আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন-
إن الصَّلوةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كتابا موقوتا. -
'নিশ্চয়ই মোমেনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে নামায আদায় করা ফরয' -সূরা নেসা: ১০৩
আল্লাহর রাসুল (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা বান্দার উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন, যে ব্যক্তি তার হক আদায় করবে এবং হালকা মনে করে বিনাশ করবে না, তার জন্য আল্লাহ্ তা'আলার ওয়াদা রয়েছে, তিনি তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। আর যে তা না করবে, তার জন্য আল্লাহর কোন ওয়াদা নেই। আল্লাহ্ চাইলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন অথবা জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন।
তিনি আরও বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, তোমাদের কারো বাড়ির সামনে একটি স্বচ্ছ নহর এবং তাতে প্রচুর পানিও রয়েছে, কেউ সে নহরে দৈনিক পাঁচ বার গোসল করলে তার দেহে কি সামান্যতম ময়লাও অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, না, থাকবে না। রাসূল (ছঃ) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও ঠিক তদ্রূপ। পানি দ্বারা যেমন দেহের ময়লা দূর হয়ে যায়, নামায দ্বারাও ঠিক তদ্রূপ মানুষ পাপের ময়লা থেকে পবিত্র হয়ে যায়।
হাদীস শরীফে আরও আছে, 'নামায এক ওয়াক্ত থেকে অপর ওয়াক্তের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহের জন্য কাফফারা; অবশ্য কবীরা গুনাহ্ থেকে যদি বেঁচে থাকা হয়।' যেমন আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন-
إِنَّ الْحَسَنَتِ يُذْهبن السيئت .
'নিঃসন্দেহে নেক আমল পাপসমূহকে দূর করে দেয়।' -সূরা হুদঃ১১৪
উপরোক্ত আয়াতে يذهبن السيئت আয়াতাংশের মর্ম হল, নেক আমল
অশুভ কর্মের পঙ্কিলতা এমনভাবে পরিষ্কার করে দেয়, যেন ইতোপূর্বে তা আদৌ ছিল না। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, এক লোক জনৈকা স্ত্রীলোককে চুমু খেয়েছিল, অতঃপর সে এসে রাসূল (ছঃ)-কে এ বিষয়ে জানালে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ
-'নামায প্রতিষ্ঠা কর দিনের দু'অংশে এবং রাতের কিছু অংশে; নিঃসন্দেহে নেক আমল পাপসমূহ দূর করে দেয়।'
তখন সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ), এ আয়াতের বিষয়বস্তু কি বিশেষভাবে আমার জন্য? বললেন, না; বরং আমার উম্মতের সকলের জন্যই এ আয়াতের বিষয়বস্তু ব্যাপক।
হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (ছঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ)। আমি হদ্দের কাজ করেছি; সুতরাং আমার উপর শান্তি প্রয়োগ করুন। একথা সে একবার কি দু'বার বলে। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এমন সময় নামাযের সময় হয়ে গেল। নবী করীম (ছঃ) নামায শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি কোথায়? সে দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহ্ রাসূল (ছঃ)। এই যে আমি উপস্থিত। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'তুমি কি পূর্ণাঙ্গ ওযু করে আমাদের সাথে নামায় আদায় করনি? লোকটি বলল, হ্যাঁ, আদায় করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বললেন, 'তোমার কৃত অপরাধ মাফ হয়ে গেছে; মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তুমি যেরূপ নিষ্পাপ ছিলে, এখন তুমি সেরূপ নিষ্পাপ।' অতঃপর এ আয়াত অবতীর্ণ হয়ঃ 'নামায প্রতিষ্ঠা কর দিনের দুঅংশে এবং রাতের কিছু অংশে নিঃসন্দেহে নেক আমল পাপসমূহ সাফ করে দেয়।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, 'আমাদের এবং মোনাফেকদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় ফজর ও এশার জামাতে উপস্থিতির দ্বারা; তারা এ দুওয়াক্তের জামাতে হাজির হয় না।' তিনি আরও বলেন, 'নামায দ্বীনের খুঁটি, যে ব্যক্তি নামায পরিত্যাগ করল সে দ্বীন বরবাদ করল।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সর্বোত্তম কাজ কোনটি? তিনি জবাবে বললেন, ঠিক সময়ে নামায আদায় করা।
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ পবিত্রতা ও ওযু সহকারে সঠিক সময়ে পাবন্দির সাথে নামায পড়বে, শেষ বিচারের দিন নামায তার জন্য নূর, প্রমান ও মুক্তির কারণ হবে। যে নামাযের হেফাযত করবে না, তার হাশর ফেরাউন ও হামানের সাথে হবে।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আরও বলেন, 'নামায বেহেশতের চাবি।' তিনি এও বলেন, 'তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের পর সর্বাপেক্ষা প্রিয় ইবাদত হল নামায। নামাযের চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ কোন ইবাদত যদি হত, তবে ফেরেশতারাও তাতে শরীক হতেন। অথচু ফেরেশতাদের অনেকেই রুকু অবস্থায়, অনেকেই সেজদাবনত অবস্থায়, অনেকেই দাঁড়ানো অবস্থায় এবং অনেকেই উপবিষ্ট অবস্থায় ইবাদতরত রয়েছেন।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, 'যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নামায পরিত্যাগ করল, সে কুফরী করল। অর্থাৎ ঈমানের বাঁধ খুলে যাওয়ার কারণে বা স্তন্ত ধসে যাওয়ায় সে কুফরের অতি নিকটবর্তী হয়ে গেল।'
রাসূল (ছঃ) আরও বলেছেন, 'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করে, তার থেকে আল্লাহর নিরাপত্তা উঠে যায়।'
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, 'যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করে নামাযের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়, যে পর্যন্ত তার হৃদয়ে নামাযের ইচ্ছা বহাল থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কদমে একটি নেকী লেখা হয় এবং একটি গুনাহ মোচন হয়। ইকামতের আওয়াজ শোনার পর নামাযের দিকে অগ্রসর না হয়ে পশ্চাদপদ হওয়া তোমাদের আদৌ উচিত নয়। তোমাদের মধ্যে যার গৃহ বেশি দূরে, আল্লাহর কাছে তার পুরস্কারও বেশি। কেননা, মসজিদ পর্যন্ত উপনীত হতে তার পদচারণার সংখ্যা বেশি।'
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন-
-'অপ্রকাশ্য আল্লাহকে সেজদা করা অপেক্ষা অধিক নৈকট্যদানকারী আর কোন বন্দেগী নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'কোন মুসলমান আল্লাহকে যখন সেজদা করে, আল্লাহ তা'আলা তখন তাঁর একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং একটি গুনাহ বিলুপ্ত করেন।'
বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর নিকট আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ), আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যাতে আমি হাশরের ময়দানে আপনার শাফাআত লাভ করতে এবং জান্নাতে আপনার সাথে থাকতে পারি। আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বললেন, থাকে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে- واسجد واقترب .
-'আপনি সেজদা করুন এবং নৈকট্য লাভ করুন।' -সূরা আলাক: ১৯
আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন-
سِيْمُهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أثر السجود .
-'তাদের লক্ষণ হচ্ছে, তাদের মুখমণ্ডলে সেজদার চিহ্ন থাকবে।' -সূরা ফাতহঃ ২৯
এক ব্যাখ্যা-অনুযায়ী উক্ত চিহ্ন দ্বারা নামাযে খুশু-খুযূর নূর বুঝানো হয়েছে। কেননা, আন্তরিক খুশু-খুযুর লক্ষণ বাহ্যিক অবয়বেও প্রকাশ পায়। অপর এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, উক্ত আয়াতে সেজদার সময় মাটিতে কপাল স্পর্শ করার বিষয় বুঝানো হয়েছে। আর এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী উক্ত আয়াতে সেই নূর ও ঔজ্জ্বল্য বুঝানো হয়েছে যা কেয়ামতের দিন নামাযী ব্যক্তির চেহারায় তার ওযুর কারণে প্রকাশ পাবে।
রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, 'পবিত্র কোরআনে সেজদার আয়াত তেলাওয়াতের পর বনী আদম যখন সেজদায় যায়, তখন ইবলীস শয়তান অদূরে বসে ক্রন্দন করতে থাকে আর বলতে থাকে, হায় আফসোস। বনী আদমকে সেজদার নির্দেশ করা হয়েছে এবং সাথে সাথে সে তা পালন করেছে। আর আমাকে সেজদার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি তা পালনে অস্বীকৃতি জানাই। তাই পরিণামে এখন আমার জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কিছু নেই।'
হযরত আলী ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'ইবলীস প্রতিদিন এক হাজার বার সেজদা করায় তার উপাধি হয়েছিল 'সাজ্জাদ', অর্থাৎ অধিক সেজদাকারী।'
বর্ণিত আছে, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) সরাসরি মাটির উপর সেজদা করতেন।
ইউসুফ ইবনে আসবাত (রঃ) বলেন, 'ওহে যুবকেরা। সুস্থ-সবল থাকতে অতি দ্রুত কিছু করে নাও। বর্তমানে কেবল এক ব্যক্তিই এমন রয়েছেন, যাকে আমি ঈর্ষা করি; তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে রুকু-সেজদা করেন। এখন দূরত্বের কারণে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় না।'
হযরত সাঈদ ইবনে জোবায়র (রঃ) বলেন, এ দুনিয়ার কোন বস্তু বা বিষয়ের জন্য আমার মোটেও আফসোস হয় না, কিন্তু কখনও আমার একটি সেজদা কম হয়ে গেলে আফসোসের কোন সীমা থাকে না।
হযরত ওব্বা ইবনে মুসলিম (রঃ) বলেন, 'আল্লাহর সাক্ষাতের জন্য আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার গুণ আল্লাহ তা'আলার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। বান্দা আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয় তখন, যখন সে সেজদায় থাকে।'
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, 'সেজদাকালে বান্দা আল্লাহর নিকটতম সান্নিধ্যে পৌঁছে যায়। সুতরাং এ সময় অন্তর ভরে খুব দোয়া করে নেয়া উচিত।'
0 Comments