ফেরেশতাদের প্রথম মনজিল
সিদরাতুল মুনতাহা হতে মহানবী (সঃ) একা সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাকে লাখ লাখ স্থান অতিক্রম করে যেতে হবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য। তিনি প্রথম মনজিলে উপনীত হলেন। এখানে তিনি একজন নূরানী চেহারা বিশিষ্ট ফেরেশতা দেখতে পেলেন। এ বিরাট ও বিশাল ফেরেশতা দর্শনে তিনি বিস্মিত হলেন। কারণ তিনি এর পূর্বে প্রথম আকাশ থেকে সপ্তম ও সিদরাহ পর্যন্ত অনেক অনেক ফেরেশতা দেখেছেন কিন্তু এমন অনুরূপ রূপে সুসজ্জিত ফেরেশতা তিনি ইতিপূর্বে দেখেন নি। এ ফেরেশতা ছিল আল্লাহর মহিমা মণ্ডিত ও উচ্চপদস্থ। এখানকার ফেরেশতাদের দৈহিক ঔজ্জল্য অন্যান্য ফেরেশতাদের চাইতে অনেক বেশি। প্রথম দর্শনেই তারা যে কোন লোককে তাক লাগাতে পারে। তাদের চেহারা চিত্তাকর্ষক।
ফেরেশতাদের দ্বিতীয় মনজিল
মহানবী (সঃ) ফেরেশতাদের প্রথম মনজিল সফর করে দ্বিতীয় মনজিলে পদার্পণ করলেন। এখানকার একটি স্থানে তিনি একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। ঐ ফেরেশতা সেখানকার রকণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। তিনিই সে স্থানের একমাত্র রক্ষক। তাকে এ কাজেই নিয়োজিত করা হয়েছে। সে অন্য সব ফেরেশতাদের চেয়ে সম্মানিত নেতা। মহানবী (সঃ) বলেন- "ঐ ফেরেশতার শারীরিক আকৃতি ভয়াবহ। তার চেহারা পৃথিবীর মোরগের চেহারার মতো। গায়ের রং সবুজ, পালকগুলো সাদা বকের মতো, তার দুটো পাখা যেন সাত আকাশ সাত যমীনে বিস্তার করে আছে। তার লেজের পাখাগুলো মুক্তোর তৈরি। তার মাথায় জড়হারের টুপি, তার গা থেকে আল্লাহর নূর ঠিকরে পড়ছে। সারা জাহার যেন তার আলোয় উদ্ভাসিত। এ ফেরেশতা যখন যুগল পাখা বিস্তার করে আল্লাহর প্রশংসায় মেতে উঠে তখন সারা বিশ্ব যেন থর থর করে কাঁপে।" এ মহান ফেরেশতা শেষ রাতে আল্লাহর প্রশংসা করে বলে-
سبْحانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ سُبْحَانَ الْكَرِيمِ .
এরূপ প্রশংসা করার ফলে আমাদের এ পৃথিবীর মোরগও এ শব্দ শুনতে পায় এবং শেষ রাতে ডেকে উঠে। অতঃপর ঐ ফেরেশতা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আপন পাখা বিস্তার করে। ভোরে আল্লাহর তাসবীহ পড়ে তখন এ বিশ্ব জাহানের মোরগগুলো তা শুনতে পায় ও আল্লাহর গুণ-গানে লিপ্ত হয় এবং ডেকে ডেকে চারদিক মুখরিত করে তোলে। ঐ ফেরেশতার সমধুর আযান ধ্বনি আমার মনে পরতে পরতে চিরদিন ভাস্বর হয়ে জেগে থাকবে। তা কোন দিন ভুলবার নয়, মুছবার নয়।"
হযরত আজরাইল (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভ
মহানবী (সঃ) এ মনজিলে এক স্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন একখানা বিরাট কেদারা। তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্ত সারা পৃথিবীর সমান। মনে হয় যেন পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করছে। ঐ কেদারায় একজন দীর্ঘদেহী ফেরেশতা তার বিরাট বিশাল রূপ নিয়ে বসে আছেন। তার পদযুগলের নীচে সারা পৃথিবীটা রয়েছে। তার হাতে একটি নূরের ফলক। তিনি তা নিরিখ করছেন আপন মনে। কোন দিকে তার খেয়াল নেই। এক মনে একাগ্রচিত্তে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন ফলকটির দিকে। তার ডান হাতের কাছেই একটি বিরাট বৃক্ষ। সেদিকে তিনি মাঝে মাঝে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। আবার হাতের ফলকটি নিরিখ করছেন।
মহানবী (সঃ) এ ফেরেশতার পরিচয় জানার জন্য মনে মনে উদ্গ্রীব হলেন। তখন অদৃশ্য হতে আওয়াজ এলো যে, এর নাম হযরত আজরাইল (আঃ) মালাকুল মউত। জীব-জন্তুর রূহ কবজ করাই এর একমাত্র কাজ। যখন আল্লাহর আদেশ হয় যে অমুক প্রাণীর রূহ কবজ করো, তখনই তিনি ঐ নির্দিষ্ট প্রাণীর রূহ কবজ করেন। ইনি হচ্ছে মৃত্যুর যমদূত।"
এ কথা শ্রবণ করে মহানবী (সঃ) তাকে সালাম করলেন। কিন্তু মালাকুল মাউত তার নিজস্ব কর্তব্যে এতো ব্যস্ত ছিলেন যে, তিনি মহানবী (সঃ)-এর সালামের জবাব মুখে দিতে। পারলেন না। বরং মাথা কাত করে ইশারায় সালামের জবাব দিলেন। কারণ তিনি জানতেন না যে, ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সঃ)। কিন্তু যখন তার মনে খটকা হলো যে, এতো উপরে কোন জন-মানব আসতে পারে না। নিশ্চয়ই কোন সম্মানিত ও আল্লাহর অতি প্রিয় রাসূল এখানে এসে আমায় সালাম করেছেন তখন তিনি অতি বিনয়ের সাথে মহানবী (সঃ)-এর সালামের প্রতি উত্তর করণে। অতঃপর আশির্বাদ করে বললেন- "আপনার আগমন শুভ হোক। আল্লাহর দীদার মঙ্গল হোক। আপনি কল্যাণ বার্তা নিয়ে ফিরে আসুন। আপনার ও আপনার অনুসারীদের জন্য আমি আল্লাহর পবিত্র দরবারে কাতরভাবে মুনাজাত করব।"
মহানবী (সঃ) মালাকুল মাউত আজরাইলকে জিজ্ঞেস করলেন- "ভাই আজরাইল। আপনি এতো একা, এত বড় বিশাল পৃথিবীর জীবজানোয়ারের প্রাণ কেমন করে হরণ করেন? এটা আমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে।"
মালাকুল মাউত জবাবে বললেন- "হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! আপনি আমার হাতে যে একখানা নূরানী ফলক দেখতে পাচ্ছেন এতে সারা জাহানের প্রাণীর নাম, ধাম, জন্ম তারিখ ও ঠিকানা লেখা রয়েছে। আমি এটা সারাক্ষণ একাগ্র মনে দর্শন করছি আর আমার সামনে ঐ যে বিরাট বৃক্ষ দেখতে পাচ্ছেন তার পাতার সংখ্যা সারা জাহানের সমগ্র প্রাণীর সংখ্যার সমান। তার এক একটি পাতায় এক একটি প্রাণীর নাম-ধাম, জন্ম-মৃত্যু তারিখ লেখা রয়েছে। যখন কোন প্রাণীর জীবন সায়াহ্নে ঘনিয়ে আসে তার জীবনের হিসেবের খাতা ঢুকে যায়। তখন তার নামের পাতাটি গোলাপী রং ধারণ করে এবং কিছুদিন পর তা শুকিয়ে খসে পড়ে। তখন আমি পাতাটি কুড়িয়ে নামটি দেখি এবং জীবন লিপি ফলক হতে ঐ নাম মুছে নিশ্চিহ্ন করে ফেলি। আমার দেহে আল্লাহর প্রদত্ত অসীম শক্তি রয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে আমার হাত পরিচালনা করতে পারি। অতএব এক স্থানে স্থির থেকে সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর রূহ কবজ করতে পারি।"
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আছে-
অর্থাৎঃ "হে নবী! আপনি লোকদেরকে বলে দিন যে, মালাকুল মাউতকে তোমাদের প্রাণ সংহারের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনিই তোমাদের রূহ কবজ করে থাকেন। তারপর তোমাদের প্রভুর সম্মুখে ফিরে যেতে হবে।"
অতঃপর মহানবী (সঃ) হযরত আজরাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন- "আচ্ছা ভাই আজরাইল। আপনি কেমন করে মুমিনদের রূহ কবজ করেন। তারা কি কষ্ট পায়?"
হযরত আজরাইল (আঃ) তদুত্তরে বললেন- "হে আল্লার প্রিয়তম রাসূল! আপনি শুনে খুশি হবেন যে, যখন কোন মুমিন বান্দার অন্তিম মুহূর্ত উপস্তিত হয়, তখন আমি আমার অর্ধনস্থ একজন ফেরেশতাকে একগুচ্ছ বেহেশতী সুগন্ধি ফুল নিয়ে তার শিয়রে পাঠাই। ঐ ফেরেশতা ঐ ফুল মৃত্যু পথযাত্রী মুমিনের শিয়রে রেখে দেয়। ঐ ফুল দেখে মুমিন বান্দা আনন্দে আত্মহারা হন এবং ফুলের ঘ্রাণ শুকতে থাকেন। এভাবে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যেভাবে দুধের শিশু তাব মায়ের স্তনের দুধ পান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। এ ঘুম তার নির্বিবাদে ও নিরাপদে হয়। এমন সময় আমি তার কাছে উপস্থিত হই এবং আল্লাহর কাছে পৌছিয়ে দেই। ঐ রূহ আল্লাহর সমীপে পৌঁছিবার প্রাক্কালে যখন তা আসমানে পৌঁছে তখন ঐ রূহের সুগন্ধিতে সমগ্র আকাশ মোহিত হয় এবং সমস্ত আকাশের ফেরেশতা তাকে অভ্যর্থনা জানায়। আল্লাহ তায়ালা খুশী হন এবং তিনি রূহকে বলেন-
يا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةٌ فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي .
অর্থাৎঃ "হে পূন্যাত্মা! তোমার প্রভুর কাছে অতি সন্তুষ্ট হয়ে এসো। অতঃপর আমার মুমিন বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করো এবং আমার জান্নাতে দাখিল হও।"
0 Comments