প্রথম মূলনীতি, বিশ্বে যা কিছু অনিত্য ও সৃষ্ট, তা আল্লাহ তাআলারই কর্ম ও আবিষ্কার। তিনি ব্যতীত কোন স্রষ্টা বিশ্ব সৃষ্টি করেনি। সুতরাং বান্দার সমস্ত ক্রিয়াকর্ম আল্লাহ তাআলার কুদরতের সাথে জড়িত।
নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে এ মূলনীতির সমর্থন পাওয়া যায়-
اللهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْرٍ
"অর্থাৎ, সবকিছুর স্রষ্টাই আল্লাহ।"
واللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ
. অর্থাৎ, "আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং যা তোমরা কর, তাকে।"
وَأَسِرُّوا قَوْلَكُمْ أَوِجْهَرُوا بِهِ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ آلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ .
অর্থাৎ, "তোমরা গোপনে কথা বল অথবা প্রকাশ্যে, তিনি অন্তরের রহস্য জানেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেনই না বা কেন? তিনি রহস্যজ্ঞানী, সর্বজ্ঞাত।”
দ্বিতীয় মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা বান্দার কাজকর্মের স্রষ্টা- এটা এ বিষয়কে জরুরী করে না, কাজকর্ম 'ইকতিসাব' তথা উপার্জন হিসাবে বান্দার ক্ষমতাধীন থাকবে না। বরং আল্লাহ তাআলা ক্ষমতা ও ক্ষমতাশালী উভয়কেই সৃষ্টি করেছেন। কুদরত তথা ক্ষমতা বান্দার একটি আল্লাহ প্রদত্ত গুণ, যা বান্দার উপার্জিত নয়। অর্থাৎ বান্দার ক্রিয়াকর্ম একটা কুদরতী গুণের অধীনে সৃজিত হয়েছে। সুতরাং ক্রিয়াকর্ম সৃষ্টির দিক দিয়ে আল্লাহ তাআলার কুদরতের অধীন এবং ইকতিসাব ও উপার্জনের দিক দিয়ে বান্দার ক্ষমতার অধীন। কাজেই বান্দার ক্রিয়াকর্ম নিছক বাধ্যতামূলক নয়।
তৃতীয় মূলনীতি, বান্দার কর্ম বান্দার উপার্জন হলেও আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বাইরে নয়। এ থেকে বুঝা গেল, পৃথিবীতে ভাল-মন্দ, সৎ অসৎ, লাভ-লোকসান, কুফর-ঈমান, গোমরাহী-হেদায়াত, আনুগত্য-নাফরমানী ইত্যাদি যা কিছু হয়, সব আল্লাহ তাআলারই ফয়সালা দ্বারা হয় এবং তাঁর ইচ্ছা ও বাসনায় প্রকাশ পায়। কেউ তাঁর ফয়সালা টলাতে পারে না এবং তাঁর আদেশ পেছনে হটাতে পারে না। তিনি যাকে ইচ্ছা গোমরাহ এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন। তিনি যা করেন তার জন্য কারও কাছে জওয়াবদিহি করেন না, তবে বান্দাকে জওয়াবদিহি করতে হবে। এর ইতিহাসগত প্রমাণ হচ্ছে, সমগ্র উম্মত এ বাক্য সত্যতা বিশ্বাস করে
আল্লাহ্ যা চান তা হয় এবং যা চান না তা হয় না।
এর যৌক্তিক প্রমাণ হল, যদি আল্লাহ তাআলা গোনাহ ও অন্যায়কে খারাপ মনে করে এগুলোর ইচ্ছা না করেন, তবে এগুলো তাঁর দুশমন অভিশপ্ত ইবলীসের ইচ্ছায় হয়ে থাকে। বলাবাহুল্য, মানুষের মধ্যে গোনাহ্ নাফরমানীই অধিক। তা হলে দেখা যায়, ইবলীস আল্লাহ্ তাআলার শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তার ইচ্ছানুযায়ী মানুষ অধিক কাজ সম্পাদন করে এবং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছানুযায়ী কম কাজ সম্পাদন করা হয়। এখন বল, মুসলমান ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলার মর্যাদা এমন স্তরে কিরূপে নামিয়ে দেবে, যে স্তরে গ্রামের কোন মাতাব্বরকে নামিয়ে দিলে সে-ও মাতাব্বরীকে ঘৃণা করতে শুরু করবে? অর্থাৎ, গ্রামে যদি মাতাব্বরের কোন শত্রু থাকে এবং তার ইচ্ছানুযায়ী অধিক কাজ সম্পাদিত হয় মাতাব্বরের ইচ্ছা কমই পালিত হয়, তবে মাতাব্বর ব্যক্তি এমন মাতাব্বরীকে কি অবমাননাকর মনে করবে না? বেদআতীদের মতে মানুষের নাফরমানী, যা সংখ্যায় অধিক- আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার খেলাফে হয়ে থাকে। এটা আল্লাহ্ তাআলা দুর্বল ও অক্ষম হওয়ার দলীল (নাউযু বিল্লাহ্)। সুতরাং যখন প্রমাণিত হল, বান্দার ক্রিয়াকর্ম আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট, তখন এটাও প্রামাণিত হল যে, বান্দার ক্রিয়াকর্ম তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সম্পাদিত হয়। এখন প্রশ্ন হয়, আল্লাহ তাআলা যে কাজের ইচ্ছা করেন তা করতে বান্দাকে নিষেধ করেন কিরূপে এবং যে কাজের ইচ্ছা তিনি করেন না, সে কাজের আদশ করেন কিরূপে? এর জওয়াব হচ্ছে, আদেশ ও ইচ্ছা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। আদেশ করলেই ইচ্ছা করা জরুরী হয় না।
চতুর্থ মূলনীতি, সৃষ্টি, আবিষ্কার, আদেশ- এগুলো আল্লাহ্ তাআলার অনুগ্রহ, তাঁর উপর ওয়াজেব নয়। মু'তাযেলা সম্প্রদায় বলে, এগুলো তাঁর উপর ওয়াজেব। কারণ, এর মধ্যে বান্দার কল্যাণ নিহিত। তাদের এ উক্তি ঠিক নয়। কেননা ওয়াজেবকারী তো তিনিই। অতএব তিনি নিজে কিরূপে ওয়াজেব হওয়ার লক্ষ্যস্থল হতে পারেন? ওয়াজেব এমন কাজকে বলা হয়, যা বর্জন করলে ভবিষ্যতে অথবা তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতি হয়। উদাহরণতঃ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ওয়াজেব। এর অর্থ, এই আনুগত্য বর্জন করলে ভবিষ্যতে অর্থাৎ, আখেরাতে শাস্তিভোগ করতে হবে। অথবা পিপাসিত ব্যক্তির উপর পানি পান করা ওয়াজেব। অর্থাৎ, এটা বর্জন করলে পরিণামে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই অর্থে আল্লাহ্ তাআলার উপর কোন কিছু ওয়াজেব হতেই পারে না।
পঞ্চম মূলনীতি, যে কাজ করার শক্তি বান্দার মধ্যে নেই, সেই কাজের আদেশ করা আল্লাহ্ তাআলার জন্যে বৈধ, যদিও তিনি এরূপ আদেশ করেন না। কেননা, বৈধ না হলে এটা না করার প্রার্থনা অর্থহীন হবে। অথচ আল্লাহ তাআলার উক্তিতে এরূপ প্রার্থনা প্রমাণিত রয়েছে-
رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ .
অর্থাৎ, “হে পরওয়ারদেগার! আমাদের উপর এমন দায়িত্ব আরোপ করো না, যার শক্তি আমাদের নেই।"
ষষ্ঠ মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা কোন পূর্ব অপরাধ অথবা ভবিষ্যৎ সওয়াব ব্যতিরেকেই তাঁর সৃষ্টিকে কষ্ট ও শাস্তি দিতে পারেন। এটা তাঁর জন্যে বৈধ। কেননা, তিনি আপন মালিকানায় এ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন- অন্যের মালিকানায় নয়। অপরের মালিকানায় তার অনুমতি ছাড়া ক্ষমতা প্রয়োগ করাকে জুলুম বলা হয়। এটা আল্লাহ্র জন্যে অসম্ভব। কেননা, তাঁর সামনে অন্যের কোন মালিকানা নেই যে, তাতে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে জুলুম হবে। এ বিষয়ের অস্তিত্বই এর বৈধ হওয়ার দলীল। আমরা জন্তু জানোয়ারকে যবেহ্ হতে দেখি। মানুষ তাদেরকে নানা রকম কষ্ট দিয়ে থাকে। অথচ পূর্বে তাদের তরফ থেকে কোন অপরাধ প্রকাশ পায় না। সুতরাং কেউ যদি বলে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতে জন্তু-জানোয়ারকে জীবিত করবেন এবং তাদেরকে মানুষের কাছ থেকে নির্যাতনের বদলা দান করবেন, তবে তা শরীয়ত ও বিবেক উভয়ের গণ্ডির বাইরে।
সপ্তম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা বান্দার সাথে যেরূপ ইচ্ছা ব্যবহার করেন। বান্দার জন্যে যা অধিক উপযুক্ত, তা করা তাঁর উপর ওয়াজেব নয়। কেননা, আমরা পূর্বেই লেখেছি যে, আল্লাহ তাআলার উপর কোন কিছু ওয়াজেব হওয়া বোধগম্য নয়। তিনি যা করেন তার জন্যে তাকে জওয়াবদিহি করতে হয় না। কিন্তু মানুষের কাজের জওয়াবদিহি রয়েছে।
অষ্টম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলার মারেফত ও এবাদত তাঁর ওয়াজেব করার দিক দিয়ে এবং শরীয়তের আইনের দিক দিয়ে ওয়াজেব।
নবম মূলনীতি, পয়গম্বর প্রেরণ নিষ্ফল নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদী সম্প্রদায় এর বিপরীতে বলে, বিবেকের উপস্থিতিতে পয়গম্বর প্রেরণের মধ্যে কোন উপকারিতা নেই। এর জওয়াব হচ্ছে, আখেরাতে মুক্তির কারণ হয় এমন কাজ বিবেক দ্বারা জানা যায় না, যেমন বিবেক দ্বারা স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী ওষুধপত্র জানা যায় না। সুতরাং চিকিৎসকের যেমন প্রয়োজন তেমনি পয়গম্বরগণেরও প্রয়োজন। পার্থক্য হচ্ছে, চিকিৎসকের কথা অভিজ্ঞতা দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়, আর পয়গম্বর মোজেযা দ্বারা সত্য প্রমাণিত হন।
দশম মূলনীতি, আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-কে খাতামুন্নাবিয়্যীন (সর্বশেষ নবী)-রূপে এবং পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহের জন্যে রহিতকারীরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি তাঁকে প্রকাশ্য মোজেযা দ্বারা সমর্থন দান করেছেন; যেমন চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া, কংকরের তসবীহ্ পাঠ করা, চতুষ্পদ জন্তুর কথা বলা, অঙ্গুলি থেকে পানির ঝরণা প্রবাহিত হওয়া ইত্যাদি। মুহাম্মদ (সাঃ) যে প্রকাশ্য মোজেযা দ্বারা সমগ্র আরবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তা হচ্ছে কোরআন মজীদ। ভাষাশৈলী ও অলঙ্কার নিয়ে আরববাসীদের গর্বের অন্ত ছিল না। এতদসত্ত্বেও তারা কোরআনের মোকাবিলা করতে সক্ষম হল না। কেননা, কোরআনে যে চমৎকার রচনাশৈলী, ভাবের গাম্ভীর্য ও বাক্যাবলীর বিশুদ্ধতা রয়েছে, তার সমাবেশ করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। আরবরা তাঁকে গ্রেফতার করেছে, লুটেছে, হত্যার চেষ্টা করেছে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে; কিন্তু পারেনি কেবল কোরআনের মত রচনা পেশ করতে। অথচ রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিরক্ষর ছিলেন, পড়ালেখার ধারে-কাছেও যাননি। এতদসত্ত্বেও তিনি কোরআন পাকে পূর্ববর্তী লোকদের নির্ভুল খবর এবং অনেক বিষয়ে অদৃশ্যের সংবাদাদি বর্ণনা করেছেন, যেগুলোর সত্যতা পরবর্তীকালে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় এর দৃষ্টান্ত:
لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللَّهُ أَمِنِينَ مُعَلِّقِينَ رُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ .
অর্থাৎ, "আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে, কেউ কেউ মস্তক মুণ্ডিত করবে এবং কেউ কেউ কেশ কর্তন করবে।"
الم غُلِبَتِ الرُّومُ فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُمْ مِنْ بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ فِي بِضْعِ سِنِينَ .
অর্থাৎ, রোম পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী ভূভাগে, কিন্তু তারা এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই কয়েক বছরের মধ্যেই বিজয়ী হবে।
0 Comments