধ্যখানে একটা শির রেখা ছিল যাহা ক্রোধের সময় প্রকাশ পেত। চক্ষু তারকা ঘনকৃষ্ণ বর্ণ ছিল। পবিত্র দাঁড়ি ঘন ও ভরপুর ছিল। গগুদ্বয় সমতল ও হালকা ছিল। মুখ বিবর মানান মত প্রশস্ত ছিল। দন্তরাজী চিকন উজ্জ্বল সম্মুখেরদন্তদ্বয়ের মধ্যখানে ফাঁক ছিল। যখন কথা বলতেন তখন মনে হত সম্মুখের দন্তরাজীর মধ্য হতে নূরের ঝলক বের হয়ে আসছে।
রাসূলুল্লাহ (স) এর ছিনা মোবারক প্রশস্ত ছিল। পবিত্র দেহে অধিক লোম ছিল না। ছিনা হতে নাভীদেশ পর্যন্ত লোমের একটা সরু রেখা ছিল। বাহু স্কন্দ ও বক্ষদেশে লোমশ ছিল। ছিনা ও উদর সমতল ছিল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযোগ অস্থিগুলো স্কুল ও দৃঢ় ছিল। অনাবৃত অবস্থায় পবিত্র দেহখানি উজ্জ্বল ও চমৎকার দৃষ্ট হত।
কনুই হতে হাতের নিম্নভাগ মানান মত দীর্ঘ, হস্তদ্বয় প্রশস্ত, হাতের তালু ও পায়ের পাতাদ্বয় পুরু মাংসল ছিল। হস্ত পদের আঙ্গুলগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ দীর্ঘ ছিল। পায়ের তালু কিঞ্চিত গভীর ছিল। পায়ের পাতা এমন মসৃণতাযুক্ত সমতল ছিল যে, উহাতে পানি লেগে থাকত না। পানি লাগার সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে যেত। যখন হাঁটতেন সবলে কদম উঠিয়ে সম্মুখ দিকে সামান্য ঝুকে চলতেন। একটু লম্বা লম্বা গা ফেলে কিঞ্চিত বেগে এমনভাবে হাঁটতেন যেন কোন উচ্চস্থান হতে অবতরণ করছেন।
মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (স) এর পবিত্র দেহ মোবারকের বং চুনের মত শুভ্রও ছিলনা, আবার সম্পূর্ণ গম রং বিশিষ্টও ছিল না। বরং, তিনি লাবণ্যময় রক্তিমাভাযুক্ত উজ্জ্বল গম রং বিশিষ্ট ছিলেন। তাঁর হুলিয়া বর্ণনাকারীগণ সকলেই এক বাক্যে এই মন্তব্য করেছেন যে, "আমি তাঁর মত এমন সুন্দর আর কাউকে দেখিনি।" অতএব, তিনি স্বীয় গুণাবলীর হিসেবে যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন অদ্রূপ দৈহিক সৌন্দর্যের দিক দিয়েও অতুলনীয়, অদ্বিতীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। হঠাৎ কেউ দেখলে সভয়ে সম্ভ্রমে নত শির হয়ে যেতেন।
যে কেউ মেলা-মেশা করে পরিচয় পেতেন, শুনে মুগ্ধ ও মহব্বতে আত্মহারা হয়ে যেতেন।
0 Comments