বে-নামাযীর আযাব
আল্লাহ তা'আলা জাহান্নামীদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন
-'কোন জিনিস তোমাদের জাহন্নামে প্রবেশ করাল? তারা বলবে, আমরা না নামায় পড়তাম, আর না দরিদ্রদের আহার করাতাম, আর (যারা সত্য দ্বীন বিলুপ্ত করার চেষ্টায় রত ছিল সে) প্রচেষ্টাকারীদের সাথে আমরাও চেষ্টারত থাকতাম।' -সূরা মুদ্দাসের: ৪২-৪৫
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন-
-'বান্দা ও কুফরীর মধ্যে (যোগসূত্র) হলো নামায ত্যাগ করা।' অর্থাৎ নামায ত্যাগ করলে বান্দার কুফ্রীতে ডুবে যেতে দেরী হয় না।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, আমাদের ও তাদের (মোনাফেকদের) মধ্যে যে ওয়াদা রয়েছে, তা হল নামায। সুতরাং যে নামায ত্যাগ করবে, সে (প্রকাশ্যে) কাফের হয়ে যাবে।
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে- مَنْ تَرَكَ الصَّلوةَ مُتَعَمِّدًا فَقَدْ كَفَرُ جِهَارًا -
-'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করল, সে প্রকাশ্যে কুফরী করল।'
হযরত ওবাদা ইবনে ছামেত (রাঃ) বলেন, 'আমার প্রাণপ্রিয় দোস্ত হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ছঃ) একদা আমাকে সাতটি উপদেশ প্রদান করেন। তন্মধ্যে (চারটি হল)- এক. আল্লাহর সাথে শরীক করো না, এমনকি এ জন্য তোমাকে কেউ টুকরা টুকরা করে ফেললে বা আগুনে নিক্ষেপ করলে বা শূলিতে চড়ালেও না। দুই, ইচ্ছাকৃতভাবে কখনও নামায ত্যাগ করো না। কেননা, এরূপ ব্যক্তি দ্বীন ও মিল্লাতের গণ্ডির বাইরে চলে যায়। তিন, আল্লাহর না-ফরমানী ও পাপকর্মে লিপ্ত হয়ো না। কেননা, পাপকর্ম আল্লাহ তা'আলার রোষ ও অসন্তুষ্টির কারণ হয়। চার, মদ্যপান করো না। কেননা, মদ্যপান সব ধরনের পাপের উৎস মূল।
তিরমিযী শরীফে উল্লেখ আছে, 'রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর সাহাবীগণ যাবতীয় আমলের মধ্যে একমাত্র নামায ছাড়া অন্য কোন আমল ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন না।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আরও বলেছেন, 'কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য হয় নামাযের মাধ্যমে; কাজেই যে নামায ছাড়ল সে কুফরী করল।
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, 'যে নামায ছাড়ল, ইসলামে তার কোন হিস্যা নেই। আর যার ওযু সঠিক নয়, তার নামাযও দুরস্ত নয়।'
তাবারানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যার আমানতদারী নেই, তার (পূর্ণ) ঈমান নেই। আর যার নামায নেই তার দ্বীন নেই। বস্তুতঃ দ্বীনের জন্য নামাযের গুরুত্ব এমন, যেমন শরীরের জন্য মাথার গুরুত্ব।
হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ছঃ) আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করো না, এমনকি তোমাকে কেটে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিলে বা আগুনে জ্বালিয়ে দিলে বা শূলিতে চড়ালেও। ফরয নামায পরিত্যাগ করো না; যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ফরয নামায ত্যাগ করবে, তার ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব থাকবে না। মদ্যপান করো না, কেননা, তা সকল পাপকর্মের মূল।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তাঁর দৃষ্টিশক্তি যখন কমে গিয়েছিল, তখন কেউ কেউ তাঁকে বলেছিল, আপনি কয়েকদিনের জন্য নামায ছাড়লে আমরা আপনার চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলতাম। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, 'যে নামায ছাড়বে, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় দেখা করবে যে, আল্লাহ্ তার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ থাকবেন।'
তাবারানী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসূল (ছঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ)। আমাকে এমন কিছু নসীহত করুন, যে অনুযায়ী আমল করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। নবী করীম (ছঃ) বললেন, 'তোমাকে যদি কঠিন শাস্তি প্রদান করা হয় বা আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তবুও আল্লাহর সাথে শরীক করো না। পিতা-মাতার অবাধ্যতা করো না। তারা তোমাকে তোমার ধন-সম্পদ ও স্ত্রী-পরিজন থেকে ভিন্ন হয়ে যেতে বললেও তাদের বাধ্য থাক। ইচ্ছাকৃত কখনও ফরয নামায ছাড়বে না। কেননা, এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত। শরাব পান করো না। কেননা, শরাব সর্ববিধ পাপের মূল। গুনাহ থেকে পরহেয কর, কারণ, তা আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধের কারণ হয়। জেহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করো না, এমনকি ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি দেখা দিলেও না। সাধারণভাবে মৃত্যু মহামারী আকারে দেখা দিলেও তুমি দৃঢ়পদ থাক। সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ কর, তাদের প্রতি শাসনদণ্ড উত্তোলিত রাখতে অবহেলা করো না, তাদের সদা আল্লাহর ভয় দেখাও।
সহীহ ইবনে হেব্বানে বর্ণিত হয়েছে, 'মেঘলা দিনে যথাসময়ে আগে-ভাগে নামায পড়। যে ব্যক্তি নামায ছাড়ল সে কুফরী করল।'
অপর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নামায ছাড়বে, আল্লাহ তা'আলা তার নাম জাহান্নামের দরজায় লেখে দিবেন, যা দিয়ে সে প্রবেশ করবে।'
বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি নামায ছাড়ল তার এরূপ ক্ষতি হল যেমন তার ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু বরবাদ হয়ে গেল।
হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন-
وَاللَّهِ يَا مَعْشَرَ قَرَيْشٍ لَتُقِيمُنَّ الصَّلوةَ وَلَتُؤْتُنَّ الزكوة أو لابْعَثَنَّ عَلَيْكُمْ رَجُلًا فَيَضْرِبُ أَعْنَاقَكُمْ عَلَى الدين -
-'হে কুরাইশ বংশীয় লোকসকল। শুনে রাখ, আল্লাহর শপথ, তোমরা অবশ্যই নামায পড়, যাকাত আদায় কর। অন্যথা তোমাদের উপর এমন লোককে জয়ী করে দেয়া হবে, যে দ্বীনের জন্য তোমাদের হত্যা করবে।'
মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে আছে, আল্লাহ তা'আলা ইসলামে চারটি বিষয় ফরয করে দিয়েছেন, ক. নামায, খ. রমযানের রোযা, গ. হজ্জে বায়তুল্লাহ এবং ঘ. যাকাত। কেউ এগুলো থেকে কোন একটিও পরিত্যাগ করে বাকী তিনটির উপর আমল করলেও কোন কাজে আসবে না, যে পর্যন্ত সে সব কয়টি বিষয়ের উপর আমল না করবে।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর যুগ থেকে সকল তত্ত্বজ্ঞানী এ ব্যাপারে একমত, 'বিনা ওধরে কেউ নামায আদায় না করে সময় পার করে দিলে সে কাফের।'
হযরত আইয়ুব (রঃ) বলেন, 'নামায ত্যাগ করা কুফরী-এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।' আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন-
-'তাদের পরে এমন অনুপযুক্ত লোক জন্মালো, যারা নামায বিনষ্ট করে দিল এবং নফসের অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই বিপদ প্রত্যক্ষ করবে। অবশ্য যারা তওবা করেছে।' -সূরা মারইয়াম : ৫৯
ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, 'উক্ত আয়াতে উল্লিখিত أضاعوا শব্দের অর্থ একেবারে নামায ছেড়ে দেয়া নয়; বরং এর অর্থ নামাযের নির্দিষ্ট সময় পার করে দেয়া-এমন ব্যক্তিদের জন্যই উপরোক্ত আয়াতে শান্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তাবেয়ী হযরত সাঈদ হচ্ছে, তারা নামাযের ব্যাপারে এতই উদাসীন যে, যোহরের সময় পার হয়ে আছরের সময় উপস্থিত হয়ে যায়, অনুরূপ আছর পার হয়ে মাগরিব, মাগরিব পার হয়ে এশা, এশা পার হয়ে ফজর-তবুও তারা নামাযের ব্যাপারে সচেতন হয় না। এহেন অবস্থা থেকে তওবা না করলে। তাদের জন্য উল্লিখিত আয়াতে জাহান্নামের একটি উপত্যকা গাইয়্যেতে পতিত হওয়ার ঘোষণা রয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন-
بايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذكر الله - وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ -
-'হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদের উদাসীন করতে না পারে; আর যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' -সূরা মোনাফেকুন: ৯
উক্ত আয়াতে ذکر দ্বারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায উদ্দেশ করা হয়েছে। যে সকল লোক পার্থিব ধন-সম্পদের মোহে পতিত হয়ে ক্রয়-বিক্রয়ে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে বা পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতার দরুন নামাযে অবহেলা প্রদর্শন করবে, তারা নির্ঘাত ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
পবিত্র কুরআনে আরও এরশাদ হয়েছে-
অতএব বড় সর্বনাশ ওই সকল নামাযীর জন্য যারা নিজেদের নামায ভুলে থাকে।-সূরা মাউন: ৪-৫
হযরত সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'আমি রাসুলুল্লাহ (হঃ)-কে উল্লিখিত আয়াতের মর্ম জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন, এরা হচ্ছে ওইসব লোক, যারা নির্দিষ্ট সময় পার করে নামায পড়ে।'
হযরত মুসআব ইবনে সা'দ (রঃ) বলেন, উক্ত আয়াত সম্পর্কে আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, নামাযে ভুল-ভ্রান্তি বা এদিক-সেদিক চিন্তা থেকে তো আমরা কেউ যুক্ত এই? তিনি বললেন, আয়াতের অর্থ এটা নয়; বরং এ আয়াতে ওইসব লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা নামাযের নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে দেয়। پُل' দ্বারা কঠিন শান্তি বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ' বলেছেন, وّث দোযখের একটি উপত্যকা। পৃথিবীর সব পাহাড়-পর্বত একত্রিত করে তাতে নিক্ষেপ করা হলেও সে উপত্যকার তাপে সবই গলে যাবে। তা হবে নামাযে অবহেলাকারী এবং অসময়ে নামায আদায়কারীদের আবাসস্থল। অবশ্য যারা সত্যিকার তওবা-অনুতাপ করবে এবং অবহেলা পরিহার করবে তারা নাজাত পাবে।
রাসুলুল্লাহ (ছঃ) বলেন-
-'কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার যে আমলের হিসাব নেয়া হবে, তা হল নামায়। নামায সঠিক হলে সে কৃতকার্য ও উত্তীর্ণ হবে। আর নামায ত্রুটিপূর্ণ হলে সে অকৃতকার্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
তাবারানী ও বলেছেন- ইবনে হেব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একদা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) নামায প্রসঙ্গে
-'যে ব্যক্তি নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, কেয়ামতের দিন সে নামায তার জন্য জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তির কারণ হবে। আর যে ব্যক্তি এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে না, তার জন্য তা জ্যোতি, প্রমাণ ও মুক্তির কারণ হবে না। কাজেই কেয়ামতের দিন সে কারুন, ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে থাকবে।'
নামায ত্যাগকারী লোকদের হাশর উপরোক্ত ব্যক্তিদের সাথে এ জন্য হবে, যে ব্যক্তিকে ধন-সম্পদের মায়া-মোহ নামায থেকে দূরে রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় কারুনের সাথে, তাই এরূপ লোকের হাশর হবে তারই সাথে। যে ব্যক্তিকে রাজত্বের মোহ নামায থেকে গাফেল করে রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় ফেরাউনের সাথে, তাই এরূপ লোকের হাশর হবে তারই সাথে। আর যে ব্যক্তিকে চাকরি-বাকরি বা মন্ত্রিত্বের মোহ নামায থেকে উদাসীন করে রেখেছে, তার সামঞ্জস্য হয় হামানের সাথে। তাই এরূপ লোকের হাশর হবে হামানেরই সাথে। তদ্রূপ ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যে রত লোকের সামঞ্জস্য হয় উবাই ইবনে খালফের সাথে, তাই তাদের হাশর হবে তারই সাথে।
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, 'যে ব্যক্তি বিনা কারণে দু'ওয়াক্ত নামায (এক ওয়াক্ত বিলম্বিত করে অপর ওয়াক্তের সাথে) একত্রিত করে পড়ল, সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত হল।' নাসায়ী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'নামাযসমূহের মধ্যে একটি নামায এমন রয়েছে, যে ব্যক্তি তা ছেড়ে দিল, সে এমন ক্ষতিগ্রস্ত হল, যেন তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ সবই বরবাদ হয়ে গেল, তা হচ্ছে আছরের নামায়।'
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, আছরের নামায তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের নিকট পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এর হক রক্ষা করেনি। এখন তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ নামাযের হেফাযত করবে, তাকে দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। এ নামাযের পর তারকা উদিত (সন্ধ্যা) হওয়া পর্যন্ত আর কোন নামায নেই।'
আহমদ, বুখারী ও নাসায়ী শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আছরের নামায ছাড়ল, তার আমল বরবাদ হয়ে গেল।
ইমাম বুখারী (রঃ) হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) প্রায়ই সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করতেন, তোমাদের কেউ কি কোন স্বপ্ন দেখেছ? কেউ যদি কোন স্বপ্ন দেখতেন, তবে তাঁর নিকট বলতেন, যা আল্লাহ্ চাইতেন। একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'রাতে আমার নিকট দু'জন আগন্তুক (ফেরেশতা) আসে। তারা আমকে জাগিয়ে উদ্বুদ্ধ করে বলল, চলুন। আমি তাদের সাথে চললাম। চলতে চলতে আমরা একজন লোকের নিকট উপনীত হলাম, সে কাত হয়ে শুয়ে ছিল। অপর একজন তার নিকট পাথর হস্তে দণ্ডায়মান। সে তার মস্তক লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছে। এতে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে আর পাথর অনেক নীচে গিয়ে পড়ছে। সে আবার পাথরের পিছনে পিছনে গিয়ে পাথরটি নিয়ে আসতে না আসতেই তার মাথা পূর্বের ন্যায় হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাবর্তন করে সে পুনরায় আগের মতো আচরণ করছে। আমি ফেরেশতাদ্বয়কে প্রশ্ন করলাম, সুবহানাল্লাহ! বলুন, এরা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন।
আমরা সামনে এগিয়ে অপর একজনকে পেলাম, যে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। আরেকজন তার নিকট লোহার সাঁড়াশি হাতে দণ্ডায়মান। সে এ সাঁড়াশি দ্বারা একের পর এক তার মুখমণ্ডলের একাংশ চিরে গলার পিছন পর্যন্ত, অনুরূপ নাক ও চোখ চিরে পিছন পর্যন্ত নিয়ে। যাচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, আবু রাজা অধিকাংশ সময় এরূপ বলতেন, সে একদিকে কেটে অপর দিকে কাটত। অপর দিকে কাটা শেষ হতে না হতেই প্রথম দিকটা আগের মত হয়ে যেত, এভাবে পুনঃ পুনঃ এরূপই করত। আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ। বলুন, এরা দু'জন কে?
তারা বললেন, সামনে অগ্রসর হোন। সামনে আমরা একটি চুলার নিকট গিয়ে উপনীত হলাম। তিনি বললেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছিলেন, আমি সেখানে শোরগোলের শব্দ শুনতে পেলাম, যাদের নীচ থেকে আগুনের লেলিহান শিখা স্পর্শ করছিল। আগুনের আওতায় আসলেই তারা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে উঠত। আমি প্রশ্ন করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন।
সামনে এগিয়ে গিয়ে আমরা এক নহরের নিকট পৌঁছলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, সেটি ছিল লাল রক্তের নহর। নহরে একজনকে সাঁতার কাটতে দেখলাম। নহরের পাড়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিল, যার নিকট ছিল অসংখ্য পাথরের স্তূপ। সাঁতারকারী লোকটি সাঁতরানো শেষ করে দাঁড়ানো লোকটির নিকট এসে মুখ খুলে দিত। আর সে তার মুখে একটি পাথর নিক্ষেপ করত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বললেন,সামনে অগ্রসর হোন
আমরা সামনে এগিয়ে একজন বীভৎস চেহারার লোক প্রতাক্ষ করলাম, যেরূপ তোমরা কোন বীভৎস চেহারার লোক দেখে থাক। তার নিকট ছিল আগুন। সে আগুন জ্বালাজিল আর তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোক কে? তারা বললেন, সামনে চলুন।
সামনে আমরা এক ঘন গাছ বিশিষ্ট বাগিচায় উপনীত হলাম। বালিচাটি বসন্তের রকমারি ফুলে সুশোভিত ছিল। বাগিচার মাঝে ছিল একজন লোক। যার আকৃতি এতবানি দীর্ঘ ছিল যে, আমরা তাঁর মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাঁর চারপাশে এত বিপুলসংনাক বালক ছিল, যেরূপ আমার নজরে আর আসেনি। জিজ্ঞেস করলাম, এ লোক কে? আর এরাই বা কারা? তারা বললেন, সামনে চলুন।
অবশেষে আমরা এক বিরাট বাগানে গিয়ে পৌছলাম। এরূপ বড় ও সুন্দর বালান আমি আর কখনও দেখিনি। আমাদের নজরে একটি শহর পড়ল। সেটি চিল সোলা ও রুপার ইট দিয়ে বানানো। আমরা ওই শহরের ফটকে পৌছলাম। ফটক খুলতে বললে আমানের জন্য ফটক খুলে দেয়া হল। ভিতরে ঢুকে আমরা কিছু লোকের দেখা পেলাম। যাদের দেহের অর্ধেক খুবই সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল। যেরূপ তোমরা খুব সুন্দর কাউকে দেখে থাক। আর অর্ধেক ছিল খুবই কদাকার। যেমন তোমরা খুব কদাকার কাউকে দেখে থাক। তারা উভয়ে ওই লোকদের লক্ষ্য করে বলল, যাও, তোমরা এ ঝর্নায় নাম। দেখা গেল, গাস্থের দিকে লা প্রবহমান একটি ঝর্না রয়েছে। তার পানি ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ সাদা। তারা পিয়ে কর্নার নেসে পড়ল। তারপর তারা আমাদের নিকট এল। দেখা গেল, কণাকৃতি দূর হয়ে তারা খুব সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে গেছে। ফেরেশতাদ্বয় আমাকে জানালেন, 'এটাই আদন নামক জান্নাত, এটাই আপনার বাসস্থান।' আমি উপরের দিকে দৃষ্টি দিলাম, দেখলাম ধবধবে সাদা মেসের ন্যায় এক প্রাসাদ। তাঁরা আমাকে জানালেন, 'এটাই আপনার প্রাসাদ।' আমি বললাম, 'আল্লাহ্ আপনাদের দু'জনেরই কল্যাণ করুন, আমকে ছেড়ে দিন আমি এতে প্রবেশ করব। তাঁরা বললেন, এখন নয়, তবে নিঃসন্দেহে এতে আপনি প্রবেশ করবেন। আমি তাঁসের • বললাম, সারারাত ধরে আমি অনেক অনেক আশ্চর্য জিনিস দেখলাম, এবার আমাকে বলুন, এগুলোর তাৎপর্য কি? তারা বললেন, এখন আমরা আপনাকে তা জানাব।
প্রথম যে ব্যক্তির নিকট আপনি গিয়েছেন, যার মাথা পাথর মেরে মেরে চৌচির করা হচ্ছিল, সে কোরআন মুখস্থ করে (তার উপর আমল) ছেড়ে দিত আর ঘুমিয়ে ফরজ নামরজ ত্যাগ করত। আর যে ব্যক্তির নিকট আপনি গেলেন, যার গলদেশের পিছন পর্যন্ত চেরা হচ্ছিল, নাসাভ্যন্তর ও চোখ পিঠ পর্যন্ত চেরা হচ্ছিল, সে সকাল বেলা গৃহ থেকে বের হতে যেত আর চতুর্দিকে মিথ্যার বেসাতি করে বেড়াত। আর ওই উলঙ্গ নারী-পুরুষ যাদের প্রজ্বলিত চুলায় দেখেছেন, তারা ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারিণী নারী। আর যে লোক রক্তের ঝর্নায় সাঁতার কাটছিল। যার নিকট দিয়ে আপনি গিয়েছিলেন, যে পাথরের লোকমা পাচ্ছিল, সে ছিল সুদখোর। আর ওই কদাকার লোক যাকে আপনি আগুনের নিকট দেখেছিলেন আর সে আগুন জ্বালিয়ে তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছিল, সে জাহান্নামের দারোগা মালেক ফেরেশতা। বাগানে যে দীর্ঘকায় লোককে দেখেছেন, তিনি ইবরাহীম (আঃ)। আর তাঁর চারপাশে যে বালকদের দেখেছেন, তারা ছিল সেসব শিশু যারা স্বভাবধর্মের (ইসলাম) উপর মৃত্যুবরণ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, মুসলমানদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, হে আল্লাহর রাসূল। মোশরেকদের সন্তানরা কোথায়? তিনি বলেছেন, তারাও সেখানে ছিল। আর যাদের অর্ধেক অংশ অত্যন্ত সুন্দর আর বাকী অর্ধেক অত্যন্ত কুৎসিত ছিল, তারা হচ্ছে ওইসব লোক, যারা। ভালো-মন্দ মিশ্রিতভাবে করেছিল। আল্লাহ্ তাদের ত্রুটিসমূহ মাফ করে দিয়েছেন।
বায্যার সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে, অতঃপর রাসূল (ছঃ) এমন কিছু লোকের পার্শ্ব দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন, যাদের মস্তক প্রস্তরাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছে এবং নিক্ষিপ্ত পাথরগুলো ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ছে। আঘাতকারী পাথর তুলে আনার সময়টাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা আবার পূর্বানুরূপ হয়ে যাচ্ছে এবং আবার ওই পাথর দিয়ে তাদের মস্তকে আঘাত হানা হচ্ছে, এভাবে পুনঃ পুন করা হচ্ছে। রাসূল (ছঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? তাদের অপরাধই বা কি? জিবরাঈল (আঃ) বললেন, এরা পৃথিবীতে নামায পরিত্যাগকারী: এ দায়িত্বের বোঝায় তাদের মাথা ভারী হয়ে রয়েছে।
খতীব ও ইবনে নাজ্জার বর্ণনা করেন, 'নামায ইসলামের পতাকা, উজ্জ্বল প্রতীক। এ নামাযর জন্য যে ব্যক্তি নিজের হৃদয়কে আলাদা করে নিবে এবং নির্ধারিত সময়ে সুন্নত মোতাবেক তা আদায় করবে (তার সম্পর্কে বলা যায়) সে মোমেন।'
ইবনে মাজা শরীফে বর্ণিত, আল্লাহ তা'আলা বলেন-
-'আমি তোমার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছি এবং আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যে ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে, আমি তাকে জান্নাতে দাখিল করাব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাযের হেফাযত করবে না, তার নিরাপত্তা সম্পর্কে আমার কোন দায়িত্ব নেই।'
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, 'যে ব্যক্তি নামায ফরয হওয়ার দৃঢ় পরিপকু বিশ্বাস সহকারে তা আদায় করবে, সে জান্নাত লাভ করবে।' অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
-'কেয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম বান্দার যে আমলের হিসাব নেয়া হবে, তা হবে নামায। যদি তা সঠিক পাওয়া যায় তবে সে সফলকাম হবে এবং নিজ লক্ষ্যে উপনীত হবে। আর নামাযে গলদ থাকলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বরবাদ হয়ে যাবে। যদি তার ফরযগুলোর মধ্যে কোন কমতি থাকে, তবে মহান রব আল্লাহ তা'আলা বলবেন, দেখ আমার বান্দার কিছু নফলও আছে কিনা? তার সাহায্যে এর ফরযগুলোর কমৃতি পূরণ করে দাও। তারপর সব আমলের হিসাব এভাবেই পূরণ করা হবে।'
বখারী শরীফে আছে-
-'কেয়ামত দিবসে সর্বাগ্রে বান্দাকে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে, তা হল সামায। নামাযের হিসাব-নিকাশে যদি তাকে ঠিক পাওয়া যায়, তবে সে সফল। আর যদি নামাযের বিষয়ে কোন ত্রুটি থাকে তবে সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধংসপ্রাপ্ত হবে।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন,, 'একদা আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে এসে বললেন, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, আমি তোমার উন্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছি। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করে সঠিক সময়ে নামায আদায় করবে এবং রুকু সেজদা পূর্ণভাবে করবে, তার জন্য আমার ওয়াদা রয়েছে, আমি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাব। আর যে ব্যক্তি তা করবে না, তার জন্য আমার নিকট কোন ওয়াদা নেই। চাইলে আমি তাকে শাস্তিও দিতে পারি আর চাইলে মাফও করতে পারি।'-তায়ালেসী ও তাবারানী '
নামাযের একটি মীযান (পাল্লা) আছে, যে ব্যক্তি (সঠিকভাবে নামায আদায় করে) তা পূর্ণ করবে, সে পূর্ণ নেকী পাবে।' বায়হাকী
'নামায শয়তানের চেহারা কালো করে দেয়, দান-খয়রাত তার পৃষ্ঠ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, একমাত্র আল্লাহর নিমিত্ত ও ইলমের খাতিরে কাউকে ভালবাসা শয়তানের তানের মূলোৎপাটন। করে দেয়, এতদ্দ্বারা শয়তান তোমাদের থেকে এত দূরে সরে যায়, যত দূরত্ব রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মাঝে।' দায়লামী
তিরমিযী শরীফে বর্ণিত রয়েছে-
-'আল্লাহকে ভয় কর, নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়, তোমাদের (রমযান) মাসটির রোযা রাখ, তোমাদের মালের যাকাত দাও, তোমাদের কর্মকর্তার অনুগত থাক, তবে তোমরা তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।'
'আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে সঠিক সময়ের নামায, তারপর পিতা- মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, তারপর আল্লাহর পথে জিহাদ।'-বুখারী ও মুসলিম
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ)। দ্বীন ইসলামের কোন আমল আল্লাহ তা'আলার কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, 'সঠিক সময়ে নামায পড়া; যে ব্যক্তি নামায তরক করল, তার দ্বীন বলতে কিছুই রইল না, বস্তুতঃ নামায দ্বীনের স্তম্ভ।' বর্ণিত আছে, নামাযের উক্তরূপ গুরুত্বের জন্যই হযরত ওমর (রাঃ)-কে তাঁর অন্তিমকালীন মারাত্মক যখমের সময় যখন নামাযের কথা বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, যার নামায নেই, দ্বীন-ইসলামে তার কোন অংশ নেই। তাই হযরত ওমর (রাঃ) এমন অবস্থায়ও নামায পড়েছিলেন, যখন তাঁর দেহ থেকে রক্ত ঝরছিল। বায়হাকী
নবী করীম (ছঃ) বলেন, 'যে ব্যক্তি প্রথম ওয়াক্তে নামায পড়ে, তার নামায নূরানী হয়ে আরশ পর্যন্ত আরোহণ করে এবং নামাযীর জন্য এই বলে দোয়া করতে থাকে, তুমি যেরূপ যত্নের সাথে আমাকে শেষ করেছ, আল্লাহ্ তোমাকে তদ্রুপ যত্ন ও সস্নেহে হেফাযত করুন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঠিকমত নামায পড়ে না, তার নামায কালো বর্ণ ধারণ করে উর্ধ্বগগনে উত্থিত হয় এবং উক্ত নামায পুরাতন ছেঁড়া কাপড়ের ন্যায় পুঁটলী বেঁধে নামাযীর মুখের উপর নিক্ষেপ করা হয়।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আরও বলেছেন, 'তিন শ্রেণীর লোকের নামায আল্লাহ তা'আলা ককূল করেন না। তন্মধ্যে এক শ্রেণীর লোক তারা, যারা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর নামায পড়ে। কোন কোন আলেম বলেছেন, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
-'যে ব্যক্তি যাবতীয় শর্তসহ যথারীতি নামায পড়বে, আল্লাহ তা'আলা তাকে পাঁচটি পুরস্কারে ভূষিত করবেন। যথা- ১. রিযিকের অভাব দূর করে দিবেন। ২. কবরের আযাব থেকে মুক্ত রাখবেন। ৩. আমলনামা ডান হাতে দিবেন। ৪. বিদ্যুৎগতিতে পুলসেরাত অতিক্রম করিয়ে দিবেন। ৫. বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আর যে ব্যক্তি নামাযের ব্যাপারে উদাসীন ও অবহেলাকারী করবে, তাকে আল্লাহ তা'আলা পনেরটি শাস্তি দিবেন; পাঁচটি দুনিয়াতে, তিনটি মৃত্যুর সময়, তিনটি কবরে এবং তিনটি কবর থেকে বের হওয়ার পর হাশরের মাঠে।
দুনিয়ার পাঁচটি শাস্তি হচ্ছে- ১. তার সময় ও জীবিকায় বরকত থাকবে না। ২. তার চেহারায় নেক লোকের চিহ্ন থাকবে না। ৩. যে কোন নেক আমল সে করবে আল্লাহর নিকট তার কোন সওয়াব পাবে না। ৪. তার কোন দোয়া কবুল হবে না। ৫. নেক লোকদের কোন দোয়াও তার পক্ষে কবুল হবে না।
মৃত্যুকালীন তিনটি শাস্তি হচ্ছে- ১. অপমৃত্যু ঘটবে। ২. অভুক্ত অবস্থায় মারা যাবে। ৩. পিপাসার্ত অবস্থায় মৃত্যু হবে; তখন তার এত বেশি পিপাসা হবে যে, কয়েক সমুদ্রের পানিও যদি তাকে পান করানো হয় তবুও তার পিপাসা দূর হবে না।
কবরের তিনটি শাস্তি হচ্ছেঃ ১. বেনামাযীর কবর এত সংকীর্ণ হবে যে, তার দেহের দু'দিকের পাঁজর একে অপরের ভিতর প্রবেশ করবে। ২. কবর অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে এবং দিনরাত সে তাতে জ্বলতে থাকবে। ৩. বেনামাযীর কবরে 'শুজা আকরা' নামক এক ভয়ংকর সাপ তার উপর নিয়োগ করা হবে। তার চোখ দুটি হবে আগুনের এবং নখরগুলো হবে লোহার। প্রতিটি নখ একদিনের পথ, অর্থাৎ বার ক্রোশ দূরত্ব পরিমাণ লম্বা হবে। সাপটি মৃত ব্যক্তির সাথে কথাবার্তা বলবে; নিজেকে 'শুজা আকরা' বলে পরিচয় দিবে। তার শব্দ বজ্রের ন্যায় কঠিন হবে। সে বলবে, তোমাকে কঠিন আযাব প্রদানের জন্যই আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে। আমি তোমাকে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকব: ফজরের নামায ত্যাগ করার দরুন যোহর পর্যন্ত, যোহরের নামায ত্যাগের কারণে আছর পর্যন্ত, আছরের নামায ত্যাগের কারণে মাগরিবে পর্যন্ত, মাগরিবের নামায ত্যাগের কারণে এশা পর্যন্ত এবং এশার নামায ত্যাগের কারণে ফজর পর্যন্ত। এভাবে আমি তোমাকে উপর্যুপরি আঘাত হানতেই থাকব। এ বিষাক্ত অজগরের আঘাত এতই মারাত্মক হবে যে, প্রতি আঘাতে বেনামাযী সত্তর গঞ্জ মাটির নীচে ধসে যাবে। এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত শান্তি হতে থাকবে।
কেয়ামতের দিন হাশরের তিনটি শান্তি হচ্ছে- ১. অত্যন্ত কঠিনভাবে বেনামাযীর হিসাব নেয়া হবে। ২. বেনামাযী আল্লাহর রোষে নিপতিত হবে। ৩. বহু অপমান করে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।
অপর এক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতের মাঠে বেনামাযীর মুখমণ্ডলে নিম্নোক্ত তিনটি বাক্য লেখা থাকবে, এক, ওহে আল্লাহর হক ধ্বংসকারী। দুই, ওহে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত। তিন, তুমি যে আল্লাহর হক নষ্ট করেছ, তদ্রুপ আজ আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকে বঞ্চিত থাক।
উপরোক্ত হাদীসের সূচনাতে যে পনের সংখ্যার কথা বলা হয়েছিল, তা পূর্ণ না হয়ে চৌদ্দটি পর্যন্ত উল্লিখিত হয়েছে। হয়ত বর্ণনাকারী একটি সংখ্যা বিস্মৃত হয়ে গেছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, 'কেয়ামতের ময়দানে একজন লোককে আল্লাহ তা'আলার সামনে দাঁড় করানো হবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে দোযখে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দান করবেন। লোকটি বলবে, হে রব্ব। কেন আমার জন্য এ নির্দেশ? আল্লাহ্ বলবেন, নামাযের বেলায় তুমি নির্ধারির সময় পার করে দিয়েছ এবং দুনিয়াতে মিথ্যা শপথে অভ্যন্ত ছিলে।'
বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) একদা সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, তোমরা আল্লাহ তা'আলার দরবারে এ মর্মে দোয়া কর
اللَّهُمَّ لَا تَدْعُ فِيْنَا شَقِيًّا وَلَا مَحْرُومًا -
-'হে আল্লাহ্! আমাদের মধ্যে কাউকে হতভাগা ও বঞ্চিত করো না।' আল্লাহর রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান, হতভাগা ও বঞ্চিত কে? সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলে রাসূল (ছঃ) বললেন-
تارك الصلوةِ مَحْرُوم محروم وشقى -
-'নামায ত্যাগকারী ব্যক্তিই হতভাগা ও বঞ্চিত।'
আরও বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন সর্বাগ্রে বেনামাযী লোকদের চেহারা কালো বর্ণ ধারণ করবে। জাহান্নামে 'লামলাম' নামক একটি উপত্যকা আছে। সেখানে অসংখ্য সাপ রয়েছে। প্রত্যেকটি সাপ উটের ঘাড়ের ন্যায় মোটা এবং এক মাসের দূরত্ব পরিমাণ লম্বা হবে। এগুলো বেনামাযী লোকদের দংশন করতে থাকবে, যার বিষ সত্তর বছর পর্যন্ত উথলে উঠতে থাকবে। ফলে তাদের দেহ বিবর্ণ হয়ে যাবে।
বনী ইসরাঈলের এক মহিলা হযরত মূসা (আঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল, হে মুসা। আমি একটি বড় গুনাহের কাজ করেছি এবং আল্লাহর কাজে তওবাও করেছি, আপনি যদি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, তবে অবশ্যই আমার তওবা কবুল হবে। হযরত মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন কি গুনাহের কাজ করেছ, যার জন্য এত ভীত হয়ে পড়েছ? সে জবাবে বলল, আমি যেনায় লিপ্ত হয়েছি এবং যেনাপ্রসূত সন্তানও হত্যা করে ফেলেছি। হযরত মূসা (আঃ) মহিলাটির কথা শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, দূর হও এখান থেকে, না জানি আকাশ থেকে অগ্নি বর্ষিত হয় আর তোমার সাথে আমরাও পুড়ে ছাই হয়ে যাই। এ কথা শুনে মহিলাটি ভগ্ন হৃদয়ে সেখান থেকে প্রত্যাগমন করল। অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) অবতরণ করে বললেন, হে মূসা। আল্লাহ তা'আলা বলছেন, আপনি তওবাকারিণী মহিলাটিকে কেন ফিরিয়ে দিলেন? তদপেক্ষা বড় অপরাধী কে, আমি কি তা বলব? হযরত মূসা (আঃ) জানতে চাইলে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেন, তদপেক্ষা অপরাধী সে ব্যক্তি, যে জেনে শুনে স্বেচ্ছায় নামায ত্যাগ করে।
জনৈক বুযুর্গ সম্পর্কে বর্ণিত, তাঁর ভগ্নির মৃত্যুর পর যথারীতি দাফনকার্য সম্পন্ন করেন, কিন্তু দাফনের পর মনে পড়ল, ভুলবশতঃ তার টাকার একটি থলি দাফন হয়ে গেছে। লোকজন বিদায় হওয়ার পর থলিটি আনার জন্য তিনি পুনরায় কবর খুঁড়লেন, কিন্তু তখন তিনি প্রত্যক্ষ করলেন, কবরের ভিতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটি দিয়ে কবরটি আচ্ছাদিত করে দেন। ফিরে এসে মাকে ভগ্নির কবরের অবস্থা বর্ণনা করে তার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মা কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, তোমার বোন নামাযর ব্যাপারে অবহেলা করত এবং সময় পার করে নামায পড়ত। এ হলো তার অবস্থা যে বিলম্ব করে হলেও নামায পড়ত। এ থেকেই উপলব্ধি করে নেয়া দরকার, যে মোটেই নামায পড়ে না, তার কি অবস্থা হবে। হে আল্লাহ্। আমাদের নামাযের যাবতীয় শর্ত ও হক আদায় করে যত্ন সহকারে তা আদায় করার তওফীক দান করুন, আপনি অনন্ত মেহেরবান ও দয়াশীল।
0 Comments