বাইতুল মোকাদ্দাসের অবস্থান

        উল্লেখিত ঘটনাসমূহ অবলোকন করতে করতে মহানবী (সঃ) বায়তুল মাকদাসে পৌঁছেন। আর বোরাক থেকে অবতরণ করেন। মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, কড়ার সঙ্গে অন্যান্য নবীগণ স্ব স্ব বাহন বাঁধতেন। তিনিও ঐ কড়ার সঙ্গে বোরাক বেঁধেছিলেন। বাযযারের এক বর্ণনায় রয়েছে, জিব্রাইল (আঃ) স্বীয় আঙ্গুল দ্বারা এক পাথর ছিদ্র করে সে ছিদ্রের সাথে বোরাক বেঁধে ছিলেন। হতে পারে বোরাক বাঁধতে উভয়ে শরীক ছিলেন আর একথারও সম্ভাবনা রয়েছে যে, কাল প্রবাহে পাথরের ছিদ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হযরত জিব্রাইল আঙ্গুল দ্বারা ছিদ্রটি পরিষ্কার করেছিলেন আর রাসূল (সঃ) বোরাক বাঁধলেন। অতঃপর তিনি মসজিদে আকসাতে প্রবেশ করে দুরাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ পড়লেন। মহানবী (সঃ) বাইতুল মান্দাসে পৌঁছানের ঘটনা কবি তার ভাষায় এভাবে বর্ণনা করে-

"বায়তুল মোকাদ্দাসে যাইয়া থামলো বোরাক শেষে,

জিব্রিলে কনঃ দিনের নবী দেখুন নতুন দেশ,

এই পবিত্র জেরুজালেম এই কেবলা মসজিদ

নবী সুলাইমানের হাতে গড়া ইহার ভীত।

থামলো বোরাক মোকাদ্দাসের মসজিদের দুয়ার

বোরাক তনে নামেন তড়িৎ পিঠের সব সোয়ার,

সেইখানে এক কড়ার সাথে আম্বিয়া কেয়াম 

বানতো সবাই উট গাধা ও খচ্চরে লাগাম।

 বন্ধু ছিল তাহার ছেদা যাবৎ অনেক দিন 

খুইল্যা দিলেন আঙ্গুলে তাই জিব্রাইল আমিন,

সেই কড়াতে দীনের নবী বান্দিলেন বোরাক,

জিব্রিলে পর সঙ্গে লইয়া দেখাইলেন বেবাক।"

হযরত আদম (আঃ)- এর সাথে সাক্ষাতঃ

        মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- "যখন আমার বোরাক মেরাজ রাত্রিতে মসজিদে আকসার একেবারে কাছে পৌছে গেলো। তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ)-এর ইশারায় বোরাক থেমে গেলে আমি বোরাক থেকে নামলাম। অতঃপর হযরত জিব্রাইল (আঃ) মসজিদে আকসার মধ্যে আমাকে সাথে নিয়ে প্রবেশ করলে আমি সেখানে দেখতে পেলাম, অনেক নূরানী চেহারার বুযুর্গ ব্যক্তিগণ সেখানে উপস্থিত আছেন। যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম নূরানী আলো জ্বলমল চেহারার অধিকারী এমন এক ব্যক্তি আমার নজরে আসলো। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও শোভামণ্ডিত এবং বিশেষ লম্বা আকৃতির। যার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে আমি প্রথমে হযরত জিব্রাঈল আমীনকে জিজ্ঞেস করলাম-"হে ভাই জিব্রাইল। যাকে এত সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখাচ্ছে এ শাহী বুযুর্গ ব্যক্তির পরিচয় কি?"

        জবাবে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন- "ইনি হলেন সে সম্মানিত ফেরেশতাদের দ্বারা সিজদাকৃত ব্যক্তি। আপনার এবং সকল মানুষের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) যাকে স্বয়ং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছেন। আপনি তাকে সম্মানের সাথে সালাম করুন।" মহানবী (সঃ) তাকে সালাম দ্বারা অভিবাদন জানালেন। মহানবী (সঃ) বলেন- আল্লাহর খলীফা হযরত আদম (আঃ) বড়ই মহব্বতের ও তাজিমের সাথে আমার সালামের জবাব দিলেন এবং দোয়া করলেন।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভ

        মহানবী (সঃ) বলেন- আমি আমার আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর কাছে উপবিষ্ট আরেকজন মৌয্য শান্ত দীর্ঘদেহী লোককে দেখতে পেলাম। তার চেহারা অনেকটা আমার চেহারার মতো। তার চেহারা হতে আল্লাহর নূর যেন ঠিকরে পড়ছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হলাম এবং ভাই জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম- "ভাই জিব্রাঈল। ইনি কে? এর চেহারাতো অনেকটা আমারই মতো।"

        হযরত জিব্রাঈল (আঃ) প্রত্যুত্তরে বললেন- "ইনি আপনার পূর্ব পুরুষ সম্মানিত নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। তিনি আল্লাহর আদেশে বাইতুল্লাহ শরীফ নির্মাণ করেছিলেন। আপনার জন্যে দোয়া করেছিলেন। নমরুদ কর্তৃক অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হয়েছিলেন। কিন্তু অগ্নি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং তা তার জন্যে গুলিস্তানে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা তাকে খলীলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু নামে অভিহিত করেছিলেন। অতএব হে রাসূল! আপনি হযরত ইব্রাহীমকে সালাম করুন।" মহনবী (সঃ) তৎক্ষণাৎ হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে সালাম করলেন-

السَّلامُ عَلَيْكُمْ يَا إِبْرَاهِيمُ خَلِيلُ اللَّهِ .


হযরত মুসা (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভ

        মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন- আমি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)- এর নিকটেই বিশেষ সম্মানিত লম্বা এক সুদর্শন বুযুর্গ ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার শরীরের রং লাল বর্ণ ও সাদা বর্ণ রং মিশ্রিত। যার প্রতি গভীর দৃষ্টিতে দেখলাম। তারপর জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম-"ভাই জিব্রাঈল! যার চেহারায় বার্ধক্যের কারণে ভাজ পড়ে গিয়েছে? ইনি কোন বুযুর্গ ব্যক্তি?" আমার কথা শুনে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) মুচকী হাসি দিয়ে বললেন- "ইনি হলেন হযরত মূসা কালিমুল্লাহ (আঃ)। মহান আল্লাহর সেই প্রিয় রাসূল। ইনি সেই পূত পবিত্র ব্যক্তি; যিনি এক চড়ের আঘাতে এক কিবতীকে দোজখে পৌছায়ে দিয়েছেন। ইনি সেই পয়গাম্বর যিনি ৪০ বার তুরে পর্বতে গিয়ে মহান আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বলতে গিয়ে মহান আল্লাহর তাজাল্লাতে বিভোর হয়ে বলেছিলেন-

رَبِّ ارْنِي أَنظر اليد .

        অর্থাৎঃ "হে খোদা আপনার জাতে মোবারক আমাকে দেখতে দিন।"

        হে আল্লাহর নবী। আপনি তাঁকে সালাম করুন। মহানবী (সঃ) বলেন- আমি হযরত মূসা কালিমুল্লাহকে সালাম জানালে তিনি অত্যন্ত মহব্বতে ও বিনয়ের সাথে তার সালামের জবাব দিলেন।

হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভ

        মহানবী (সঃ) বলেন- "আমি হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে দেখা করার পর অন্যান্য নবীদের সাথে দেখা করতে সামনে এগিয়ে গেলাম। সব নবীর সাথে সাক্ষাত করলাম। সর্বশেষ আমি এমন একজন সম্মানিত নবীর সাথে সাক্ষাৎ করলাম যার মাথার কেশরাশি কাধ পর্যন্ত বিস্তৃত, তা থেকে বিন্দু বিন্দু পানি ঝাড়ছে। প্রতিটি বিন্দু যেন একটি মুক্তো। তার পরনে ছিলো অতি সাধারণ পোশাক। একটি মাত্র শতচ্ছিন্ন তালিয়ালা কম্বল। এহেন অবস্থা দেখে আমি হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর কাছে এই সাধারণ বেশের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলাম।"

        প্রত্যুত্তরে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন- "এ লোকটি হলেন হযরত ঈসা নবী। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রুহুল্লাহ বা আল্লাহর রুহ নামে অভিহিত করেছেন। কেননা তাকে পিতা ছাড়া মরিয়মের গর্ভে সৃষ্টি করেছেন। ইহুদীরা চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো, কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে অকুস্থল থেকে নিমিষে উত্তোলন করে চতুর্থ আসমানে নিয়েছেন। তাঁকে ইনজিল কিতাব দেয়া হয়েছিল। তিনি বড় সম্মানিত, মাসুম নবী। হে রাসূল আপনি তাকে সালাম করুন।" অতঃপর মহানবী (সঃ) হযরত ঈসা (আঃ)-কে সালাম করলেন। তিনিও অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সালামের জবাব দিলেন।

ঈমান নির্বাচন

        মহানবী (সঃ) একে একে সব নবী রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) মসজিদুল আকছার একটি পবিত্র অংশ গম্বুজ সাখরায় উঠলেন। এই বিরাট সাখরা বা পাথরটি ভূমি হতে দু'শো গজ উঁচু। সেখানে তিনি সুমধুর কণ্ঠে আযান দিলেন। তার সুললিত কণ্ঠের আযান ধ্বনিতে আকাশ পাতাল মুখরিত হলো এবং মুহূর্তে আসমানের সব দ্বার উন্মুক্ত হলো। এই দ্বার দিয়ে অসংখ্য ফিরেশতা পবিত্র মসজিদুল আকসায় জড়ো হলো। তাদের ভিড়ে মসজিদ ভরে গেল। মসজিদের বাইরেও তারা জড়ো হলো। সব জায়গা ফিরেশতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। অতঃপর ফিরেশতা ও নবী রাসূলরা একই জামায়াতে নামাজ পড়ার জন্যে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন-"সবাই কাতার বন্দী হয়ে নামাযের জন্যে দাড়ালেন। কিন্তু ইমামের জায়গায় কেউ যাচ্ছেন না। ঐ স্থানটি তখনো শূন্য। কারণ আল্লাহ তায়ালা যাকে ইমামতীর উচ্চ সম্মানে অভিষিক্ত করেন। একমাত্র তিনিই ঐ স্থানে দাঁড়িয়ে সব নবীদের ইমামতী করতে পারবেন। মহান আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া ওখানে গিয়ে কেউই ইচ্ছানুযায়ী ইমামতী করতে পারবেন না।

        হযরত আদম (আঃ) মনে মনে এ আশা পোষণ করলেন যে, তিনিই সৃষ্টির প্রথম মানব। তার থেকে সব মানব সৃষ্টি হয়েছে। তাই আজ হয়তো এ বিষয়টি জামাতের ইমামতী করতে হয়তো তার প্রতিই আদেশ আসতে পারে।

        হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ আশা করলেন যে, আমি আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহর আদি গৃহ বা কাবার প্রতিষ্ঠাতা, আল্লাহর হাবীব মুহাম্মদ (সঃ)-এর আগমনের প্রার্থনাকারী। অতএব, আমিই হয়তো বা এই ইমামতী করে মর্যাদার অধিকরী হবো।

        হযরত মুসা (আঃ) আকাংখা করলেন যে, তিনি আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, যাদুকরের যাদু স্বীয় হাতের লাঠির দ্বারা মিমমার করেছেন। আল্লাহর ঘোর দুশমন ফিরাউনকে পানিতে ডুবিয়েছেন। তাই তিনিই এ মর্যাদাসম্পন্ন ইমামতীর একমাত্র উপযুক্ত। হযরত ঈসা (আঃ) এ বাসনা করলেন যে, একমাত্র তিনিই আল্লাহর রুহ দ্বারা সৃষ্ট। আল্লাহ তাকে আপন কুদরতে বিনা পাপে সৃষ্টি করেছেন। ইহুদীদের হাত হতে বাঁচিয়েছেন। অতএব এসব কারণে তিনিই এ ইমামতীর কেবলমাত্র উপযুক্ত।

        সবাই মনে মনে এসব জল্পনা কল্পনা করে চলেছেন। কিন্তু কারো সঠিকভাবে জানা নেই যে, কাকে আল্লাহ এ মর্যাদা ভূষিত করেন।

        অতঃপর দেখা গেল যে, হযরত জিব্রাঈল আমীন জামাতের ইকামত দিচ্ছেন। সবাই ধারণা করলেন যে, হয়তো তিনিই ইমামতী করবে। কিন্তু তা করলেন না। তিনি সামনে গিয়ে আমাদের মহানবী (সঃ)-কে হাত ধরে ইমামের স্থানে দাড় করিয়ে দিলেন এবং তাকে ইমামতী করার জন্যে আল্লাহর নির্দেশের কথা জানালেন। এভাবে মহানবী (সঃ) সর্বসম্মতিক্রমে ফিরেশতা ও নবী রাসূলদের ইমামতি করলেন।

বিশ্ব ইমাম নির্বাচন

        মহানবী (সঃ) বললেন- "হয়রত জিব্রাঈল (আঃ) আমার হাত ধরে ইমামেক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি "আল্লাহু আকবার" বলে নামাজ আরম্ভ করলাম। সুষ্ঠভাবে দুরাকাআত নামাজ আদায় করলাম এবং সালাম ফিরালাম। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) দাঁড়িয়ে বিনম্রভাবে আমায় বললেন- "হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি জানেন যে, আপনার পিছনে কারা নামাজ পড়েছে?"

        আমি জবাব দিলাম- "না, আমি কেমন করে জানবো? আপনি আমাকে আমার মুক্তাদীদের সম্পর্কে জানিয়ে দিন।"

        তখন হযরত জিব্রাঈল আমীন বললেন- "হে আল্লাহর রাসূল! এই জামায়াতের নামাজে আপনার পেছনে এক লাখ চব্বিশ হাজার নবী হাজির হয়েছেন। এছাড়া সারা জাহানের ফিরিশতা, বেহেশতের হুর। গেলমান এবং মুমিনদের আত্মাও আপনার পিছনে নামাজ আদায় করেছেন।"

নবীদের খুৎবা প্রদান প্রসঙ্গে

        মহানবী (সঃ)-এর ইমামতীতে নামায সমাপন হবার পর তার চারদিকে নবীরা সমবেত হলেন। তারা মহানবী (সঃ)-এর এ ভ্রমণ উপলক্ষ্যে খুৎবা প্রদান করলেন। মূলতঃ আল্লাহ পাকে প্রশংসা করলেন। এখানে নবীদের খুৎবা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হল- সর্বপ্রথম হযরত আদম (আঃ) খুৎবা প্রদান করলেন। তিনি বললেন- "সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ পাকের জন্য। যিনি আমাকে তার নিজ কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছেন। সকল ফিরিশতাকুলের দ্বারা আমাকে সিজদা করায়েছেন। আমার সহধর্মিনী হযরত হাওয়া (আঃ)-কে আমার বাম পাজরের হাডিড দিয়ে সৃষ্টি করায়ে আমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করায়েছেন। আমাকে সর্বপ্রথমে বেহেশতে বসবাসের স্থান দিয়েছেন। আমার পরম শত্রু যাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার রহমত থেকে বঞ্চিত ঘোষণা করেছেন। আমাকে মানব জাতির আদি পিতা হিসেবে বেহেশতে থেকে দুনিয়াতে প্রেরণ করে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এজন্য সকল প্রশংসা তারই নিমিত্তে।

হযরত নুহ (আঃ)-এর খুতবা

        সকল প্রশংসা সে মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য। যিনি আমাকে প্রথম নবী হিসেবে। সম্মানিত করে আমার গোত্রের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি তাদের কাছে প্রায় নয়শ বছর হেদায়েতের বাণী শুনাতে থাকি। কিন্তু তারা আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আমার বদ দোয়ায় তাদের সবাইকে পানির প্লাবনে ডুবায়ে মারেন। তারপর শুধুমাত্র আমরাই তিন সন্তান হাম, শ্যাম ইয়াফেস কর্তৃৎ পুনরায় তাদের সন্তানদের দিয়ে দুনিয়াকে পুনরায় আবাদ করেন। যার জন্য আমাকে আবুল বাশার সানি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সুতরাং সে মহান পাকের জন্য আমার সকল প্রশংসা মোবারকবাদ নিহীত।

    হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর খুৎবা

        হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহ পাকের যে প্রশংসা করেন, তা হল- সমস্ত প্রশংসা ঐ পবিত্র সত্তার জন্য, যিনি আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর আমাকে ইমাম ও অনুসরণীয় বানিয়েছেন। আমাকে নমরুদের অগ্নি থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং আমার জন্য অগ্নি শীতল ও আরামপ্রদ করে দিয়েছেন।

হযরত মূসা (আঃ)-এর খুৎবা

        সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি কোন মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আমার সাথে কথোপকোথন করেছেন। আর আমার দ্বারা ফেরাউন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে বনি ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছেন। আর আমার উম্মাতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন। যারা সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং ইনসাফ করে।

হযরত দাউদ (আঃ)-এর খুৎবা

        সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, তিনি আমাকে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী করেছেন। আমাকে যবুর মহাগ্রন্থের জ্ঞান দান করেছেন। আমার হাতে লৌহ কোমল করে দিয়েছেন। পাহাড় পর্বত ও পক্ষীকূলকে আমার আজ্ঞাধীন করে দিয়েছেন। তারা আমার সাথে আল্লাহর পাকে তাসবীহ পাঠ করতঃ আমাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং মর্মস্পশী বাগ্মীতা দান করেছেন।

হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর খুৎবা

        সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ বাঁকের জন্য। তিনি বায়ু এবং জ্বীন জাতিকে আমার আজ্ঞাধীন করে দিয়েছেন। তারা আমার ইচ্ছা অনুযায়ী বড় বড় সৌধ প্রতিমা এবং প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাড়ি ও থালার ন্যায় পেয়ালা প্রস্তুত করত। আমাকে পক্ষীকূলের ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন। জ্বীন মানুষ ও পক্ষীকূলের সৈন্যদল আমার আজ্ঞাবাহ বানিয়ে দিয়েছেন। অনেক মুমীন বান্দাদের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাকে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি করেছেন যে, আমার পরে কারো পক্ষে এত বড় সম্রাজ্যের অধিপতি হওয়া সম্ভব হবে না। আর আমার রাজত্বকে এত পবিত্র বানিয়েছেন যে, এ সম্বন্ধে আমার কোন হিসাব দিতে হবে না।

হয়রত ঈসা (আঃ)-এর খুৎবা

        সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি আমাকে একটি মাত্র শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম (আঃ)-এর ন্যায় আমাকে পিতা ব্যতীত সৃষ্টি করেছেন। হযরত আদম (আঃ)-কে শুধু মাটি দ্বারা সৃষ্টি করে বলেছিলেন যে, 'হয়ে যাও' তারপর তিনি হয়ে গেলেন। আমাকে মহাগ্রন্থ যেমন তৌরাত ও ইঞ্জিন সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন। আমাকে এমন শক্তি দান করেছেন যে, আমি মৃত্তিকার যারা পাখির আকৃতি প্রস্তুত করে তারপর এর ভিতর ফুক দিলে তখন আল্লাহর হুকুমে তা পাখি হয়ে যেত এবং আমাকে জন্মাদ্ধ, শ্বেত, কুষ্ঠ রোগী আরোগ্য করার এবং আল্লাহর হুকুমে মৃত ব্যক্তি জীবিত করার অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তিনি আমাকে এমন সম্মান প্রদান করেছেন আমাকে পবিত্র করেছেন। আমাকে ও আমার মাতাকে শয়তানের প্রভাব মুক্ত রেখেছেন। তাই শয়তান আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করার পথ খুঁজে পায়নি।

মহানবী (সঃ)-এর খুৎবা

        সকল নবীগুণ যখন মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা থেকে অবসর হলেন, তখন সর্বশেষ আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সঃ) দাঁড়িয়ে খুৎবা শুরু করেন-"সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তারই, যিনি আমাকে তার আপন নূরে সৃষ্টি করেছেন। আমাকে সৃষ্টি না করলে আসমান জমীন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তিনি আমায় সমস্ত বিশ্বের রহমত রূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি আমায় আধ্যাত্মিক জগতে নবুয়ত প্রদান করেছেন আর দৃশ্যমান জগতে সর্বশেষ রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন।

        যখন আদম মাটি ও পানির মধ্যে ছিল তখনই আমি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে বিদ্যমান ছিলাম। তিনি আমায় আল-কোরআন দিয়েছেন। তার মহিমার অন্ত নেই। হে পরওয়ার দেগার! তোমার প্রশংসা অনন্ত অসীম তুমি আমায় আবে কাওসার দান করেছ। কেয়ামতের ময়দানে সব নবী নিজেকে নিয়ে বিবৃত থাকবেন। তখন আমিই একমাত্র আপন উম্মতের জন্য চিন্তিত থাকব। তারা সবাই নাফসী নাফসী বলবেন। আমি বলবো, উম্মাতি উম্মাতি। আমার উম্মতেরা যতক্ষণ বেহেশতে প্রবেশ না করবে ততক্ষণ অন্যন্য নবীদের উম্মতেরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। এটা তোমার অশেষ করুণা বই আর কিছুই নয়। সারাটা জীবন তোমার প্রশংসা করেও শেষ করা যাবে না হে মাবুদ।"

        মহানবী (সঃ)-এর এ অপূর্ব খুৎবা শুনে উপস্থিত নবীরা বিমুগ্ধ হলেন। তারা আমাদের নবীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দাঁড়িয়ে বললেন-" হে আল্লাহর রাসূল। নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর অতি প্রিয় নবী আর আমাদের প্রশংসীত রাসূল। আমি আল্লাহর পবিত্র দরবারে আপনার আগমনের জন্য এই দোয়া করেছিলাম-

         অর্থাৎ: "পরওয়ার দেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত্য দল সৃষ্টি কর। আমাদের হজ্জে রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী দয়ালু। হে পরওয়ারদেগার তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন। তাদের কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রশালী, পরমজ্ঞানী।" (সূরা-বাকারা, আয়াত-২৮, ২৯)

        আমার এ আন্তরিক দোয়া কবুল হয়েছে। তাই আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আমরাই বংশে প্রেরণ করেছেন। আপনি আমাদের সকল নবীর শিরতাজ। আল্লাহ স্বয়ং আপনার প্রতি সালাম পাঠান আর ফিরিশতারা আপনার কাছে দরূদ প্রেরণ করেন। অতএব আপনি সৃষ্টির সেরা।"

        হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর ভাষণ শেষ হলে চারদিক থেকে আকাশ পাতাল মুখরিত করে ধবনিত হলো- "মারহাবা, ইয়া রাসুল আল্লাহু মারহাবা।"

Post a Comment

0 Comments