নুরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বয়ান

        অনন্ত অসীম প্রেমময় আল্লাহ্। তাঁর কুদরত, তাঁর হেকমত, তাঁর ছিফত অগণিত অসীম। তাঁর অনন্ততা ও অসীমতা মানবীয় জ্ঞানের অতীত। মানবীয় জ্ঞান সসীম, তার চিন্তায় পরিসর সংকীর্ণ। সেই মানুষ কি করে বুঝবে তার স্রষ্টার অসীম কুদরত ও হেকমতের কথা? সে সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন-সপ্ত সাগর হত কালি, বৃক্ষজগত আর কলম, লিখত যদি অনন্ত কাল, না হত তার গুণ খতম।

        অর্থাৎ এমতাবস্থায়, আল্লাহর মহাশক্তি ও কুদরতের সম্মুখে আত্ম-সমর্পন ব্যতীত গত্যান্তর নেই। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা দয়া-পরবশ হয়ে কাউকে কোন বিশেষ জ্ঞান দান করলে তার জন্য আল্লাহর নিকটই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক, নিজের বাহাদুরী করার কিছু নেই। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহম্মদ মুযতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা'আলা অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন। কালাম পাকের বিভিন্ন অধ্যায়ে এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ

         (১) নিশ্চয় আমি আপনাকে 'কাওসার' অর্থাৎ অনন্ত কল্যাণ দান করেছি। সূরা কাওসার-১

         (২) এবং নিশ্চয় আপনার জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরষ্কার। সূরা কুলম-৩ 

        এত নেয়ামত লাভ করেও তিনি কখনও অহংকার করেন নি। সর্বাবস্থায় তাঁর প্রাণ ছিল বিনয়ে বিগলিত, এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদিস হতেই প্রমাণিত হয় তিনি কেমন নিরহংকার বিনয়ী ছিলেন:

        হযরত যাবের (রা) বলেন রাসূল (স) বলেছেন- আমি সকল রাসূলের পরিচালক, সকল নবীগণের শেষ এবং আমি প্রথম শাফায়াতকারী এবং শাফায়াতের অনুমতি প্রাপ্ত, এতে আমার কোন অহংকার নেই। (মিশকাত শরীফ)

         অতএব, আমরা ফখর করবো না। ফখর করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলার জন্যই সংরক্ষিত। তবে সত্য প্রকাশের জন্য, দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর কুদরত, হিকমত, ছিফত অবহিত করার জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন ততটুকু করব, যা বলা প্রয়োজন তা বলব। 

         আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুযতবা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্ তা'আলার সর্ব প্রথম সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টির পূর্বে চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আকাশ-বাতাস কিছুই ছিল না। মহাবিশ্বের সর্বত্র জুড়ে শুধু মহা প্রভুর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁকে দেখার কেউ ছিল না, তাঁর কথা শোনার কেউ ছিল না। তাঁর প্রশংসা করার কেউ ছিল না। তাঁর আদেশ পালন করার কেউ ছিল না। আল্লাহ প্রকাশিত হতে ইচ্ছে করলেন। তাই তিনি নুরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করলেন প্রকাশ হওয়ার মাধ্যম হিসাবে। নিম্নোক্ত হাদিসে কুদসিসমূহে এ সম্বন্ধে আল্লাহ্ পাক যথেষ্ট আলোকপাত করেছেন।

        (১) আল্লাহ্ বলেন, "আমি ছিলাম গুপ্ত ধনভাণ্ডার, তৎপর প্রকাশিত হতে ইচ্ছা করলাম, এবং নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টিকে সৃজন করলাম।" (সিররুল আসরার)

        (২) আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই'হে ওয়া সাল্লামকে স্বীয় কুদরতী মুখ-মণ্ডলের জ্যোতি হতে সৃষ্টি করেছি। হে মোহাম্মদ। আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি আকাশমণ্ডল সৃষ্টি করতাম না এবং আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি বিশ্বের প্রতিপালন বিধান প্রকাশ করতাম না। (সিরুল আসরার)

        (৩) রাসূলুল্লাহ (স) এরশাদ করেন "সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা'আলা আমার রূহ সৃষ্টি করেছেন, সর্বাগ্রে আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। (সিররুল আসরার)

        (৪) রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেন, "আমি আল্লাহ তা'আলার নূর এবং প্রত্যেক বস্তু আমার নূর হতে সৃষ্ট হয়েছে।" (মুসলমানী জিন্দেগী)

        কুতুবে সোবহানী মাহবুবে রব্বানী গাউসুল আযম শাইখ সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী (র) স্বীয় গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সানা ও ছিফত নিম্নোক্ত ভাবে বর্ণনা করেছেন:

        "ইয়া আল্লাহ! রাসূলুল্লাহ্ (স) হচ্ছেন আপনার দৃষ্টিস্থল। তিনি সমস্ত সৃজনের উপর আপনার রহমতের মাধ্যম। উচ্চ স্থানীয় ফেরেস্তা তাঁর হাকিকত উপলব্ধি করতে অক্ষম। তিনি দ্বিজগতের সমস্ত দেহের রূহ ও জীবন। আপনার সৃজনের সমস্ত উৎসের উৎস। তাঁর নূর সমস্ত সৃজনের অগ্রবর্তী, তাঁর বিকাশ সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত। আপনার দরবারে দ্বারপাল, সৃজনের। প্রতি আপনার দানের উৎস। তাঁর নূর সমগ্র সৃজনভেদী তাঁর কালব সর্বব্যাপী। তাঁকে আপনি আপনার সৃষ্ট নূর হতে সৃজন করেছেন এবং আপনার সমস্ত আসমা ও সিফতের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর নূর হতে আম্বিয়া আলাইহি ওয়াসাল্লামগণকে সৃজন করেছেন। এবং তিনি হচ্ছেন অস্তিত্বের মূলাধার, প্রত্যেক বস্তুর জীবন, সমস্ত স্থায়িত্বের মূল, আদীর আদী, অন্তের অন্ত।" (হাকীকতে মোহাম্মদী পৃ. ২৭) 

        ইমামে রাব্বানী শাইখ আহম্মদ মোজাদ্দেদে আলফে সানী সেরহিন্দী (র) তাঁর মাতুবাতদ -তৃতীয় খণ্ডের ২৩১ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ

        "হাকীকতে মুহাম্মদী (স) বিকাশের দিক দিয়ে সর্বপ্রথম এবং সমস্ত হকিকতের হকিকত। সমস্ত আম্বিয়া (আ) গণ এবং উচ্চ পদস্থ ফেরেস্তা (আ) গণের হাকিকত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) এর হাকিকতের প্রতিচ্ছায়া মাত্র এবং তিনিই সমস্ত হাকিকতের ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন, "সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা'আলা যা সৃজন করলেন তা ছিল আমারই নূর।" আমি আল্লাহর সৃষ্ট নূর হতে এবং সমস্ত ঈমানদারগণ আমার নূর হতে বহির্গত।" অতএব ইহা সুনিশ্চিত যে তার হাকিকত আল্লাহ্ তা'আলা এবং অন্যান্য যাবতীয় হাকিকতের মধ্যবর্তী। তার মধ্যবর্তীতা ব্যতীত কারো পক্ষে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব, তিনি সকল রসূল ও নবী (আ) গণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং তাঁর প্রেরিত হওয়া সমস্ত আলমের জন্য রহমত। এই জন্য সমস্ত নবী (আ) গণ তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স) এর অনুগতা ও তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিলেন। (হাকিকতে মোহাম্মদী পূঃ ৫৭) 

        উল্লেখিত হাদিসসমূহ ও ওলী আল্লাহ্ গণের অভিজ্ঞতা খারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (স) ই সমগ্র সৃষ্টির আদি।

         দুঃখের বিষয় আজকাল একশ্রেণীর ওলামা নামধারী ব্যক্তিবর্গ নূর সম্পর্কিত হাদিসসমূহে সন্দেহ পোষণ করছেন। তারা এ হাদিসসমূহকে মওজু, যয়িফ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করছেন। তাদের নিকট আমার জিজ্ঞাসা আপনারা কি গাওছুল আযম বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (র) হতেও বড় আলেম হয়ে গেছেন? আপনারা কি মুজাদ্দেদে আলফেসানী (র) অপেক্ষা ও অধিক জ্ঞানী হয়ে গিয়েছেন।আপনারা কি শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী (র)-র চেয়েও বড় মুহাদ্দেস হয়ে গেছেন। উল্লিখিত ওলামাবৃন্দ ও আরও অনেক শক্তিশালী সাহেবে কাশফ ওলামাবৃন্দ এই সমস্ত হাদিসের সত্যতা যাচাই বাছাই-করে তাদের পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন। আর আপনারা তাদেরকে বেকুব বানাবার কোশেশ করছেন। 

        এই উদ্ধ্যত্যপূর্ণ বেয়াদবীর কারণেই আজ মুসলিম মিল্লাত কাফের মোশরেকদের নিকট মার খাচ্ছে। ত্রুটিপূর্ণ আকীদার কারণে মুসলিম মিল্লাত কাফের মোশরেকদের সেবাদাসে পরিণত হচ্ছে। সময় থাকতে সতর্ক না হলে, যথা সময়ে পরিশুদ্ধ ঈমান গ্রহণ না করলে দুনিয়া-আখেরাত সব বরবাদ হয়ে যাবে। 

        প্রশ্ন হতে পারে আল্লাহ্ কেন তার প্রিয়তম সৃষ্টিকে গোপন রাখলেন। তাঁকে কেন প্রথম নবীর মর্যাদা দিলেন না। তাঁকে কেন সর্বশেষ নবীরূপে প্রেরণ করলেন। তাঁকে সর্বপ্রথম নবীরূপে প্রেরণ করলে কী অসুবিধা হত।

         এসব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র আল্লাহই জানেন। মানবীয় চিন্তায় কিংবা যুক্তিতে জানেক কারণ বা যুক্তি প্রদর্শন করা যায়। তবে তার যথার্ততা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (স)-কে সর্বশেষ নবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছে, সেহেতু আমরা তাঁর শেষ নবীর বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম নিয়েই আনন্দিত। তিনি যদি সর্বপ্রথম নবীরূপে প্রেরিত হতেন তখন আমরা প্রথম নবীর মর্যাদা নিয়েই গর্ববোধ করতাম। মূলকথা, আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর ইচ্ছাকেই সর্বাবস্থায় স্বাগতম জানাই।

        তবে একথাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রূহানী জগতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) সর্বপ্রথম নবীর মর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছেন এবং বস্তুজগতে তিনি সর্বশেষ নবীরূপে প্রেরিত হয়েছেন।

         রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, অর্থাৎ যখন আদম (আ) এর অস্তিত্ব পানি এবং মাটির মধ্যে ছিল তখনও আমি নবী ছিলাম। আমি আল্লাহর নিকট শেষ নবী রূপে নির্ধারিত ছিলাম যখন আদম (আ) মাটি দর্নাম গঠিত হচ্ছিলেন।

        যখন আদম (আ) রুহ ও শরীরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন তখনও আমি নবী ছিলাম। এইরূপে প্রমাণিত হয় যে আল্লাহতালা তার হাবিবকে রূহানী জগতে সর্বপ্রথম নবীর মর্যাদা দান করেছেন আর বস্তু জগতে তিনি সর্বশেষ নবীরূপে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বড় মেহেরবানী করে তাকে উভয় জগতে বিশেষত্ব দান করে মহিমান্বিত করেছেন। এ কারণে নবী করীম (স)-এর পবিত্র অন্তকরণ কৃতজ্ঞতায় অমিয় বারিতে সিক্ত হয়েছে। তিনি অহংকার করেন নি। (হাকিকতে মোহাম্মদী-৬১)

        খাছায়েছে কোবরা কিতাবে বর্ণিত আছে, হযরত আদম স্বীয় পুত্র শীষ (আ) কে নিম্নরূপ উপদেশ দিয়েছিলেন। হে আমার প্রিয় পুত্র, তুমি আমার পর আমার খলিফা হবে। উক্ত খিলাফত তুমি পরহেজগারী ও দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর। তুমি যে কোন সময় আল্লাহ তা'আলার নাম উচ্চারণ করবে, সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামও উচ্চারণ করবে। কেননা যে সময়ে আমার খামিরযুক্ত মৃন্ময় দেহে প্রাণবায়ু প্রবেশ করেছিল সেসময় তাঁর নামটি আরসের পাদদেশে দর্শন করেছিলাম। তৎপর আমি আসমামসমূহ ভ্রমণকালে প্রত্যেক স্থানে তাঁর নাম অঙ্কিত দেখেছিলাম। তারপর আল্লাহ্আমাকে বেহেশতের মধ্যে স্থান দান করলেন। আমি উহার প্রত্যেক কক্ষে ও অট্টালিকায়, হুরদের বক্ষস্থলে, তুবা ও কুল বৃক্ষের প্রত্যেক পাতায়, পরদাসমূহের প্রতিপ্রান্তে ও ফেরেস্তাদের ললাটে তাঁর নাম লিখিত দেখেছিলাম। (মিলাদে মোস্তফা-১৫/১৬)

         নছবনামা নিয়ে আইয়ামে জাহিলিয়াত যুগে তুমুল প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত। কবিতা প্রিয় আরব জাতি কবিতার ছন্দে ছন্দে নিজেদের বংশের গৌরবগাথা নেচে-গেয়ে বয়ান করত। কখনও কখনও অন্য বংশের দুর্নাম করত। এভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হত। রাসূলুল্লাহ্ (স) ঐ সমস্ত বদ রুসম সমূলে উৎপাটন করে দিলেন। এজন্যই যখনই তিনি নিজ বংশের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন সঙ্গে সঙ্গে একথা দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোণা করেছেন, "ইহাতে কোন প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, ইহাতে কোন ফখর নেই, ইহা (নহায়েত সত্য প্রকাশের জন্য বয়ান করা হল।"

        মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (স) ই আদি সৃষ্টি। কুল মাখলুকাত সৃষ্টির উৎস। সকল বংশের মূল কেন্দ্র। তথাপি বিকাশের ধারাবাহিকতায় তিনি সর্বশেষ পয়গাম্বর। তাই তাঁকে একটা বংশকে আশ্রয় করেই বিকাশ লাভ করতে হয়েছে। এই ধারাবাহিকতাটাও যে কত পুতপবিত্র, কত নিখুঁত, কত মহিমা মণ্ডিত তা প্রকাশের জন্যই এ অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছে। 

        এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর নিম্নোক্ত হাদিস সমূহ উল্লেখ করা যেতে পারে : ১। রাসূলুল্লাহ (স) এরশাদ করেন, "আমি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মোত্তালিব। আল্লাহ্ মাখলুক (জ্বিন ও ইনসান) সৃষ্টি করলেন এবং আমাকে উত্তম দলভুক্ত (ইনসান) করলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে দুই দলে- আরব ও আযমে (অনারব) বিভক্ত করলেন এবং আমাকে উত্তম দলভুক্ত (আরব) করলেন। তারপর তিনি তাদেরকে কবিলায় পরিণত করলেন এবং আমাকে উত্তম কবিলাভুক্ত (কোরাইশ) করলেন। তারপর তিনি তাদেরকে বংশে পরিণত করলেন এবং আমাকে উত্তমটির (হাশিম বংশের) অন্তর্ভুক্ত করলেন। সুতরাং, আমি গুণে তাদের সকলের শ্রেষ্ঠ এবং বংশে সর্বাপেক্ষা মহান।"

        ২। "আমি আদম সন্তানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং ইহা গর্ব নহে।"

        ৩। নিশ্চয় আল্লাহ্ ইসমাঈলের (আ) আওলাদদের মধ্যে কানানা বংশকে মনোনীত করেছেন এবং কানানা বংশের মধ্যে কোরাইশকে মনোনীত করেছেন এবং কোরাইশ এর বংশের মধ্যে বনি হাশিমকে মনোনীত করেছেন এবং ধনি হাশিমেও মধ্যে আমাকে মনোনিত করেছেন।"

        ৪। "আদম (আ) হতে আমার মাতা-পিতা পর্যন্ত কাউকে জাহেলিয়াতের কলঙ্ক পূর্ণ করেনি।"

        নুরে মোহাম্মদীর তাজাল্লিতে রাসূলুল্লাহ্ (স) এর সকল উর্ধ্বতন পুরুষদের চেহারা দিপ্তীময় থাকত। ঐ রকম দিন্তী অন্য কারো মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি।

        তাঁরা ছিলেন সর্বত্র সম্মানিত ও সমাদ্রিত। যাঁরা তাঁর নূর বহন করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন তাঁরা সকলেই শিরক মুক্ত ছিলেন। [দ্রষ্টব্য: সাইয়্যেদুল মুরছালিন।।

        পাক কালাম কোরআনুল করীম ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে অবগত হওয়া যায়, হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ্ (আ) হচ্ছেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) এর উর্ধ্বতন পুরুষ। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) হচ্ছেন হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর দোয়ার ফলশ্রুতি।

        প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে মেসোপোর্টেমিয়ার অন্তর্গত বাবেল নগরে ইব্রাহিম (আ) এর জন্ম। পৌত্তলিকতা ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রধর্ম। পৌত্তলিকতার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত সম্রাট নমরুদ নিজেকেই 'রব' বা প্রতিপালক হিসাবে দাবী করত। নমরুদ জ্যোতিষীদের মাধ্যমে অবগত হল শীঘ্রই তারই রাজ্যে তার শত্রু জন্ম লাভ করবে। সে নমরুদকে রব বা প্রতিপালক বলে স্বীকার করবে না। শত্রুকে অঙ্কুরেই খতম করার এক মহাপরিকল্পনা করল নমরুদ। রাজ্যময় জন্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হল। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীন মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক আল্লাহ জাল্লাশানুহু এর মহাপরিকল্পনার সম্মুখে নমরুদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। আল্লাহর খলিল হযরত ইব্রাহিম (আ) জন্মলাভ করলেন। প্রায় ৭/৮ বৎসর পর্যন্ত নমরুদ জানতেই পারেনি তাঁর জন্মের খবর। বাল্য বয়সেই ইব্রাহিম (আ) পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠলেন। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা বিবৃতি ও যুক্তি প্রদর্শন করতে লাগলেন। তাঁর তীক্ষ্ণধার যুক্তির সম্মুখে নমরুদের শোচনীয় পরাজয় ঘটল। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতেই নমরুদ ইব্রাহিম (আ) কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করল। ঈমানের বলে মহাবলীয়ান ইব্রাহিম (আ) অগ্নিকুণ্ড হতে বাঁচার কোন আগ্রহই দেখালেন না। এমনকি আল্লাহর নিকটও প্রার্থনা করলেন না। যেহেতু আল্লাহ শ্রবণকারী মহাজ্ঞানী। তাঁর অজ্ঞাত কিছুই নেই। কাজেই শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার নিকট ইব্রাহিম (আ) আত্মসমর্পণ করলেন। আল্লাহর হুকুমে অগ্নিকুণ্ড শান্তিদায়ক পুষ্পোদ্যানে পরিণত হল। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইব্রাহিম (আ) খলীল উপাধিতে ভূষিত হলেন।

        হযরত ইব্রাহিম (আ) একবার মিশর এলেন। মিশররাজ তার পরমা সুদর্শনা কন্যা হাজেরাকে ইব্রাহিম (আ) এর সঙ্গে বিবাহ দিলেন। হাজেরার গর্ভে জন্ম নিলেন ইসমাঈল (আ)। তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ছিলেন বন্ধ্যা। তার (সারার) অন্তরে সপত্নীসুলভ মনোভাবের কারণে হাজেরার উপর নির্যাতন হতে লাগল। আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ) শিশুপুত্র ইসমাঈলসহ হাজেরাকে নির্বাসন দিলেন আরবের এক ধূসর মরু প্রান্তরে, বর্তমান কাবা প্রাঙ্গনে। এই মরু প্রান্তরের নির্জনতা, নিস্তব্ধতা ও বিশুষ্কতা উপেক্ষা করে হযরত ইসমাঈল (আ) আল্লাহর অপার অনুগ্রহে কৈশোরে পদার্পণ করলেন। শুরু হল আল্লাহর আর এক মহাপরীক্ষা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইব্রাহিম (আ) প্রিয়তম পুত্রের গ্রীবায় চালালেন তীক্ষ্ণধার খঞ্জর। বিবি হাজেরা আল্লাহর রেজামন্দী হাসিলের জন্য একমাত্র পুত্রকে স্বামীর হাতে সঁপে দিলেন। আর ইসমাঈল নিশঙ্ক চিত্তে স্বীয় কণ্ঠ উন্মুক্ত করেছিলেন পিতার তরবারীর নীচে। ঈমানের ও প্রেমের এক অবিস্মরণীয় পরীক্ষায় কামিয়াব হলেন আল্লাহর এই তিন প্রেমিক। ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ), ইসমাঈল জবিহউল্লাহ আর হাজেরা। এই তিন প্রেমিকের রক্তের ও বংশের ধারা পরিলক্ষিত হয় হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহাম্মদ মুযতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম-এর নছব নামায়।

        হযরত ইব্রাহিম (আ) অগ্নিকুণ্ডের মহাপরীক্ষায় চরম ঈমানী কুয়ত প্রদর্শন করেছেন। অগ্নিশিখার ভয়াবহতা তাঁকে সামান্যতম বিচলিত করতে পারেনি। আর মা হাজেরা। মিশর সম্রাটের পুষ্পোদ্যানের (সুবাসিত) হাসনাহেনা, রাজকীয় বিলাস ব্যসনে লালিত রাজকন্যা। সপত্নীর অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও কোন অভিযোগ নেই। তারপরও শিশু ইসমাঈল (আ)-কে বুকে নিয়ে নির্জন মরু প্রান্তরে নির্বাসিতা অবস্থায়ও চরম সহিষ্ণুতা ও ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। যে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে তিনি বিগত ৮/১০ বৎসর হৃদয়ের সমুদয় মাধুরী দিয়ে প্রতিপালন করে আসছিলেন আজ তাঁকেই আল্লাহর (রাহে) কুরবানী করতে স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে সর্বহারা হয়ে গেলেন।

        আর বালক ইসমাঈল! গ্রীবা উন্মুক্ত করে দিলেন পিতার শানিত খঞ্জরের তলদেশে। মহাপ্রভুর সাথে মহা মিলনের প্রেরণায় বিভোর বালক হৃদয় কম্পিত হয়নি তিল পরিমাণ। ত্যাগের মহিমায় ভাস্মর এই পিতা পুত্র মাতাকে অবলোকন করতে থমকে দাঁড়াল বিশ্ব প্রকৃতি। আকাশ কাঁদলো, বাতাস কাঁদলো, কাঁদলো সারা মাখলুকাত। 

        এই তিন মহতীর মিলিত শোণিত ধারায় জন্মলাভ করেছেন আমাদের প্রাণের রাসূল মুহাম্মদ মোস্তফা আহম্মদ মুযতবা (স)। এমন পুত পবিত্র নছব নামার অধিকারী আর কেউ আছেন কি? না, না, আর কোন মানব কিংবা দানব (জ্বীন) এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারেন নি।

        হযরত ইব্রাহিম (আ) মাঝে মাঝে মক্কায় আগমন করে স্ত্রী-পুত্রের খবরা-খবর নিয়ে যেতেন। ইসমাঈল (আ) বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মক্কার যুরহাম গোত্রের মাদারের কন্যা সাঈদার সাথে বিবাহ দিলেন। মক্কায় অবস্থান কালে একদা ইব্রাহিম (আ) কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণের প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হলেন। ওহীর আদেশ অনুসারে তিনি পুত্র ইসমাঈল (আ)-এর সহযোগিতায় কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণ করলেন। নির্মাণ শেষে পিতা পুত্র মিলিতভাবে প্রার্থনা করলেন "েেহ আমাদের প্রভু। আমাদের বংশধরদের মধ্যে হতে একজন রসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদের মধ্যে তোমার বাণী প্রচার করবেন, কিতাব (কুরআন) শিক্ষা দিবেন; জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমি শক্তিমান ও পরমজ্ঞানী। (বাকারা-১২৮-১২৯) 

        আল্লাহ্ তায়ালা ইব্রাহিম (আ) এর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারেই পরবর্তীকালে হযরত ইসমাঈল (আ) এর বংশে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (স) জন্মলাভ করেন।  রসুলুল্লাহ (স) বলেনঃ "আমি "আমি উদ্ধতন পিতা হযরত। হযরত ইব্রাহিম (আ) দোয়ার ফল। 

Post a Comment

0 Comments