উম্মে সালামার (রা) দ্বিতীয় বিয়ে

        আবু সালামার (রা) ইনতিকালের সময় উম্মে সালামা সন্তানসম্ভবা। সন্তান প্রসবের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) তাঁর একাকীত্ব ও দুঃখ- বেদনার কথা চিন্তা করে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উম্মে সালামা (রা) এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

        একটি বর্ণনায় এসেছে যে, হযরত 'উমর (রা)-এর মাধ্যমে হযরত রাসূলে কারীম (সা) বিয়ের পয়গাম পাঠান। আবু সালামার আত্মত্যাগ এবং উম্মে সালামার (রা) অসহায় অবস্থা ও একাকীত্ব রাসূলে কারীমের (সা) অনুভূতিকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। তাই আবু বকরের (রা) প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ পাকের নির্দেশে রাসূল (রা) হযরত 'উমারের (রা) মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। সালামা (রা) কতকগুলি কারণ উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহর (সা) উম্মে সালামার (রা) সকল শর্ত মেনে নেন। তখন উম্মে সালামা (রা) রাজি হয়ে যান। উম্মু সালামা রাসূলুল্লাহর (সা) প্রস্তাব কবুল করতে অপারগতার কারণগুলি (ক) আমি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্না এক মহিলা, (খ) আমার কয়েকটি সন্তান রয়েছে, (গ) আমি বয়স্কামহিলা, (ঘ) আমার কোন ওলী নেই। জবাবে রাসূল (সা) বলেনঃ তোমার সন্তানদের দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। তোমার আত্মমর্যাদাবোধ আল্লাহ দূর করে দেবেন। তোমার আত্মীয়দের মধ্যে এমন কেউ নেই যে রাজি হবে না, আর তুমি বয়স্কা, তোমার চেয়ে আমার বয়স বেশী।

        হিজরী ৪র্থ সনের শাওয়াল মাসের শেষের দিকে হযরত রাসূলে পাকের (সা) সাথে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। স্বামী আবু সালামার (রা) মৃত্যুতে তিনি যে দুঃখ-বেদনার শিকার হন, এভাবে তা দূর হয় এবং তাঁর চেয়ে ভালো বিকল্প লাভ করেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দুঃখকে অনন্তকালের জন্য আনন্দে রূপান্তর করে দেন।

        রাসূলে কারীম (সা) একজোড়া যাঁতা, দুইটি মশক, এবং চামড়ার কভার ও খোরমার ছালে ভরা একটি বালিশ উম্মে সালামাকে দেয়। এ সকল জিনিসই তিনি অন্য বিবিগণকেও দিয়েছিলেন রাসূলে কারীম (সা) উম্মে সালামাকে বিয়ে করার পর তাঁর রূপ ও সৌন্দর্যের কথা হয়রত আয়েশার (রা) কানে গেলে তাঁর মধ্যে একটু ঈর্ষার ভাব সৃষ্টি হয়। তিনি উন্মে সালামাকে দেখতে এসে বুঝতে পারলেন, উম্মে সালামার রূপের কথা যতটুকু বলা হয়, তিনি তার চেয়েও বেশী সুন্দরী। তিনি তাঁর রূপের কথা হাফসাকে (রা) বললেন। তারপর হাফসা (রা) তাঁকে দেখেন এবং একই কথা বলেন। এ ধরনের বহু বর্ণনা দ্বারা উম্মে সালামার (রা) সুদর্শন চেহারার প্রমাণ পাওয়া যায়।

        রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বিয়ের পর প্রথম দিকে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, যখনই রাসূল (সা) কাছে আসতেন, তিনি দুগ্ধপোষ্য মেয়ে যয়নাবকে দুধ পান করাতে শুরু করতেন। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) ফিরে যেতেন। হযরত 'আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা) ছিলেন তাঁর দুধভাই। তিনি একথা শুনে ক্ষেপে যান এবং মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যান। এরপর রাসূল (সা) উম্মে সালামার ঘরে আসেন এবং এদকি ওদিক তাকাতে থাকেন। শিশু মেয়েকে না দেখে জিজ্ঞেস করেনঃ যয়নাব কোথায়? তাকে কি করেছো? তিনি জবাব দিলেন। আম্মার এসে নিয়ে গেছে। সেদিন থেকে রাসূল (সা) অন্য বিবিদের ঘরে অবস্থান করতে থাকেন। ক্রমশ এ অবস্থা দূর হয়ে যায় এবং অন্য বিবিগণ যেভাবে ছিলেন সেভাবে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তার সম্পর্ক এত গভীর হয় যে, হযরত 'আয়িশার (রা) পরেই তাঁর স্থান নির্দারণ করা হয়ে থাকে।

        হিজরী ৫ম সনে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জার অবরোধের এক পর্যায়ে তাদের সাথে আলোচনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) আবু লুবাবাকে (রা) পাঠান। তাদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি হাতের ইঙ্গিতে তাদেরকে একথা বুঝিয়ে দেন যে, তোমাদের হত্যা করা হবে। কিন্তু এটাকে রাসূলুল্লাহর (সা) গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে মনে করে ভীষণ অনুতপ্ত হয়। তারপর তিনি মসজিদের একটি খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে ফেলেন। অনেকদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে এ অবস্থায় রাখেন, অতঃপর তাঁর তাওবা কবুল হয়। সেদিন রাসুল (সা) উন্মে সালামার (রা) ঘরে ছিলেন।

        সকালে রাসূল (সা) উম্মে সালামার (রা) ঘরে ঘুম থেকে জেগে মৃদু হাসতে থাকেন। উন্মে সালামা (রা) তা দেখে বলেন: 'আল্লাহ আপনাকে সর্বদা হাসিতে রাখুন। এ সময় হাসির কারণ কি?' বললেনঃ আবু লুবাবার তাওবা কবুল হয়েছে। উম্মে সালামা তাঁকে এ খোশখবরটি শোনাবার অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সা) বললেনঃ হাঁ, চাইলে শোনাতে পার। উম্মে সালামার ঘরটি ছিল মসজিদে নববীর এত নিকটে যে, ঘর থেকে আওয়ায দিলে মসজিদ থেকে শোনা যেত। অনুমতি পেয়ে তিনি হুজরার দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠেনঃ আবু লুবাবা। তোমাকে মুবারকবাদ। তোমার তওবা কবুল হয়েছে। এ আওয়ায মানুষের কানে যেতেই গোটা মদীনা যেন আনন্দ উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। এটা হিজাবের হুকুম নাযিলের আগের ঘটনা।

        সেই বছরই হিজাবের (পর্দা) আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াত নাযিলের আগ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর (সা) বিবিগণ কিছু কিছু দূরের আত্মীয়-স্বজনদের সামনে যেতেন। এখন কিছু বিশেষ আত্মীয় ও আপনজন ছাড়া সবার থেকে পর্দা করার নির্দেশ হলো। হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম ছিলেন কুরাইশ বংশের একজন অতি মর্যাদাবান অন্ধ সাহাবী। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মু'য়াজ্জিনও ছিলেন। যেহেতু তিনি অন্ধ ছিলেন, এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সা) অন্দর মহলেও তাঁর যাতায়াত ছিল। হিজাবের আয়াত নাযিলের পর পূর্বের অভ্যাস মত একদিন তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। রাসূল (সা) উম্মে সালামা (রা) ও হযরত মায়মুনাকে (রা) বললেন : 'তার থেকে তোমরা পর্দা কর।' তাঁরা বললেনঃ তিনি তো একজন অন্ধ মানুষ। রাসূল (সা) বললেন, তোমরা তো আর অন্ধ নও। তোমরাতো তাকে দেখছো।

        খন্দক যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। তবে তিনি রাসূল (সা)-এর এত নিকটে ছিলেন যে, তাঁর প্রতিটি কথা ভালোমত শুনতে পেতেন। তিনি বলতেন, আমার সেই সময়ের কথা খুব ভালো মনে আছে, যখন রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র বুকে ধুলোবালি লেগে ছিল। তিনি লোকদের মাথায় ইট উঠিয়ে দিচ্ছিলেন, আর কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। হঠাৎ আম্মার ইবনে ইয়াসিরের প্রতি দৃষ্টি পড়লে তিনি বললেনঃ হে ইবনে সুমাইয়্যা, তোমাকে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।

        হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উম্মে সালামা (রা) রাসূলুল্লাহকে (সা) একটি সঠিক পরামর্শ দান করেছিলেন। সহীহ বুখারীতে এসেছে, সন্ধি চুক্তির পর রাসূল (সা) বলেন, লোকেরা যেন হুদায়বিয়ায় নিজ নিজ পশু কুরবানী করে। যেহেতু সন্ধির শর্তাবলী দৃশ্যত মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী ছিল। এ কারণে, সাধারণভাবে মুসলমানরা মনঃক্ষুণ্ণ ও বিমর্ষ ছিল। রাসূল (সা) তিনবার নির্দেশ দানের পরেও কারও মধ্যে নির্দেশ পালনের তোড়জোড় দেখা গেল না। রাসূল (সা) তাঁবুতে ফিরে এসে উম্মে সালামার নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তখন উম্মে সালামা বলেন: 'আপনি কাকেও কিছু বলবেন না। বাইরে যেয়ে নিজের কুরবানী করুন এবং ইহরাম ভাঙ্গার জন্য মাথার চুল ফেলে দিন।' রাসূল (সা) তাঁর পরামর্শ মত কাজ করেন। লোকেরা যখন দেখলো রাসূল (সা) তাঁর নির্দেশ মত নিজেই আমল করছেন তখন সবাই কুরবানী করে ইহরাম ভেঙ্গে ফেলে। তখন কুরবানী করা ও ইহরাম ভাঙ্গার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। উম্মে সালামার (রা) এ পরামর্শ ছিল খুবই সময় উপযোগী ও বাস্তব সম্মত। যা এক কঠিন সমস্যাকে নিমেষেই সমাধান করে দেয়।

        মক্কা বিজয়ের সময় হযরত উম্মে সালামা (রা)ও রাসূলুল্লাহর (সা) সফর সঙ্গিনী ছিলেন। কাফেলা যখন মক্কার অদূরে মাররুজ জাহরান মতান্তরে নীকুল ওকাব নামক স্থানে তখন রাতের অন্ধকারে মক্কার আবু সুফইয়ান ও আবুদুল্লাহ ইবনে আবী উমাইয়া মুসলমান শিবিরে উপস্থিত হন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। এ সময় উম্মে সালামা (রা) রাসুলুল্লাহকে (সা) পরামর্শ দেন-ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজন আপনার চাচার ছেলে, আর একজন আপনার ফুফুর ছেলে ও আপনার শ্যালক। অর্থাৎ আবু সুফইয়ান রাসূলুল্লাহর (সা) বড় চাচা আল-হারিসের ছেলে, আর আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর ফুফু আতিকার ছেলে এবং উম্মে সালামার (রা) ভাই। তায়েফ অভিয়ানের সময় উম্মে সালামা (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে ছিলেন। হিজরী ১০ম সনে বিদায় হজ্জের সময় হযরত উম্মে সালামা (রা) অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু একটি ফরজ কাজ আদায়ে কোন রকম শিথিলতা তাঁর পছন্দ হয়নি, তাই সঠিক ওজর বা কারণ থাকা সত্ত্বেও তিনি রাসুলুল্লাহর (সা) সফরসঙ্গিনী হন। তাওয়াফের ব্যাপারে রাসূল (সা) তাঁকে বলেন : উম্মে সালামা। যখন ফজর নামাযের সময় হতে থাকবে তুমি উটের উপর সওয়ার হয়ে তাওয়াফ করে নিবে। তিনি তাই করেছিলেন। হিজরী একাদশ সনে হযরত রাসূলে কারীম (সা) জীবনের শেষ দিনগুলিতে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হযরত আয়েশার (রা) ঘরে অবস্থান করতে থাকেন তখন উম্মে সালামা (রা) প্রায়ই রাসূলকে (সা) দেখতে আসতেন। একদিন রাসূলুল্লাহর (সা) শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন। রাসূল (সা) নিষেধ করে বললেন: এটা মুসলমানদের আদর্শ নয়।

Post a Comment

0 Comments