নামাযের বাহ্যিক ক্রিয়াকর্ম

        নামাযী যখন ওযু করে, শরীর, স্থান ও বস্ত্র নাপাকী থেকে পাক করে নেয় এবং নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত বস্ত্রাবৃত করে, তখন কেবলামুখী হয়ে উভয় পায়ের মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব রেখে দণ্ডায়মান হবে। উভয় পা পরস্পর মেলাবে না। এভাবে দণ্ডায়মান হওয়া মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। রসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাযে 'সকদ' ও 'সকন' করতে নিষেধ করেছেন। সকদ মানে উভয় পা মিলিয়ে দণ্ডায়মান হওয়া এবং সকন অর্থ এক পায়ে জোর রেখে অপর পা বাঁকা করে রাখা। দণ্ডায়মান অবস্থায় উভয় হাঁটু ও কোমর সোজা রাখতে হবে। মাথা সোজাও রাখা যায় এবং নতও রাখা যায়। নত রাখা বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী। দৃষ্টি জায়নামাযের উপর রাখা উচিত। যদি জায়নামায না থাকে, তবে প্রাচীরের কাছে দাঁড়াবে অথবা নিজের চারপাশে রেখা টেনে নেবে। এতে দৃষ্টির দূরত্ব কমে যায় এবং চিন্তা বিক্ষিপ্ত হয় না। যদি জায়নামাযের কিনার থেকে অথবা রেখার সীমার বাইরে দৃষ্টি চলে যায়, তবে বাধা দিতে হবে। দণ্ডায়মান হওয়ার এ অবস্থা রুকু পর্যন্ত অব্যাহত রাখা উচিত। এভাবে কেবলামুখী হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে গেলে শয়তান থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে সূরা নাস পাঠ করবে। এর পর তকবীর বলবে।

        যদি কোন মুক্তাদীর আগমন প্রত্যাশা করা হয়, তবে প্রথমে আযান দেবে। এরপর নিয়ত করবে। উদাহরণতঃ মনে মনে যোহরের নামাযের নিয়ত করে বলবে, আমি যোহরের ফরয আল্লাহর ওয়াস্তে আদায় করছি। এ নিয়ত তকবীরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে। মনে একথা উপস্থিত করে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত এমনভাবে উঠাবে যে, উভয় হাতের তালু উভয় কাঁধের বিপরীতে এবং উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলি উভয় কানের লতির বিপরীতে থাকবে। অঙ্গুলিসমূহের মাথা উভয় কানের বিপরীতে থাকবে। হাত এখানে স্থির হওয়ার পর অন্তরে নিয়ত উপস্থিত করে আল্লাহু আকবার বলবে এবং উভয় হাত নামাতে শুরু করবে। এর পর আল্লাহ আকবার পূর্ণ করে উভয় হাত নাভির উপরে এবং বুকের নীচে বাঁধবে। (এটা ইমাম শাফেয়ী (রঃ)-এর মাযহাব)। ডান হাত উপরে ও বাম হাত নীচে থাকবে এবং ডান হাতের শাহাদত ও মধ্যের অঙ্গুলিগুলো বাম হাতের কব্জির উপর ছড়িয়ে দেবে। বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দ্বারা বাম হাতের বাহু ধরে রাখবে। রেওয়ায়েতসমূহে আল্লাহু আকবার বলা হাত উঠানোর সাথেও, হাত থেমে যাওয়ার সময়ও এবং বাঁধার জন্যে নামানোর সাথেও বর্ণিত আছে। কাজেই এই তিন সময়ের যে কোন সময় আল্লাহু আকবার বলা যায়। এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহু আকবার বলার পর হাত ঝুলিয়ে দিতেন। এর পর কেরাআত পড়ার ইচ্ছা করলে ডান হাত বাম হাতের উপর বেঁধে নিতেন। এ হাদীস বিশুদ্ধ হলে এ পদ্ধতি উত্তম।

        এর পর শুরুর দোয়া পড়বে। আল্লাহু আকবারের সাথে এ দোয়া মিলিয়ে পড়া উত্তম-

اللهُ أَكْبَرُ كَبِيرًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيرًا وَسُبْحَنَ اللَّهِ بكْرَةً وَأَصِيلًا إِنِّي وَجَهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ والأرض حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ إِنَّ صَلوتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ وبذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ .

        অর্থাৎ, "আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করি। আমি একনিষ্ঠ হয়ে আমার মুখমণ্ডল তাঁর দিকে করলাম, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্তে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি এ বিষয়েই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।” (হানাফী মযহাব অনুযায়ী উক্ত দোয়াটি নিয়তের আগে পড়া হয়। শাফেয়ী মতাবলম্বী লেখক এখানে স্বীয় মাযহাবের অনুসরণ করেছেন। -অনুবাদক) এরপর বলবে-

سُبْحَنَكَ اللهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ .


        অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র। আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনার নাম বরকতময়, আপনার স্থান উচ্চ এবং আপনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই।"

        ইমাম এত দীর্ঘ বিরতি না দিলে মুক্তাদী এ অবস্থায় কেবল শেষোক্ত দোয়াটিই পড়ে নেবে। এর পর আউযু বিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ করে সূরা ফাতেহার কেরাআত শুরু করবে। সূরা ফাতেহা শেষ করে 'আমীন' শব্দটি একটু টেনে উচ্চারণ করবে। ফজর, মাগরিব ও এশার নামাযে কেরাআত সরবে পড়বে। মুক্তাদী হলে পড়বে না। এর পর একটি সূরা অথবা কমপক্ষে তিন আয়াত পরিমাণ পাঠ করবে। কেরাআতের শেষ ভাগকে রুকুর আল্লাহু আকবারের সাথে মেলাবে না। বরং সোবহানাল্লাহ্ বলার সময় পরিমাণ বিরতি দেবে। ফজরের নামাযে তিওয়ালে মুফাসসাল ও মাগরিবে কিসারে মুফাসসালের কেরাআত পড়বে। যোহর, আছর ও এশার নামাযে وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الْبُرُوج ও তার মত অন্যান্য সূরা পাঠ করবে। সফর অবস্থায় ফজরের নামাযে সূরা কাফিরুন ও সূরা এখলাস পড়বে। ফজরের সুন্নতেও তাই পড়বে। কেরাআত শেষে রুকু করবে, এর জন্যে আল্লাহু আকবার বলবে। তকবীর এতটুকু টেনে পড়বে যেন রুকুতে পৌঁছার পর শেষ হয়। রকুতে উভয় হাতের তালু হাঁটুর উপর রাখবে এবং অঙ্গুলিসমূহ ছড়িয়ে গোছার দিকে কেবলামুখী রাখবে। এ সময় মাথা, ঘাড় ও পিঠ সমতল থাকবে। উভয় কনুই পার্শ্ব থেকে আলাদা থাকবে। স্ত্রীলোক কনুই পার্শ্বের সাথে মিলিয়ে রাখবে।

        রুকুতে তিন বার সোবহানা রাব্বিয়াল আযীম বলবে। ইমাম না হলে তিনের অধিক সাত ও দশ বার পর্যন্ত বলা উত্তম। এর পর রুকু থেকে  سمعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ )  বলতে-বলতে সোজা দাঁড়াবে এবং

ربَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلاَ السَّمَوَاتِ وَمِلًا الْأَرْضِ وَمِلًا مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ

        এর পর তকবীর বলতে বলতে সেজদার জন্যে নত হবে। প্রথমে হাঁটু মাটিতে রাখবে, এর পর খোলা অবস্থায় হাতের তালু ও কপাল মাটিতে রাখবে এবং সকলের শেষে নাকের ডগা রাখবে। এ সময় কনুই পার্শ্ব থেকে আলাদা রাখবে এবং স্ত্রীলোক হলে মিলিয়ে রাখবে। সেজদায় পেট উরু থেকে আলাদা রাখবে এবং উভয় উরু পৃথক রাখবে। স্ত্রীলোক পেট উরুর সাথে এবং উভয় উরু পরস্পরে মিলিয়ে রাখবে। হাত মাটিতে কুকুরের ন্যায় বিছিয়ে রাখবে না; বরং কনুই উপর রাখবে। কনুই মাটিতে লাগানো নিষিদ্ধ। সেজদায় তিন বার সোবহানা রাব্বিয়াল আ'লা বলবে। আরও বেশী বার বলা উত্তম। ইমাম হলে তিন বারের বেশী বলা অনুচিত। এর পর তকবীর বলতে বলতে সেজদা থেকে মাথা তুলে স্থিরভাবে বসে যাবে। বাম পায়ের উপর বসে ডান পা খাড়া রাখবে এবং উরুর উপর উভয় হাতের অঙ্গুলিসমূহ স্বাভাবিক অবস্থায় খোলা রাখবে। এরপর প্রথম সেজদার ন্যায় দ্বিতীয় সেজদা করবে এবং আল্লাহু আকবার বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় রাকআতও প্রথম রাকআতের মতই পড়বে। দ্বিতীয় রাকআত সেজদাসহ শেষ করার পর বসা অবস্থায় তাশাহ্হুদ পড়বে। তাশাহ্হুদ পড়ার সময় দু'সেজদার মাঝখানে যেভাবে বসেছিলে, সেভাবে বসবে। অর্থাৎ, ডান পা খাড়া রেখে বাম পায়ের উপর বসবে এবং ডান হাত ডান উরুর উপর ও বাম হাত বাম উরুর উপর রাখবে। তাশাহহুদের মধ্যে 'ইল্লাল্লাহু' বলার সময় ডান হাতের শাহাদত অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করবে এবং অন্য অঙ্গুলিগুলো বন্ধ করে নেবে। শেষ তাশাহহুদের মধ্যে দরূদের পর দোয়া মাসূরা পাঠ করবে। এরপর ডান السَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله মুখ এতটুকু ফেরাবে যেন পেছনের মুসল্লী তার ডান গাল দেখতে পায়। এর পর বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে একইভাবে সালাম বলবে। প্রথম সালামে ডান দিকের ফেরেশতা ও মুসল্লীদের নিয়ত করবে। তেমনি দ্বিতীয় সালামে বাম দিকের ফেরেশতা ও মুসল্লীদের নিয়ত করবে। ইমাম হলে নামাযের সকল তকবীর সরবে বলবে। ইমাম ইমামতির নিয়ত করবে। এতে সওয়াব হবে। যদি ইমামতির নিয়ত না করে নামায পড়ে নেয়, মুক্তাদীর নামায দুরস্ত হবে এবং জামাআতের সওয়াব সকলেই পাবে। ইমাম নামাযের দোয়া, আউযু বিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ নীরবে পড়বে। ফজরের দু'রাকআতে এবং মাগরিব ও এশার প্রথম দু'রাকআতে ইমাম আলহামদু ও অন্য সূরা সরবে পাঠ করবে। পরবর্তী রাকআতসমূহে কেবল আলহামদু পড়বে এবং নীরবে পড়বে। সালামের পর ইমাম বুকের বিপরীতে দুই হাত তুলে দোয়া করবে এবং দোয়ার পর মুখমণ্ডলের উপর হাত বুলিয়ে নেবে।

Post a Comment

0 Comments