আল্লাহ জাল্লাশানুহু তার হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (স)-কে তার মাহবুব রূপে, তার হাবিব রূপে গ্রহণ করেছেন। স্রষ্টা স্বয়ং তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রতি প্রেম নিবেদন করেছেন। বিশ্ব সম্রাট, আলমসমূহের একচ্ছত্র অধিপতি সর্ববিষয়ে শক্তিমান, মহা ক্ষমতাশালী আল্লাহ। তার হাবিব কি রিক্ত নিম্ন ভিখারী হতে পারে? তার মাহবুব কি অতীব সুর্বল। শক্তি-সাম্য অপর বন্ধুর সাথে গুণ-গরিমায় শরি হতে পারে? এক বন্ধু সামঞ্জস্য পূর্ণ। না হলে বন্ধুত্ব হতে পারে না। হান আল্লাহ অসামঞ্জস্যশীলশীল বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় না। কাজেই তার হাবিবকে অগণিত জাহেরী ও বাতেনী নেয়ামত দান করেছেন। মুহাম্মদ মুস্তফা আহম্মদ মুযতবা (স)-এর শান-শওকত বৃদ্ধি করে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন, শক্কে ছদর বা শরহে ছদর এ অফুরন্ত নেয়ামতরাশির অন্যতম। জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর জীবনে চারবার তার বক্ষ বিদারণ হয়েছে:
প্রথম বক্ষ বিদারণ
রাসূলুল্লাহ (স)-এর শিশু বয়সে মা হালিমার (রা) গৃহে অবস্থানকরার সময়ে সংঘটিত হয়েছে। একদা শিশু মুহাম্মদ (স) তাঁর দুধ ভাই ও অপরাপর বালকদের সাথে চারণ ভূমিতে বকরী চড়াচ্ছিলেন। সেখানে শ্বেত বসন পরিহিত দুইজন ফেরেস্তা অবতীর্ণ হন। ফেরেস্তাদ্বয় মুহাম্মদ (স)-এর নিকটবর্তী হলে তিনি ভীত হয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ফেরেস্তাদ্বয় তাঁকে ধরে ফেলেন। অতঃপর চিৎ করে শোয়ায়ে বক্ষ উন্মোচন করে হৃৎপিণ্ড বা কলা বের করলেন। তথা হতে কালবর্ণের জমাট রক্ত বের করে ফেলে দিলেন। অতঃপর কালব মোবারক সোনার পেয়ালায় রেখে জমজমের পানি দ্বারা ধৌত করে যথাস্থানে সংস্থাপন করলেন। বালকেরা দৌড়ে গিয়ে মা হালিমাকে এ সংবাদ দিল। মা হালিমা ও তার স্বামী ছুটে এসে দেখলেন মুহাম্মদ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন। তাঁরা কিছুই বুঝতে পারলেন না। সেবা শুশ্রূণা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। আরও বর্ণিত আছে যে, ফেরেস্তাদ্বয় দশ জনের বিপরীতে ওজন করলে তিনি অধিক ভারী হন। অতঃপর একশত জনের বিপরীতে ওজন করলেও তিনি অধিক ভারী হন। ফেরেস্তাদ্বয় বলেন, "আল্লাহর কসম, যদি তাঁকে সমস্ত উন্মতের বিপরীতে জন করা হয় তাতেও তিনি অধিক ভারী হবেন।" এই ওজন করাটা একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। জামে নিসবতের অধিকারী বলেই তিনি ওজনে অধিক ভারী হলেন। সমস্ত নবী, ওলি, শহিদ, সালেহ ও ফেরেস্তাবৃন্দ পৃথক পৃথক ভাবে যে সমস্ত কামালতের অধিকারী, রাসুলুল্লাহ্ (স) একাই সে সমস্ত কামালত হতেও অধিক কামালতের অধিকারী।
এ ঘটনার পর মা হালিমা (রা) তাঁর স্বামী মুহাম্মদ (স) সম্পর্কে শংকিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা তাকে জ্বীনগ্রন্থ ভেবে মক্কায় মা আমিনার (রা) নিকট ফের দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মা আমিনা (রা) ঘটনা শ্রবণ করে জিজ্ঞেসা করলেন, "তুমি কি মনে করছো আমার ছেলের উপর ভূত-প্রেতের আসর হয়েছে?" হালিমা (রা) বলেন, "হ্যাঁ, সে রকমই মনে হয়।" মা আমিনা (রা) বলেন, "অসম্ভব, আমার ছেলের উপর জ্বীনের আসর হতে পারে না। আমার সন্তানের মধ্যে একটা পবিত্র ভাব নিহিত আছে। এটা সেভাবেরই প্রকাশ, তার শানই আলাদা।"
দ্বিতীয় বক্ষ বিদারণ
রাসূলুল্লাহ (স) এর দশ বৎসর বয়সে একদা তিনি মক্কার মরু প্রান্তরে অবস্থান করছিলেন। অকস্মাৎ দুইজন ফেরেস্তার আবির্ভাব ঘটে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, "তাদের চেহারার মত নূরাণী চেহারা আমি আর কাহারো দেখিনি। তাদের খুশবোর মত খুশব্যে আমি কোন আতরে পাইনি, তাদের লেবাসের মত উজ্জ্বল ও পরিষ্কার লেবাস আমি কারো দেখিনি। তারা ছিলেন জিদ্রাঈল (আ) ও মিকাঈল (আ)। তারা আমার দু বাহু ধরে চিৎ করে শোয়ালেন, পেট বিদীর্ণ করলেন, কোন রক্তপাত হল না, ব্যথা অনুভব হল না। একজন মোনার পেয়ালায় পানি আনলেন, অপরজন আমার অভ্যন্তর ভাগ দুইয়ে দিলেন। একজন অপরজনকে বলেন, দীল বিদীর্ণ করে ঘৃণা ও হিংসা বের করে ফেল। তারা ভিতরের জমাট বাধা রক্ত বের করে ফেলে দিলেন এবং এক প্রকার তৈলাক্ত পদার্থ ভিতরে ঢেলে দিলেন। উহা ছিল স্নেহ ও দয়া। অতঃপর কিছু বিচূর্ণ পদার্থ (মেঘচণর) ছিটালেন। তারা রাসূলুল্লাহ (স) -এর বৃদ্ধাঙ্গুলী ধারণ করত বলেন, "শান্তিতে থাকুন।" রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, "সেদিন হতে আমি দুনিয়ার সকলের জন্য অপূর্ব দয়া ও স্নেহ অনুভব করতে লাগলাম।"
তৃতীয় বক্ষবিদারণ
নবুয়ত প্রাপ্তির প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ (স) যখন হেরা গুহায় এতেকাফে রত ছিলেন তখন হৃদয়কে আরও শক্তিশালী ও তেজীয়ান করার জন্য বক্ষ বিদারণ করা হয়েছিল। পূর্ববৎ জিব্রাঈল ও মিকাঈল (আ) কালব বের করে পরিষ্কার করে দিলেন এবং তাঁকে উপুর করে শোয়ায়ে পিঠে সীল মহর করে দিয়েছিলেন। "রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, "মোহর করার সময়ে আমি উহ্য হৃদয়ে অনুভব করলাম।
চতুর্থ বক্ষবিদারণ
মিরাজ রজনীতে জিব্রারঈল (আ), মিকাঈল (আ) ও অপর একজন ফেরেস্তা রাসূলুল্লাহ (স) কে জমজম কূপের ধারে নিয়ে আসেন। পূর্ববৎ বক্ষবিদারণ করত জমজমের পানি আরা কালব ধৌত করলেন। ঈমান ও হিকমত ভরা একটা স্বর্ণপাত্র তাঁর কলবে ঢালা হল। অতঃপর কালব মোবারক যথাস্থানে সংযোজিত করা হলে রাসুলুল্লাহ (স) পূর্বাবস্থায় ফিরে এলেন।
বক্ষবিদারণের ফলে রাসূলুল্লাহ (স)-এর অন্তরে কোনরূপ কুভাব, কুচিন্তা, কালিমা-কলুষ কামনা-বাসনা কখনও স্থান পায়নি। তিনি কখনও অন্যায় অধর্মের কাজে লিপ্ত হন নি। মেরাজ রজনীতে বক্ষবিদারণের ফলে তিনি আরশ, আকাশসমূহ ও অন্যান্য অদৃশ্য জগৎসমূহে পরিভ্রমণের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তার দেহ এরূপ নির্মল বিশুদ্ধ ও হালকা হয়েছিল এবং তিনি দৈহিক ভাবে এমন শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন যে, এই সুদীর্ঘ সফরে কোনরূপ শ্রান্তি, ক্লান্তি অনুভব করেন নি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত অন্তরে অফুরন্ত প্রেম-প্রীতি ও স্নেহ ভালবাসার সন্নিবেশ করা হয়েছিল।
দৈহিক বক্ষ উন্মোচন ব্যতীত অন্য ভাবেও আল্লাহ্ তা'আলা তার হাবিবের হৃদয় সম্প্রসারণ করেছিলেন। এভাবে তার হৃদয় সম্প্রসারিত ও কলুষমুক্ত হওয়ার পর তিনি 'ওহী' প্রাপ্ত হন। নবুয়তের শ্রেষ্ঠতম গৌরব অর্জন করেন। তার উন্মুক্ত অন্তর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জ্ঞানের অনন্ত খনি বা অফুরন্ত ভাণ্ডারে পরিণত হয়। আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহ্ তা'লা অনেক মহাপুরুষের অন্তরই সম্প্রসারিত করে নানারূপ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী করেছেন। কিন্তু একাধারে দৈহিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বক্ষ উন্মোচন ও সম্প্রসারণ অন্য কারো নসিবে হয় নি। এটা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)-এর প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার খাছ অনুগ্রহ। বক্ষ উন্মোচনের ফলে তাঁর জিসিম মোবারক এরূপ সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ, নির্মল ও বিশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর অন্তর এমন সমুজ্জ্বল ও জ্যোতিপূর্ণ হয়েছিল যে, প্রখর সূর্য কিরণেও তাঁর পবিত্র দেহের ছায়া প্রতিবিম্বিত হত না। এতে প্রমানিত হয় রাসূলুল্লাহ (স)-এর জিসিম মোবারকের জ্যোতি সূর্য্যের জ্যোতি হতেও শক্তিশালী ও প্রখর ছিল।
0 Comments