যেসব আভ্যন্তরীণ বিষয় দ্বারা নামাযের জীবন পূর্ণাঙ্গ হয়

        প্রকাশ থাকে যে, এসব বিষয় বুঝানোর জন্যে অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ছয়টি শব্দ সবগুলো বিষয় একত্রে সন্নিবেশিত করে। এখন কারণ ও প্রতিকারসহ এসব শব্দের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে প্রথম শব্দ হচ্ছে হুযুরে দিল (অন্তরের উপস্থিতি)। এর উদ্দেশ্য, মানুষ যে কাজ করছে এবং যে কথা বলছে, সেটি ছাড়া অন্যান্য কাজ ও কথা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। অর্থাৎ, অন্তর কাজ ও কথা উভয়টি জানবে এবং এ দুটি ছাড়া অন্য কিছুতে তার চিন্তা ঘুরাফেরা করবে না। মানুষ যে কাজে লিপ্ত, তার চিন্তা যখন সেই কাজ ছাড়া অন্য দিকে না যায় এবং স্মৃতিতে সেই কাজই জাগরূক থাকে, তখন তার অন্তরের উপস্থিতি অর্জিত হয়।

        দ্বিতীয় শব্দ ফাহম অর্থাৎ কালামের অর্থ বুঝা। এটা অন্তরের উপস্থিতি থেকে ভিন্ন। কেননা, প্রায়ই অন্তর শব্দের সাথে উপস্থিত থাকে এবং অর্থের সাথে উপস্থিত থাকে না। ফাহমের উদ্দেশ্য অন্তরে শব্দের অর্থ জানা। এক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। কোরআনের অর্থ ও তসবীহ্ বুঝার ব্যাপারে সকলেই একরূপ নয়। অনেক সূক্ষ্ম অর্থ নামাযী ঠিক নামাযের মধ্যেই বুঝে নেয়, অথচ পূর্বে তার অন্তরে এ অর্থ কখনও ছিল না। এ কারণেই নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ করতে বারণ করে। অর্থাৎ এমন বিষয় হৃদয়ঙ্গম করায়, যা মন্দ কাজে প্রতিবন্ধক হয়।

        তৃতীয় শব্দ তাযীম (ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন)। এটা অন্তরের উপস্থিতি ও ফাহম থেকে ভিন্ন। কেননা, মানুষ তার গোলামের সাথে কথা বলে, অন্তরও হাযির থাকে এবং নিজের কথার অর্থও বুঝে; কিন্তু গোলামের তাযীম করে না। এ থেকে জানা গেল, তাযীম হুযুরে দিল ও ফাহমের ঊর্ধ্বে।

        চতুর্থ শব্দ 'হয়বত' অর্থাৎ ভয়। এটা তাযীমেরও ঊর্ধ্বে। বরং হয়বত সেই ভয়কে বলে, যা তাযীম থেকে উদ্ভূত হয়। বিচ্ছু, গোলামের অসচ্চরিত্রতা ইত্যাকার সামান্য জিনিসের ভয়কে হয়বত বলে না; বরং প্রতাপশালী বাদশাহকে ভয় করার নাম হয়বত।

        পঞ্চম শব্দ রাজা অর্থাৎ আশা। এটাও পূর্ববর্তী সবগুলো থেকে ভিন্ন। অনেক মানুষ কোন বাদশাহের তাযীম করে। তার প্রতাপকে ভয় করে; কিন্তু তার কাছে কোন কিছু আশা করে না। বান্দার উচিত নামায দ্বারা আল্লাহ তাআলার সওয়াব আশা করা।

        ষষ্ঠ শব্দ হায়া অর্থাৎ লজ্জা-শরম। এটা পূর্ববর্তী পাঁচটি থেকে আলাদা। কেননা, এর উৎপত্তি নিজের ভুল ত্রুটি উপলব্ধি করা থেকে। অতএব তাযীম, ভয় ও আশা এমন হতে পারে, যাতে হায়া নেই। অর্থাৎ, ত্রুটির ধারণা ও গোনাহের কল্পনা না থাকলে হায়া হবে না।

        মোট কথা, উপরোক্ত ছয়টি বিষয় দ্বারা নামাযের প্রাণ পূর্ণাঙ্গ হয়। এখন এগুলোর কারণ আলাদা আলাদা বর্ণিত হচ্ছে।

        মনের উপস্থিতির কারণ হিম্মত তথা চিন্তা-ফিকির। মানুষের মন তার হিম্মতের অনুকরণ করে। যে বিষয় মানুষকে চিন্তান্বিত করে দেয় তাতেই তার অন্তর উপস্থিত থাকে। চিন্তার কাজে অন্তর উপস্থিত থাকাই মানুষের মজ্জা। নামাযে অন্তর উপস্থিত না হলে অন্তর বেকার থাকবে না; বরং যে পার্থিব বিষয়ে চিন্তা ব্যাপৃত থাকবে তাতেই অন্তর উপস্থিত থাকবে। কাজেই নামাযে অন্তর উপস্থিত করার একমাত্র প্রতিকার হচ্ছে, চিন্তাকে নামাযের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। চিন্তা নামাযের দিকে ঘুরবে না, যে পর্যন্ত প্রকাশ না পায় যে, প্রার্থিত লক্ষ্য নামাযের সাথেই সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ এ বিষয়ের পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে যে, আখেরাত উত্তম, চিরস্থায়ী ও প্রার্থিত লক্ষ্য। নামায এ লক্ষ্য অর্জনের উপায়। এ বিষয়কে দুনিয়ার নিকৃষ্টতার সাথে যোগ করলে উভয়ের সমষ্টি দ্বারা নামাযে অন্তরের উপস্থিতি অর্জিত হবে। তুমি যখন কোন শাসনকর্তার কাছে যাও, যে তোমার উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না, তখন এ ধরনের বিষয় চিন্তা করলে অন্তর হাযির হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সকল প্রকার লাভ লোকসান এবং পৃথিবীর ও আকাশের রাজত্বের অধিকারী আল্লাহর সাথে মোনাজাতের সময় যদি তোমার অন্তর উপস্থিত না হয়, তবে এর কারণ তোমার ঈমানের দুর্বলতা ছাড়া অন্য কিছুকে মনে করো না। এ অবস্থায় তোমার উচিত ঈমান শক্তিশালী করার চেষ্টায় ব্রতী হওয়া। এর উপায় পূর্ণরূপে অন্যত্র বর্ণনা করা হবে।

        অন্তরের উপস্থিতির পর ফাহমের কারণ হচ্ছে চিন্তাকে সদা ব্যাপৃত রাখা এবং অর্থোপলব্ধির দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। এর উপায় তাই, যা অন্তর উপস্থিত করার উপায়। এর সাথেই চিন্তার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে এবং যেসব কুমন্ত্রণা অন্তরকে বিমুখ করে দেয়, সেগুলো দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। এ ধরনের কুমন্ত্রণা দূর করার প্রতিকার হচ্ছে এগুলোর উপকরণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, অর্থাৎ যেসব উপকরণের দিকে কুমন্ত্রণা ধাবিত হয়, সেগুলো নিজের কাছে না রাখা। কেননা, মানুষ যে বস্তুকে প্রিয় মনে করে, তার আলোচনা বেশী করে। এ আলোচনা নিশ্চিতই অন্তরে ভীড় সৃষ্টি করে। এ কারণেই যারা গায়রুল্লাহকে ভালবাসে, তাদের নামায কুমন্ত্রণা মুক্ত হয় না।

        দু'টি বিষয় জানার কারণে অন্তরে তাযীম সৃষ্টি হয়- (১) আল্লাহ্ তাআলার প্রতাপ ও মাহাত্ম্যের পরিচয় লাভ করা, যা মূল ঈমান। কেননা, যেব্যক্তি আল্লাহর মাহাত্ম্যের বিশ্বাসী হবে না, তার মন আল্লাহর সামনে নত হবে না। (২) নিজের হেয়তা ও নীচতা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। এ দু'টি বিষয় জানা থেকে অনুনয়, বিনম্র ভাব ও খুশু জন্ম লাভ করে, যাকে তাযীম বলা হয়। যে পর্যন্ত নিজের নীচতা জ্ঞান আল্লাহ তাআলার প্রতাপ জ্ঞানের সাথে যুক্ত না হয়, সে পর্যন্ত তাযীম ও খুশুর অবস্থা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় না।

        হয়বত ও ভয় আল্লাহ তাআলার কুদরত, প্রাবল্য ও তাঁর ইচ্ছা প্রযোজ্য হওয়ার জ্ঞান থেকে জন্ম লাভ করে। অর্থাৎ, একথা হৃদয়ঙ্গম করবে, যদি আল্লাহ্ তাআলা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলকে ধ্বংস করে দেন, তবে তাঁর রাজত্ব বিন্দুমাত্রও হ্রাস পাবে না। এর সাথে পয়গম্বর ও ওলীগণের উপর আগত বিপদাপদ সম্পর্কেও চিন্তা-ভাবনা করবে। মোট কথা, আল্লাহ তাআলার পরিচয় মানুষ যত বেশী লাভ করবে, হয়বত বা ভয়ও ততই বেশী হবে।

        'রাজা' তথা আশার কারণ এই, মানুষ আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহ, কৃপা ও নেয়ামতকে চিনবে এবং নামাযের কারণে তিনি যে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন তা সত্য মনে করবে। যখন ওয়াদার প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁর কৃপার জ্ঞান অর্জিত হবে, তখন উভয়ের সমষ্টি মানুষের অন্তরে নিশ্চিতই আশার সৃষ্টি করবে।

        'হায়া' তথা লজ্জা-শরম সৃষ্টি হওয়ার উপায় হচ্ছে, মানুষ এবাদতে নিজেকে ত্রুটিকারী মনে করবে এবং বিশ্বাস করবে, আল্লাহ্ তাআলার যথার্থ হক আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে না। সাথে সাথে একথাও জানবে, অন্তরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কুমন্ত্রণা সম্পর্কেও আল্লাহ তাআলা অবগত আছেন। এসব জ্ঞান থেকে নিশ্চিতরূপে যে অবস্থা উৎপন্ন হবে, তাকেই হায়া বলা হয়।

        অতএব উপরোক্ত ছয়টি বিষয়ের মধ্য থেকে কোন একটি অর্জন করতে হলে তার কারণ জানতে হবে। কেননা, কারণ জানা হয়ে গেলে তার প্রতিকার আপনা আপনি জানা যায়। উপরে বর্ণিত জ্ঞানসমূহ একীনের স্তরে পৌছে যেতে হবে। তাতে কোন প্রকার সন্দেহ থাকতে পারবে না। এগুলো অন্তরে প্রবলও হতে হবে। একীনের অর্থ যে সন্দেহ না থাকা এবং অন্তরে প্রবল হওয়া, একথা আমরা এলেম অধ্যায়ে লেখে এসেছি। যে পরিমাণে একীন হয়, সেই পরিমাণে অন্তর খুশু করে। এ কারণেই হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন: রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের সাথে কথা বলতেন এবং আমরা তাঁর সাথে কথা বলতাম, কিন্তু নামাযের সময় এসে গেলে তিনি যেন আমাদেরকে চিনতেন না এবং আমরাও তাঁকে চিনতাম না। বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে ওহী পাঠালেন: হে মূসা! তুমি যখন আমাকে স্মরণ কর, তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঝেড়ে নাও এবং খুশু ও স্থিরতা সহকারে থাক। যখন আমার যিকির কর তখন জিহ্বাকে অন্তরের পেছনে রাখ। যখন আমার সামনে দাঁড়াও, তখন লাঞ্ছিত দাসের মত দাঁড়াও। সাচ্চা মুখে ও ভীত অন্তরের সাথে আমার কাছে মোনাজাত কর। আল্লাহ তাআলা মূসা (আঃ)-এর প্রতি আরও ওহী প্রেরণ করেন- হে মূসা! তোমার উম্মতকে বলে দাও,

        তারা যেন আমাকে স্মরণ না করে। কেননা, আমি নিজেকে কসম দিয়েছি, যে কেউ আমাকে স্মরণ করবে, আমি তাকে স্মরণ করব। সুতরাং তোমার উম্মত আমাকে স্মরণ করলে আমি তাদেরকে লানত সহকারে স্মরণ করব। এ হচ্ছে গাফেল নয়- এমন গোনাহগারের অবস্থা। যদি গাফিলতি ও গোনাহ উভয়টি একত্রিত হয়, তবে অবস্থা কি হবে?

        আমরা উপরে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছি, এগুলোতে মানুষের অবস্থা বিভিন্ন রূপ। কতক মানুষ এমন গাফেল যে, নামায সবগুলো পড়ে, কিন্তু এক মুহূর্তও অন্তর উপস্থিত হয় না। আবার কেউ কেউ এমন, নামায পূর্ণরূপে পড়ে এবং এক মুহূর্তও অন্তর অনুপস্থিত থাকে না; বরং মাঝে মাঝে চিন্তাকে এমনভাবে নামাযে নিয়োজিত রাখে, তাদের কাছে কোন দুর্ঘটনা হয়ে গেলেও তারা তার খবর রাখেন না। এ কারণেই মুসলিম ইবনে ইয়াসার নামাযে দাঁড়িয়ে মসজিদের একাংশের পতন ও এ কারণে লোকজনের জড়ো হওয়ার বিষয় জানতে পারেননি। কোন কোন মনীষী দীর্ঘ দিন পর্যন্ত নামাযের জামাআতে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু কোন সময় চিনতে পারলেন না, ডান দিকে কে এবং বাম দিকে কে দাঁড়িয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর অন্তরের স্ফুটন দু'মাইল দূর থেকে শুনা যেত। কিছু লোকের মুখমন্ডল নামাযের সময় ফ্যাকাসে হয়ে যেত এবং স্কন্ধ কাঁপতে থাকত। এসব ব্যাপার মোটেই অবাস্তব নয়। কেননা, দুনিয়াদারদের ধমক এবং দুনিয়ার বাদশাহদের ভয়ে এর চেয়েও অনেক বেশী ভীতকম্পিত হতে দেখা যায়। অথচ তারা অক্ষম ও দুর্বল। তাদের কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তাও নগণ্য ও তুচ্ছ। এমনকি, কোন ব্যক্তি বাদশাহ অথবা মন্ত্রীর কাছে গিয়ে কোন নালিশ সম্পর্কে কথা বলার পর যখন চলে আসে, তখন যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয়- বাদশাহের আশেপাশে কারা ছিল এবং বাদশাহের পোশাক কি ছিল, তবে সব কিছুতেই বলবে, জানি না। কেননা, নিজের কাজে মগ্ন থাকার কারণে বাদশাহের পোশাক অথবা আশেপাশের লোকজনকে দেখার কোন ফুরসতই তার ছিল না। যেহেতু প্রত্যেকেই তার আমলের বিভিন্ন অংশ পাবে, তাই নামাযে প্রত্যেকের অংশ ততটুকুই হবে, যতটুকু সে ভয়, খুশু ও তাযীম করবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা দেখেন অন্তর- বাহ্যিক নড়াচড়া নয়। এজন্যেই কোন কোন সাহাবী বলেন: কেয়ামতে মানুষ সেই অবস্থায় উত্থিত হবে, যা তার নামাযে হবে। অর্থাৎ নামাযে যে পরিমাণ প্রশান্তি, স্থিরতা ও আনন্দ হবে, কেয়ামতে সে সেই পরিমাণে প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ করবে। সাহাবায়ে কেরাম ঠিকই বলেছেন। কেননা, মানুষের হাশর সেই অবস্থায় হবে, যে অবস্থায় সে মরবে। আর মানুষ মরবে সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় সে জীবন যাপন করেছে। এতে তার অন্তরের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে- বাহ্যিক শারীরিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করা হবে না। কেননা, অন্তরের গুণাবলী দ্বারাই পরকালে আকার আকৃতি তৈরী করা হবে এবং নাজাত সে-ই পাবে, যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে যাবে। আল্লাহ স্বীয় কৃপায় আমাদেরকেও তওফীক দিন।

Post a Comment

0 Comments