সিদরাতুল মুনতাহায় অবস্থান কোথায়

 বাইতুল মামুর দর্শন

        মহানবী (সঃ)-কে গৃহের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহকে দেখেছেন। সেই গৃহই বাইতুল মামুর। এ গৃহটি মক্কা মুয়ায়যামার কাবা গৃহের সত্যরূপ। অর্থাৎ দুনিয়ার কাবা গৃহ বাইতুল মামুরেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে সেখানে কাবা গৃহ বাইতুল মামুর অবস্থিত। বাস্তব জগতের সাথে এখানের কোনই সম্পদ নাই। ফেরেশতারা প্রতি নিয়ত এখানে আল্লাহর গুণ গানে মশগুল থাকে। এখানে প্রতিদিন এমন সত্তর হাজার নতুন ফেরেশতা প্রবেশ করে যারা আর কোন দিন এখানে ফিরে আসে না। এ অপূর্ব জ্যোতিতে এ স্থান চির স্নিগ্ধ চির মনোরম।

এক বিশেষ ফেরেশতা

        রাসুলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন- হযরত জিব্রাইল (আঃ) যখন আমাকে সপ্তম আসমানে বাইতুল মামুরে নিয়ে যান। তখন আমি দেখতে পেলাম মহান আল্লাহ তা'য়ালার ফেরেশতাদের মধ্য থেকে সেখানে এক বিশেষ ফেরেশতা। যার নূর এবং উজ্জ্বলতা এত অধিদ ছিল যে, তার সম্পর্কে হযরত জিব্রাইল (আঃ) কসম খেয়ে বললেন- হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আজ পর্যন্ত এ রকমেও বিশেষ নূরানী এবং শান শওকতের অধিকারী ফেরেশতা আর কখনো দেখিনি। আজ শুধু আপনার কারণেই তাকে পাঠানো হয়েছে বলে তাকে দেখা সম্ভবপর হয়েছে।

এক বিশেষ আযান

        উক্ত নূরানী ফেরেশতা 'আলমে বানা' হতে আগমন করার পর তিনি এক বিশেষ স্থানে এসে দণ্ডায়মান হলেন। তারপর তিনি এমন মধুর সুরে আযান দেওয়া আরম্ভ করলেন, যার মধুর আওয়াজ আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে সপ্ত আকাশ যেন কম্পিত হতে আরম্ভ করল। যেমন প্রকম্ভিত হত দুনিয়া ও সপ্ত যমিন হযরত বেলাল হাবসীর মধুর আওয়াজে।

তিনটি উপাধি লাভ

        বিশেষ ফেরেশতা কর্তৃক আযান দেয়া শেষ হলে মহানবী (সঃ) এ বাইতুল মামুরে ফেরেশতাদের নিয়ে প্রবেশ করলেন এবং নামায আদায় করলেন। এখানেও তিনি ইমামতি করলেন।

        নামাজ শেষ হলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তিনটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন উপাধিতে ভূষিত করেন। ইতিপূর্বে এ ধরনের পদবী কেউ পায়নি। তা হলো-

سيد المرسلين     বা নবী কূলের শ্রেষ্ঠ

إِمَامُ الْمُتَّقِينَ  বা খোদা ভীরু দের নেতা

رَحْمَةٌ لِلْعَالَمِينَ বা জগতবাসীর জন্য রহমত

 অপ্রাপ্ত মৃত সন্তান দর্শন

        মহানবী (সঃ) বাইতুল মা'মুরের সোনালী দেয়ালের সন্নিকটে দুখাসা স্বর্ণ কেনাকা দেখলেন। তার এক খানায় একজন বৃদ্ধ এবং অপর খানায় জনৈকা বৃদ্ধা বসে আছেন। তালের উভয়ের রূপ অপরূপ। তাদের চারপাশে অগণিত শিশু মহানন্দে খেলা করছে। এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। হেসে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। তারা খেলতে খেলতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে আসছে। তাদের চুমু খাচ্ছে, কোলে বসছে আবার খেলায় মেতে উঠছে।

        এ স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে মহানবী (সঃ) আল্লাহর দূত জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন- "হে জিব্রাইল। এ বুড়ো-বুড়ী কারা? আর এ শিশুরাই বা কারা? এখানে এসব খেলাধুলার তাৎপর্য কি?"

        হযরত জিব্রাইল আমীন জবাব দিলেন- "চেয়ারে উপবিষ্ট রয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তার সহধর্মিনী হযরত বিবি সারা (আঃ)। আর অসংখ্য শিশু, যারা নানারূপ খেলায় মাতোয়ার, তাদের নাচ গানে এ আকাশ মুখরিত দধ্বনিত হচ্ছে তারা হচ্ছে মৃত অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম সন্তান।

        যখন তারা তাদের আপন পিতা-মাতাকে স্মরণ করে তখন তারা ইব্রাহীম সারার কাছে ছুটে আসে। তাদের নিজেদের জনক-জননী মনে করে। তাই কাছে গিয়ে তাদের সান্ত্বনা লাভ করে। এভাবে তারা পিত্র ও মাতৃ বিচ্ছেদ ক্ষণিকের তরে ভুলে যায়।

        যাদের শিশু সন্তান মারা গেছে, তারা অবশ্যই এ সংবাদ শুনে খুশি হবে। কেন না কিয়ামতের দিন এ সব সন্তান-সন্ততির ওয়াসিলায় তাদের পিতা-মাতা বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাবে। তাই তাদের শিশুর অকাল মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করা উচিত। তাদের শিশুদের মৃত্যুতে বিচলিত হওয়া উচিত নয় বরং একে আল্লাহর রহমত মনে করা উচিত।

নূরানী সবুজ বাহন

        প্রথম আকাশ হতে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তা'য়ালার কুদরতের যত নির্দশনাবলী দেখানো দরকার ছিল মহানবী (সঃ)-কে তা সবাই দেখানো হল। অতঃপর সপ্ত আকাশের উপরে সিদরাতুল সুনতাহার দিকে যখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) মহানবী (সঃ)-কে নিয়ে যাওয়ার এরাদা পোষণ করলেন। তখন মহানবী (সঃ) একটি সবুজ রং এর নূরানী বাহন দেখতে পেলেন। মহানবী (সঃ)-কে তাতে উঠে বসতে অনুরোধ করলে তিনি উহাতে আরোহণ করলেন এবং রাজকীয় গৌরবময় প্রিয় জুলুন তার সাথে সপ্ত আকাশ হতে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে অগ্রসর হলো। আর অল্প সময়ের মধ্যে পাঁচশত বৎসরের পথ অতিক্রম করে নূরানী বাহন তথায় গিয়ে পৌঁছল। পথিমধ্যে আল্লাহর এবাদতে মশগুল রং বেরং এর ফেরেশতা তিনি দেখতে পেলেন। এমন কি অনেক ভীতিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানও দেখতে পেলেন। যেমন- তিনি এক স্থানে গিয়ে দেখলেন অসংখ্য নূরানী মূর্তি। প্রত্যেকটি মূর্তির উপর খাঁটি স্বর্ণের ফ৮ লাগানো রয়েছে। আর সে মূর্তিগুলো এত বড় যে, প্রতিটি সেভিং নিচে পঞ্চাশ জন করে এমন ফেরেশতা রয়েছে যারা সূরত ও আকৃতিতে খুব বড়। তাদের প্রত্যেকের মুখে জারী রয়েছে-

مرحبا با مُحَمَّدُ مَرحبا .

 তারা আরও বলছে-

    أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لأَسْرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدٌ عَبْدَهُ وَرَسُولُهُ .

        অর্থাৎঃ "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক তার কোন অংশীদার নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।"

সিদরাতুল মুনতাহায় অবস্থান

        মহানবী (সঃ) সপ্তম আকাশে আল্লাহ তায়ালার নানারূপ কুদরত ও সৃষ্টি নৈপূণ্য দেখলেন অতঃপর তিনি জিব্রাইল (আঃ) সহ সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন। সিদরাত অর্থ কুল বুদ্ধ মুনতাহা অর্থ শেষ সীমা। সিদরাতুল মুনতাহা অর্থ উর্ধ্বালোকের শেষ সীমার বরই গাছ। এ গাছ সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেন- "এ গাছের পাতা হাতির কানের মতো প্রকাণ্ড এবং এর বরই হিজর নামক স্থানের মটকার ন্যায় বিরাট। এ বৃক্ষের প্রতিটি পাতা পৃথিবীর যাবতীয়। সৃষ্টিকুলের জীবন ও জীবিকিা বহন করছে। এখান হতেই আল্লাহর নির্দেশে জীব-জন্তু, মানব-দানব প্রভৃতির আহার বণ্টিত হয়। আবার এখান থেকেই মানব জাতির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ জারী হয়। এ বৃক্ষের শাখায় শাখায় পাতায় পাতায় ফেরেশেতারা বসে আছে। তারা সর্বদা আল্লাহ তায়ালার যিকর করছে।"

        হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, মহানবী (সঃ) বলেছেন- "সিদরাতুল মুনতাহার এক জায়গায় বিরাট রিবাট মুক্তো আমার চোখে পড়ল। প্রতিটি মুক্তোর উপর আবার এক একটি স্বর্ণ ফুল। এ ফুলগুলোর উপর বসে পঞ্চাশ জন ফেরেশতা আল্লাহর ইবাদত করছে তারা বলে চলছে- "হে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। আপনার শুভাগমনকে আমরা সর্বান্তকরণে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা আজ ধন্য। আপনিই একমাত্র সর্ব পাপি-তাপির রক্ষা কর্তা। আল্লাহ আজ আপনার মনোবাসনা পূর্ণ করবেন।"

        মহানবী (সঃ) বলেন- "আমি ফেরেতাদের এরূপ কথা শুনে বিস্মিত হলাম এবং উৎফুর মনে সামনে অগ্রসর হলাম। এখানকার বিভিন্ন নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে হযরত (সঃ) সাথী হযরত জিব্রাইল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন- "হে সত্যের আমানতদার জিব্রাইল! এত সব দৃশ্য দেখে আমার মনে হয় যে, যিনি এ নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি করেছেন তিনি জানি কতো বড় রূপকার, সৌন্দর্যময়, আর তার সৃষ্টি জানি কতো বিরাট, বিশাল।।

        আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমীন জবাব দিলেন- "হ্যাঁ তিনি অসীম অনন্ত। এ দৃশ্যমান কীর্তি তার কোটি ভাগের এক ভাগও নয়। তার সৃষ্টি কৌশল ও রহস্য সীমাহীন আল্লাহ নিজে সুন্দর তাই তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন।"

        মহানবী (সঃ) আরও সামনে অগ্রসর হতে চাইলে হযরত জিব্রাইল (আঃ) তার অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। নবী (সঃ)-এর কারণ জিজ্ঞেস করলে জিব্রাইল বললেন- "এ পর্যন্ত আসতে আমি সক্ষম। এর ওপর আমি যেতে পারি না। সিদরাতুল মুনতাহা হতে চুল বরাবর সামনে অগ্রসর হলেই আামর ছয়শো ডানা আল্লাহর নূরে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আমার গতি এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এখান থেকে সামনে অগ্রসর হবার ক্ষমতা আল্লাহ আমায় প্রদান করেন না। শুধু আপনিই ওপরে যেতে পারবেন, অন্য কারো আর সামনে অগ্রসর হবার ক্ষমতা নেই। আপনি আল্লাহর সাথে কথা-বার্তা বলে আসুন। আমি এখানে আপনার প্রতিক্ষায় রইলাম। যতক্ষণ না আপনি মালায়ে আলা থেকে ফিরে আসবেন, ততক্ষণ আমি আপনার আগমন অপেক্ষায় থাকবো।"

        সিদরাতুল মুনতাহা হতে মহানবী (সঃ) বোরাক ছেড়ে দিলেন। সেখানে সবুজ রাফরাফ এলো। রাফরাফ এর আভিধানিক অর্থ- বিছানা। এটা নরম তুলতুলে, দামী বিছানার মতো ছিল। সূর্য রশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্ত তার গতিবেগ হযরত (সঃ) কার ইঙ্গিতে যেন একাই অগ্রসর হতে লাগলেন।

Post a Comment

0 Comments